স্বামী বিবেকানন্দ ও নিবেদিতা। গুরু-শিষ্যার এক অসামান্য সম্পর্ক। স্বামীজির সংস্পর্শে আসার পর মার্গারেট নোবেল আক্ষরিক অর্থেই তাঁর পরবর্তী সমগ্র জীবন উৎসর্গ করেছিলেন ভারত ও ভারতবাসীর সেবায়। আইরিশ খাপ খোলা তলোয়ারের মতো তেজস্বিনী এক নারীকে স্বামীজি কী মন্ত্রে আদ্যন্ত ভারতীয়ায় রূপান্তরিত করেছিলেন, তার থই আজও পাওয়া যায় না।
স্বামীজির শেষ জীবনে, যখন তাঁর শরীর ক্রমশই ভেঙে পড়ছিল, নিবেদিতা তখন ছায়ায় মতো তাঁর অনুগামী ছিলেন। ১৮৯৮ সালে স্বামীজি-সঙ্গের কথা মর্মস্পর্শী ভাষায় ধরা আছে নিবেদিতার ‘স্বামীজির সহিত হিমালয়ে’ গ্রন্থে। ওই বছরই স্বামীজির শেষবারের মতো হিমালয়ে গিয়েছিলেন। শৈবতীর্থ অমরনাথে শিবের কাছে স্বামীজি ইচ্ছামৃত্যুর বর পেয়েছিলেন। গুহা থেকে বেরিয়ে প্রিয় শিষ্যাকেই তিনি প্রথম সে কথা জানিয়েছিলেন। স্বামীজির মর্ত্যজীবনের এই পরম প্রার্থনাটির কথা জেনে বিস্মিত হয়েছিলেন নিবেদিতা। আরও বিস্মিত হয়েছিলেন স্বামীজি যখন তাঁকে বলেছিলেন, তাঁর এ বার হিমালয়ে আসার অন্যতম উদ্দেশ্য শিবসুন্দরের কাছেই নিবেদিতাকে উৎসর্গ করা তাঁর জীবনব্রত উদ্যাপনের জন্য। আজ সকলেই প্রায় জানেন, হিমালয় তীর্থে সেই দুটি প্রার্থনাই পূরণ হয়েছিল বিবেকানন্দ ও তাঁর মানসকন্যা নিবেদিতার জীবনে।
১৯০২ সালের ৪ঠা জুলাই স্বামীজির সেই প্রথম ইচ্ছাপূরণের দিনটি এসেছিল। সে দিন ছিল শুক্রবার। বেলুড় মঠে সন্ধ্যায় মন্দিরের প্রার্থনার সময় স্বামীজি তাঁর নিজের ঘরে ধ্যানাসনে বসে রাত ৯টায় শান্তভাবে মহাসমাধি লাভ করেছিলেন। সেই অনিন্দ্যসুন্দর দিব্যকান্তি মুখমণ্ডল দেখে প্রথমে কেউ বুঝতেই পারেননি যে, এ স্বামীজির অমৃতধামযাত্রা তথা দু’বছর আগে হিমালয়তীর্থ অমরনাথধামে তুষারলিঙ্গ মহাদেবের কাছে গিয়ে তাঁর ইচ্ছামৃত্যু প্রার্থনার ‘প্র্যাক্টিক্যাল ডিমনস্ট্রেশন’। কিন্তু বিবেকানন্দের কাছে জীবনমৃত্যু পায়ের ভৃত্য হলেও তাঁর জীবনব্রত উদ্যাপনের জন্য যাঁদের রেখে গিয়েছিলেন, এর পর তাঁদের কী হয়েছিল?
পরদিন ৫ই জুলাই, শনিবার। তখন ভগিনী নিবেদিতার ঠিকানা ছিল ১৬ নন্বর বাগবাজার লেন। সকাল ৯টা নাগাদ তিনি বেলুড় মঠ থেকে একটা ছোট চিঠি পেয়েছিলেন স্বামী সারদানন্দজি স্বাক্ষরিত নিম্নলিখিত বয়ানে, ‘‘মাই ডিয়ার নিবেদিতা, দ্য এন্ড হ্যাজ কাম, স্বামীজি হ্যাজ স্লেপ্ট লাস্ট নাইট অ্যাট নাইন ও’ক্লক। নেভার টু রাইজ এগেন সারদানন্দ।’’
চিঠির অক্ষরগুলি যেন চোখের সামনে কেঁপেছিল নিবেদিতার, সঙ্গে তাঁর শরীরটাও। ঘরে উপস্থিত নিবেদিতার সেবিকাও কেঁদে উঠেছিলেন। মাত্র দু’দিন আগেই তো নিবেদিতা বেলুড় মঠে গিয়েছিলেন স্বামীজিরই নিমন্ত্রণে। স্বামীজি তাঁদের খাইয়েছিলেন পরম যত্নে এবং আহার শেষে স্বামীজি অতিথিদের হাতে জল ঢেলে দিয়েছিলেন হাত ধোওয়ার জন্য। নিবেদিতা সঙ্কুচিত হয়েছিলেন। স্বামীজি বলেছিলেন, “যিশু তো শিষ্যদের পা ধুইয়ে দিয়েছিলেন।” কিন্তু সে তো শেষের দিনে। তখন নিবেদিতা ভাবতেও পারেননি, তাঁর গুরুর ক্ষেত্রেও এই কথাটা আক্ষরিক অর্থেই মিলে যাবে।
স্বামীজি কিন্তু অমরনাথে নিবেদিতাকে আভাস দিয়েই রেখেছিলেন, মহাদেব-কৃপায় তিনি ইচ্ছামৃত্যুর বর পেয়েছেন। যার নিহিত অর্থ হল, মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত না হলে তাঁর দেহত্যাগ হবে না। স্বামীজির মহাসমাধির পূর্ব পর্যন্ত আনুপূর্বিক সব কথা শুনে নিবেদিতার সে-সব কথাই মনে পড়েছিল। এক দিকে নিবেদিতার শোকস্তব্ধ উদ্গত নয়নের অশ্রুধারা, আর এক দিকে এই সব স্মৃতি। নিবেদিতা আর কালবিলম্ব না করেই বেলুড় থেকে আসা পত্রবাহকের সঙ্গেই রওনা হয়েছিলেন বেলুড় মঠ অভিমুখে। ইতিমধ্যে স্বামীজির প্রয়াণের খবর ছড়িয়ে গিয়েছিল সারা শহরে। সবাই ছুটেছিল সেই বেলুড়ের দিকে। বেলুড় মঠে পৌঁছেই নিবেদিতা সোজা উঠে গিয়েছিলেন দোতলায় স্বামীজির ঘরের দিকে। ঘরে তখন বেশি লোকজন ছিলেন না। স্বামীজির দেহটি মেঝেতে শায়িত ছিল হলুদ রঙের ফুলমালা আচ্ছাদিত হয়ে। মানসকন্যা স্বামীজির শিয়রের কাছে বসে পড়েছিলেন। তাঁর নয়নে ছিল অবিরল অশ্রুধারা, মুখে কোনও কথা ছিলনা। আবেগ-আকুল কম্পিত হাতে তিনি তুলে নিয়েছিলেন গতপ্রাণ স্বামীজির মাথাটি। তখন আর তিনি কন্যা ছিলেন না, তিনি হয়েছিলেন মাতা! স্বামীজির তাঁর প্রতি আশীর্বচনের সার্থক রূপ একাধারে তিনি সেবিকা ও মাতা। যেন মায়ের মতোই প্রিয়বিচ্ছেদ-বেদনায় কাতর হয়ে সেই অনিন্দ্যসুন্দর শিবরূপী গুরুর সেবা করেছিলেন ছোট একটি পাখা হাতে। এর পর এসেছিল সেই মহাযাত্রার পালা। একে একে সন্ন্যাসী-ভাইরা এসে স্বামীজির দেহটি নীচে নামিয়ে এনেছিলেন। তাঁরা আরতি ও প্রণাম-শেষে স্বামীজীর পা দু’টি অলক্তরাগে রঞ্জিত করেছিলেন ও মস্তক অবলুণ্ঠিত করে প্রণাম করেছিলেন। গুরুভাইরা শ্রীপাদপদ্মের ছাপ নিয়েছিলেন। নিবেদিতাও অশ্রুসিক্ত নয়নে স্বামীজীর পা দুটি ধুয়ে একটি পরিষ্কার রেশমি রুমালে তাঁর গুরুর পদচিহ্ন গ্রহণ করেছিলেন। সন্ন্যাসী ও সমবেত জনতার সঙ্গে নিবেদিতাও এগিয়ে গিয়েছিলেন পায়ে পায়ে সেই গতপ্রাণ বিজয়ী বীরের দেহটি নিয়ে মিছিলের সঙ্গে সঙ্গে। স্বামীজির শেষকৃত্য সমাপনের নির্দিষ্ট স্থানে, যে স্থান বিবেকানন্দ নিজেই চিহ্নিত করেছিলেন মহাপ্রয়াণের কিছু দিন আগে, তাঁর প্রিয় বেলগাছের কাছে অপেক্ষাকৃত ঢালু জায়গায়।
দেহটি নামানো হলে নিবেদিতা সেই গাছেরই একটু দূরে এসে বসে পড়েছিলেন। চিতাগ্নি প্রজ্বলিত করেছিলেন প্রথমে নিবেদিতা ও পরে একে একে গুরুভাই ও অন্যান্য সন্ন্যাসী-ভাইয়েরা। প্রজ্বলিত চিতাগ্নির সামনে বিবেকানন্দের প্রিয় ‘জি.সি’ অর্থাৎ নাট্যকার ও মহাকবি গিরিশচন্দ্রের বিলাপ করে বলে উঠেছিলেন, “নরেন, তুমি তো ঠাকুরের ছেলে, ঠাকুরের কোলে গিয়ে উঠলে। আর আমি বুড়ো মানুষ, কোথায় তোমার আগে যাব, তা না হয়ে আজ আমাকে দেখতে হচ্ছে তোমার এই দৃশ্য!” এ কথা শোনামাত্র নিবেদিতা শোক চেপে রাখতে না পেরে দাঁড়িয়ে উঠে স্বামীজির প্রজ্বলিত চিতাগ্নির পাশে প্রদক্ষিণ করতে শুরু করেছিলেন। এ দৃশ্যে বিচলিত স্বামী ব্রহ্মানন্দ স্বামীজির শিষ্য নিশ্চলানন্দকে নিবেদিতাকে চিতাগ্নির কাছ থেকে সরিয়ে নিয়ে সান্ত্বনা দিতে বলেছিলেন। সেই অনুযায়ী নিশ্চলানন্দ রোরুদ্যমানা নিবেদিতাকে সেখান থেকে দূরে নিয়ে গিয়ে, নানা সান্ত্বনাবাক্যে ভোলানোর চেষ্টা করেছিলেন।
সারা অঙ্গ চন্দনচর্চিত মনুষ্যদেহে তাঁর শিবরূপী গুরুর ধূপধুনো-গুগগুল সুবাসিত চিতাগ্নি তথা হোমাগ্নি নিবেদিতার অনর্গল নয়নধারায় বুঝি নির্বাপিত করতে চেয়েছিল। সেই হৃদয় হাহাকার করা মুহূর্তে সহসা গুরুর এক অলৌকিক স্নেহস্পর্শ নিবেদিতাকে চমকিত করে তুলেছিল। চিতাগ্নি থেকে একখণ্ড গেরুয়া বস্ত্র হাওয়ায় উড়ে এসে নিবেদিতার কোলে গিয়ে পড়েছিল। পরম মমতায় ও যত্নে নিবেদিতা তা গুরুর আশীর্বাদ ভেবে মাথায় ঠেকিয়েছিলেন। সেই পবিত্র স্পর্শ যেন তাঁর শোকস্তব্ধ হৃদয়ে সান্ত্বনা ও শক্তি যোগান দিয়েছিল। তবু অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে তিনি বলে উঠেছিলেন, “পরের জন্য নিজেকে যিনি বিলিয়ে দিয়েছিলেন, তাঁকেও কেন ছেড়ে দিতে হয় আমাদের? হে ভগবান, কেন?”
স্বামীজীর দেহত্যাগের পরে শোকের সময়ও পাননি নিবেদিতা। শোকের বদলে যেন তাঁর বুকের মধ্যে পুঞ্জীভূত হয়েছিল ক্ষোভ আর অভিমান। তাঁর প্রভু কেন এভাবে চলে যাবেন? না, না, এ সময়ে তাঁর চলে যাওয়া মোটেই উচিত হয়নি। তাঁর এত প্রিয় এই দেশ, এই দেশের মানুষ, এখানে অবিলম্বে কত কী ঘটতে যাচ্ছে, স্বামীজি নিজে তখন উপস্থিত থাকবেন না? স্বাধীনতার সংগ্রাম শুরু হবে, তার নেতৃত্ব দিতে অস্বীকার করেছিলেন স্বামীজি, কিন্তু নিবেদিতা ঠিক বুঝিয়ে সুঝিয়ে শেষ পর্যন্ত তাঁকে রাজি করাতেনই। এই নেতৃত্বের যোগ্যতা স্বামীজির চেয়ে আর কার বেশি ছিল? পরাধীনতার মর্মবেদনায় এক এক সময় তাঁকে ক্ষিপ্তের মতন হয়ে যেতে কি দেখেননি নিবেদিতা? যদি বা স্বামীজি প্রত্যক্ষভাবে নেতৃত্ব দিতে রাজি নাও হতেন, তবু তাঁর উপস্থিতিই হত এক বিশাল প্রেরণা।
নিবেদিতা জানতেন, তিনি কাছে নেই, তবু কোথাও আছেন, তাতেই অনেক জোর পাওয়া যায়। কিন্তু তিনি নেই, আর একেবারেই নেই, এ যে মেনে নেওয়া অসম্ভব। তিনি সত্যিই নেই? বিলীন হয়ে গেছেন পঞ্চভূতে? হিন্দুরা পরলোকে বিশ্বাস করে। মৃত্যুলোকের ওপারে কোথাও বিরাজ করে মানুষের আত্মা। কেউ কেউ মৃত ব্যক্তিদের কখনও কখনও সশরীরে দেখতে পায়। মহাপুরুষরা মাঝে মাঝে দর্শন দিতে আসেন। আজন্ম সংস্কারে নিবেদিতার পক্ষে এসব মানা সম্ভব ছিলনা, আবার পুরোপুরি অবিশ্বাস করতে তাঁর ইচ্ছে করত না। কই, স্বামীজীর মৃত্যুর পরে দশদিন কেটে গিয়েছিল, তবু তো স্বামীজি একবারও তাঁর প্রিয় শিষ্যাকে দর্শন দেননি। নিবেদিতা নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করতেন, তাঁর বিশ্বাসের তীব্রতা নেই, সে জন্য কি তিনি দেখতে পান না?
এমন নিঃসঙ্গতা আগে কখনও বোধ করেননি নিবেদিতা। বিশ্বব্রহ্মাণ্ড ভরা নিঃসঙ্গতা। এ দেশে তাঁর আর কে ছিল? কথা বলারও আর কেউ ছিলনা। কারুর মৃত্যু হলে আনুষঙ্গিক ও পারিপার্শ্বিক এমন অনেক কিছু ঘটতে থাকে যে, সেই দিকেই মন চলে যায়, শোক করার সময় থাকে না।
এর মধ্যে নিবেদিতা কয়েকবার বেলুড় মঠে গিয়েছিলেন, সন্ন্যাসী ও গুরুভ্রাতাদের ব্যবহার তাঁর কাছে বড় অদ্ভুত মনে হয়েছিল। দিনের পর দিন ধরে প্রায় সকলেই কান্নাকাটি ও হা-হুতাশ করে চলেছিলেন। অথচ তখনই তো ছিল কাজের সময়, কাজের মধ্য দিয়েই শোক দমন করতে হয়, স্বামীজি প্রতিষ্ঠিত এই মঠ ও কর্মপন্থাকে সচল রাখা, আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়াই তো স্বামীজির স্মৃতিরক্ষার শ্রেষ্ঠ উপায়। কিন্তু সেদিকে যেন কারুর মন ছিলনা। নিবেদিতা ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা সম্পর্কে প্রশ্ন করলেও কেউ ঠিক উত্তর দিতেন না। এমনকী নিবেদিতার এমন সন্দেহও হত যে, সন্ন্যাসীরা যেন তাঁকে এড়িয়ে যাচ্ছেন। একদিন এক জাপানি বন্ধু ওকাকুরাকে সঙ্গে নিয়ে বেলুড়ে গিয়েছিলেন নিবেদিতা, তিনিও স্বামীজির আকস্মিক তিরোধানে খুব আঘাত পেয়েছিলেন, কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার, মঠের কেউ তাঁদের উপস্থিতি গ্রাহ্য করেননি, কেউ কথাও বলেননি তাঁদের সাথে। তাঁরা দু’জনে মঠের বাইরে স্বামীজির চিতাস্থলের কাছে কিছুক্ষণ বসে ছিলেন। গঙ্গায় চলমান জলযানগুলির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে নিবেদিতার মনে হয়েছিল, জীবনের স্রোত একইরকম বয়ে চলেছে, শুধু স্বামী বিবেকানন্দ নেই। তাঁর উপস্থিতি অতি প্রবল ছিল বলেই তাঁর না-থাকাটা একেবারে অসহনীয় মনে হত নিবেদিতার কাছে।
দু দিন পরে নিবেদিতা আবার বেলুড় মঠে গিয়েছিলেন একা। সেদিনও অন্যদের নিস্পৃহ ভাব দেখে তিনি সারদানন্দের পাশে গিয়ে বসেছিলেন। সারদানন্দের সঙ্গে তাঁর অনেক বিষয়ে আগে আলোচনা হয়েছিল, তিনি ইংরিজি ভাল জানতেন বলে কথাবার্তা সহজে বলা যেত। নিবেদিতা সরাসরি সারদানন্দকে প্রশ্ন করেছিলেন, “বেলুড় মঠের ভবিষ্যৎ নিয়ে আমরা কোনও পরিকল্পনা করব না? স্বামীজির আর কাজের দায়িত্ব এখন আমাদেরই ভাগ করে নিতে হবে।”
সারদানন্দ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিলেন। সরাসরি নিবেদিতার মুখের দিকে না তাকিয়ে অন্যদিকে চোখ ফেলে বলেছিলেন, “হ্যাঁ, এ বিষয়ে আমরা অনেক চিন্তা করেছি। ব্রহ্মানন্দের সঙ্গে তোমার বিষয়েও অনেক আলোচনা হয়েছে। আমাদের সবার প্রিয়, বন্ধু এবং গুরু নরেন এখন নেই, তাঁর অবর্তমানে অনেক কিছুই বদলে গেছে। তুমি বরং ব্রহ্মানন্দের সঙ্গে নিভৃতে কথা বলে নাও।”
ব্রহ্মানন্দকে খবর দেওয়া হয়েছিল, তিনি ওপরতলায় স্বামীজির ঘরের পাশের বারান্দায় নিবেদিতাকে নিয়ে বসেছিলেন। সেখানে কয়েকজন সন্ন্যাসী চক্ষু বুজে, জপ-তপধ্যান করছিলেন, তাঁদের বলা হয়েছিল নীচে চলে যেতে। স্বামীজির ঘরের জানালা খোলা ছিল, দেখা যাচ্ছিল তাঁর খাটটি। বৃষ্টি শুরু হয়েছিল, বৃষ্টির ধারায় গঙ্গানদী তখন ঝাপসা দেখাচ্ছিল।
আর কেউ নেই, তবু ব্ৰহ্মানন্দ কিছুক্ষণ গম্ভীরভাবে চুপ করে বসে ছিলেন। যেন তিনি আরম্ভের বাক্যটি খুঁজে পাচ্ছিলেন না। নিবেদিতা কৌতূহলী হয়ে চেয়ে ছিলেন তাঁর দিকে। নীরবতা কাটছে না দেখে তিনিই ব্রহ্মানন্দকে প্রশ্ন করেছিলেন, “আপনি আমাকে কিছু বলবেন না?”
মুখ তুলে ব্রহ্মানন্দ তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “ভগিনী, তুমি কি এই বেলুড় মঠকে ভালবাস? আমাদের রামকৃষ্ণ সঙেঘর মঙ্গল চাও?”
নিবেদিতা চমকে ভুরু তুলে তাকিয়েছিলেন। এ কী অদ্ভুত প্রশ্ন! স্বামীজির প্রতিটি পদক্ষেপ অনুসরণ করার জন্যই তিনি এ দেশে এসেছেন। স্বামীজির নিজের হাতে গড়া এই মঠ, এই সঙ্ঘ, এর জন্য স্বামীজি কত পরিশ্রম করেছেন, নিবেদিতা কি সব সময় স্বামীজির সঙ্গে সঙ্গে থাকেননি? এখানে এক সময় মাঠ ছিল, বিদেশি ভক্তদের টাকায় জমি কেনা হল, আস্তে আস্তে গড়ে উঠল এত বড় মঠ, স্বামীজির চেষ্টায়, স্বামীজির ব্যক্তিত্বের আকর্ষণেই টাকা এসেছিল বিদেশ থেকে, নিবেদিতাও কি সেই অর্থ সংগ্রহে সহায়তা করেননি? স্বামীজি দ্বিতীয়বার যখন আমেরিকায় গিয়েছিলেন, তখন নিবেদিতাকেও কি বহু জায়গায় এই উদ্দেশ্যে বক্তৃতা দিয়ে বেড়াতে হয়নি? এখন এমন প্রশ্ন উঠতে পারে যে তিনি এই মঠকে ভালবাসেন কি না?
ব্রহ্মানন্দ আবার তাঁকে বলেছিলেন, “জানি, তুমি মন প্রাণ দিয়ে এখানকার সব কিছু ভালবাসো, তবু, বলতে আমার খুবই খারাপ লাগছে, কষ্ট হচ্ছে, তা হলেও বলতেই হবে, তুমি আর এখানে এসো না। তুমি এলে আমাদের ক্ষতি হবে!”
নিবেদিতা আর্ত স্বরে বলে উঠেছিলেন, “আমি এলে ক্ষতি হবে?”
ব্রহ্মানন্দ তাঁকে বলেছিলেন, “তোমার কাজের ধারা বদলে গেছে, তুমি এখন রাজনীতির সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়েছ, আমরা সন্ন্যাসী, আমরা রাজনীতির সঙ্গে কোনও সংশ্রব রাখতে চাই না। তোমার বন্ধু ওকাকুরা উগ্র জাতীয়তাবাদের আদর্শ প্রচার করেন। আমরা বেলুড় মঠকে রাজনীতির আখড়া বানাতে চাই না।”
নিবেদিতা বলেছিলেন, “সে প্রশ্নই ওঠে না। মঠের সঙ্গে রাজনৈতিক কার্যকলাপের কোনও সম্পর্ক নেই। সেটা আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার। স্বামীজির সঙ্গে আমার এ বিষয়ে কথা হয়েছে, তর্ক হয়েছে, কিন্তু তিনি তো আমাকে আসতে বারণ করেননি। মাত্র কয়েক দিন আগে তিনি অসুস্থ শরীর নিয়েও আমার বাড়িতে উপস্থিত হয়েছিলেন। আমাকে মঠে আসতে বললেন, আমি এলাম, তিনি নিজের হাতে আমাকে আহার্য প্রস্তুত করে দিলেন …”
ব্রহ্মানন্দ বলেছিলেন, “নরেন ছিল পাহাড়ের মতন, সে অনেক কিছু সামলাতে পারত, এখন মঠের ওপর যদি পুলিশের নজর পড়ে তা হলে সব কিছু তছনছ হয়ে যাবে। এখানে আর কেউ আসবে না। এমনিতেই গোঁড়া হিন্দুরা আমাদের নামে অনেক কিছু বলে …”
নিবেদিতা বাধা দিয়ে বলেছিলেন, “স্বামীজি কোনওদিনই গোঁড়া হিন্দুদের মতবাদ কিংবা হীন কুৎসা তোয়াক্কা করতেন না। সন্ন্যাসীরা নির্জন জঙ্গলে কিংবা গিরিকন্দরে আশ্রম বানিয়ে বসবাস করলে শুধু আধ্যাত্মিক চিন্তায় নিমগ্ন থাকতে পারেন। কিন্তু লোকালয়ের মধ্যে এরকম মঠ বানিয়ে থাকলে আশেপাশের মানুষদের সম্পর্কে কি উদাসীন থাকতে পারে? মানুষের অভাব, অনাহার, দুর্বলের ওপর শক্তিমানের উৎপীড়ন, পরাধীনতার গ্লানি, এই সব বিষয়ে স্বামীজি স্বয়ং বিচলিত হতেন না? এই সব দূর করার চেষ্টাই কি রাজনীতি?”
ব্রহ্মানন্দ নিবেদিতার কথায় কান না দিয়ে তাঁকে বলেছিলেন, “সঙ্ঘ, মঠের জন্য তুমি যত টাকাপয়সা তুলেছ, এখনও তোমার নামে অনেক চেক ও ড্রাফট আসে, সে সব মঠেরই প্রাপ্য। সেগুলি তুমি এখানে জমা করে দেওয়ার ব্যবস্থা নিয়ে অবিলম্বে। এ যাবৎ তোমার ব্যক্তিগত উদ্যোগে সংগৃহীত অর্থ ন্যায়তঃ মঠেরই প্রাপ্য। তোমার মঠে আসা-যাওয়া বন্ধ করাই যথেষ্ট নয়, বিভিন্ন সংবাদপত্রে তোমার একটা বিবৃতি দেওয়া দরকার যে তুমি বেলুড় মঠের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করেছ।”
নিবেদিতার সমস্ত অন্তরাত্মা চিৎকার করে বলতে চেয়েছিল, না, না, আমি এ সব মানি না। এই মঠের ওপর আপনাদের যতখানি অধিকার আছে, আমার অধিকারও কোনও অংশে কম নয়। আমি কেন সেই অধিকার ছাড়ব? আমি যখন ইচ্ছে আসব। যেকক্ষে আমার প্রভু, আমার স্বামীজি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছেন, আমি সেখানে বসে থাকব। তিনি আমাকে কখনও ছেড়ে যাবেন না বলেছিলেন, ওই ঘরটায় বসলে তবু আমি তাঁর কিছুটা সাহচর্য পাব।
ব্রহ্মানন্দ বলেছিলেন, “মঠের সঙ্গে তোমার আর সম্পর্ক না থাকলেও তোমার সঙ্গে আমাদের ব্যক্তিগত সম্পর্ক অক্ষুণ্ণ থাকবে …”
নিবেদিতা আর কিছুই শুনতে চাননি। রাগে তাঁর শরীর জ্বলছিল, তিনি তরতর করে নেমে এসেছিলেন নীচে। অন্য দিন কেউ না কেউ তাঁকে নৌকোর ঘাট পর্যন্ত পৌঁছে দিতেন, শেষের দিকে স্বামীজি নিজে না এলেও সঙ্গে কোনও লোক দিতেন আর ওপরের জানলা দিয়ে তাকিয়ে থাকতেন, সেদিন কেউ আসেননি। নিবেদিতা বৃষ্টির মধ্যে একা দৌড়ে চলে গিয়েছিলেন।
অবিশ্রান্ত বৃষ্টির মধ্যে গঙ্গার ওপর দিয়ে নৌকো চলেছিল বাগবাজার ঘাটের দিকে। নিবেদিতার দু চক্ষু দিয়ে ঝরে পড়েছিল অশ্রু। সেদিনই তিনি প্রথম কেঁদেছিলেন।
বাড়ি ফিরে তাঁর মনে হয়েছিল, এই সিদ্ধান্ত কি ব্রহ্মানন্দের একার, না মঠের সকলের? ব্রহ্মানন্দ মঠাধ্যক্ষ হলেও এরকম সময়ে নিশ্চয় সকলের সঙ্গে পরামর্শ করবেন। স্বামী বিবেকানন্দর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে নিবেদিতাকে মঠ থেকে তাড়িয়ে দেবার ব্যাপার সবাই মেনে নেবে? তিনি আশা করেছিলেন, অন্য কেউ এসে বলবে, না, ও সব ভুলে যাও, তুমি আগের মতনই মঠে আসবে, কাজের ব্যাপারে পরামর্শ দেবে। সেরকম কেউ আসেননি, তবে কানাঘুষো শোনা গিয়েছিল যে নিবেদিতা যদি রাজনীতির সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক বর্জন করেন, সেই ধরনের লোকজনের সঙ্গে মেলামেশাও বন্ধ করে মঠের নির্দেশ মেনে চলেন, তা হলে তাঁকে ফিরিয়ে নেওয়া যেতে পারে। এ কথা শুনে নিবেদিতার মেজাজ দপ করে জ্বলে উঠেছিল। তাঁর মনে হয়েছিল, এঁরা ব্যক্তিস্বাধীনতার মূল্য বোঝে না! দেশের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য তিনি অন্য অনেককে উদ্বুদ্ধ করেছেন, এখন নিজে পিছিয়ে আসবেন? না, তা হতেই পারে না।
এর দিনকতক পরে স্বামী ব্রহ্মানন্দের কাছ থেকে গম্ভীর সরকারি ধরনের একটা চিঠি এসেছিল। নিবেদিতা কী সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তা তিনি জানতে চেয়েছিলেন। সংবাদপত্রের বিবৃতির ব্যাপারে তিনি আর দেরি করতে চাননি।
সঙ্গে সঙ্গে চিঠিখানির উত্তর না দিয়ে নিবেদিতা স্নান করতে গিয়েছিলেন। তারপর ধ্যানে বসেছিলেন, মুদ্রিত চক্ষুর অন্ধকারে বারবার ভেসে উঠেছিল স্বামী বিবেকানন্দর মুখ, অসুস্থ হবার আগেকার সেই দিব্যকান্তি, উজ্জ্বল দুই চক্ষু। কিন্তু শুধুই মুখচ্ছবি, তা সবাক নয়, স্বামীজি তাঁর প্রিয় শিষ্যাকে কোনও নির্দেশ দেননি।
অনেকক্ষণ স্থির হয়ে বসে থাকবার পর নিবেদিতার মন প্রশান্ত হয়ে গিয়েছিল। তিনি জানতেন, বেলুড় মঠের সঙ্গে তাঁর কোনও প্রকার মতবিরোধ বাইরে জানাজানি হলে বহু লোক মজা পাবে, হাসাহাসি করবে। মঠের কোনও প্রকার ক্ষতি হয়, এমন কাজ তিনি কিছুতেই করতে পারেন না। তিনি স্থির করেছিলেন, ব্রহ্মানন্দ যা চান তাই হবে, মঠের ওপর অধিকার তিনি ত্যাগ করবেন। টাকাপয়সা যা আছে, তা পাইপয়সা পর্যন্ত হিসেব করে চুকিয়ে দেবেন মঠের কাছে।
কাগজ কলম নিয়ে তিনি চিঠি লিখতে বসেছিলেন এর পর। একটা চিঠিতে ব্রহ্মানন্দকে সশ্রদ্ধভাবে জানিয়েছিলেন, “যতই বেদনাদায়ক হোক, তবু আপনি যে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে চান, তা আমি মেনে নিলাম। প্রতিদিন শ্রীরামকৃষ্ণ ও আমার প্রিয় গুরুর ভস্মাবশেষের বেদীমূলে আমার ভালবাসা ও শ্রদ্ধা নিবেদন করতে ভুলবেন না।”
সংবাদপত্রের জন্যও একটি বিবৃতিতে লিখেছিলেন, তাঁর ভবিষ্যৎ কর্মধারা সম্পূর্ণ তাঁরই ব্যক্তিগত, রামকৃষ্ণ সঙ্ঘের নির্দেশের সঙ্গে এর কোনও সম্পর্ক থাকবে না। কাছেই ছিল অমৃতবাজার পত্রিকার অফিস, বিবৃতিটি পাঠিয়ে দিয়েছিলেন সেখানে।
এরপর নিবেদিতার বাকি জীবন যেন অগ্নিশিখাই। মানবসেবার পুণ্যব্রতে। ১৬ নম্বর বোসপাড়া লেনের বাড়ি থেকে নিবেদিতার সংগ্রাম আর এক ইতিহাস। তার সবটুকুই গুরু বিবেকানন্দের দেখানো পথে।
বিদেশিনী নিবেদিতার এই নিঃশর্ত আত্মনিবেদনকে আমরা কী ভাবে নিয়েছিলাম, তার পরিবর্তে আমরা তাঁকে কী দিয়েছিলাম, বা কী দিয়েছি না তার হিসেবনিকেশ একশো বছরেও করা সম্ভব হয়নি। তাঁর তেতাল্লিশ বছরের নিদারুণ কষ্টের বিবরণ ঠিক মতো তৈরি হলে, ভবিষ্যতে কেউ আর নিজের মেয়ের নাম ‘নিবেদিতা’ রাখবেন না, তাঁরা বুঝবেন এই শব্দটির মানে শুধু দিয়ে যাওয়া, প্রতিদানে প্রায় কিছুই না পাওয়া এবং সেই সঙ্গে প্রশ্ন, মানুষের ইতিহাস কোন অদৃশ্য শক্তির ধারায় এমন সব আশ্চর্য বিদেশিনীর সৃষ্টি করে এবং তাঁরা অজানা দেশে নিজেদের তিলে তিলে নিজেদের উৎসর্গ করেন। যে বিদেশিনী এই দেশকে ভালোবেসেছিলেন, এবং পরিবর্তে নানা দুঃখ, অন্তহীন নিঃসঙ্গতা ও অকালমৃত্যু পেয়েছিলেন, তাঁর সম্বন্ধে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের অন্য প্রসঙ্গে বলা উক্তিটা বেশ মিলে যায় – ‘‘যাঁরা শুধু দিল, পেল না কিছুই, সারাজীবন ধরে ভেবে পেল না কেন সব কিছু থেকেও কোনও কিছুতেই অধিকার নেই তাদের, তারাই আমার মুখ খুলে দিল।’’ নিবেদিতা কিন্তু সব মুখ বুজেই সহ্য করেছিলেন। তাঁর ৪৩ বছরের জীবনে নিবেদিতা যত আঘাত শত্রু ও আপনজনদের কাছ থেকে পেয়েছিলেন তার নির্ভরযোগ্য বিবরণ সংগ্রহ করলে একটা পাঁচশো পাতার বই সহজেই হয়ে যায়। পরবর্তী কালে এ দেশের কেউ কেউ চেষ্টা করেছিলেন পরিস্থিতি সামাল দিতে, প্রমাণ করতে এই বিদেশিনীর প্রতি কেউ তেমন অন্যায় করেনি, যা কিছু ঘটেছিল তার সবই পরিস্থিতির পাকে। কিন্তু ব্যাপারটা বোধ হয় অত সহজ নয়। কয়েকটা বিষয়ে দৃষ্টিপাত করে নেওয়াটা বোধ হয় অন্যায় হবে না।
নিবেদিতা সমস্ত জীবন ধরে কত আঘাত পেয়েছিলেন, কত অবহেলা অপমান সহ্য করেছিলেন তা ছড়িয়ে আছে বিভিন্ন স্মৃতিচারণে। স্বয়ং নিবেদিতা এক জন বিদেশিনীকে বলেছিলেন, যখন আলমোড়ায় স্বামীজির সঙ্গে ছিলেন তখন প্রায়ই তাঁকে কাঁদতে হয়েছিল। তিনি আরও বলেছিলেন, সিস্টার ক্রিস্টিন স্কুলে আসার পর তিনি বেলুড় মঠে খুবই কম যেতেন, তাঁর মনে হয়েছিল স্বামীজি ক্রিস্টিনকেই শিক্ষা দেবেন বলে মনস্থ করেছিলেন। নিবেদিতা আশঙ্কা করেছিলেন, তিনি বিস্মৃত হয়েছেন। সুতরাং তিনি স্কুলে থাকতেন, নিঃসঙ্গ যাতনায়। ৪ঠা জুলাই স্বামীজির আকস্মিক তিরোধানের পর দিন সকালে বেলুড়ে নরেন্দ্র-জননী ভুবনেশ্বরীকে তিনি দেখেছিলেন। তবে দেহাবসানের কয়েক দিনের মধ্যে মঠের সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ বড়ই তড়িঘড়ি হয়েছিল বলে যাঁরা মনে করেন, তাঁদের মনে রাখা উচিত, সেই সময় মিশনকে কোনও ভাবে রাজনীতিতে জড়ানো হলে মিশনের অস্তিত্বই বিপন্ন হতে পারত। মিশন-সভাপতি স্বামী ব্রহ্মানন্দ বলেছিলেন, ‘‘বিচ্ছিন্ন হওয়ার খবরটা নিবেদিতাই সংবাদপত্রকে জানিয়েছিল।’’ ব্যাপারটা হয়েছিল ১৯শে জুলাই ১৯০২ সালে। যাকে ঠিক বিতাড়িত বলা বোধহয় ঠিক নয়। পরবর্তী কালে নিবেদিতা কিন্তু তাঁর এক প্রিয়জনকে বলেছিলেন, ‘‘ছাপার অক্ষরে যখন কথাগুলো দেখলাম, মনে হল এর আগে মরলাম না কেন?’’ জীবনের শেষ পর্বে নিবেদিতার অভিজ্ঞতা বড়ই বেদনাময়। তার বিস্তারিত বিবরণ আজও লিপিবদ্ধ হয়নি। তবে যা অনেক সময় নজরে পড়ে না, বেলুড় মঠের সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত সম্পর্ক কখনও ব্যাহত হয়নি। নতমস্তকে তিনি প্রায়ই মঠে আসতেন এবং সন্ন্যাসীরা আসতেন তাঁর স্কুলে। শ্রীশ্রীসারদামণির সঙ্গে সম্পর্ক, সেও এক বিস্ময়! আমরা এখন জানি, নিবেদিতা মায়ের সঙ্গে সাধু বাংলায় কথা বলতেন। সেই নিয়ে রসিকতাও হত। যা সবাই জানে না, শ্রীমায়ের পা বাতে পঙ্গু হওয়ায় নিবেদিতা প্রায় তাঁকে কোলে করে উপরতলায় তুলতেন এবং এই কাজ করে তিনি সীমাহীন আনন্দ পেতেন।
নিবেদিতার সৎকারক্ষেত্রে অবিস্মরণীয় লিপিটি মিশনের দান নয়। এটি স্থাপন করেছিলেন স্বামী অভেদানন্দ প্রতিষ্ঠিত রামকৃষ্ণ বেদান্ত মঠ, যেখানে ইংরেজিতে লেখা আছে, ‘‘এখানে ভগিনী নিবেদিতা শান্তিতে নিদ্রিত – যিনি ভারতবর্ষকে তাঁর সর্বস্ব অর্পণ করেছিলেন।’’ এই অবিশ্বাস্য নিবেদনের পরিবর্তে আমরা তাঁকে কী দিয়েছি বা এখনও দিতে পারি, তার হিসেব কি কোনদিন হবে?
(তথ্যসূত্র:
১- নিবেদিতা লোকমাতা, শঙ্করীপ্রসাদ বসু, আনন্দ পাবলিশার্স।
২- ভগিনী নিবেদিতা ও বাংলায় বিপ্লববাদ, গিরিজাশঙ্কর রায়চৌধুরী, অরুণা প্রকাশন।
৩- প্রথম আলো, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, জ্যোৎস্না পাবলিশার্স।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত