তখন লখনউতে অতুলপ্রসাদের ভরাট সংসার। সারাদিন তাঁর কোর্টের কাজ থাকত। কোর্ট থেকে বাড়ি ফিরেও রেহাই ছিল না। সাক্ষাৎপ্রার্থী আসতেন অগুনতি। তার মধ্যে লখনউ শহরের গণ্যমান্যরাও যেমন থাকতেন, তেমনই থাকতেন লখনউ শহরের এক্কাওয়ালাদেরও কেউ কেউ। অতুলপ্রসাদের বাড়ির দরজা ছিল সবার জন্য খোলা। প্রতি দিন কোর্ট থেকে বাড়ি ফেরার পর গানের মজলিশ বসতই বসত। এমনই এক মজলিশে এক মহিলা তাঁকে এক বার প্রশ্ন করে বসেছিলেন, ‘‘এত যে সুন্দর সুন্দর সব গান বাঁধেন, সময়ই বা পান কখন, কোথায়ই বা বাঁধেন? এ গান তো বাঁধতে কোনও নির্জন সাগরের ধার, নয় ফুলের বাগান চাই। আপনিও কি তেমনই কোথাও যান?’’ কথা শুনে অতুলপ্রসাদ যা উত্তর দিয়েছিলেন, সেটা শুনে উপস্থিত সবাই শুনে হাঁ হয়ে গিয়েছিলেন। অতুলপ্রসাদ সহাস্যে বলেছিলেন, ‘‘সারাদিন বাড়িতে মক্কেলের ভিড়। আবার কোর্টে যাবার তাড়া। তার মধ্যেই স্নান করতে গিয়েছি। ঘটি নিয়ে বারবার জল ঢালছি গায়ে। ঘটির ওই কল কল শব্দে একটা কলি ভেসে উঠল মনে। কোর্টে যেতে যেতে, কোর্ট থেকে বাড়ি ফিরতে ফিরতে গানটি লিখে ফেললাম, ‘জল বলে চল মোর সাথে চল/ তোর আঁখি জল হবে না বিফল।’ …’’
অতুলপ্রসাদ সেনের গানের বহুল প্রচারক দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের পুত্র ‘দিলীপকুমার রায়’ মনে করতেন, ‘‘তিনি ছিলেন বাংলার শ্রেষ্ঠ সুরকারত্রয়ীর কনিষ্ঠ, রবীন্দ্রনাথ–দ্বিজেন্দ্রলাল–অতুলপ্রসাদ।’’ অন্যদিকে স্বয়ং বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ তাঁর সম্পর্কে লিখেছিলেন, ‘‘দিল বঙ্গবীণাপাণি অতুলপ্রসাদ,/ তব জাগরণী গানে নিত্য আশীর্বাদ।’’
অতুলপ্রসাদের বহু বিখ্যাত সব গানের সৃষ্টির উৎসে আছে নানা মজার গল্প। বিখ্যাত দেশাত্মবোধক গান – ‘ওঠো গো ভারত লক্ষ্মী’ লেখার নেপথ্য কাহিনি অতুলপ্রসাদ নিজেই শুনিয়েছেন – ‘‘ভেনিসে এক সন্ধ্যায় গন্ডোলায় করে বেড়াচ্ছি। চারিদিকে বাড়ির আলো, আকাশে তারা। আর এধারে-ওধারে গন্ডোলায় ছপছপ শব্দ। চুপ করে দেখছি। হঠাৎ করে একটা গন্ডোলা থেকে বেহালার সুর ভেসে এল। সুরটা মনে লাগল। ফিরে এসেই লিখে ফেললাম ওই গানটা – ‘ওঠো গো ভারত লক্ষ্মী’।’’ একবার গোমতী নদী ধরে যেতে যেতে চোখে পড়েছিল এক কুমারী মেয়ে নদীর পাড়ে উদাস হয়ে বসে রয়েছে। ঐ উদাসী মেয়েকে দেখেই কবি অতুলপ্রসাদ নৌকায় বসেই লিখেছিলেন – ‘কে তুমি বসি নদীকূলে একেলা’। দাম্পত্য যন্ত্রণা বিদ্ধ ব্যারিস্টার অতুলপ্রসাদ মফস্বলের ডাক বাংলোয় রাত্রিবাসের সময় প্রবল বৃষ্টির রাতে জমাট অন্ধকারে ঝিঁ-ঝিঁ পোকা আর ব্যাঙের ঐকতানের মধ্যে বারান্দার ইজি চেয়ারে বসে বসে লিখে ফেলেছিলেন সেই বিখ্যাত গান – ‘বঁধুয়া, নিদ নাহি আঁখি পাতে, আমিও একাকী তুমিও একাকী আজি এ বাদল রাতে।’ একবার লখনউয়ের রাস্তায় এক ভিখারিণী গান গেয়ে চলেছিলেন করুণ সুরে ভৈরবী রাগে। ওই গান শুনে চমকে উঠেছিলেন অতুলপ্রসাদ। লোক দিয়ে বাড়িতে নিয়ে এসেছিলেন। অতুলপ্রসাদকে দেখে ওই ভিখারিণী লজ্জায় জড়সড় হয়েছিলেন। আর অতুলপ্রসাদও তাঁকে চিনে ফেলেছিলেন। আরে – এ তো এককালের লখনউ শহরের বিখ্যাত বাইজি ছিল। শুনেছিলেন একজনের প্রেমে পড়েছিল সে। ওই প্রেমিকের জন্য সর্বস্ব পণ করেছিল ওই বাইজি। বিনিময়ে প্রেমিকের মিথ্যা প্রতারণায় ভুলে শেষে হয়েছিল রাস্তার ভিখারিণী। ওই ভিখারিণীকে মোটা টাকা দিয়ে বিদায়ের পর ব্যথিত চিত্তে বেহাগ রাগে লিখেছিলেন – ‘এত হাসি আছে জগতে তোমার, বঞ্চিলে শুধু মোরে। বলিহারি বিধি, বলিহারি যাই তোরে।’
গানের সঙ্গে ঘর-করা মানুষ নরমসরম হয়, কর্মী হয় না, এমন ভাবনার চল আছে বাঙালির মনে। অতুলপ্রসাদ ছিলেন এই ধারণার মূর্তিমান ব্যতিক্রম। পেশায় তিনি ছিলেন ব্যবহারজীবী, অওধ বার অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন। তিনিই ছিলেন এই পদে প্রথম ভারতীয়। বিচারপতি আর আইনজীবীদের মন-কষাকষি সে যুগেও ছিল, তার জেরে লখনউ কোর্টের বদনামও হচ্ছিল। নিজের হাতে সামলে, আদালতের হৃত সম্মান ফিরিয়ে এনেছিলেন ব্যারিস্টার অতুলপ্রসাদ সেন। লখনউয়ে প্রবাসী বাঙালিদের মধ্যে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ধারাটি ফলবতী রাখতে শুরু হয়েছিল প্রবাসী বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলন (এখন নাম নিখিল ভারত বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলন)। লখনউ, এলাহাবাদ, কাশী, নানা শহরে হত প্রবাসী বাঙালিদের সভা। বাংলা থেকে এসেছিলেন রবীন্দ্রনাথ সহ বহু সারস্বত। অতুলপ্রসাদ ছিলেন এই সাহিত্যযজ্ঞের ঋত্বিক। গুণিজনসংবর্ধনার আয়োজন করেছিলেন, সভামুখ্য হয়েছিলেন। সাহিত্য সম্মেলনের পত্রিকা ‘উত্তরা’ প্রকাশের ব্যবস্থা করেছিলেন নিজের অর্থ দিয়ে। লখনউ বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনি ছিলেন অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা-সদস্য, উপাচার্য থেকে অধ্যাপক সকলেই তাঁর গুণমুগ্ধ ছিলেন। লখনউয়ের রামকৃষ্ণ সেবাশ্রমের সঙ্গে তাঁর যোগ ছিল গভীর। সেবাশ্রমে বাবা-মায়ের নামাঙ্কিত ‘রামপ্রসাদ হল’, ‘হেমন্তশশী শুশ্রূশালয়’ তৈরি করে দিয়েছিলেন নিজ ব্যয়ে, উদ্বোধনের দিন নিজে কীর্তন গেয়েছিলেন। রোগীদের জন্য বেঙ্গল কেমিক্যাল থেকে কয়েকশো টাকার ওষুধ আনিয়ে দিয়েছিলেন আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের আনুকূল্যে। মৃত্যুর আগে নিজের ইচ্ছাপত্রে মাসিক ২৫ টাকা বরাদ্দ করে গিয়েছিলেন সেবাশ্রমের ওষুধের জন্য! কলকাতায় মা সারদার কাছে এসেছিলেন, জানিয়ে গিয়েছিলেন অন্তরের প্রার্থনা, যন্ত্রণা।
বাইরে একটা গভীর মজলিশি মানুষ, হইচই, হাসিখুশি, গান-বাজনা, বাইজি-মুজরো আর মনের মধ্যে দাম্পত্য জীবনের অপূর্ণতা, অসমঝোতা, নিকট আত্মীয়দের মৃত্যু অতুলপ্রসাদের সর্বদা সঙ্গী থেকে ক্রমশ মন ঈশ্বরমুখী হয়ে যায়। মাত্র এগারো বছর বয়সে পিতাকে হারিয়ে আত্মীয় বিয়োগের সূচনা। তারপর মা-র ছেড়ে চলে যাওয়া। ১৯০৩ সালে হারিয়েছিলেন আশ্রয়দাতা অভিভাবক মাতামহকে। ১৯২৪ সালে হারিয়েছিলেন প্রিয় মেজ ভগ্নিপতিকে। বছরখানেকের মধ্যে ছোট বোনের স্বামী শেষাদ্রী চাকরি হারিয়ে অতুলপ্রসাদের আশ্রয়ে থাকতে থাকতে ১৯৩০ সালে মারা গিয়েছিলেন। তাই নিজের মনকে শান্ত রাখতে লখনউতে গড়ে তোলেন নিজস্ব গোষ্ঠী। লোকাপবাদ, সমাজভয়, পারিবারিক ভ্রুকুটি – সবকিছুকে অগ্রাহ্য করে রাতের পর রাত বিখ্যাত বাইজিদের বাড়িতে বসে তাঁদের গান শুনতেন অতুলপ্রসাদ। আর তাদের ঠুংরি রসে জারিত হয়ে গান লিখে গিয়েছেন বিভিন্ন রাগসংগীতে। সারাদিন কোর্টের কাজ। কোর্ট থেকে ফিরেই সাক্ষাৎপ্রার্থীর ভিড়। এসব কিছু সামলিয়ে প্রতিদিন গানের মজলিশ বসতই বসত তাঁর নিজের চঞ্চল মনকে শান্ত করার জন্য।
চলাফেরার সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর বিভিন্ন গানের কলি ভেসে উঠত আর তখনই যে কোনও টুকরো কাগজে লিখে রাখতেন। এইভাবে একটার পর একটা কলি জুড়ে জুড়ে অপূর্ব সব গান সৃষ্টি হয়েছে।
বিলেত থেকে ফিরে দিলীপকুমার রায় গজল সুরে গান বেঁধেছিলেন –
‘‘যদি দিন না দেবে তবে
এত ব্যথা কেন সওয়াও!
যদি আশা নাহি রবে,
মিছে বোঝা কেন বওয়াও।’’
তাঁর বন্ধু অতুলপ্রসাদ গানটি শুনে লিখেছিলেন বিখ্যাত গান – ‘কত গান তো হল গাওয়া/আর মিছে কেন গাওয়াও’। নজরুলের হিন্দুস্থানী কাজরি সুরে – ‘এত জল ও কাজল চোখে পাষাণী, আনলে বলো কে?’ এই গানটি দিলীপকুমারের কণ্ঠে শুনে লিখে ফেলেছিলেন একটা চমৎকার গান। – ‘জল বলে চল, মোর সাথে চল, তোর আঁখি জল, হবে না বিফল, কখনো হবে না বিফল।’ সারাটা জীবন দুঃখের আগুনে ঝলসিয়ে অতুলপ্রসাদের যে ভাব সৃষ্টি হয় তা লক্ষণীয়। তাই তো তিনি লিখেছিলেন – ‘দুঃখেরে আমি ডরিব না আর, কণ্টক হোক কণ্ঠের হার; জানি তুমি মোরে করিবে অমল, যতই অনল দহিবে।’ ভগবদ-প্রেমে, প্রকৃতি প্রেমে দেশাত্মবোধক সংগীতে তাঁর বিভিন্ন ভাবের প্রকাশ হয়েছে। সিন্ধু কাফি রাগে – ‘যখন তুমি গাওয়াও গান তখন আমি গাই’ পংক্তিতে আত্মসমর্পণ। বাউল কীর্তনে ‘মেঘেরা দল বেঁধে যায় কোন দেশে’ এই পংক্তিতে যে ঔদার্য আবার – ‘ঝরিছে ঝরঝর গরজে গর’ গানে যে দোলা কিংবা – ‘বলো বলো বলো রবে শতবীণা বেণু রেবে’ যে দেশাত্মবোধকের ছোঁয়া, আবার – ‘চাঁদিনী রাতে কে গো আসিলে’ অথবা – ‘কে আবার বাজায় বাঁশি এ ভাঙা কুঞ্জবনে’ গানে প্রেমের উচ্ছ্বাসভাবের কিংবা – ‘নিচুর কাছে হতে নিচু শিখলি নারে মন’ গানে নীতিবদ্ধতার সুর সঞ্চারিত। অতুলপ্রসাদের মনের সারল্যভাবের জন্যই লিখতে পেরেছিলেন – ‘সবারে বাসরে ভালো, নইলে মনের কালো ঘুচবে নারে।’ আবার ব্রহ্মসংগীত, ব্রহ্মোপসনা ছাড়িয়ে হরি এবং মানুষ – এই হরি এবং দেশ সবই তাঁর কাছে সমার্থক, না হলে দেশাত্মবোধক গানে কবি কেন লিখবেন – ‘ঐই ভাষাতেই বলবো হরি, সাঙ্গ হলে কাঁদা হাসা।’ রাগ রাগিণীর ওপর অতুলপ্রসাদের খুব দখল ছিল। তবুও বেহাগ, মল্লার, খাম্বাজ, পিলু, দেশ, ভৈরবীর প্রতি বিশেষ আকর্ষণ দেখা যায়। জৌনপুরী রাগে লেখা – ‘তব চরণ তলে সদা রাখিও মোরে’ অথবা বসন্ত রাগে – ‘নব রূপ হেরি আজি বিশ্ব বিমোহিত’।
কতশত উপলক্ষেই যে গান লিখেছিলেন অতুলপ্রসাদ! একুশ শতকের উৎসবসর্বস্বতার ভিড়ে দেশবন্দনার গানগুলি পিছু হটতে হটতে এখন ১৫ই অগস্ট, ২৩শে কি ২৬শে জানুয়ারির দেওয়ালে এসে ঠেকেছে, তবু ‘জনগণমন অধিনায়ক’ বা ‘আমার সোনার বাংলা’-র পরেই এখনও যে গানগুলি শুনলে পরাধীন এক দেশে মানুষের চকচকে চোখ আর দৃঢ়বদ্ধ মুষ্টির কথা মনে পড়ে, তার অনেকগুলিরই রচয়িতার নাম অতুলপ্রসাদ সেন। ‘উঠ গো ভারতলক্ষ্মী’, ‘মোদের গরব মোদের আশা, আ মরি বাংলা ভাষা’, ‘হও ধরমেতে ধীর, হও করমেতে বীর’, ‘বলো বলো বলো সবে, শত–বীণা-বেণু-রবে’ – অতুলপ্রসাদের গান কোন বাঙালি গায়নি? গান-বাঁধার উপলক্ষগুলিও মনে রাখার মতো। বিলেতে ইংরেজ গায়িকার গান শুনে লিখেছিলেন ‘প্রবাসী চল রে, দেশে চল’। লোকমান্য তিলক কারারুদ্ধ হয়েছিলেন, দেশ জুড়ে প্রতিবাদ চলছিল। অতুলপ্রসাদের বাড়িতে সে দিন অতিথি হয়ে এসেছিলেন বিপিনচন্দ্র পাল ও শিবনাথ শাস্ত্রী। তাঁদের সামনেই অতুলপ্রসাদ গেয়েছিলেন ‘কঠিন শাসনে করো মা শাসিত’। ১৯১৩ সালে রবীন্দ্রনাথের নোবেলজয়ের পর অতুলপ্রসাদের নিজস্ব গুরুবন্দনা ছিল ‘মোদের গরব মোদের আশা’-র দু’টি কলি: ‘বাজিয়ে রবি তোমার বীণে/ আনল মালা জগৎ জিনে …’ শান্তিনিকেতনে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ তাঁকে শুনিয়েছিলেন ‘মোর সন্ধ্যায় তুমি সুন্দরবেশে এসেছ, তোমায় করি গো নমস্কার …’ আর প্রত্যুত্তরে অতুলপ্রসাদ গেয়েছিলেন, ‘ওগো আমার নবীন সাথী, ছিলে তুমি কোন বিমানে?’ দার্জিলিংয়ে টয়ট্রেনে গান বেঁধেছিলেন, আপনমনে গেয়েছিলেন মধুপুরে, শিমুলতলায়, সুন্দরবনে স্টিমারে। মামলার কাগজের ফাঁক থেকেও উদ্ধার হয়েছিল অতুলপ্রসাদের গান!
১৮৮৬ সাল। অতুলপ্রসাদ তখন মাত্র ১৫ বছর। রবীন্দ্রনাথের সদ্যপ্রকাশিত ‘কড়ি ও কোমল’ কাব্যটি পড়ে প্রেসিডেন্সির ছাত্র অতুলপ্রসাদ মুগ্ধ হয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর পরিচিতির ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথের অতি প্রিয় ভাগিনেয়ী সরলা দেবী চৌধুরানী। রবীন্দ্রনাথ এবং অতুলপ্রসাদ নিজেদের রচনা কবিতা, গান ভাগ করে নিতে নিতে ‘অতুলবাবু, আপনি’ সম্বোধন ‘অতুল ও তুমি’তে পর্যবসিত হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ ছাড়া ঠাকুরবাড়িতে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের সংস্পর্শে এসেও সমৃদ্ধ হয়েছিলেন। অতুলপ্রসাদ জ্যোতিরিন্দ্রনাথ সম্পাদিত ‘বীণাবাদিনী’ পত্রিকায় খাম্বাজ একতালা রাগে বিধৃত ‘তুমি মধুর’ অঙ্গে, নাচো গো রঙ্গে’, মিশ্র কাওয়ালিতে লেখা ‘এসো হে প্রাণে প্রাণসখা’ এবং মিশ্র কাওয়ালিতে রচিত ‘ভারতলক্ষ্মী’ গান তিনটির স্বরলিপি প্রকাশিত হয়েছিল। ১৯১৪ সালে রবীন্দ্রনাথের আমন্ত্রণে অতুলপ্রসাদ রামগড় পাহাড়ে দশ দিন আতিথ্যে কাটিয়ে এসেছিলেন। কর্ম সংস্থানের জন্য কলকাতা ছেড়ে দূর লখনউতে স্থায়ী বসবাস করলেও দু’জনের মধ্যে দূরত্ব রচিত হয়নি। হেমকুসুম অতুলের বাড়ি ছেড়ে অন্য বাড়িতে থাকছিলেন। হঠাৎ রবীন্দ্রনাথ এসেছিলেন লখনউয়ে কোনও এক সাহিত্য সম্মেলনে। উঠেছিলেন তাঁর প্রিয় অতুলের বাড়িতে। অতুলপ্রসাদের আনন্দ আর ধরে না। কিন্তু সেই সঙ্গে চিন্তা – কে কবিগুরুর পরিচর্যা করবে? হেম যে তখন বাড়িছাড়া। কিন্তু কী আশ্চর্য! লোকমুখে কবির আগমনের দিনই অতুলপ্রসাদের আদরের হেমকুসুম ফিরে এসেছিলেন স্বামীর ঘরে। কবির দেখভালের সব দায়িত্ব নিয়েছিলেন নিজেই। অতুলও আনন্দে ভেবেছিলেন যে নিজে থেকেই যখন হেম ফিরে এসে ভাঙা সংসারের দায়িত্ব নিয়েছে, তাই এবার আর বাড়ি ছেড়ে যাবে না। কিন্তু বিধি বাম। কবি যেদিন চলে গিয়েছিলেন সেদিনই অতুলকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন হেমকুসুম। অভিমানে দুঃখে অতুলপ্রসাদের মনে হয়েছিল – হেম যতটাই তাঁর জন্য দরদি, ততটাই যেন নিষ্ঠুর। তিনি হেমকে উদ্দেশ্য করে সেই রাতেই লিখেছিলেন,
‘‘ওগো নিঠুর দরদী, একি খেলছো অনুক্ষণ।
তোমার কাঁটায় ভরা বন, তোমার প্রেমে ভরা মন।’’
রবীন্দ্রনাথ তাঁকে ভালবাসতেন খুব। ১৮৯৬ সালে রবীন্দ্রনাথ গড়েছিলেন ‘খামখেয়ালী সভা’, সদস্য ছিলেন দ্বিজেন্দ্রলাল, মহারাজা জগদীন্দ্রনারায়ণ রায়, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, লোকেন্দ্রনাথ পালিত … আরও অনেকে। অতুলপ্রসাদ ছিলেন সভার সর্বকনিষ্ঠ সভ্য। নিয়ম আর সময়ের ঘুড়ি ভোকাট্টা হত সেখানে; গানবাজনা, সাহিত্য – সবই হত মজার ঢঙে। অতুলপ্রসাদ নিজেই দিয়েছেন সেই আনন্দসভার বিবরণী –
‘‘খামখেয়ালীর মজলিসকে মজগুল রাখিতেন পরম হাস্যরসিক দ্বিজেন্দ্রলাল রায় … আমরা সকলে তাঁর হাসির গানের কোরাসে যোগ দিতাম, রবীন্দ্রনাথ ছিলেন কোরাসের নেতা। দ্বিজেন্দ্রলাল গাহিতেন – ‘হোতে পাত্তেম আমি একজন মস্ত বড় বীর’ আর রবীন্দ্রনাথ মাথা নাড়িয়া কোরাস ধরিতেন – ‘তা বটেইত, তা বটেইত’… অধিবেশন এক একজন সদস্যের বাড়ীতে হইত। যেদিন আমার বাড়ীতে অধিবেশন হয় সেদিন কবি বাড়ি গেলেন রাত্রি বারোটার পরে, মহারাজ নাটোর বাড়ি গেলেন একটা-দু’টার সময় আর দ্বিজেন্দ্রলাল ও আমরা কয়েকজন সারারাত কীর্তন শুনিয়া ও তাঁর হাসির গান শুনিয়া কাটাইলাম। তারপর দিন প্রাতে হাস্যরাজকে আমি বাড়ি পৌঁছাইয়া আসি। মনে আছে, তাঁর স্ত্রী বড়ই চিন্তিত হইয়া পড়িয়াছিলেন …’’
একবার কুমায়ুনের রামগড়ে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ, লখনউ থেকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন অতুলপ্রসাদকে। পাহাড়ে তখন প্রবল বর্ষা, দিন-রাত অঝোর বৃষ্টি। একদিন বর্ষার আসর বসেছিল, বিকেল থেকে শুরু করে রাত দশটা পর্যন্ত চলেছিল কবির বর্ষার কবিতা পাঠ, বর্ষার গান। প্রতিমা দেবী খেতে ডাকছিলেন, ভ্রুক্ষেপ ছিলনা কারও। রবীন্দ্রনাথের গান-রচনারও সাক্ষী ছিলেন অতুলপ্রসাদ। একবার ভোরে সূর্যোদয়ের আগে রবীন্দ্রনাথ বেরিয়ে পড়েছিলেন, অতুলপ্রসাদ লুকিয়ে তাঁর পিছু নিয়েছিলেন। দেখেছিলেন, কবি গিয়ে বসেছেন একটি পাথরের উপরে, সামনে ভোরের আকাশ, অনন্ত হিমালয়। গুনগুন করে গান রচনা করছিলেন রবীন্দ্রনাথ, ‘এই লভিনু সঙ্গ তব সুন্দর হে সুন্দর’। অতুলপ্রসাদ এই গানের জন্মক্ষণের গোপন প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন, আড়াল থেকে শুনে পালিয়ে এসেছিলেন ঘরে। দু’তিন দিন পরে কবি যখন ‘এই লভিনু’ গেয়ে শোনাচ্ছিলেন প্রকাশ্যে, অতুলপ্রসাদ বলেছিলেন, এই গান আমি আগেও শুনেছি। কবি তো অবাক! অতুলপ্রসাদ রহস্য ভাঙলে রবীন্দ্রনাথের প্রশ্রয়ী মন্তব্য ছিল, ‘তুমি ত ভারি দুষ্টু, এইরকম করে রোজ শুনতে বুঝি?’ রবীন্দ্রনাথ লখনউয়ে এসেছিলেন, তাঁর জন্মবার্ষিকীর সংবর্ধনা সভায় অতুলপ্রসাদ নিজে গান লিখে, তরুণ পাহাড়ী সান্যালকে সেই গান তুলিয়ে, গাইয়েছিলেন – ‘এসো হে এসো হে ভারতভূষণ …’ রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘পরিশোধ’ গ্রন্থটি উৎসর্গ করেছিলেন অতুলপ্রসাদকে।
সেই যুগে ৩৩ হাজার টাকা দিয়ে লখনউয়ের কেশরবাগে বিরাট বাড়ি করেছিলেন অতুলপ্রসাদ। গাইয়ে-বাজিয়েদের আসর বসত সেখানে। বড় ভালবাসতেন ঠুমরি, নিজের গানে ঠুমরির চলন-ঠাট এনেছিলেন অনায়াস দক্ষতায়। দিলীপকুমার রায়, পাহাড়ী সান্যাল, সাহানা দেবীকে সেই গীতিসম্পদ শিখিয়ে, বিলিয়ে গিয়েছেন নিজে হাতে ধরে। কলকাতা তো বটেই, রামপুর, গোয়ালীয়র, মথুরা, ইনদওর, কাশী, হায়দরাবাদ, সব শহরের তাবড় শিল্পীর ঠিকানা ছিল লখনউয়ে সেনসাহেবের বাড়ি। এসেছিলেন স্বয়ং বিষ্ণুনারায়ণ ভাতখণ্ডেজি ও তাঁর সুযোগ্য শিষ্য শ্রীকৃষ্ণরতনজানকার। শ্রীকৃষ্ণরতনজানকারের গলায় ‘ভবানী দয়ানী মহাবাক্বাণী’ শুনে অতুলপ্রসাদ ভৈরবীতে বেঁধেছিলেন ‘কে ডাকে আমারে/ বিনা সে সখারে রহিতে মন নারে!’ যেখানে ভাল গান, সুকণ্ঠের সন্ধান পেতেন, সেখানেই ছুটে যেতেন এই সংগীত-সন্ন্যাসী। সাহানা দেবী লিখেছেন, ‘‘গান শুনে অত খুশি হয়ে উঠতে (অন্য কাউকে) আমি কমই দেখেছি। কি যে করবেন ভেবে পেতেন না।’’ অমল হোম তাঁকে বলেছেন ‘অক্লান্তকণ্ঠ’।
সে সব কী দিনই না ছিল! ভাবুকের সঙ্গে মনের যোগ ছিল কর্মীর। গায়কের সঙ্গে বিজ্ঞানীর। দেশনেতার সঙ্গে চিত্রশিল্পীর। কবির সঙ্গে ব্যারিস্টারের। দুরন্ত প্রযুক্তি ছিল না, চিঠিপত্রের গতায়াতে সময় লাগত বিস্তর। দেশ জুড়ে কত ওঠানামা, ঘটনার বুড়বুড়ি অন্য প্রান্তে পৌঁছনোও সময়ের ব্যাপার। তবু মনের যোগ ছিল বলেই দূর এসে যেত কাছে। আর সৌভাগ্যের কথা, সব যুগেই থাকেন কিছু মানুষ – গোটা দেশকে একসূত্র রাখেন প্রজ্ঞা, প্রতিভা আর হৃদয়বত্তায়। অতুলপ্রসাদ সেন যেমন। ঊনবিংশ-বিংশ শতকের ভারতে এক বিস্তীর্ণ সেতুবন্ধ।
একসময় অতুলপ্রসাদ এবং হেমকুসুমের দাম্পত্য প্রেম দেখে সকলে হিংসা করতেন। কিন্তু কী এমন ঘটেছিল যার জন্য দু’জনের সাংসারিক জীবন লণ্ডভণ্ড হয়ে গিয়েছিল! অতুল ও হেম দু’জনে দু’জনকে ভীষণভাবে ভালোবাসতেন। এই দাম্পত্য অশান্তির সূত্রপাত হয়েছিল অতুলপ্রসাদের বিধবা মা হেমন্তশশীকে নিয়ে। অতুলপ্রসাদের মাকে দেখবার কেউ ছিলেন না। অতুলপ্রসাদের তো তখন রমরমা বাজার, বিশাল অট্টালিকা লখনউ শহরে, গাড়ি, অনেক দাস-দাসী, আর গুণমুগ্ধ ভক্তের দল। কোনও কিছুরই অভাব ছিলনা। বৃদ্ধা অসহায় মাকে একমাত্র ছেলে হয়ে কি তিনি দূরে সরিয়ে রাখতে পারতেন?
একদিন লখনউয়ের বিখ্যাত ব্যারিস্টার ‘এ পি সেন’ সাহেব বা অতুলপ্রসাদ সেন কোর্টের পর গাড়ি থেকে নেমে বাড়ির সদর দরজা পেরিয়ে দেখেছিলেন সুন্দর সবুজ লনের এককোণে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। আর সেই আগুনে এক এক করে দামি দামি স্যুট, জামাকাপড় পোড়াচ্ছেন তাঁরই সহধর্মিণী হেমকুসুম! তার আগে কয়েকদিন দু’জনের অশান্তি চলেছিল। এই অদ্ভুত দৃশ্যে অতুলপ্রসাদের মাথায় আগুন জ্বলে উঠতেই ছুটে বাড়ি থেকে বের হয়ে ড্রাইভারকে হুকুম করেছিলেন দাদা সত্যপ্রসাদের বাড়ি নিয়ে যেতে। দাদাকে গিয়ে এই হেমকুসুমের অদ্ভুত কাণ্ডকারখানা বলে বলেছিলেন – আর ওই বাড়িতে ফিরব না। হেমকুসুমের সঙ্গে প্রতিদিনের ঝগড়ায় জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। দাদা সত্যপ্রসাদ কয়েকদিন ধরে নানাভাবে বুঝিয়েছিলেন যাতে স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়া মিটমাট হয়। কয়েকদিন পর অতুলপ্রসাদের মনটা শান্ত হতে কান্না হয়ে ঝরে পড়েছিল এক অপূর্ব গানে – ‘‘… যাব না যাব না যাব না ঘরে, বাহির করেছে পাগল মোরে। …’’
হেমকুসুম চাইতেন না তাঁর শাশুড়িমা তাঁদের সঙ্গে একই বাড়িতে থাকুন। অতুলপ্রসাদ মাতৃভক্ত বিবেকবান ছেলে। তাই মাকে এনে বাড়িতে রাখলেন, আর বাড়ির নামকরণ করলেন ‘হেমন্ত নিবাস।’ তখন থেকেই হেমকুসুম ও অতুলপ্রসাদের ভালোবাসার বন্ধন ছিন্ন হতে লাগল। এই ঝগড়ার কারণ অনুসন্ধান করতে গেলে অতুলপ্রসাদের জীবনী জানতে হবে।
কারও কাছে ‘অতুলদা’, কারও ‘ভাইদাদা’। আরও অনেকের কাছে ‘এ পি সেন’, ‘সেনসাহেব’, লখনউয়ের শ্রেষ্ঠ ব্যারিস্টার। কারও ‘প্রিয়বরেষু’, ‘কবিবন্ধু’। সব সম্বোধনের পিছনে ছিলেন সদাশিবের মতো মানুষটি, যাঁর ছিল মুখে হাসি, গলায় গান, দু’হাতে কাজ, দান-ধ্যান। সেই মানুষটি, যিনি কাগজে বিবেকানন্দের শিকাগো-জয়ের খবরে উচ্ছ্বসিত হয়ে সেলিব্রেট করতেন, রবীন্দ্রনাথের জন্মবার্ষিকী পালনে উঠেপড়ে লাগলেন, মহাত্মা গান্ধীর ডাকে ছুটে গিয়ে গান শোনাতেন, তিনি অতুলপ্রসাদ। তিনি অওধ বার অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট, আবার প্রবাসী বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনের কান্ডারি। তাঁকে ছাড়া লখনউয়ের মুশায়েরা, ঠুমরি-গজলের মজলিশ পূর্ণ হত না। তিনি দীনের সহায়, লখনউয়ের রাস্তায় যেতে যেতে ঘুমন্ত দরিদ্রের বালিশের তলায় টাকা গুঁজে দিয়ে বেরিয়ে আসতেন নিঃশব্দে। অন্তরের গহনতম প্রদেশে সেই মানুষটাই নীরব কান্নাকে সমর্পণ করেছিলেন প্রার্থনায়। সব যন্ত্রণার শেষ ঘটাতেন নির্মাণে – গান রচনায়, সুর-সাধনায়।
অতুলপ্রসাদ জন্মেছিলেন অবিভক্ত বঙ্গের ঢাকা শহরে ২০শে অক্টোবর ১৮৭১ সালে। অতুলপ্রসাদের বাবা ডাক্তার রামপ্রসাদ সেন ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করেন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রবর্তনায়। পিতা রামপ্রসাদ সংগীতজ্ঞ ও সংগীত রচয়িতা ছিলেন। তিনি কেশবচন্দ্র সেনের অনুরাগী হয়ে ‘নব বিধান সমাজের’ অনুগামী হন এবং প্রতিদিন বালক অতুলকে সঙ্গে নিয়ে সমাজে যেতেন এবং সংগীতে অংশগ্রহণ করতেন। মা হেমন্তশশী নানা গীতরচনায় পারদর্শী ছিলেন। তাই এক সংগীতময় পরিবেশেই বালক অতুলপ্রসাদের জীবন গড়ে উঠতে থাকে। খুব অল্প বয়সেই অতুলপ্রসাদ গান লিখতে শুরু করেন। কিন্তু হঠাৎ বিনা মেঘে বজ্রপাত। মাত্র এগারো বৎসর বয়সে পিতা রামপ্রসাদ সেন ইহলোক ত্যাগ করায় মা হেমন্তশশী নাবালক এক পুত্র ও তিন কন্যাকে নিয়ে ভাটপাড়ায় বাপের বাড়িতে এসে আশ্রয় নেন।
অতুলপ্রসাদের পিতা রামপ্রসাদ সেন ছিলেন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্নেহভাজন, মহর্ষিই তাঁকে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হতে সাহায্য করেন। ঢাকার বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব, ঋষি কালীনারায়ণ গুপ্তের মেয়ে হেমন্তশশীর সঙ্গে বিয়ে হয় উদার, বুদ্ধিমান তরুণটির। জন্মাবধি অতুলপ্রসাদ দেখেছিলেন উনিশ শতকীয় সংস্কারমুক্ত খোলা একটা আকাশ। বাবা রামপ্রসাদ নববিধানের, দাদু কালীনারায়ণ ভারতীয় ব্রাহ্মসমাজের সদস্য ছিলেন। শ্বশুর-জামাতার মতান্তর মনান্তরে রূপ নেয়নি কখনও। শিশু অতুল দেখেছিলেন রবিবারের প্রার্থনায় দু’জনেরই প্রণত যোগদান। কালীনারায়ণের কাছে আসতেন বহু দীনজন। দানসামগ্রী যা কিছু শিশু অতুলের হাত দিয়ে দেওয়াতেন মাতামহ। অতুলপ্রসাদ বড় হতে হতে দেখেছিলেন, দাদু একটা কালো পাথরের থালায় ভাত খান, নিজের হাতে থালা ধুয়ে তাতেই ভাত বেড়ে দেন লক্ষ্মীবাজারের বাড়ির বহু দিনের পুরনো মেথরকে, সে খেয়ে উঠলে নিজে সেই থালা ধুয়ে রাখেন ফের। উচ্চবর্ণের, সচ্ছলতার গুমোর ভেঙেছিল রোজকার সহজ শিক্ষায়, আমৃত্যু সেই শিক্ষা ভোলেননি।
অতুলপ্রসাদের মাতামহ প্রখ্যাত ব্রাহ্মসংগীত বিশারদ ও অর্থবান কালীনারায়ণ গুপ্ত ও তাঁর ছেলেরা এই অসহায় পরিবারকে নিজেদের পরিবারের অংশ করে নেন। বালক অতুলপ্রসাদের লালন ঘটেছিল আর এক ব্রাহ্ম পরিবারে, যেখানে সুগায়ক ও ব্রাহ্ম সংগীত রচয়িতা হিসাবে মাতামহ কালীনারায়ণের পরিচিতি ও প্রতিষ্ঠা সুবিদিত হয়েছিল। মাতুলালয়েই অতুলপ্রসাদের শিক্ষা জীবন সূচনা হয়। ১৮৮৬ সালে ঢাকা শহর থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় ভালোভাবে পাশ করে বিএ পড়ার জন্য কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে ভরতি হন।
প্রবেশিকা পরীক্ষা দিয়ে ঢাকায় সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সংস্পর্শে এসে দেশের কাজে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। ঠিক তখনই খবর গিয়েছিল তাঁর মা হেমন্তশশী দ্বিতীয় বিয়ে করেছেন শ্রী দুর্গামোহন দাশকে, যিনি ছিলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের জ্যাঠামশাই। অতুল হঠাৎ মায়ের এই বিয়ে মেনে নিতে পারেননি। প্রিয় বাবাকে হারাবার পর মা-ই তাঁর এবং ছোট তিন বোনের অভিভাবিকা ছিলেন। সেই সময় মায়ের চিঠি পেয়েছিলেন – ‘অতুল বোনেদের নিয়ে কলকাতায় চলে এসো অবিলম্বে।’ মা-র এহেন অদ্ভুত সিদ্ধান্তে অতুলপ্রসাদের মনের ব্যথা কুরে কুরে খেতে লেগেছিল। বোনেদের মায়ের কাছে রেখে নিজে বিধ্বস্ত অবস্থায় ভাটপাড়ায় মামার বাড়ি ফিরে এসে সেখানেই থাকতে শুরু করেছিলেন। কলকাতায় বড়মামা কৃষ্ণগোবিন্দ গুপ্তের বাড়িতে থাকতেন তখন, অভিমানে মায়ের কাছেই ঘেঁষতেন না। অভিমান থেকে এসেছিল জেদ, প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়ে, পরে বিলেত গিয়ে হতে হবে ব্যারিস্টার। একা নিজের ঘরে মায়ের জন্য কাঁদতেন, তখন তাঁর কাছে এসে বসতেন তাঁর মামার মেয়ে হেমকুসুম। সান্ত্বনা দিতেন, প্রেরণা যোগাতেন, বড় হতে হবে জীবনে, অনেক বড়। হেমকুসুমের সঙ্গ অতুলপ্রসাদকে তিরতির করে কাঁপিয়ে তুলত। কিছুকাল বাদে দাদামশাই ও মামারা অতুলপ্রসাদকে বিলেতে ব্যারিস্টারি পড়ার জন্য পাঠাবেন বলে ঠিক করেছিলেন।
যদিও প্রায় সব ব্যবস্থাই করেছিলেন তাঁর সম্পর্কে সৎবাবা, সৎ তো কি? তাতে তো স্নেহ আটকায় না। দুর্গামোহনই ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন অতুলপ্রসাদের বিলেত যাওয়ার প্যাসেজ মানি, ভারী শীতপোশাকের। ১৮৯০ সালে ব্যারিস্টারি পড়তে ইংল্যান্ডে পাড়ি দিয়েছিলেন বছর কুড়ির অতুল। জাহাজে ভেনিস হয়ে আসার পথে গন্ডোলা-চালকরা একটা গান গাইছিল, কী মিষ্টি! সেই সুরই অতুলপ্রসাদকে দিয়ে লিখিয়ে নিয়েছিল একটা গান –
‘‘উঠ গো ভারতলক্ষ্মী, উঠ আদি জগৎজনপূজ্যা
দুঃখ-দৈন্য সব নাশি, কর দূরিত ভারতলজ্জা …’’
যে গান পরে বিংশ শতাব্দীর ভারতে জাতীয়তাবাদের আবহে মানুষের মুখে মুখে ঘুরেছিল। লন্ডনে মিডল টেম্পল-এ পড়েছিলেন, ব্রিটিশ মিউজিয়াম দেখেছিলেন অবাক চোখে। সেখানেই তখন চিত্তরঞ্জন দাশ, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, অরবিন্দ ঘোষ, সরোজিনী নাইডু – অতুলপ্রসাদ ছিলেন এঁদের সবার বন্ধু। পড়ার সমান্তরালে চলত অপেরা, পাশ্চাত্য সংগীত, বিশ্বসাহিত্যের পাঠ। তাঁদের সঙ্গে সময় কাটিয়ে নিজের মনের ঝড় কিছুটা কমেছিল তাঁর। এর মধ্যে তাঁর মামা কৃষ্ণগোবিন্দ ও তাঁর মেয়ে হেমকুসুম বিলেতে গিয়েছিলেন। সেখানে মামা ও মামাতো বোন হেম একসঙ্গেই থাকতেন। ছোট থেকে একসঙ্গে বড় হলেও অতুল-হেমের ঘনিষ্ঠতা ক্রমে প্রেমের আকার নিয়েছিল। দু’জনেই হয়ে উঠেছিলেন দু’জনের চোখের মণি। কলকাতায় ফিরে হাইকোর্টে নাম লিখিয়েছিলেন অতুলপ্রসাদ, লর্ড সত্যেন্দ্রপ্রসন্ন সিংহের ‘জুনিয়র’ হিসেবে শুরু হয়েছিল তাঁর কর্মজীবন।
অতুল ব্যারিস্টারি পাশ করে দেশে ফেরার কিছুদিনের মধ্যেই মামা ও হেমকুসুম ভাটপাড়ায় ফিরে এসেছিলেন।
কঠিন ব্যারিস্টারি পরীক্ষা পাশ করে ছেলে দেশে ফেরার পরে হেমন্তশশী-দুর্গামোহন খুব খুশি হয়েছিলেন। মায়ের কাছে যেতে তবু পা সরত না তাঁর, মাঝে কী এক দুর্লঙ্ঘ্য বাধা অনুভব করতেন। পরিস্থিতি জটিলতর হয়েছিল, যখন অতুলপ্রসাদ-হেমকুসুম ঠিক করেছিলেন, বিয়ে করবেন। আত্মীয়রা শিউরে উঠেছিলেন। মামাতো-পিসতুতো ভাইবোন, বিয়ে হবে কী! ব্রিটিশ বা হিন্দু, কোনও আইনেই এ বিয়ে যে সিদ্ধ নয়। শেষে লর্ড সত্যপ্রসন্ন সিংহ অতুলপ্রসাদকে একটা উপায় বলে দিয়েছিলেন। বিয়ে করতে হলে বিদেশে গিয়ে করো। স্কটল্যান্ডে গ্রেটনাগ্রিন নামে একটা গ্রাম আছে যেখানে ভাইবোনের বিবাহের সম্মতি মেলে। স্কটল্যান্ডে গ্রেটনাগ্রিন গ্রামের গির্জায়, সেখানকার নিয়মে বিয়ে করেছিলেন হেমকুসুম-অতুলপ্রসাদ। বিংশ শতাব্দীর শুরুর বছরটি তখন সবে চোখ মেলতে শুরু করেছিল।
১৮৯২ সালে ব্যারিস্টার হয়েও কলকাতা হাইকোর্টে এবং উত্তরবঙ্গে রংপুরে আইন ব্যবসা করেও অতুল তেমন সুবিধা করতে পারেননি। অতুল হেমকুসুমকে বিয়ে করে সর্বদা কাছে পাবার জন্য এতই উদগ্রীব ছিলেন যে দু’জনেই দেশ ছেড়ে গ্রেটনাগ্রিন গ্রামে পাড়ি দিয়ে বিয়ে করে সেখানেই সংসার পেতেছিলেন ১৯০১ সালে।
বিয়ে তো হয়েছিল, কিন্তু দেশে ফেরা? কিছু দিন চেষ্টা করেছিলেন, বিলেতেই যদি থাকা যায়। রোজগার বড় বালাই। তখন তাঁদের দুই পুত্র দিলীপকুমার-নিলীপকুমার জন্ম নিয়েছিলেন, সংসার চালাতে হবে। সাত মাসের মাথায় জ্বরে নিলীপকুমার মারাও গিয়েছিলেন। কাজ জুটছিল না, হেমকুসুম গয়না বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছিলেন। কিন্তু ব্যারিস্টার অতুলপ্রসাদ না স্কটল্যান্ড, না ইংল্যান্ড, না আয়ারল্যান্ড কোথাওই পসার জমাতে না পেরে সমস্ত জমানো পুঁজি শেষ করে দেশে ফিরে এসেছিলেন। এখানেই যদি কিছু রোজগার করা যায়। সব আত্মীয়রা তাঁদের সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করেছিলেন। প্রচণ্ড দারিদ্র। দিন আর চলছিল না।
কলকাতায় তো ফিরেছিলেন, কিন্তু প্র্যাকটিস জমানো মুখের কথা নয়। মুখ ফিরিয়ে-থাকা পরিজন-বন্ধুর মাঝে বাঁচাও মুশকিল হয়ে দাঁড়িয়েছিল। হঠাৎ তাঁর ব্যারিস্টার বন্ধু মমতাজ হোসেন বুদ্ধি দিয়েছিলেন, লখনউ চলুন। উত্তরপ্রদেশের নবাবি নগর, ঠুমরি-টপ্পা-শায়েরির লখনউয়ে তখন ছিল বহু বাঙালির বাস; তাঁরা গোমতীর তীর আলো করে ছিলেন শিক্ষা-সাহিত্য-শিল্পে। গুণীর কদর করত লখনউ, মানীর মান রাখত। অতুলপ্রসাদ লখনউ এসেছিলেন, ক’জন বন্ধুও এগিয়ে এসেছিলেন তাঁর সাহায্যে। লখনউ বার অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য হয়েছিলেন, প্র্যাকটিস শুরু করেছিলেন লখনউ কোর্টে।
আস্তে আস্তে ভাগ্যের চাকা ঘুরে গিয়ে কিছুদিনের মধ্যেই ভালো পসার ও খুব সুনাম হয়েছিল। এই পরিক্রমা হেমকুসুম ভোলেন কীভাবে! অর্থাভাবে যমজ ছেলে নিলীপ প্রায় বিনা চিকিৎসায় মারা গিয়েছিলেন। নিজের গায়ের সমস্ত গহনা বিক্রি করে কোনওরকমে সংসার চালিয়েছিলেন তিনি। তখন তাঁদের পাশে কেউ ছিলেন না। এই অবস্থা থেকে সুখের মুখ দেখার পর শাশুড়ি যে আবার তাঁর নিজের পিসিমা, তাঁকে বাড়িতে অতুল নিয়ে আসাতে হেমকুসুম আর সহ্য করতে পারেন নি। হাজার হলেও এটা ছিল তাঁদের অতি দুঃখ কষ্টে তিলতিল করে গড়া সংসার।
অতুল তাঁর বাবাকে জন্ম থেকে দারুণ ভালোবাসতেন। তারপর মা। মা-র শত অপরাধ ছেলে হয়ে ক্ষমা করতেই হয়। অতুলপ্রসাদ মনে করতেন পৃথিবীতে মা-র স্থান সবচেয়ে আগে। হেমের শত আপত্তি অগ্রাহ্য করে মা হেমন্তশশীকে এনে রাখতেই সংসারে আগুন জ্বলে উঠেছিল। আবার হেমকুসুম আদরে, সোহাগে, সেবা, পরিচর্যায় অতুলকে ভরিয়ে দিয়েও এরকম অবিবেচিত কাজের জন্য স্বামীকে কিছুতেই সহ্য করতে পারছিলেন না। হেমকুসুম আর হেমন্তশশীর এই বিবাদের টানাপোড়েনে অতুলপ্রসাদ বারবার ক্ষতবিক্ষত হয়েছিলেন। তবু না পেরেছেন গর্ভধারিণী মাকে ছাড়তে, না স্ত্রীকে। হঠাৎ হেম বাড়ি ছেড়ে ওই শহরেই অন্য বাড়িতে থাকতে শুরু করেছিলেন। হেমের এই অসহিষ্ণুতা যে একেবারে যুক্তিহীন ছিল এমন নয়। অতুলের প্রতি ভালোবাসার টান এতই অটুট ছিল যে, আলাদা বাড়িতে বাস করলেও মাঝে মাঝেই অতুলের বাড়ি এসে বাড়ি ঘরদোর গুছিয়ে দিয়ে চলে যেতেন দিনের বেলায় যখন অতুল কোর্টে থাকতেন। হেমের পিসিমা বর্তমানে শাশুড়ি তাঁদের বিয়ের ব্যাপারে এবং অন্যান্য আত্মীয়রা নানা সমালোচনার ঝড় তুলে তাঁদের প্রায় একঘরে করে নির্বাসিত করেছিলেন। তাঁকে কী করে ক্ষমা করতেন তিনি?
ওদিকে অতুলপ্রসাদের শুরু হয়েছিল নতুন জীবন। অতুলপ্রসাদ উর্দু শিখেছিলেন, তাঁর বন্ধুতা হয়েছিল শহরের গণ্যমান্য বিদ্বজ্জনদের সঙ্গে। প্রিয়দর্শন, সহাস্য মানুষটি অচিরেই প্রিয় হয়ে উঠেছিলেন সবার। কোর্টে তালুকদারি শরিকি ঝগড়া মেটাতেন পেশাদারি দক্ষতায়, সারস্বত সমাজেও তাঁর সক্রিয় উপস্থিতি দেখা যেত। কলকাতায় যে জীবন চেয়েছিলেন, তা তিনি শেষে পেয়েছিলেন লখনউতে। কত যে কাজ করার ছিল! হরিজন মানুষের মধ্যে কাজ, অতুলপ্রসাদ হাজির। কাশীতে বিধবা আশ্রম প্রতিষ্ঠা, অতুলপ্রসাদ উপস্থিত হতেন। গোমতীর বন্যায় দুর্গতদের জন্য পথে পথে ঘুরে গান গেয়ে অর্থসংগ্রহ, অতুলপ্রসাদকে দেখে লোকে এগিয়ে আসতেন। একবার হিন্দু-মুসলমানের দাঙ্গা লেগেছিল শহরে, ছুটে গিয়েছিলেন অতুলপ্রসাদ। উন্মত্ত মানুষ একে অন্যকে আঘাত করছিল রাজপথে, আর তাঁদের মধ্যে ছুটে গিয়ে অতুলপ্রসাদ বোঝাচ্ছিলেন, ভুল হচ্ছে কোথাও, এ ঠিক নয়। রাতে ঘরে ফিরে কলম তুলে নিয়েছিলেন হাতে, লিখেছিলেন –
‘‘পরের শিকল ভাঙিস পরে, নিজের নিগড় ভাঙ রে ভাই … সার ত্যজিয়ে খোসার বড়াই! তাই মন্দির মসজিদে লড়াই।
প্রবেশ করে দেখ রে দু’ভাই – অন্দরে যে একজনাই।’’
গান ছিল তাঁর প্রাণ। কর্মমুখর জীবনে নিজের জন্য তিনি সময় রাখেননি, গানের জন্য রেখেছিলেন। দিলীপকুমার রায় লিখেছেন,
‘‘আমাদের আগেকার যুগে ভক্তির গানে ফুলের মতন ফুটে উঠছিলেন চারজন কবি: দ্বিজেন্দ্রলাল, রবীন্দ্রনাথ, রজনীকান্ত ও অতুলপ্রসাদ। এঁদের মধ্যে অতুলপ্রসাদ সর্বকনিষ্ঠ তথা অনলংকৃত কবি … তাঁর গান শুনতে শুনতে মনে হয়, দৈনন্দিন ঘরকন্নার মধ্য দিয়ে যেন একটি সরল উচ্ছ্বাসী কবি-হৃদয় নিজের মনের কথা বলে চলেছে তার আনন্দ বেদনা আশা-নিরাশার পসরা নিয়ে।’’
তাঁর দাম্পত্যজীবন দীর্ণ ছিল যন্ত্রণায়। তাঁর স্ত্রী ‘হেমকুসুম’ লখনউতেই দীর্ঘকাল আলাদা বাড়ি ভাড়া করে থাকতেন। অতুলপ্রসাদ তাঁর মা হেমন্তশশীকে নিজের কাছে এনে রাখতে চেয়েছিলেন, রেখেওছিলেন, তাতেই ছিল হেমকুসুমের রাগ। অতুলপ্রসাদ সবার এত কাছে, কাজে থাকতেন, অথচ তাঁর কাছে থাকতেন না, সেটাই ছিল তাঁর অভিমান। অথচ তাঁদের দু’জনের মধ্যেই ছিল ভালবাসার পূর্ণপাত্র। এমনও হয়েছিল, রবীন্দ্রনাথের সংবর্ধনা, হেমকুসুম এসে সমস্ত আয়োজন করেছিলেন হাসিমুখে নিজে হাতে, অনুষ্ঠান-শেষে ফিরে গিয়েছিলেন অভিমানী ভাড়াবাড়িতেই, অতুলপ্রসাদের ঘরে নয়। সুশিক্ষিতা হেমকুসুমের গলায় বিচ্ছেদকালে ঠাঁই পেত অতুলপ্রসাদেরই গান। অতুলপ্রসাদও বহু বিনিদ্র রাত কাটিয়েছিলেন চোখের জলে, গান লিখে-গেয়ে। গ্যেটেকে উদ্ধৃত করে ‘দিলীপকুমার রায়’ লিখেছিলেন, ‘‘গভীর দুঃখ পাওয়াও সার্থক যদি সে-দুঃখে একটি গানও ফুটে ওঠে আঁধারে তারার মতো।’’ অতুল-আকাশ ভরা ছিল অগণিত গীতি-নক্ষত্রে।
তবু অতুলপ্রসাদ হাসতেন, হা-হা করে! একবার প্রিয় বন্ধুকে বলেছিলেন, ‘‘আমি কি প্রার্থনা করি ভগবানের কাছে জান? শ্মশানে যেদিন আমাকে নিয়ে যাবে সেদিন চিতায় শুয়ে হঠাৎ যেন সকলের দিকে চেয়ে একবার হেসে তবে চোখ মুদি।’’
১৯২৫ দেরাদুনে হেমকুসুম ভীষণ অসুস্থ হয়ে যান। এর আগেই এক দুর্ঘটনায় তাঁর পা ভেঙেছিল। প্রায় শয্যাশায়ী ছিলেন। হেম সেবার ঠিক করেছিলেন – অনেক হয়েছে এবার স্বামীর কাছে ফিরে গিয়ে একসঙ্গে শেষ জীবনটা কাটাবেন। এই খবর জানতে পেরে অতুলপ্রসাদ আনন্দে আত্মহারা হয়েছিলেন। নিজেদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি, মান-অভিমান, ভুলে এবার অতুলের একান্ত প্রিয়া স্ত্রী হেম তাঁর কাছে ফিরে আসছেন যে। হেম ফিরে এসেছিলেন স্বামীর ঘরে। বিধি বাম। কয়েকদিন কাটার পরই আবার শুরু হয়েছিল তাঁদের সংঘাত। হেমকুসুম ওই অসুস্থ শরীরে আবার বাড়ি ছেড়েছিলেন। জীবনের অপরাহ্নে দু’জনের এই বিচ্ছেদ জ্বালা উভয়েরই খুব দ্রুত স্বাস্থ্যহানির কারণ হয়ে উঠেছিল। অতুলপ্রসাদ বিশ্রাম ও স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য দার্জিলিং যান। বিধ্বস্ত মনে ভগ্ন স্বাস্থ্যে তিনি লিখেছিলেন তাঁর অন্তরের কান্না জড়ানো বেহাগ-খাম্বাজ মিশ্র রাগে –
‘‘তখনি তোরে বলেছিনু মন
যাসনে রে তুই এ বিপথে
মানলি না তখন
দুখের বোঝা লয়ে শিরে চলরে ভোলা চলরে ফিরে
ভরসা তোর এ তিমিরে হরির চরণ।’’
আর কিছুই শরীর সারে নি তাঁর। তারপর ডাক্তারের পরামর্শে হাওয়া বদলের জন্য কিছুদিন পুরীর সমুদ্র তীরে কাটিয়ে লখনউয়ের বাড়িতে যখন ফিরে এসেছিলেন তখন তিনি তখন প্রায় শয্যাশায়ী। হেমকুসুমকে একবার দেখতে চেয়েছিলেন। খবর গিয়েছিল। কিন্তু হেম আর আসেননি তাঁর কাছে। বিধ্বস্ত মনে ভগ্ন শরীরে ১৯৩৪ সালের ২৫শে আগস্ট (ইংরেজি দিনের হিসাবে ২৬শে আগস্ট) গভীর রাতে তাঁর মৃত্যু এসেছিল। সকালে গোটা লখনউ ভেঙে পড়েছিল শোকে। অধুনা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের গাজীপুর জেলার শ্রীপুর উপজেলাধীন কাওরাইদ ব্রহ্ম মন্দিরের পাশে তাঁকে সমাহিত করা হয়। তাঁর শ্রাদ্ধবাসরে আচার্য ছিলেন ক্ষিতিমোহন সেন। তাঁর শোকসভায় শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বলেছিলেন আসল কথাটি, ‘‘তাঁর দয়া, দান, দাক্ষিণ্য জানাবার লোক এ-সভায় নেই – তাঁরা অত্যন্ত গরীব – অখ্যাত অজ্ঞাত অজানা লোক। তাঁরা যদি আসতে পারতেন, তাহলে বলতেন কত বিপদের মধ্য দিয়ে নিঃশব্দে অতুলপ্রসাদ দিয়েছেন।’’
সেদিন সবার অলক্ষ্যে তখন বুঝি বেজেছিল, ‘‘সবারে বাস্ রে ভালো, নইলে মনের কালো ঘুচবে না রে …’’
(তথ্যসূত্র:
১- অতুলপ্রসাদ সেন, বিশ্বজিৎ ঘোষ, বেঙ্গল পাবলিকেশন্স (২০১৯)।
২- আমারে এ আঁধারে, কল্যাণ কুমার বসু, অভ্যুদয় প্রকাশ মন্দির (১৯৬৯)।
৩- Historical Dictionary of the Bengalis, Kunal Chakrabarty, Scarecrow Press (২০১৩)।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত