ধন্যবাদ প্রশাসন। প্রথম দিন থেকে ঠিক এই জন্যই ক্ষমা চেয়ে নিয়েছিলাম শিখ সম্প্রদায়ের মানুষের কাছে। আশা রেখেছিলাম প্রশাসনও ক্ষমা চাইবে। সর্বশেষ খবর যা পেলাম, কলকাতার শিখ সম্প্রদায়ের বৃহৎ সংগঠন গুরুদ্বারা বড়া শিখ সংগত বলবিন্দর সিং এর পাগড়ি খুলে যাওয়া ও তার সাথে যে ব্যবহার করা হয়েছে তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ও কঠোর নিন্দা করেছে এই ঘটনার। উল্লেখ্য, তারা মমতা বন্দোপাধ্যায়ের কাছে তদন্ত দাবি করেছে যাতে এর সাথে জড়িত ব্যক্তিদের কঠোর শাস্তি হয়। ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ যে অংশটি তা হলো, কলকাতার শিখ সংগঠন জানাচ্ছেন, এই ঘটনায় প্রশাসন থেকে ক্ষমা চাওয়া হয়েছে আর এটাও বলা হয়েছে যে যেহেতু বলবিন্দর সিং বিনা ইউনিফর্ম ওখানে কাজ করছিলেন তাই ওই হট্টগোলে বোঝা যায় নি। পাশাপাশি যারা এর থেকে রাজনৈতিক ফায়দা তুলতে চায় তাদের সাবধান করেছে কলকাতার শিখেরা। বলেছে বাঙালি আর শিখেদের সৌহার্দ্য কলকাতায় আজ থেকে না, দীর্ঘদিনের৷
আলবাত তাই। একশো শতাংশ তাই। এটাই গলা ফাটিয়ে প্রথম দিন থেকে বলছিলাম। আমার শহর সরদারজীর ও শহর। আমার শহরে যে প্রায় একলাখ শিখ মানুষ আছেন তারা আজ থেকে না প্রায় ১০০বছর আগে এখানে চলে আসেন। এ শহরে গুরু নানক সাহাবও পা রেখেছিলেন শ্রীচৈতন্যদেবের সাথে সাক্ষাৎ এর আগে।
বাঙালি আর শিখেদের সৌহার্দ্য, বন্ধুত্ব কি আজ থেকে? নেতাজী সুভাষের নেতাজী হয়ে ওঠার পিছনেও তো কতো শিখের সমর্থন ছিল৷ অনেকে স্রেফ মনে রেখেছেন মহানিষ্ক্রমণের সেদিন ১৯৪১–এ গাড়িতে বসেছিলেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু, আর স্টিয়ারিংয়ে ভাইপো শিশির বসু। কিন্তু আরেকটা লোক যে ছায়ার মতো গোটা প্ল্যানটা সফল করতে খেটে গেছিলেন সেটা আমরা ভুলে যাই। ওনার নাম নিরঞ্জন সিং তালিব। বোস পালিয়ে যাওয়ার পরে যাকে গ্রেফতারও করা হয়। ফরোয়ার্ড ব্লক যেদিন বানানো হয় সেদিনও তো ভবানীপুর থেকে দলে দলে সরদারজী ‘বোস পাজী’র জন্য এসেছিল নতুন দলে নাম লেখাতে। সব্বার খাবারের দায়িত্ব নিয়েছিল ফরওয়ার্ড ব্লকের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য চৌধুরী জয়মাল সিং। ভুলে যাবো সেই পাগড়িধারীদের? পাশাপাশি শিখেদের বানানো গাদার পার্টিতেও বাঙালির ছড়াছড়ি! হাড় পাঁজরের মতো দুটো সম্প্রদায় কতো না ঝড় দেখলো, কাঁটাতারের দাগ, দেশভাগের ক্ষত, ওপারে ফেলে আসা খেলার মাঠ, আচারের বয়াম, বাবার রক্তাক্ত লাশ।
মোবাইল, জিপিএস এর আগে কলকাতায় মায়েরা মেয়েদের ফিরতে রাত হলে বলতো, “পাঞ্জাবি ট্যাক্সি ড্রাইভার দেখে উঠবে। নিশ্চিন্ত থাকবো।” ওই যে আমরা রান্না করতে ইচ্ছে না করলে রুমালি রুটি আর এগতরকা পেঁয়াজ লঙ্কা দিয়ে খাই হ্যাঁ সেটাও এই শিখদেরই আমদানি আমার শহরে। এখন আমাদের খাবার হয়ে গেছে ওই রুটি-তরকা। আর ওদের খাবার ধোকার ডালনা, মোচার ঘন্ট!
আমার কলকাতা মানে ভবানীপুর, জগুবাবুর বাজারের ঝরঝরে বাংলায় কথা বলে যাওয়া সরদারজীরও শহর, আমার কলকাতা মানে বচ্চন ধাবাও, আমার কলকাতা মানে ১৯৮৪ এর পরে বাঙালির বুক চিতিয়ে রক্ষা করা শিখ পরিবারদের, আমার কলকাতা মানে সমানতালে বাটার চিকেন আর শুক্তো খাওয়া কোন ধিল্লো, কক্কর, আহলুওয়ালিরও যে আবার তিনপুরুষ ধরে মোহনবাগানের সমর্থক। আমার কলকাতা মানে ১৯৮৪র রাত পাহারা যাতে একজন শিখের গা তো ছেড়েই দিন পাগড়িতেও যেন হাত না পরে। হ্যাঁ এটা আমার শহর আর সেই শহরে এরকম একটা অনভিপ্রেত পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে ক্ষমা চেয়ে নেওয়াটা সৌজন্য।
ধন্যবাদ প্রশাসন। ক্ষমা চাইলে মানুষ ছোট হয় না৷ তাদের কাছে তো হয়ই না যারা আপদে বিপদে একশো বছর ধরে আমাদের পাশে আছে। যাদের সাথে গপগপিয়ে রসগোল্লার কম্পিটিশন যেমন করতে পারি আবার ইয়া বড় গেলাশের লস্যিও সাবাড় করতে পারি৷ বেশ আছি ভায়া রাশবিহারী এভিনিউ এর গুরুদ্বারার হালুয়া আর কালীঘাটের প্যাড়া প্রসাদে। বেঁচে থাক জো বোলে সোনিহাল সৎ শ্রী আকাল আর জয় কালী কলকত্তেওয়ালীর শহর। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যাক হ্যারি পুত্তর আর হরিপদ! বেঁচে থাক অমরিক সিং অরোরার এই শহর যে খোলা মাঠে মা কালীর গান গেতো আর দাবী করতো, মা কালীর ভক্ত এই সরদারজী।
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত
স্কেচঃ দেবাশীষ দেব