সুকুমার রায়ের পরিচয় উপেন্দ্রকিশোরকে বাদ দিয়ে সম্ভব নয়। বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী উপেন্দ্রকিশোর ছিলেন একাধারে ‘শিশু-সাহিত্যিক’, ‘মুদ্রণ বিশেষজ্ঞ’, ‘চিত্রশিল্পী’ ও ‘সংগীতজ্ঞ’। তাঁর হাত ধরে ছোটদের মাসিক পত্রিকা ‘সন্দেশে’র আবির্ভাব। ১২৭০ বঙ্গাব্দের ২৮শে বৈশাখ (১৮৬৩ খ্রীঃ ১২ই মে) ময়মনসিংহ জেলার মসূয়া গ্রামে এক কায়স্থ পরিবারে উপেন্দ্রকিশোরের জন্ম। পিতা ও মাতা ছিলেন ‘কালীনাথ রায়’ ও ‘জয়তারা দেবী’। কালীনাথের ছিল পাঁচ ছেলে ও তিন মেয়ে। ছেলেরা ছিল ‘সারদারঞ্জন’, ‘কামদারঞ্জন’, ‘মুক্তিদারঞ্জন’, ‘কুলদারঞ্জন’ ও ‘প্রমদারঞ্জন’। প্রখ্যাত শিশু সাহিত্যিক ‘লীলা মজুমদার’ ছিলেন ‘প্রমদারঞ্জনের কন্যা’। জ্ঞাতিভাই জমিদার ‘হরকিশোর রায়চৌধুরী’ ছিলেন প্রতিবেশী ও অপুত্রক। তাঁর একান্ত অনুরোধে ‘কালীনাথ’ তাঁর দ্বিতীয় পুত্র ‘কামদারঞ্জন’কে দত্তক দিতে রাজি হন। সেটা ছিল ১৮৬৮ সাল। ‘কামদারঞ্জনের’ নতুন নাম হয় ‘উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী’। পরে তিনি ‘ব্রাহ্মধর্ম’ গ্রহণ করেন। ১৮৮৫ সালের ১৫ই জুন উপেন্দ্রকিশোর ‘ব্রাহ্মসমাজের নেতা দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রথম পক্ষের কন্যা বিধুমুখী’কে বিয়ে করেন। তিনি তখন থাকতেন ‘১৩নং কর্নওয়ালিস স্ট্রীটের’ ‘লাহাবাড়ি’তে। সেখানেই তাঁর ‘প্রথম পাঁচ পুত্রকন্যার জন্ম’ হয়েছিল। তাঁদের নাম – ‘সুখলতা’, ‘সুকুমার’, ‘পুণ্যলতা’, ‘সুবিনয়’ ও ‘শান্তিলতা’। সুকুমারের জন্ম হয়েছিল ১৮৮৭ সালের ৩০শে অক্টোবর। স্থানাভাবের জন্য উপেন্দ্রকিশোর ১৮৯৫ সাল নাগাদ কর্নওয়ালিস স্ট্রিটের বাড়ি ছেড়ে পাশেই ‘৩৮/১নং শিবনারায়ণ দাস লেনের বাড়িতে’ উঠে আসেন। সেখানেই জন্ম হয়েছিল তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র ও সুকুমারের ছোট ভাই ‘সুবিমলের’। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে উপেন্দ্রকিশোরের সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। তাঁর ‘রাজর্ষি’ উপন্যাসের দুই শিশু চরিত্রের নামানুসারে ‘সুখলতা’ ও ‘সুকুমারের’ ডাক নাম হয় ‘হাসি’ ও ‘তাতা’।
ছোটবেলা থেকেই সুকুমারের প্রতিভার উন্মেষ লক্ষ্য করা যায়। তিনি ‘গান গাইতেন’, ‘নাটক করতেন’, ‘কবিতা লিখতেন’, ‘মুখে মুখে তৈরি করে ফেলতেন নানা ধরণের ছড়া’। পড়াশোনায় মেধাবী সুকুমার স্বাভাবিক ভাবেই ভাইবোনদের নেতৃত্ব দিতেন, গান ও মজাদার ছড়ায় বাড়ির সবাইকে মাতিয়ে তুলতেন। ‘পুণ্যলতা’র ভাষায়, “দাদা যেমন আমাদের খেলাধুলা ও সব কিছুরই পাণ্ডা ছিল, তেমনি বন্ধুবান্ধব ও সহপাঠীদের মধ্যেও সে সর্দার হল। তাঁর মধ্যে এমন কিছু বিশেষত্ব ছিল যার জন্য সবাই তাকে বেশ মানত। বড়রাও তার কথার বেশ মূল্য দিতেন।” সুকুমারের খুড়তুতো বোন ‘লীলা মজুমদার’ লিখেছিলেন তাঁর ‘বড়দা’ সুকুমারের কথা, “চেহারার মধ্যে কি যেন একটা ছিল, যা তাঁর সর্বাঙ্গ থেকে আলোর মত ঝড়ে পড়ত।”
‘সিটি স্কুল’ থেকে প্রবেশিকা পাশ করে ‘ফিজিক্স ও কেমিস্ট্রিতে ডাবল অনার্স’ নিয়ে ১৯০৬ সালে ‘প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে বি. এস-সি’ পাশ করেন সুকুমার। কলেজে থাকতে গড়ে তোলেন ‘ননসেন্স ক্লাব’। তাঁর শিক্ষকদের মধ্যে ছিলেন প্রখ্যাত রসায়নবিদ ‘আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়’। ক্লাবের ‘মুখপত্র’ ছিল হাতে লেখা কাগজ – ‘সাড়ে বত্রিশ ভাজা’ (৩২II ভাজা)। সুকুমারের খেয়াল রসাস্রিত লেখা প্রথম ‘সাড়ে বত্রিশ ভাজা’র পাতাতেই বেরিয়েছিল। ননসেন্স ক্লাবের সভ্যদের নিয়ে অভিনয় করার জন্য দু’টি নাটক লিখেছিলেন সুকুমার, ‘ঝালাপালা’ ও ‘লক্ষণের শক্তিশেল’। ‘ঝালাপালা’তেই রয়েছে তাঁর সেই বিখ্যাত রসসৃষ্টি,
“পণ্ডিত। বটে! তোর বাড়ি কদ্দুর?
কেষ্টা। আজ্ঞে, ওই তালতলায় – ‘আই গো আপ, ইউ গো ডাউন-’ মানে কি?
পণ্ডিত। ‘আই’ – ‘আই’ কিনা চক্ষুঃ, ‘গো’ – গয়ে ওকার গো – গৌ গাবৌ গাবঃ, ইত্যমরঃ, ‘আপ’ কিনা আপঃ সলিলং বারি অর্থাৎ জল – গরুর চক্ষে জল – অর্থাৎ কিনা গরু কাঁদিতেছে – কেন কাঁদিতেছে – না উই গো ডাউন, কিনা ‘উই’ যাকে বলে উইপোকা – ‘গো ডাউন’, অর্থাৎ গুদোমখানা – গুদোমঘরে উই ধরে আর কিছু রাখলে না – তাই না দেখে, ‘আই গো আপ’ – গরু কেবলই কাঁদিতেছে …”
‘ননসেন্স ক্লাবে’র নাটক দেখার জন্য ছেলেবুড়ো সকলেই ভিড় জমাতো। ‘পুণ্যলতা’ লিখেছিলেন, “বাঁধা স্টেজ নেই, সীন নেই, সাজসজ্জা ও মেকআপ বিশেষ কিছুই নেই, শুধু কথা সুরে ভাবে ভঙ্গিতেই তাদের অভিনয়ের বাহাদুরি ফুটে উঠত, দাদা নাটক লিখত, অভিনয় শেখাত। … হাঁদারামের অভিনয় করতে দাদার জুড়ি কেউ ছিল না। অভিনয় করতে ওরা নিজেরা যেমন আমোদ পেত, তেমনি সবাইকে আমোদে মাতিয়ে তুলত। চারিদিকে উচ্ছ্বসিত হাসির স্রোত বইয়ে দিত। … ননসেন্স ক্লাবের অভিনয় দেখার জন্য সবাই উৎসুক হয়ে থাকত।”
‘বঙ্গভঙ্গ’ আন্দোলন বাংলার ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। ১৯০৫ সালের ১৬ই অক্টোবর তৎকালীন ‘বড়লাট লর্ড কার্জনের আদেশে’ বঙ্গভঙ্গ কার্যকর করা হয়। পরে অবশ্য বিরোধী আন্দোলনের তীব্রতায় সেটা হয়ে ওঠেনি। তখন শিক্ষিত বাঙালিরা অনেকেই শপথ নিয়েছিলেন যে তাঁরা বিদেশী জিনিস ব্যবহার করবেন না। উপেন্দ্রকিশোরের পরিবারেও এর ব্যতিক্রম ঘটে নি। ‘পুণ্যলতা’র লেখা থেকে জানা যায়, “মেজভাই মণি (সুবিনয় রায়) দেশি সুতোর মোটা কাপড়, হাতে তৈরি তুলোট কাগজ, ট্যারা ব্যাঁকা পেয়ালা পিরিচ খুঁজে পেতে নিয়ে আসত।” ‘লীলা মজুমদারের’ ভাষায়, “বাড়িসুদ্ধ সবাই এইসব জিনিস ব্যবহার করত। বড়দাও করত। অবিশ্যি এই নিয়ে একটা গান না লিখেই সে কি করে?”
গানটি ছিল,
“আমরা দেশি পাগলের দল,
দেশের জন্য ভেবে ভেবে হয়েছি পাগল,
(যদিও) দেখতে খারাপ টিকবে কম, দামটা একটু বেশী
(তাহোক) তাতে দেশেরই মঙ্গল।”
তাঁর আরও একটি লেখা –
“লর্ড কার্জন অতি দুর্জন বঙ্গগগন শনি
কূট নিঠুর চক্রী চতুর উগ্র গরল ফণী।”
সুকুমারের পিতা উপেন্দ্রকিশোর ছিলেন রবীন্দ্রনাথের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। সেই সূত্র ধরে বাল্যকাল থেকেই রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সুকুমারের পরিচয়। কবি সুকুমারকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন, দীর্ঘদিন সুকুমার তাঁর সান্নিধ্য পেয়েছেন। কবির নোবেল পুরস্কার পাবার বহু আগে থেকেই এই সম্পর্ক গড়ে ওঠে। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সুকুমারের নিয়মিত দেখা হত। কলকাতায় ‘ডাঃ দ্বিজেন্দ্রনাথ মৈত্রের বাসভবনে’ও অন্যান্য কবি ভক্তের সঙ্গে সুকুমার উপস্থিত থাকতেন। এই অন্তরঙ্গতা ও শান্তিনিকেতনের বহু অনুষ্ঠান ও উৎসবে সুকুমারের যোগদানের ঘটনা অনেক লেখকের বিবরণে লিপিবদ্ধ হয়ে রয়েছে। ১৯১১ সালে ২৫শে বৈশাখ উপলক্ষে সুকুমার রায়েরা দল বেঁধে শান্তিনিকেতনে যান।
‘পুণ্যস্মৃতি’ গ্রন্থে ‘সীতাদেবী’ লিখেছিলেন, “ইহারই ভিতর একদিন সুকুমার রায় তার ‘অদ্ভুত রামায়ণ’ গান করিয়া শুনাইয়াছিলেন। উহা ২৪ কি ২৬ বৈশাখ হইয়া থাকিবে। এই রামায়ণ গানটি সকলেই খুব উপভোগ করিয়াছিলেন। ‘অদ্ভুত রামায়ণে’ একটি গান আছে, ‘ওরে ভাই, তোরে তাই কানে কানে কই রে, ওই আসে, ওই আসে, ওই ওই ওই রে।’ আশ্রমের ছোট ছেলেরা ঐ গানটি শোনার পর সুকুমারবাবুরই নামকরণ করিয়া বসিল, ‘ওই আসে’। একটি ছোট ছেলে মাঠের ভিতর একটি গর্তে পড়িয়া গিয়া আর উঠিতে পারিতেছিল না। সুকুমারবাবুকে সেইখান দিয়ে যাইতে দেখিয়া সে চীৎকার করিয়া বলিল, ‘ও ওই আসে, আমাকে একটু তুলে দিয়ে যাও তো’!”
‘রবীন্দ্রজীবনীকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়’ও এ প্রসঙ্গে লিখেছেন, “সুকুমার রায় তার ‘অদ্ভুত রামায়ণ’ দলবল নিয়ে গান করে শোনান। তাতাবাবুর সেই চোখ গোল গোল করে গান,
‘রাবণ রাজায় মারো, রাবণ রাজায় মারো,
তারে উলটো গাধায় তোল’ …”
১৮৯৫ সালে ‘শিবনারায়ণ দাস লেনের বাড়িতে’ উপেন্দ্রকিশোর ‘U. Ray’ নামে একটি ‘ব্লক তৈরির প্রতিষ্ঠান’ গড়ে তোলেন; পরে নামকরণ হয় ‘U. Ray & sons’। তিনি কখনও বিলেত যান নি। কিন্তু মুদ্রণ শিল্পে তাঁর গবেষণা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে স্বীকৃতি লাভ করেছিল। ১৮৯৭ থেকে ১৯১২ সালের মধ্যে লন্ডন থেকে প্রকাশিত মুদ্রণ সম্বন্ধে বিখ্যাত পত্রিকা ‘Penrose’s Pictorial Annual’-এ তাঁর ন’টি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল। সঙ্গে উপেন্দ্রকিশোরের তোলা ছবিও থাকত। এ প্রসঙ্গে মন্তব্য করা হয়েছে, “Mr U. Ray of Calcutta is far ahead of European and American workers in originality”। এটি কম স্বীকৃতির কথা নয়। নিজে বিলেতে না গেলেও পুত্র সুকুমার বিদেশে গিয়ে মুদ্রণ বিষয়ে উচ্চশিক্ষা লাভ করুক এ বাসনা তাঁর ছিল। ১৯১১ সালের অক্টোবর মাসে ২৩ বছর বয়সে ‘গুরুপ্রসন্ন বৃত্তি’ নিয়ে সুকুমার বিলেতে যান। প্রথমে লন্ডনে এক বছর ‘County Council School of Photoengraving and Lithography’-তে পড়াশোনা করে পরে ম্যানচেস্টারে ‘Municipal School of Technology’-তে ‘chomolithography and litho-drawing’ সম্বন্ধে শিক্ষা লাভ করেন। বিলেত থেকে সুকুমার বাবাকে যেসব চিঠি লিখেছেন তাতে তাঁর কাজের বিস্তৃত বিবরণ মেলে। বিলেতে শেষ পরীক্ষায় কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়ে ‘bronze পদক’ লাভ করেন সুকুমার। তাঁর গবেষণা-পত্র ‘Penrose’s Pictorial Annual’ এবং ‘The British Journal of Photography’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। ১৯২২ সালে তিনি ‘দ্বিতীয় ভারতীয়’ হিসাবে ‘Royal Photographic Society’-এর সদস্য নির্বাচিত হন।
ইংল্যান্ডে একটি সভায় রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে ‘The spirit of Rabindranath Tagore’ নামে একটি প্রবন্ধ পাঠ করেন সুকুমার। ১৯১৩ সালের ২১শে জুলাই প্রবন্ধটি তিনি পাঠ করেছিলেন ‘East and West Society’-তে। আমেরিকায় ছ’মাস কাটিয়ে লন্ডনে ফিরে অর্শ রোগের চিকিৎসার জন্য রবীন্দ্রনাথ তখন একটি নার্সিং হোমে ভর্তি। দু’সপ্তাহ সেখানে ছিলেন তিনি। নার্সিং হোমে কবিকে দেখতে যেতেন সুকুমার। পঠিত প্রবন্ধটির মাধ্যমে বিলেতে অনেক বিদ্বজ্জনের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের পরিচয় ঘটে। ‘প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়’ লিখেছেন, “ইহাই বোধ হয় রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে ভারতীয়দের পক্ষে প্রথম পাবলিক ভাষণ।” প্রবন্ধটি বিখ্যাত পত্রিকা ‘Quest’-এ প্রকাশিত হয়।
১৯১৩ সালের ১৩ই সেপ্টেম্বর ‘সিটি অব লাহোর’ নামক জাহাজে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেশে ফিরে আসেন সুকুমার, সঙ্গে ছিলেন ‘কালীমোহন ঘোষ’। ‘অমিতাভ চৌধুরী লিখেছেন’, “কুড়ি দিনের এই দীর্ঘ পথে কবির সঙ্গে সুকুমারের কি কি বিষয়ে আলাপ হয়েছিল, কেমন কেটেছিল কবিসঙ্গ, তার কোন লিপিবদ্ধ বিবরণ মেলে নি। সত্যজিৎ রায়কে এই প্রসঙ্গে পরে যখন জিজ্ঞাসা করি, তিনি বলেন, ‘আপশোসের কথা, শৈশবে বাড়ি বদলের সময় বাবা ও ঠাকুরদার অনেক কাগজপত্র হারিয়ে যায়।’ হারিয়ে যাওয়াটা আমাদের সকলের পক্ষেই দুর্ভাগ্য। থাকলে হয়ত আরও অনেক কিছুই জানা যেত।”
বিলেত থেকে ফেরার দু’মাস পরেই সুকুমারের বিয়ে হয় ‘কে. জি. গুপ্তর ভাগ্নি এবং সরলা ও জগৎচন্দ্র দাশের মেজ মেয়ে সুগায়িকা সুপ্রভা’র সঙ্গে। ‘সুপ্রভা’র ডাক নাম ছিল ‘টুলু’। ‘রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের বড় মেয়ে শান্তা দেবী’র কথায়, “সুকুমারবাবু বিবাহ করেন আমার সহপাঠিনী এবং বন্ধু টুলুকে। তারপর ওদের বাড়িতে মাঝে মাঝে চায়ের নিমন্ত্রণে যেতাম।” ‘সুপ্রভা’ ও ‘শান্তা’ একই সঙ্গে ‘বেথুন স্কুল ও কলেজে’ পড়তেন। বিয়েতে উপস্থিত থাকার জন্য উপেন্দ্রকিশোর ও সুকুমার রবীন্দ্রনাথকে বিশেষভাবে অনুরোধ করেন। কিন্তু কবি চিঠি দিয়ে জানান শিলাইদহে জমিদারীর কাজে ব্যস্ত থাকায় তিনি বিয়েতে উপস্থিত থাকতে পারবেন না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ এসেছিলেন। বিয়েতে আমন্ত্রিত হয়ে উপস্থিত ছিলেন ‘সীতা দেবী’। তিনি তাঁর ‘পুণ্যস্মৃতি’ গ্রন্থে এ প্রসঙ্গে লিখেছেন, “এই বৎসর অর্থাৎ ১৯১৩-র ডিসেম্বর মাসের মাঝামাঝি বোধ হয় সুকুমার রায়ের বিবাহ হয়। রবীন্দ্রনাথ তখন শিলাইদহে ছিলেন শুনিয়াছিলাম। বিবাহ প্রায় আরম্ভ হইতে যাইতেছে এমন সময় গেটের কাছে করতালিধ্বনি শুনিয়া কিছু বিস্মিত হইয়া গেলাম। পরক্ষণেই দেখিলাম কবি আসিয়া সভাস্থলে প্রবেশ করিলেন। পরে শুনিয়াছিলাম, এই বিবাহে উপস্থিত থাকিবার জন্যই তিনি কলিকাতায় আসিয়াছিলেন। সুকুমারবাবুকে তিনি অত্যন্ত স্নেহ করিতেন।”
বিয়ের পরে সুপ্রভাকে সঙ্গে নিয়ে সুকুমার শিলং-এ এলেন। সেখানে তাঁর কাকা ‘প্রমদারঞ্জন’ তাঁর স্ত্রী ‘সুরমা’ ও মেয়ে ‘লীলা’কে নিয়ে থাকতেন। ‘রামকুমার বিদ্যারত্নের’ (‘হিমারণ্য’ গ্রন্থের লেখক) মেয়ে ‘সুরমা’ মানুষ হয়েছিলেন উপেন্দ্রকিশোরের পরিবারে। ‘লীলা মজুমদার মা’র কাছে ‘তাতা’ অর্থাৎ সুকুমারের নাম শুনেছেন কিন্তু কখনও চোখে দেখেন নি। তিনি ‘বড়দা’ (সুকুমার) সম্বন্ধে লিখেছিলেন, “লম্বা দোহারা মানুষটি। একমাথা কালো কোঁকড়া চুল। চোখ দুটি প্রায় সব সময় হাসত। কিন্তু গম্ভীর হলে এমন গম্ভীর হত যে কাছে যেতে ঘেঁষতে ভয় পেতাম। বড়দা ছিল যেমন আমুদে তেমনি রাশভারী। অন্যায় সে কখনো সইত না। যতদূর মনে পড়ে বড়দার বাঁ-গালে একটা বড় তিল ছিল, আমাদের সেটিকে ভারি পছন্দ ছিল।” তাঁর ‘সুপ্রভা বৌঠান’কে প্রথম দেখার অভিজ্ঞতা ছিল, “তখন বিকেল বেলা। পড়ন্ত রোদে বৌঠানকে বড় সুন্দর দেখাচ্ছিল। পড়নে ঢাকাই শাড়ি। গলায় লম্বা মটরমালা, শ্যামলা রঙের উপর অমন সুন্দর মুখ কখনো দেখেছি বলে মনে পড়ে না।”
‘সীতা দেবী’ তাঁর ‘পুণ্যস্মৃতি’ গ্রন্থে শান্তিনিকেতনে অনুষ্ঠিত ‘বাঙাল সভা’র এক কৌতুকপূর্ণ বিবরণ দিয়েছেন,
“সকলে মিলিয়া আবার বাহির হইবার উপক্রম করিতেছি এমন সময় একটি ছোট ছেলে আসিয়া খবর দিল যে, ‘বাঙাল সভা’ হইবে, আমাদের সেখানে উপস্থিতি প্রার্থনীয়। সকলেই উৎসুক হইয়া চলিলাম। বাঙাল-সভার নাম ইতিপূর্বেই শুনিয়াছিলাম, তবে কোনো অধিবেশনে কখনো উপস্থিত থাকি নাই। শুনিলাম অন্যান্য অতিথিরাও আসিতেছেন এবং স্বয়ং কবিও উপস্থিত থাকিবেন। পথেই তাঁহাদের সঙ্গে দেখা হইল। রবীন্দ্রনাথ সর্বাগ্রে খোঁজ করিলেন যে আমার মাথা-ধরা কেমন আছে; তাহার পর বলিলেন, ‘আচ্ছা, চলো বাঙাল-সভায়, তাদের কথা শুনলে বোধ হয় তোমার মাথা ছেড়ে যেতে পারে। খোলা মাঠেই সভা হইতেছিল। মেয়েরা এবং মান্যগণ্য অতিথিবর্গ তক্তপোষে বসিলেন, ছেলের দল বসিল মাটিতে শতরঞ্চি বিছাইয়া। সর্বসম্মতিক্রমে সুকুমারবাবু সভাপতি নির্বাচিত হইলেন। রবীন্দ্রনাথ প্রস্তাব করিলেন যে সুকুমারবাবুর পত্নী শ্রীমতি সুপ্রভাকেই সভানেত্রী করা হোক, কারণ আজন্ম কলিকাতায় বাস করিয়া সুকুমারবাবুর বাঙালত্ব খানিকটা লোপ পাইয়াছে। কিন্তু সুপ্রভা রাজি না হওয়াতে সুকুমারবাবুই সভাপতির পদে বহাল রহিলেন। সভার কার্যতালিকা বেশি বড়ো ছিল না। একটি গল্প, একটি বিজ্ঞাপন ও একটি রিপোর্ট পড়া হইল, সবই বাঙাল ভাষায়। দুইটি গান হইল, একটি বাঙাল ভাষায়, অন্যটি সাধারণ বাংলা ভাষায়। সভার কার্য যথাসম্ভব বাঙাল ভাষাতেই হইতেছিল। অনেকে উঠিয়া ছোট ছোট বক্তৃতা দিলেন, বক্তব্য সকলেরই প্রায় এক, ‘তাহাদের বিশেষ কিছু বলিবার নাই।’ বক্তাদিগের ভিতর নাম মনে পড়ে দুইজনের শ্রীযুক্ত সুধাকান্ত রায়চৌধুরী ও শ্রীযুক্ত নরেন্দ্রনাথ গাঙ্গুলি। চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় সেই সভায় উপস্থিত ছিলেন, তাঁহাকেও তাহার মামার বাড়ির (মালদহ) ভাষায় বক্তৃতা করিতে হইল। রবীন্দ্রনাথকেও সভাপতি অনুরোধ করিলেন তাঁহার মামার বাড়ির ভাষায় কিছু বলিতে। রবীন্দ্রনাথ অসম্মতি জানাইয়া বলিলেন, খুলনার ভাষায় মাত্র দুটি কথা তিনি জানেন, তাহাতে বক্তৃতা দেওয়া চলে না। সে কথা দুটি হইতেছে ‘কুলির অম্বল ও মুগির ডাল।’ অতঃপর সভাপতি তাঁহার অভিভাষণ দিলেন অতি কষ্টে।”
‘বাঙাল-সভা’র মতই আর একটি অনুষ্ঠান ছিল ‘হৈ হৈ সঙ্ঘ’। এখানে গাইবার জন্যই রবীন্দ্রনাথ সুকুমারের সেই বিখ্যাত কবিতা, ‘গান জুড়েছেন গ্রীষ্মকালে ভীষ্মলোচন শর্মা’-তে সুর সংযোগ করেন।
‘অমিতাভ চৌধুরী’ একটি ‘অপ্রকাশিত চিঠির কথা’ জানিয়েছেন। ১৯৪০ সালের সেই চিঠিতে ‘ইন্দিরা দেবী’ (চৌধুরাণী) ‘সুকুমার-পত্নী সুপ্রভা’কে তাঁদের বাড়িতে গিয়ে ‘ভজন’ ও ‘হিমাংশু দত্তের গান’ শোনাবার জন্য নেমন্তন্ন করেছেন। ‘বিমলাংশুপ্রকাশ রায়’ তাঁর স্মৃতিকথায় জানিয়েছেন, একবার সুকুমার রায়কে দেখে রবীন্দ্রনাথ বলেন, “সুকুমার তুমি যে লিখেছ, ‘ভাব এক্কে ভাব, ভাব দুগণে ধোঁয়া তিন ভাবে ডিসপেপসিয়া ঢেঁকুর উঠবে চোঁয়া’- আমাকে উদ্দেশ্য করে লিখেছ কি?”
সুকুমারের মত তাঁর পত্নী ‘সুপ্রভা’ও রবীন্দ্রনাথের স্নেহধন্য ছিলেন। কবির কাছে গান শেখার সৌভাগ্যও তাঁর হয়েছিল। ‘অমিতাভ চৌধুরী’র লেখায় রয়েছে, “সুপ্রভা রায়ের একটি খাতায় দেখা যায় ১৯২১ সালের পূজার ছুটিতে রবীন্দ্রনাথ অনেকগুলি পাতায় একটি করে গান নিজের হাতে লিখে দিয়েছেন। দিন অবসান হল, আমার দোসর যে জন, আকাশে আজ কোন চরণের আসা যাওয়া ইত্যাদি। রবীন্দ্রনাথের স্বহস্তে ঐ খাতায় লেখা শেষ রবীন্দ্রসঙ্গীত-সকাল বেলার বাদল আঁধারে। তারিখ ২০ জ্যৈষ্ঠ ১৩২৯।”
অল্প বয়সে স্বামীকে হারিয়ে সুপ্রভা মাঝে মাঝেই চলে যেতেন শান্তিনিকেতনে, রবীন্দ্রনাথের কাছে। রবীন্দ্রনাথও তাঁর ‘স্নেহের টুলুকে’ স্নেহের স্পর্শে সান্ত্বনা দিয়েছিলেন, গানের জগতে টেনে নিয়েছিলেন।
সুকুমার রায়ের সঙ্গে সুপ্রভা দাশের বিয়ে হয়েছিল ১৯১৩ সালে ডিসেম্বর মাসে। একমাত্র পুত্র ‘সত্যজিতের’ জন্ম হয়েছিল ১৯২১ সালের ২রা মে। সে বছরেই নিতান্তই শিশু ‘চার মাসের সত্যজিৎ’ বাবা ও মায়ের সঙ্গে শান্তিনিকেতনে যান। এ সময়ে ‘সুপ্রভা’ বেশ কিছু গান শিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথের কাছে। ছোট বেলার স্মৃতিচারণ করে ‘সত্যজিৎ’ তাঁর ‘যখন ছোট ছিলাম’ রচনায় বলেছেন, “আমার বাবা যখন মারা যান তখন আমার বয়স আড়াই বছর। সে ঘটনা আমার মনে নেই। কিন্তু বাবা যখন অসুস্থ, এবং আমার বয়স দুই কিম্বা আরও কম তখনকার দুটো ঘটনা আমার পরিষ্কার মনে আছে। বাবা অসুখে পড়েন আমি জন্মাবার কিছুদিনের মধ্যেই। এ অসুখ আর সারে নি, তবে মাঝে মাঝে একটু সুস্থ বোধ করলে বাবাকে বাইরে চেঞ্জে নিয়ে যাওয়া হত। বাবার সঙ্গেই আমি গিয়েছিলাম একবার সোদপুর আর একবার গিরিডি। গঙ্গার উপর সোদপুরের বাড়ির উঠোনটা আমার মনে আছে। একদিন বাবা ছবি আঁকছেন, ঘরে জানালার ধারে বসে, এমন সময় হঠাৎ বললেন, ‘জাহাজ যাচ্ছে।’ আমি দৌড়ে উঠোনে বেরিয়ে এসে দেখলাম একটা স্টীমার চলে গেল।”
১৯১২ সালে রবীন্দ্রনাথ ইংল্যান্ডে যান, সঙ্গে ছিলেন পুত্র ‘রথীন্দ্রনাথ’ ও পুত্রবধূ ‘প্রতিমা দেবী’। রবীন্দ্রনাথ সঙ্গে করে ‘গীতাঞ্জলির ইংরাজি অনুবাদ’ও নিয়ে গিয়েছিলেন। লন্ডনে তখন রবীন্দ্রভক্তদের মধ্যে ছিলেন ‘রামানন্দের জ্যেষ্ঠ পুত্র কেদারনাথ’, ‘আনন্দমোহন বসুর কনিষ্ঠ পুত্র অরবিন্দ’, ‘কালীমোহন ঘোষ’, ‘প্রশান্ত মহলানবীশ’ ও ‘সুকুমার রায়’। বিলেতে সুকুমারের রচিত এবং একটি সভায় পঠিত ‘The spirit of Rabindranath Tagore’ নামক একটি রচনার মাধ্যমে কবি প্রাথমিক ভাবে বিদ্বজ্জনের কাছে পরিচিত হন একথার উল্লেখ আগেই করা হয়েছে। রচনাটি ‘Quest’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল।
সুকুমার স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের কয়েকটি কবিতা ইংরেজিতে অনুবাদ করেছিলেন। ১৯১২ সালের ১৯শে জুন লন্ডনে ‘উইলিয়ম পিয়ার্সনের’ (পরে শান্তিনিকেতনের অধ্যাপক) বাড়িতে এক ঘরোয়া বৈঠকে রবীন্দ্রনাথের উপস্থিতিতে সেগুলি পাঠ করেন। সুকুমার তার ছোট বোন ‘পুণ্যলতা’কে লিখেছিলেন, “পরশু দিন পিয়ার্সন তার বাড়িতে বেঙ্গলি লিটারেচার সম্বন্ধে একটি পেপার পড়বার নেমন্তন্ন করেছিলেন। সেখানে গিয়ে দেখি মিঃ অ্যান্ড মিসেস আর্নল্ড, মিঃ অ্যান্ড মিসেস রটেনস্টাইন, ড: পি. সি. রায় প্রভৃতি অনেকে। তাছাড়া কয়েকজন অচেনা সাহেব মেম উপস্থিত। শুধু তাই নয় ঘরে ঢুকে দেখি রবিবাবু বসে আছেন। বুঝতেই পারছিস আমার অবস্থা। যা হোক, চোখ কান বুঁজে পড়েছিলাম। ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরি থেকে বইটই এনে ম্যাটেরিয়াল জোগাড় করতে হয়েছিল। তাছাড়া রবি বাবুর কয়েকটি কবিতা – সুদূর, পরশপাথর, সন্ধ্যা, কুঁড়ির ভিতর কাঁদিছে গন্ধ ইত্যাদি অনুবাদ করেছিলাম। মিঃ ক্র্যানমার বীং, নর্থব্রুক সোসাইটির সেক্রেটারি, আর উইজডম অব দি ইস্ট সিরিজের এডিটর খুব খুশি। আমাদের ধরেছেন অনুবাদ করতে, তিনি পাবলিশ করবেন।”
‘মিঃ বিং’ (‘Crammer Byng’) অবশ্য সে অনুবাদ পরে আর ছাপেন নি। এই সমাবেশের পরের দিন রবীন্দ্রনাথ ‘অজিতকুমার চক্রবর্তী’কে একটি চিঠি লিখেছিলেন। সেখানে কিন্তু সুকুমারের কবিতা পাঠের কোন উল্লেখ নেই। রচনার কলেবর বৃদ্ধি করে লাভ নেই। এখানে শুধু ‘সুদূর’ কবিতাটির সুকুমার এবং রবীন্দ্রনাথ কৃত অনুবাদের কয়েক পংক্তি তুলে দেওয়া যাক। মূল কবিতাটি হ’ল,
“আমি চঞ্চল হে
আমি সুদূরের পিয়াসি
দিন চলে যায়, আমি আনমনে
তারি আশা চেয়ে থাকি বাতায়নে
ওগো, প্রাণে মনে আমি যে তাহার
পরশ পাবার পিয়াসী।
আমি সুদূরের পিয়াসি
ওগো সুদূর, বিপুল সুদূর, তুমি যে
বাজাও ব্যাকুল বাঁশরি। …”
‘সুকুমারের ইংরেজি অনুবাদ’টি ছিল –
“I am restless
I am athirst for the great Beyond
Sitting at my window,
I listen for its tread upon the air, as the day weras on.
My life goes out in longing
For the thrill of its touch,
I am athirst for the great Beyond!
O Beyond! Vast Beyond!
How passionate comes thy clarion call. …”
‘রবীন্দ্রনাথ কৃত অনুবাদ’টি ছিল –
“I am restless. I am athirst for far-away things.
My soul goes out in a longing to touch the skirt of the dim distance.
O Great Beyond. O the keen call of thy flute!”
এখানে একটা বিষয় স্পষ্ট। সুকুমারের অনুবাদ সবটাই ‘মূলানুগ’। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ যেহেতু তাঁর ‘স্বরচিত কবিতা’ নিজেই অনুবাদ করছেন, তখন অনেক সময়েই তিনি শুধু ভাবটি গ্রহণ করেছেন, আবার অনেক কিছু বাহুল্য মনে করে বর্জন করেছেন। সে স্বাধীনতা সুকুমারের ছিল না। তবে ‘ব্যাকুল বাঁশরি’র অনুবাদ সুকুমার করেছিলেন ‘passionate clarion call’. এক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের ‘keen call of the flute’-এ ‘ভাবের দ্যোতনা’ অনেক বেশি। ‘তার পরশ পাবার প্রয়াসী’ সুকুমারের অনুবাদে হয়েছে ‘for the thrill of its touch’; কিন্তু রবীন্দ্রনাথের হাতে সেটা হয়েছে ‘to touch the skirt of the dim distance’। এটা মূল রচনার বাইরে বেরিয়ে এসে কবি করেছেন, কিন্তু অন্য কেউ তো সেটা করতে পারে না। রবীন্দ্রনাথ কি তবে সুকুমারের অনুবাদ গ্রহণ করেন নি! হয়ত তাই, স্পষ্ট করে কিছু বলা নেই। তবে পরে কবি তাঁর নিজের লেখা নিজেই অনুবাদ করেছিলেন।
সুকুমারের ‘আবোল তাবোল’ কবিতার শেষের দু’লাইন ছিল –“ঘনিয়ে এল ঘুমের ঘোর/গানের পালা সাঙ্গ মোর”। এটি বাস্তবায়িত করেই সুকুমার পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন মাত্র ৩৬ বছর বয়সে। ১৯২১ সালেই তিনি ‘কালাজ্বরে’ আক্রান্ত হন। এর চিকিৎসা তখনও অধরাই ছিল। শেষের আড়াই বছর তাঁর অধিকাংশ সময়েই কেটেছিল রোগশয্যায়। পুত্র ‘সত্যজিৎ’ লিখেছিলেন – “… রুগ্ন অবস্থাতেও তাঁর কাজের পরিমাণ ও উৎকর্ষ দেখলে অবাক হতে হয়। শুধু লেখা বা আঁকার কাজেই নয়, ছাপার কাজেও যে তিনি অসুখের মধ্যে অনেক চিন্তা ব্যয় করেছেন তারও প্রমাণ রয়েছে। একটি নোটবুকে তাঁর আবিষ্কৃত কয়েকটি মুদ্রণ পদ্ধতির তালিকা রয়েছে। এগুলি পেটেন্ট নেবার পরিকল্পনা তাঁর মনে ছিল, কিন্তু কাজে হয়ে ওঠে নি।”
তাঁর অসুখের কোনও চিকিৎসা নেই এবং মৃত্যু প্রায় নিশ্চিত জেনেও অসাধারণ মানসিক স্থৈর্যের পরিচয় দিয়েছিলেন সুকুমার। প্রকৃত কর্মযোগীর মত অবিচলিতভাবে তিনি তার নিজের কাজ করে গিয়েছিলেন। ‘লীলা মজুমদারের স্মৃতিচারণে’ জানা যায় – “শুনলাম রোগের নাম কালাজ্বর। তার তখন কোন ভাল চিকিৎসা ছিল না। চোখের সামনে একটু একটু করে বড়দার শরীর ভাঙতে লাগল। তার আগের বছরেই বড় বৌঠানের একটি সুন্দর ছেলে হয়েছিল, ঘটা করে তাঁর নামকরণ হয়েছিল ছেলের নাম সত্যজিৎ। ডাক নাম মানিক।”
এসময় রবীন্দ্রনাথ এসে মৃত্যুপথযাত্রী তাঁর ‘যুবক বন্ধু’কে মাঝে মাঝে দেখে যেতেন। একবার সুকুমারের ইচ্ছে হয়েছিল তিনি কবির স্বকন্ঠে গান শুনবেন। এসেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সুকুমারের অনুরোধে শুনিয়েছিলেন – ‘আছে দুঃখ আছে মৃত্যু’, ‘আমার সকল দুখের প্রদীপ’, ‘দুঃখ এ নয় সুখ নহে গো গভীর শান্তি এ যে’ গান কয়টি। এ প্রসঙ্গে ‘সুকুমারের খুড়তুতো বোন মাধুরীলতা’ (‘খুল্লতাত কুলদারঞ্জনের’ দুই মেয়ে – ‘ইলা’ ও ‘মাধুরীলতা’) লিখেছিলেন, “গানের পর গান চলিল, সকলে তন্ময় হইয়া গান শুনিতে লাগিল। দাদার প্রশান্ত মুখখানি দেখিয়া মনে হইতেছিল যে তিনি পরম শান্তি লাভ করিয়াছেন।”
১৯২৩ সালের ১০ই সেপ্টেম্বর সকাল ৮টা ১৫ মিনিটে ১০০নং গড়পার রোডের বাড়ি থেকে, তাঁর সংসার থেকে এবং এই পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নিয়েছিলেন সুকুমার। ‘লীলা মজুমদারের কলমে’ – “… কত ইচ্ছা, কত আশা। … মাত্র ছত্রিশ বছর বয়সে বড়দা তার সাজানো সংসার ছেড়ে চলে গেলেন। … জীবনে এই প্রথম ব্যক্তিগত শোকের আঘাত বুঝলাম।”
সুকুমার চলে যাবার পর রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনের মন্দিরে একটি প্রার্থনা সভার আয়োজন করেন। ‘আচার্যের ভাষণে’ তিনি বলেছিলেন, “আমার পরম স্নেহভাজন যুবকবন্ধু সুকুমার রায়ের রোগশয্যার পাশে এসে যখন বসেছি, এই কথাই বার বার মনে হয়েছে, জীব-লোকের ঊর্ধ্বে আধ্যাত্মলোক আছে। যে-কোন মানুষ এই কথাটি নিঃসংশয়ে বিশ্বাসের দ্বারা নিজের জীবনে স্পষ্ট করে তোলেন, অমৃতধামের তীর্থযাত্রায় তিনি আমাদের নেতা। আমি অনেক মৃত্যু দেখেছি, কিন্তু এই অল্পবয়স্ক যুবকটির মতো অল্পকালের আয়ু নিয়ে মৃত্যুর সামনে দাঁড়িয়ে এমন নিষ্ঠার সঙ্গে অমৃতময় পুরুষকে অর্ঘ্যদান করতে আর কাউকে দেখি নি। মৃত্যুর দ্বারের কাছে দাঁড়িয়ে অসীম জীবনের জয়গান তিনি গাইলেন। তাঁর রোগশয্যার পাশে বসে সে গানের সুরটিতে আমার চিত্ত পূর্ণ হয়েছে।”
(তথ্যসূত্র :
১- যখন ছোট ছিলাম, সত্যজিৎ রায়।
২- পুণ্যস্মৃতি, সীতা দেবী।
৩- শতায়ু সুকুমার, সম্পাদনা শিশিরকুমার দাশ।
৪- একত্রে রবীন্দ্রনাথ, অমিতাভ চৌধুরী।
৫- ব্রাহ্মসমাজের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস, বারিদবরণ ঘোষ।
৬- স্মৃতির খেয়া, সাহানা দেবী।
৭- পাকদন্ডী, লীলা মজুমদার।
৮- ছেলেবেলার দিনগুলি, পুণ্যলতা চক্রবর্তী।
৯- উপেন্দ্রকিশোর (প্রবন্ধ), প্রসাদরঞ্জন রায়।
১০- ব্যক্তি সুকুমার, স্মৃতির আলোয় (প্রবন্ধ), শ্যামলী দেবী এবং শুভাশিস ঘোষের একটি ছোট রচনা।
১১- সুকুমার, লীলা মজুমদার, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি (১৯৮৯)।
১২- বিশেষ সুকুমার রায় সংখ্যা, সুভাষ চক্রবর্তী সম্পাদিত, যুবমানস (এপ্রিল ১৯৮৮)।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত