নিজের স্মৃতিকথায় তিনি লিখেছিলেন, ‘আমি সেই ত্রিপুরার মাটির মানুষ।’ কোন ত্রিপুরার? যেখানে ‘‘ধানের খেতে চাষিরা গান গাইতে গাইতে চাষ করে, নদীর জলে মাঝিরা গানের টান না দিয়ে নৌকা চালাতে জানে না, জেলেরা গান গেয়ে মাছ ধরে, তাঁতিরা তাঁত বুনতে বুনতে আর মজুরেরা পরিশ্রম করতে করতে গান গায়। … আমি সেই ত্রিপুরার মাটির মানুষ … তাই বোধহয় আমার জীবনটাও শুধু গান গেয়ে কেটে গেল।’’ এই মানুষটিকে চিনতে আমাদের বিন্দুমাত্র ভুল হয় না। তিনি আমাদের শচীন কর্তা। শচীন দেববর্মণ। ত্রিপুরার এই মানুষটি না কুমিল্লার, না কলকাতার, না মুম্বাইয়ের। তিনি আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশের। রাজনীতিবিদরা দেশ ভাঙতে পারেন। দেওয়াল তুলতে পারেন। সুর আর ছন্দের প্রবাহকে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে বন্দি করতে পারেন না। শচীন কত্তা তাঁর স্মৃতি কথায় লিখেছিলেন, ‘‘জীবনের সায়াহ্নে আমার শুধু কামনা – আমি আর কিছু চাই না। শুধু চাই, সরগমের নিখাদ হয়ে তলানিতে পড়ে থাকতে।’’
অনেক দিন আগের কথা। বোম্বের কোনও এক জায়গায় এক ঘরোয়া আসরে নিজের সদ্য সুর করা গান গাইছিলেন এক তরুণ সঙ্গীতপরিচালক। সুরের সমস্ত লালিত্য ঢেলে গান শেষ করে, তিনি তাকিয়েছিলেন সেই আসরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শ্রোতা, ফিল্মিস্তানের কর্ণধার এস. মুখার্জীর দিকে। এস. মুখার্জী তাঁর কাছে শুধু শ্রোতা ছিলেন না, বিচারকও ছিলেন। কেননা তাঁর রায় পেলেই মুম্বাই ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে একটা হিল্লে হয়ে যেতে পারত কলকাতা থেকে আসা তরুণ সঙ্গীত পরিচালকের। কিন্তু এস মুখার্জী গান শুনলে তো! তিনি তো নাক ডাকিয়ে ঘুমাচ্ছিলেন! পরের দিন আবার হারমোনিয়াম নিয়ে বসা হয়েছিল। শুরু হয়েছিল গান। শেষও হয়েছিল। গায়ক তাঁর কাজ শেষ করে যথারীতি তাকিয়েছিলেন শ্রোতার দিকে। সেই লোক তখন ঠিক আগের দিনের মতন রীতিমতো হুইসেল বাজিয়ে ঘুমাচ্ছিলেন! এভাবে চলেছিল পাক্কা দু’মাস। প্রযোজকের গান শোনা শেষ হচ্ছিল না, ফলে মুম্বাইতে (তখনকার বোম্বে) কাজও শুরু করা হচ্ছিল না সঙ্গীত পরিচালকের। একদিন রুটিনমাফিক গান শেষ করে হতাশ গায়ক ভাবছিলেন, ‘‘এখানে আর নয়। ফিরে যাবো কোলকাতায়। যা হয় হবে …।’’ অমনি ভাবনায় ছেদ টেনে এস মুখার্জী বলে উঠেছিলেন, ‘‘গানটা রেকর্ড করিয়ে ফেলুন না।’’ নিজের কানকে বিশ্বাস করতে না পেরে গায়ক জানতে চেয়েছিলেন, ‘‘আমাকে কিছু বললেন?’’ জবাব এসেছিল, ‘‘হ্যাঁ, আপনার এ গান আমার খুব পছন্দ হয়েছে। রেকর্ড করিয়ে ফেলুন।’’ রেকর্ড করানো হয়েছিল। এরপরেই মুম্বাই ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে পায়ের নিচে মাটি পেয়ে গিয়েছিলেন সঙ্গীত পরিচালক শচীন দেব বর্মন, উপমহাদেশের সঙ্গীতভুবন যাঁকে পরে ‘শচীন কত্তা’ নামে চিনেছিল। এটা ছিল ১৯৪৪ সালের কথা। ফিল্মে অভিনেতা ও গায়ক হিসেবে তাঁর অভিষেকও হয়েছিল হতাশা দিয়ে। ইহুদি কি ল্যাড়কি (১৯৩৩) ছবিতে তাঁর গাওয়া গান নতুন করে গাওয়ানো হয়েছিল পাহাড়ি স্যান্যালকে দিয়ে। তাতে অবশ্য তিনি মুষড়ে পড়েননি। ত্রিপুরার রাজপরিবারের সদস্য হয়েও ছোটবেলা থেকে নানা প্রতিকূলতাকে জয় করেই তাঁকে আসতে হয়েছিল। রণে ভঙ্গ দেয়ার মানসিকতা তাঁর ছিলনা। তাই বাংলা ও হিন্দি গানে তাঁর নিজের একটা জায়গা হয়েছিল, আর সেই জায়গা আজও রয়েছে। আজ উপমহাদেশের গানের জগতে শচীন দেব বর্মনকে না চেনা তাই লজ্জা পাওয়ার মতো অজ্ঞতা।
শচীন দেব বর্মনের জন্ম হয়েছিল ত্রিপুরার রাজপরিবারে। বাবা নবদ্বীপ চন্দ্র বর্মন ছিলেন রাজসিংহাসনের সরাসরি উত্তরাধিকারী। নয় ভাই-বোনের মধ্যে সবার ছোট শচীন অবশ্য রাজকীয় জীবন-যাপনে অভ্যস্ত ছিলেন না। প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে নবদ্বীপ চন্দ্রকে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হতে হয়েছিল। এমনিতেও সিংহাসনের প্রতি তাঁর কোনো আকর্ষণ ছিল না। ধ্রুপদ সঙ্গীত, সেতার বাজানো আর ভাস্কর্য তৈরিকেই ধ্যান-জ্ঞান বলে মেনেছিলেন তিনি। শচীন দেবের প্রথম সঙ্গীত-গুরুও ছিলেন তিনি। পরে ইংরেজি সাহিত্যে মাস্টার্স করার জন্য কলকাতাতে আসলে উস্তাদ বাদল খান, আলাউদ্দীন খান, আব্দুল করিম খান, ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায় আর মান্না দে’র কাকা দৃষ্টিশক্তিহীন শিল্পী কৃষ্ণ চন্দ্র দে’র কাছে তালিম নেয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল শচীন কত্তার। কৃষ্ণ চন্দ্র দে’র শিক্ষা শচীন কত্তার সফল শিল্পী, সুরস্রষ্টা আর সঙ্গীত পরিচালক হয়ে ওঠার পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছে। তবে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে সম্ভবত বাংলার লোকগান। হিন্দি ছবির অমর কিছু গানের সুর তিনি লোকগানের বিশাল ভাণ্ডার থেকেই নিয়েছিলেন। মোহাম্মদ রফির গাওয়া ‘তু কাঁহা ইয়ে বাতা’, ‘তেরে ঘরকে সামনে’, ‘দিলকা ভঁওয়ার কারে পুকার’সহ অসংখ্য গানে বাংলার লোকগানের প্রভাব খুব স্পষ্ট। কিশোর কুমারের ‘রূপ তেরা মাস্তানা’ আর নিজের গাওয়া ‘কাহেকো রোয়ে, চাহেযো হোয়ে’র মতো তুমুল জনপ্রিয় গানের সুরেও আছে লোকগীতির ছোঁয়া। রবীন্দ্র সঙ্গীত, নজরুল গীতি বা বাংলার অন্য কোনো গানের সুন্দর সুর নিয়েও হিন্দি ছবির গানকে সমৃদ্ধ করেছিলেন শচীন দেব বর্মন। এর মধ্যে নজরুলগীতি ‘অরুণ কান্তি কে গো যোগী ভিখারি’ অবলম্বনে মান্না দে’র গাওয়া ‘পুছো না ক্যায়সে ম্যায়নে র্যায়েন বিতায়ি’ (ফিল্ম : মেরি সুরত তেরি আঁখে, ১৯৬৩) তো মুম্বাই ফিল্ম ইতিহাসের সেরা গানগুলোর মাঝেই জায়গা করে নিয়েছে। একজন সেরা পেশাদার সঙ্গীত পরিচালকের মাঝে যেসব গুণ না থাকলেই নয় তার সবই ছিল শচীন দেব বর্মনের। নিজে ক্লাসিক্যালে তালিম নিয়েছিলেন দীর্ঘদিন। ফলে শিল্পী হিসেবে নিজেকে এমন এক উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন যে একবার (১৯৩৪) অল বেঙ্গল ক্লাসিক্যাল মিউজিক কনফারেন্সে স্বর্ণপদকও লাভ করেছিলেন। ফঈয়াজ খান, আলাউদ্দীন খান, ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়ের মতো সঙ্গীতগুরুরাও অংশ নিয়েছিলেন সেখানে। তো ক্লাসিক্যালে এমন দখল ছিল যাঁর তিনি কিন্তু সুরসৃষ্টিতে প্রাধান্য দিয়েছিলেন সাধারণ মানুষের মনে দোলা দেবে এমন সুরকেই। তাঁর কথাই ছিল, ফিল্ম হচ্ছে সাধারণ মানুষের মাধ্যম, এখানে উচ্চ-মার্গীয় সঙ্গীত মাঝে মাঝে চলতে পারে, সবসময় নয়। তাই বলে তিনি নিজেকে শুধু জনপ্রিয়তার মাপকাঠিতেই সফল করতে চাননি। সেরকম চাইলে প্রচলিত ধারাকে মেনে নিয়ে এগোনোর চেষ্টা করাই হতো শ্রেয়, যা তিনি কখনোই করেননি। তাই রফি যখন জনপ্রিয়তার শীর্ষে সেসময় তাঁর কথা ভেবে সুর করা ‘জ্বলতে হ্যায় যিসকে লিয়ে’ (ফিল্ম : সুজাতা, ১৯৫৯) গানটি গাইয়েছিলেন তালাত মাহমুদকে দিয়ে। সে গান অমরত্বও পেয়েছে। উল্টোটাও হয়েছে। চিত্রগুপ্ত ছবির জন্য তালাত মাহমুদ গেয়েছিলেন ‘যা উড় যা রে পনছি’। কিন্তু ছবি মুক্তি পাওয়ার কদিন আগে সেই গান নতুন করে রেকর্ড করানো হয়েছিল মোহাম্মদ রফিকে দিয়ে। ওই গানটিও এখন মাস্টারপিস। সে আমলে মুম্বাই ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে শচীন দেব বর্মনের এত এগিয়ে যাওয়া আসলেই বিস্ময়কর। সম্ভব প্রায় সব উপায়ে প্রচলিত ধারার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে কেউ যে এত সফল হতে পারেন তখন সেটা ছিল কল্পনাতীত ব্যাপার।
সে যুগে নিয়ম ছিল গীতিকার আগে গান লিখবেন, সুরকার তাতে সুর দেবেন। শচীন দেব বর্মন নিয়মটা উল্টে দিয়েছিলেন। সেই থেকে শতকরা কমপক্ষে আশি ভাগ গানের সুর হয় আগে, তারপর কথা। উপমহাদেশের সঙ্গীতে ‘এসডি’ (মুম্বাই ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে শচীন দেব বর্মন এই নামে বেশি পরিচিত) যে এমন যুগান্তকারী পরিবর্তনও এনে দিয়েছিলেন সে খবর ক’জন জানেন? একসময় শচীন দেব বর্মনের সবচেয়ে প্রিয় শিল্পীদের একজন ছিলেন লতা মঙ্গেশকর। ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে লতার তখন দোর্দণ্ড প্রতাপ। একটা গান রেকর্ডিংয়ের পর পছন্দ না হওয়ায় লতাকে দিয়ে আবার গাইয়েছিলেন শচীন কত্তা। সেবারেও গানটি পছন্দ হয়নি তাঁর। শচীন কত্তা আবার রেকর্ড করাতে বললে লতা জানিয়েছিলেন, সেদিন তাঁর পক্ষে সময় দেওয়া সম্ভব নয়, সুতরাং আরেকদিন …। এতেই লতার উপরে ক্ষেপে গিয়েছিলেন এসডি। তাঁর ছবিতে লতাকে আর না নেওয়ার সিদ্ধান্তও নিয়ে ফেলেছিলেন। এ সিদ্ধান্তে তিনি অটল ছিলেন অনেকদিন। সেই সুযোগে আশা ভোঁসলের ইন্ডাস্ট্রিতে তাড়াতাড়ি স্থায়ী আসন করে নেওয়ার সেটাও একটা কারণ। তখন হিন্দি ছবিতে নায়কের সব গান গাইতে হতো একজন শিল্পীকে। মুকেশ গাইতেন রাজ কাপুরের জন্য, কিশোর কুমার দেবানন্দের জন্য আর মোহাম্মদ রফি গাইতেন শাম্মি কাপুর আর দিলীপ কুমারের গান, এটা একেবারে অবধারিত ছিল। এসডি এ নিয়মও মানেননি। তাই ‘অভিমান’ ছবিতে (১৯৭৩) অমিতাভ বচ্চনকে ঠোঁট মেলাতে দেখা গিয়েছিল কিশোর কুমার, মোহাম্মদ রফি আর মুকেশের গাওয়া গানে। আবার ‘মঞ্জিল’ ছবিতে (১৯৬০) রফি, কিশোর আর মান্না দে গেয়েছিলেন দেবানন্দের জন্য। এমন কি ততদিনে নায়ক -গায়ক গিসেবে সুখ্যাতি পেয়ে যাওয়া কিশোর কুমারকেও ‘নটি বয়’ ছবিতে (১৯৬২) ঠোঁট মেলাতে হয়েছিল মান্না দে’র গানে। দর্শক কিন্তু শচীন দেব বর্মনের এসব এক্সপেরিমেন্ট মেনেও নিয়েছিল। নিয়ম ভাঙতে গিয়ে যত এক্সপেরিমেন্টই করুন, শচীন কত্তা কিন্তু অযৌক্তিভাবে, বেপরোয়া কিছু করতেন না। বরং ছবির স্বার্থে এমন সিদ্ধান্তও নিতেন যা আর কেউ পারতেন কিনা সন্দেহ। ফিল্মের গানেও শিল্পী হিসেবে তাঁর দক্ষতা, উপযোগিতা বা গ্রহণযোগ্যতা তো প্রমাণিত। ফিল্মে গেয়ে জাতীয় পুরস্কারও পেয়েছিলেন শচীন দেব বর্মন (‘কাহেকো রোয়ে’, ১৯৭২)। কিন্তু এ সাফল্য কোনদিন তাঁর মাথা ঘুরিয়ে দেয়নি। তিনি মনে করতেন, তাঁর কণ্ঠের গান নায়কের ঠোঁটে মানাবে না। তাই কোনোদিন কোনো ছবিতে নায়ককে সরাসরি শচীন দেব বর্মনের গান গাইতে দেখা যায়নি। এমনকি তাঁর নিজের যেসব জনপ্রিয় বাংলা গানের হিন্দি সংস্করণ হয়েছিল সেগুলোও তিনি গাইয়েছিলেন অন্য শিল্পীদের দিয়ে। আসলে শচীন দেব বর্মন সঙ্গীতকে, নিজের পেশাকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসতেন। তাই ভালো গানের স্বার্থে, ভালো ছবি নির্মাণে ভূমিকা রাখার প্রয়োজনে যতটুকু করার তা করতে কখনো দ্বিধা করেননি। নিজের সৃষ্টির প্রতিও শচীন কত্তার ছিল অগাধ ভালোবাসা। স্বল্প পরিসরে সব বলা সম্ভব নয়। তবে একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। কোন এক গভীর রাতে মুম্বাইয়ের এক রাস্তায় কয়েকজন পাঁড় মাতালের আড্ডা চলছিল। সুখ-দুঃখের কথার ভীড়ে এক মাতাল দুঃখ সইতে না পেরে গাইতে শুরু করেছিল, ‘সুন মেরে বন্ধুরে, সুন মেরে মিতোঁয়া’। হঠাৎ কাছের একটি বাড়িতে আলো জ্বলে উঠেছিল। দরজা খুলে বেরিয়ে এসেছিলেন একজন ভদ্রলোক। সেই ভদ্রলোক করজোড়ে মাতালদের বলেছিলেন, ‘তোমরা যা খুশি তা-ই কর, শুধু গানকে রেহাই দাও। অন্তত এই গানটা তোমরা গেয়ো না, প্লিজ।’ মাতাল তরুণেরা রেগেমেগে জানতে চেয়েছিল, ‘কেন? কে আপনি?’ লম্বা, রোগা লোকটি জানিয়েছিলেন, ‘আমি শচীন দেব বর্মন। তোমরা যে গানটির ইজ্জত লুটছো, আমি সেই গানের অভাগা গায়ক, কম্পোজার!’
বিখ্যাত বেশ কিছু গানের স্রষ্টা হিসেবেই শচীন দেব বর্মনকে জানেন অনেকেই। কিন্তু এর বাইরেও তাঁর আরও অনেক পরিচয় আছে, ইতিহাসের ফেরে সেগুলিই হয়তো হতে পারত তাঁর মূখ্য পরিচয়। এছাড়াও তাঁর জীবন জুড়ে অসংখ্য মজার সব ঘটনা ছড়ানো আছে।
শচীনকর্তার বিষয়ে মান্না দে’র কাছে ছিল অফুরন্ত স্টক। শচীন কর্তা একদিন ডেকে পাঠিয়েছিলেন মান্না দে কে। একটি গান নিয়ে বসতে হবে। একটু দুপুর করে আসতে বলেছিলেন। মান্না দে কে দেখে বলেছিলেন, ‘‘মানা, আইসা গ্যাছো! ভাল হইছে। তুমি খাইছ?’’ মান্না দে তো খেয়ে আসেননি। কত্তা তাঁকে দুপুরে আসতে বলেছিলেন। মান্না দে ‘না’ বলতে শচীন কত্তা তাঁকে বলেছিলেন, ‘‘অ! তাইলে তুমি বসো। আমি চারটি খাইয়া লই।’’ আর এক দিন শচীন কত্তা ও মান্না দে খেতে বসেছিলেন। হঠাৎ শচীন কত্তা একটা ঘিয়ে রঙের শিশি বের করে নিজের গরম ভাতে ঢালতে শুরু করেছিলেন। ঢালতে ঢালতে বলেছিলেন, ‘‘তোমার বৌদি পাঠাইছে। ঘিয়ের গন্ধ দ্যাখছ? মানা, খাইবা নাকি একটু?’’ মান্না দে কিছু বলার আগেই শচীন কর্তা পরিপাটি করে ঘিয়ের শিশিটা বন্ধ করে তাঁকে বলেছিলেন, ‘‘আজ আর তোমার ঘি খাইয়া কাজ নাই।’’ একদিন সাতসকালে মান্না দে’র কাছে শচীন কত্তার ফোন এসেছিল। ‘‘আজ কি ফ্রি না কি রে ভাই?’’, ‘‘আজ রেকর্ডিং নেই।’’ ‘‘তোর লিগা দরবারির উপর একটা গান বাঁধছি। এক বারটি চইল্যা আয়।’’ দরাবারি। মধ্য রাতের রাগ। খুব মিষ্টি রাগ। সেই রাগ ছিল মান্না দে’র অসম্ভব পছন্দের। শচীনদেবের মুখে শুনেই রেওয়াজে বসে গিয়েছিলেন। না জানি কী গান পাবেন তাঁর কাছে! বিকেলে কর্তার বাড়ি যেতেই শুনেছিলেন, গানটা মেহমুদের লিপে যাবে। মান্না দে জানিয়েছিলেন, ‘‘দেখি একটা মজার গান শোনাচ্ছেন। বললাম, আরে আমায় কোনটা গাইতে হবে শোনান।’’ ‘‘এই গানটাই গাইবি।’’ কী গান? ‘জিদ্দি’ ছবির ‘পেয়ার কি আগ মে তনবদন জ্বল গয়া’। দরবারি কানাড়ার মতো একটা ভাবগম্ভীর রাগে অমন কৌতুক গান কী করে যে বেঁধেছিলেন উনি! মান্না দে বারবার বলতেন, ‘‘ওটা শচীনদার পক্ষেই সম্ভব।’’ ‘পুছনা ক্যায়সে’ গানটার গল্প এক বার শুনলে ভুলতে পারা মুশকিল। ছবির নাম ‘মেরি সুরত তেরি আঁখে’। এরপরে একদিন রাত প্রায় সাড়ে ন’টা। বাড়ির পোশাকে শচীন কত্তা হঠাৎ হাজির হয়েছিলেন মান্না দে’র ‘আনন্দন’-এ। তখন তাঁর রাতের খাওয়াদাওয়া শেষ। তাতে কী! শচীনদেব এসেই বলেছিলেন, ‘‘মনা, হারমোনিয়ামটা লইয়া বইস্যা বড়।’’ তাঁকে শিখিয়েছিলেন আহির ভৈরবী রাগের ওই গান। যাওয়ার সময় বলেছিলেন, ‘‘কাল রেকর্ডিং। গানটা তোর মতো করে যে ভাবে ভাল হয় গাইবি।’’ এ ছবির অন্য গান মহম্মদ রফিকে দিয়ে গাইয়েছিলেন শচীনদেব। তাতে মান্না দে’র খুব অভিমান হয়েছিল। ‘পুছনা ক্যায়সে’ গাইতে হবে শুনে বলেছিলেন, ‘‘আবার আমায় কেন! বেশ তো রফি ছিল।’’ এক ধমকে তাঁকে থামিয়ে দিয়েছিলেন শচীনকর্তা, ‘‘তুই অত কথা কস ক্যান? এইডা তর গান। তুই-ই গাইবি।’’ যে বছর এই গান বেরোয়, সে বছর জাতীয় পুরস্কার ঘোষণার সময় শচীনদেব ভর্তি ছিলেন হাসপাতালে। মান্না দে তাঁর সাথে দেখা করতে গিয়েছিলেন। তাঁকে দেখামাত্র শচীন কত্তা প্রশ্ন করেছিলেন, ‘‘কী হইল, পাইলি তুই?’’ ঘটনাটা বলতে গিয়ে মান্না দে জানিয়েছিলেন, ‘‘আমার মুখে ‘না’ শুনে শচীনদা বললেন, ‘এই গানের পরও তরে দিল না! কথা শেষ হতে দেখি, শচীনদার চোখে জল।’’ আর এক রাতে মান্না দে’র বাড়িতে এসেছিলেন শচীনকর্তা। সেদিন অবশ্য এসেছিলেন ফোন করে। এসেই খুব ব্যস্ত হয়ে তাঁকে বলেছিলেন, ‘‘মানা, এক বোতল হুইস্কি, জল আর বৌমাকে বল পাঁপড় আর নানারকম ভাজা করে আনতে।’’ মান্না দে তো শশব্যস্ত হয়ে সব ব্যবস্থা করেছিলেন। মনে মনে ভেবেছিলেন শচীনদার আবার কী হল? মাথায় গন্ডগোলটোল হয়েছে নাকি! শচীন কর্তা গ্লাসে দু’চার ফোঁটা হুইস্কি ফেলেছিলেন, হোমিওপ্যাথি ডোজের মতো। জল ঢেলেছিলেন গ্লাসভর্তি। ততক্ষণে টেবিলও পাঁপড় এবং নানারকম ভাজায় ভর্তি হয়ে গিয়েছিল। মান্না দে শচীন কর্তার কাণ্ড দেখছিলেন। শচীন কত্তা গ্লাসের অতল জলে হারিয়ে যাওয়া কয়েক ফোঁটা হুইস্কি নিয়ে নাড়াচাড়া করছিলেন, আর ‘অনেক খাব, অনেক খাব’ ভঙ্গি করে শুধু পাঁপড়ের ছোট্ট একটা টুকরো মুখে দিয়েছিলেন। রাত একটু বাড়তে ‘বৌমা, আজ আসি গিয়া’ বলে শচীন কত্তা অন্তর্ধান করেছিলেন। পরে মান্না দে জানতে পেরেছিলেন, সেদিন সন্ধ্যায় এক প্রোডিউসর ও ডিরেক্টরের আসার কথা ছিল শচীন কর্তার বাড়িতে, একটা মালয়ালি ছবিতে সুর করার জন্য। প্রচুর টাকার অফার ছিল। শচীন কর্তার কথা ছিল – ‘‘ওই ভাষাটাই বুঝি না, সুর করুম কী কইর্যা!’’ তাঁদের কাছ থেকে লুকিয়ে থাকার জন্যই তিনি চলে এসেছিলেন মান্না দে’র বাড়িতে। একবার একজন কলাকুশলী খুবই অসুস্থ ছিলেন। তিনি ছিলেন সবারই পরিচিত। শচীনকর্তা শুনে ভীষণ দুঃখ পেয়েছিলেন। খুবই আহা, উহু করেছিলেন। এমন সময় কেউ একজন একটা প্রস্তাব দিয়েছিলেন – ‘চিকিৎসার তো প্রচুর খরচ, বেচারি একা আর কত করবে? সামর্থ্যই বা কোথায়? আচ্ছা শচীনদা, আমরা সবাই চাঁদা তুলে কিছু টাকা সাহায্য করতে পারি না?’ এ বার শচীন কর্তা চুপ করে গিয়েছিলেন। খানিক পরে বলেছিলেন – ‘তোমার মুখরাটা সুন্দর ছিল। কিন্তু অন্তরায় আইসা সুর কাইট্যা গ্যাছে।’ ‘তমান্না’ ছবিতে মান্না দে’র প্রথম প্লে-ব্যাক, কিন্তু ‘মশাল’ ছবির ‘উপর গগন বিশাল’ গানটিই মান্না দে’কে শিল্পী হিসেবে প্রথম প্রতিষ্ঠা দিয়েছিল। এই বিখ্যাত গানটি ছিল প্রদীপ (গীতিকার), শচীন দেব বর্মন (সুরকার) এবং মান্না দে’র সম্মিলিত সৃষ্টি। এঁদের তখন কেউই তেমন ভাবে প্রতিষ্ঠা পাননি। তখন ‘মশাল’ ছবির কাজ চলছিল। কাজের শেষে তিন জনই কথা বলতে বলতে মালাড স্টেশন যেতেন। একদিন শচীন কত্তা দু’জনকে পিছনে ফেলে জোর পায়ে হাঁটতে শুরু করেছিলেন। কারণটা পরে বোঝা গিয়েছিল। স্টেশনের কাছে ছিল একটা ফলের দোকান। সেখানে তিনি একটু আগে পৌঁছে কয়েকটা কলা কিনেছিলেন, দোকানি দাম চাইতে ততক্ষণে সামনে এসে যাওয়া মান্না দে’কে দেখিয়ে দিয়ে আবার দ্রুত হাঁটতে শুরু করেছিলেন। নিজের আত্মজীবনী ‘জীবনের জলসাঘরে’তে মান্না দে লিখেছিলেন – ‘‘দু’জন শিল্পীর প্রতি কেন জানি না ভীষণ দুর্বল আমি। একজন রফি সাহাব। আরেকজন শচীন কর্তা। খুব ছোটবেলায় কাকা কৃষ্ণ চন্দ্র দে-র কাছে শচীন দেব বর্মন এসেছিলেন। আমি সেদিন বাড়িতেই| ফুটবল খেলতে যাইনি। কাকার ঘরে শচীন কর্তা বসতেই আস্তে আস্তে প্রায় গা ঘেঁষে বসে পড়লাম। কী সুন্দর দেখতে! টকটক করছে গায়ের রং। আমি অত ফর্সা নই। রীতিমতো কালো। ফলে, এক দেখাতেই শুধু ফর্সা রঙের জন্য কর্তাকে দারুণ পছন্দ হয়ে গেল। সেদিন গান নিয়ে অনেকক্ষণ আড্ডা মেরেছিলেন কাকার সঙ্গে। আমি এক মিনিটের জন্য সেখান থেকে উঠিনি। এরপর কাকার অনুরোধে গান ধরলেন দেব দাদা। খুব খুঁটিয়ে সব গান শুনলাম। কর্তা চলে গেলেন। আমি পরের দিন কাকার কাছে বসে ওই গানগুলোই ফের গাইলাম। একদম কর্তার মত করে। ওরকম নাকি নাকি গলায়। সঙ্গে সঙ্গে কাকার এক ধমক, ‘মানা, ওভাবে নাকি নাকি গলায় গাইছ কেন? ওটা কর্তার নিজস্বতা। কাউকে নকল কর না। জীবনে দাঁড়াতে পারবে না। তোমার মত করে গাও।’ কাকার কথা শুনে সেদিনই অনুকরণ করার অভ্যেস ছাড়লাম। কিন্তু শচীন কর্তা মনের গভীরে রয়েই গেলেন। ওই দিনের পর শচীন কর্তার সঙ্গে সাময়িক বিচ্ছেদ। বড় হয়ে, গানের তালিম নিয়ে, পড়া শেষ করে গেলাম মুম্বই। কারণ, বাংলা আমায় তখন পাত্তা দিত না। মুম্বইতেও অবশ্য তখন এক সে বড়কর এক শিল্পী। হেমন্ত কুমার, মহম্মদ রফি, তালাত মেহমুদ, কিশোর কুমার …। আমি সেখানে টিমটিম করে জ্বলছি। এতজনের মধ্যে আমায় তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াত রফি সাহাবের গলা। গলায় যেন কোকিল পুষে রেখেছেন! যেমন মিষ্টি তেমনি নেশা ধরানো। একবার শুনলে মনে হয় বারবার শুনি। … শচীন কর্তার প্রতি দুর্বলতার কথা তো শুরুতেই বলেছি। সেই দুর্বলতা আরও বেড়ে গেল মুম্বইয়ে কাজের পর। হিন্দি-বাংলা মিশিয়ে অসাধারণ কম্পোজিশন, অদ্ভুত গায়কী তাঁর। একই সঙ্গে মারাত্মক ভয়ও পেতাম কর্তাকে। ১৯৬৬-র দুর্গা পঞ্চমী। কলকাতায় সতীনাথ মুখোপাধ্যায়, উৎপলা সেন তাঁদের বাড়িতে জলসার আয়োজন করেছেন। আমি ছাড়াও আমন্ত্রিত হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সলিল চৌধুরি, শ্যামল মিত্র। গিয়ে শুনলাম, কর্তাও নাকি আসবেন। রাত ঘড়ি ১০-টার কাঁটা ছুইছুই। সবাই এসেছেন। কর্তার দেখা নেই। আমরা মুখ চাওয়াচায়ি করছি। আচমকা ডোর বেল বাজল। সঙ্গে সানুনাসিক কন্ঠ, ‘সতীনাথ আসো নাকি?’ আমি, উৎপলা, সতীনাথ প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ে দরজা খুললাম। দেখি, হাসিমুখে সাদা ধুতি-পাঞ্জাবি পরে কর্তা দাঁড়িয়ে। উৎপলার গলায় আনন্দের কান্না, অভিমানের সুর মিলেমিশে একাকার, ‘এত দেরী করলেন দাদা!’ একহাতে উৎপলাকে জড়িয়ে হাসিমুখে আমাদের সবার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘ফ্লাইট লেট করসে। কয়নের আর কিসসু নাই রে!’ সেই সন্ধেয় আমি গাইলাম, ‘তুমি আর ডেকো না।’ শ্যামল শোনালো, ‘যা যা রে যা, যা পাখি’। উৎপলা পরিবেশন করল, ‘কিংশুক ফুল হিংসুক ভারী’। যথারীতি সেদিনেও আমাদের গিলে খেয়ে নিলেন ‘রাজা’ কর্তা। আসর জমিয়ে দিলেন, ‘টাকডুম টাকডুম বাজে’ গান দিয়ে। সেদিন বুঝেছিলাম, আরেকজন মান্না দে হতেই পারেন। কিন্তু আরেকজন শচীন কর্তা? কোনওদিন, কেউ হতে পারবে না।’’
সব ভুলে গেলেও কী ভুলতে পারতেন না শচীন কত্তা? টাকডুম টাকডুম বাংলাদেশের ঢোল? বাংলামায়ের কোল? খাঁটি বাঙ্গালী মনটার কোণে ওসব তো থাকতোই, তবে ফুটবলও খুব টানতো তাঁকে। একসময় নিজেও ছিলেন তুখোড় খেলোয়াড়। টেনিস তো এত ভালো খেলতেন যে তার ভেতরে ভারতের অন্যতম সেরা খেলোয়াড়কেও দেখতেন অনেকে। আর নিয়মিত ফুটবল খেলায় সঙ্গীত সাধনার ক্ষতি হতো বলে একবার গুরু কৃষ্ণ চন্দ্র দে তো জানতেই চেয়েছিলেন, ‘তুমি খেলোয়াড় হতে চাও নাকি সঙ্গীত শিল্পী?’ শচীন কত্তা সেদিন সঙ্গীতের দিকটাই নিয়েছিলেন। তবে তাঁর খেলাপাগল মনটা বেঁচে ছিল দেহাবসানের আগ পর্যন্ত। শচীন দেব বর্মন ফুটবল আর ইস্টবেঙ্গল বলতে ছিলেন অজ্ঞান। কলকাতা ফুটবলের ‘অন্যতম জায়ান্ট’ ইস্টবেঙ্গলের প্রতি তার ভালোবাসার একটা দৃষ্টান্ত শুনলে যে কোনো ক্রীড়াপ্রেমীই অভিভূত হবেন। মৃত্যুর আগের প্রায় এক বছর শচীন দেব বর্মন কোমায় ছিলেন। বোধশক্তি আছে বলে কখনো মনেই হতো না। আইএফএ শিল্ডের ফাইনালে ইস্টবেঙ্গল যেদিন চিরপ্রতিদ্বন্ধী মোহনবাগানকে ৫-০ গোলে হারিয়েছিল, রাহুল দেব বর্মন খবরটা ছুটে গিয়ে জানিয়েছিলেন বাবাকে। খবরটা শুনে কত্তার প্রায় প্রাণহীন শরীরে কিছুটা প্রাণ ফিরেছিল, শচীন কত্তা নাকি খুশিতে একটুখানি হেসেছিলেন! খেলা ছেড়ে সঙ্গীতকে চিরদিনের সাথী করে নিলেও শচীন দেব বর্মনের সঙ্গে ক্রিকেটের কিন্তু একটা চিরস্থায়ী সম্পর্ক হয়ে গেছে। মুম্বাইয়ে এক ভদ্রলোক ছিলেন পেশায় শিক্ষক। মারাঠিতে উপন্যাস লিখেও বেশ নামডাক হয়েছিল তাঁর। ভদ্রলোক ছিলেন শচীন দেব বর্মনের অন্ধভক্ত। তো শচীন কত্তা মারা যাওয়ার ঠিক দু’বছর আগে তাঁর এক পুত্রসন্তান হয়েছিল। রমেশ টেন্ডুলকার তাঁর নামের আগে শচীন দেবের শচীন লাগিয়ে ছেলের নাম রেখেছিলেন শচীন রমেশ টেন্ডুলকার। ক্রিকেট থেকে শচীন টেন্ডুলকারের নাম কি কোনোদিন মোছা যাবে? আর টেন্ডুলকার থাকলে তাঁর সঙ্গে শচীন দেব বর্মনও কি থাকবেন না? রিমিক্সের এই যুগে ‘ছোড় দো আঁচল জমানা কেয়া ক্যাহেগা’ গানটি শোনেননি এমন মানুষ পাওয়া মুশকিল। আশা ভোঁসলে-কিশোর কুমারের এই গানের পেছনে মজার একটা ইতিহাস আছে। শিল্পীদের জন্য রেওয়াজ যতটা গুরুত্বপূর্ণ কখনো কখনো ঠিক ততটাই গুরুত্বপূর্ণ ‘মুড’। বিশেষ করে পারফর্ম করার সময় তো মুড ভালো না থাকলে কিছুই জমে না। আশা ভোঁসলেরও ঠিক জমছিল না সেদিন। রিহার্স করছিলেন ঠিকই, কিন্তু প্রাণ পাচ্ছিলেন না। মন খারাপ করে বসে ছিলেন তিনি। হঠাৎ তাঁর মাথায় কে যেন একটা ‘চাঁটি’ দিয়ে বসেছিল! সঙ্গে সঙ্গে আশা’র মুখ থেকে বেরিয়ে এসেছিল বিরক্তিসূচক শব্দ, ‘আহ্!’ তিনি তাকিয়ে দেখেছিলেন তাঁকে মাথায় চাঁটি মারা লোকটি আর কেউ নন, স্বয়ং শচীন দেব বর্মন। তারপরে হাসিমুখে এগিয়ে এসে তিনি আশাকে চাঁটি মারার রহস্যটাও খুলে বলেছিলেন, ‘‘আমি তোমার কন্ঠে ঠিক এই অভিব্যাক্তিটাই (এক্সপ্রেশন) চাচ্ছিলাম।’’ আশা ভোঁসলে বুঝেছিলেন ওই ‘আহ্’ দিয়ে শুরু করলেই গানটা একেবারে খুলে যাবে। সেটাই হয়েছিল। ‘ছোড় দো আঁচল’-এর আবেদন এখনো তাই একশভাগ অটুট।
‘ত্রিপুরার রাজবাড়ির রাজকুমার’ ছিলেন শচীন কর্তা। রাজবাড়ির লোকজন চাইতেন, তিনি যেন সাধারণ মানুষদের সঙ্গে মেলামেশা না করেন। অথচ কি লিখেছিলেন শচীন কত্তা? ‘‘আমি তাঁদের এ আদেশ কোনদিনও মেনে চলতে পারিনি। … মাটির টান অনুভব করে মাটির কোলে থাকতেই ভালোবাসতাম। … আমার এই আচরণ ও স্বভাব রাজপরিবারের কেউ পছন্দ করতেন না।’’ ত্রিপুরার রাজপরিবারের বিস্তারিত সালতামামিতে যাচ্ছি না। মহারাজা ঈশ্বানচন্দ্র মাণিক্যের দুই পুত্র। ব্রজেন্দ্র চন্দ্র ও নবদ্বীপ চন্দ্র। নবদ্বীপ চন্দ্রের পাঁচপুত্র, চারকন্যা। সবার ছোট ছিলেন শচীন দেববর্মণ। ওই যে বলছিলাম, রাজপরিবারের লোকেরা সাধারণ মানুষজনের সঙ্গে রাজকুমারদের মেলামেশা পছন্দ করতেন না, শচীন কত্তার বাবা নবদ্বীপ চন্দ্র ছিলেন তাঁদের চেয়ে আলাদা। বাবার কথা বলতে গিয়ে শচীন কর্তা লিখেছিলেন, ‘‘বাবার কিন্তু কোনপ্রকার ‘Pride’ বা ‘Prejudice’ ছিল না।’’ যদি এই সুর ও সংগীত সাধকের জীবনকথা লিখতে হয়, তবে তাকে তিন পর্বে ভাগ করে আলোচনা করতে হয়। কুমিল্লা পর্ব, কলকাতা পর্ব ও মুম্বাই পর্ব। শচীনদেব ‘‘যেমন গান বাজনায় তেমনি খেলাধুলায় চৌকস, টাউন হলের মাঠে টেনিস খেলায় একজন পয়লা নম্বরের খেলোয়াড়। পড়াশোনায়ও ভালো। মনোযোগী ছাত্র। অবসর সময়ে বাঁশি বাজান, তবলায় সংগত করেন, মাছ ধরার বাতিক প্রচণ্ড।’’ শচীন কত্তা ‘আর বাঁশি’ নয়, ‘টিপরাই বাঁশি’ বাজাতেন। নারায়ণ চৌধুরি লিখেছেন, ‘‘গান গাইবেন শচীন দেববর্মণ ও হিমাংশু দত্ত। আমরা সব শ্রোতার দল সার বেঁধে বৈঠকে হাজির। মনে আছে শচীনদেব প্রথমে গাইলেন ‘চেয়ো না সুনয়না আর চেয়ো না এই নয়ন পানে’ – নজরুলের প্রসিদ্ধ গজলগীতি। প্রথম গানেই তিনি আসর মাত করে দিলেন। সে যে কী সুরের সম্মোহন বলে বোঝাতে পারব না। আজও এই বৃদ্ধ বয়সে সেই গানের ভালো লাগার স্মৃতি মনে হলে গায়ে কাঁটা দেয়। … সেদিন হিমাংশু দত্তও কয়েকটি গান গেয়েছিলেন – তার মধ্যে নিজের সুরারোপিত গান ছিল আবার অন্যবিধ গানও ছিল। অজয় ভট্টাচার্যের লেখা ‘হাসুহানা আজ নিরালা ফুটিলি কেন আপন মনে’ গানটি এবং একটি মীরার ভজনের কথা আজও মনে পড়ে। … সুর সংযোজনায় তিনি ছিলেন অদ্বিতীয় … তবে যাকে বলে কণ্ঠশিল্পী তা তিনি ছিলেন না।’’
শুরুতে শচীন কত্তা কয়েকবছর ইউসুফ হাইস্কুলে পড়েছেন। ক্লাস ফাইভ থেকে কুমিল্লা জেলা স্কুলে পড়েছেন। ১৯২০ সালে ম্যাট্রিক পাশ করেন। তারপর তিনি কুমিল্লার ভিক্টোরিয়া কলেজে ভর্তি হন। ১৯২২ সালে শচীন কর্তা আই এ এবং ১৯২৪ সালে বি এ পাশ করেন। তারপর তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। পড়া শেষ করেননি। বাবা তাঁকে বিলেত পাঠাতে চেয়েছিলেন। রাজি হননি। শচীন কত্তার কুমিল্লা পর্ব তাহলে কতদিন? ১৯০৬ সালে জন্ম। ১৯২৪ সালে কলকাতায় আসা। বলা যেতে পারে উনিশ বছর। প্রথম কবে শচীন কত্তা বাইরে গান করেছেন? তাঁর নিজের কথায়, ‘‘পঞ্চম শ্রেণিতে ছাত্রজীবনে বাবার শেখানো গান আমি সরস্বতী পূজায় আমাদের স্কুলের অনুষ্ঠানে গেয়েছি।’’ সে গান খুব ভালো হয়েছিল। স্কুলের প্রধান শিক্ষক প্রশংসা করে নবদ্বীপ চন্দ্রকে চিঠি দিয়েছিলেন। প্রথম শংসাপত্র বা প্রথম সাম্মানিকের কথা কেউ কি কখনও ভুলতে পারে? বলছি বটে আমরা কুমিল্লা পর্ব, কলকাতা পর্ব ও মুম্বাই পর্ব – কোনও স্রষ্টার জীবনে এভাবে স্পষ্ট দেওয়াল তোলা যায় না। যখন তিনি কলকাতায়, কুমিল্লায় নিয়মিত আসতেন। যখন তিনি মুম্বাইয়ে, কলকাতায় নিয়মিত এসেছেন। তবে একথা ঠিক, যে সম্ভাবনার উন্মেষ দেখা গিয়েছিল কুমিল্লা শহরে, তা বিস্তার পেয়েছে কলকাতা ও মুম্বাই শহরে। দুই মহানগরে শচীন কত্তা গানের ভুবন গড়ে তুলেছিলেন। সে ভুবন অনন্য, অপরাজেয় ও অবিস্মরণীয়। জীবনের প্রথম লগ্ন থেকেই শচীন কত্তা অর্থের জীবনই বেছে নিতে পারতেন। সে পথে গেলেন না তিনি। একটা সময়ের পর বাবার কাছেও আর্থিক সাহায্য চাননি। কলকাতায় জীবন শুরু করার ছ’বছরের মাথায় ১৯৩০ সালে বাবা নবদ্বীপ চন্দ্র প্রয়াত হন। যে কোনও সংগীত শিল্পীর কথা উঠলেই জানতে ইচ্ছে করে অনেকের, কে ছিলেন ওই শিল্পীর সংগীত গুরু? কলকাতায় শচীন কত্তার সংগীত শিক্ষা অনেকটাই প্রাতিষ্ঠানিক ছিল বলা যায়। বদল খাঁ, কৃষ্ণচন্দ্র দে এবং ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়ের কাছে গান শিখেছেন। শাস্ত্রীয় ও ধ্রুপদ সংগীতের তালিম নিয়েছেন। যে মানুষ লিখেছিলেন, ‘‘ভাটিয়ালির সুরে ও কথায় নিজেকে হারিয়ে ফেলতাম’, তাঁর প্রথম দুই গুরু অজানা ও অচেনা ‘মাধব ও আনোয়ার।’’ মাধব ও আনোয়ারের পরিচয় দিয়েছেন শচীন কত্তা নিজেই। আর এই পরিচয় যখন তিনি দিয়েছেন তখন শিল্পীর খ্যাতি জগৎময় প্রসারিত। শচীন কত্তা লিখেছেন, ‘‘মাধব নামে আমাদের এক বৃদ্ধ চাকর ছিল। রবিবার স্কুল ছুটির দিনে খাওয়া-দাওয়ার পর দুপুরে এই মাধব আমাদের সুর করে রামায়ণ পড়ে শোনাত। সে যখন সুরে রামায়ণ পড়তো, তখন তার তান খট্কি ছাড়া, সরল সোজা গানের ধরন আমাকে পাগল করে দিত। কোন ওস্তাদি নেই, কিন্তু কত অনায়াসে সে গেয়ে যেত। … আমাদের বাড়িতে আনোয়ার নামে আরেক ভৃত্য ছিল। … আনোয়ার আর আমি সুযোগ বুঝে ছিপ নিয়ে বসে যেতাম – আর দু’জনে মাছ ধরতাম। তারপর গান গাইতে গাইতে পুকুরের ধারে-ধারে ও বাগানে দু’জনে বেড়িয়ে মনের কথা বলতাম। আনোয়ার রাত্রে তার দোতারা বাজিয়ে যখন ভাটিয়ালি গান করত, তখন আমার ব্যাকরণ মুখস্থ করার দফারফা হয়ে যেত। … ব্যাকরণ মুখস্থ, অঙ্ক কষা ছেড়ে আনোয়ারের কোল ঘেঁষে বসে তার ভাটিয়ালির সুরে ও কথায় নিজেকে হারিয়ে ফেলতাম। এরাই হলো, লোকসংগীতের আমার প্রথম দুই গুরু – মাধব ও আনোয়ার।’’ তার মানে শৈশবে সুরের নির্মাণ হচ্ছে শচীন কর্তার বুকে। কৈশোরেও তাই। তাঁর কথায়, ‘‘পড়ায় তেমন মন ছিল না। পাশের নবাব বাড়িতে প্রতিবছর বড় বড় গাইয়ে, বাজিয়ে ও বাঈজীরা এসে গান বাজনা করতেন। পড়া ফাঁকি দিয়ে লুকিয়ে রাত জেগে সেই সব মজলিশে সময়মতো উপস্থিত হতাম আর রাতের পর রাত তাঁদের গান বাজনা উপভোগ করতাম।’’ এমন এক তরুণের উনিশ বছর বয়সে কলকাতায় আসা। ১৯২৪ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের এম এ-তে ভর্তি। পরের বছর লেখাপড়ার পাট চুকিয়ে দিলেন। ১৯২৫ সালে তিনি বদল খাঁ, কৃষ্ণচন্দ্র দে ও ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়ের কাছে গান শিখতে শুরু করেছেন। খুব ধীরে তাঁর সাংগীতিক প্রতিভার পরিচয় বাড়ছে। বেতারে পনেরো মিনিট গাইলেন। নিজের সুরেই গান গেয়েছেন। পেয়েছেন দশ টাকা। শচীন কত্তা লিখেছেন, ‘‘এ আমার কাছে লক্ষ টাকার থেকেও বেশি মনে হয়েছিল।’’ আগেই বলা হয়েছে, কলকাতায় থাকলেও নিয়মিত তিনি কুমিল্লা যেতেন। আগরতলায়ও যেতেন। বছরে তিনবার তো যেতেন-ই। রাজপরিবারের পুত্র বা কন্যা যদি লোকগানে ডুবে থাকতে চান তবে তো তাঁকে গান সংগ্রহ করতে হবে। গায়ে গঞ্জে মাঠে ঘাটে যারা গাইছে লোকগান, তাদের কাছে শুনতে হবে সেই গান। শচীন কর্তা এই কাজ সুচারুভাবে করেছেন। গোয়ালপাড়িয়া লোকগানের সম্রাজ্ঞী প্রতিমা বড়ুয়ার সম্পর্কেও একই কথা বলা যায়। শচীন কত্তার রচনা থেকে জানা যাচ্ছে, ‘‘… ঘুরে বেড়াতাম গ্রামে মাঠে ঘাটে। ভাসাতাম নদীর জলে নৌকা, চাষি ছেলেদের সঙ্গ – বাউল বোষ্টম ভাটিয়ালি গায়ক ও গাজন দলের সঙ্গে ছুটির ফাঁকে কলেজ ফাঁকি দিয়ে সময় কাটাতাম গান গেয়ে। আমরা সবাই যে এক হুঁকোয় তামাক খেতাম, বাবা তা জানতেন না। …পূর্ববঙ্গের ওই অঞ্চলের এমন কোনও গ্রাম নেই বা এমন কোন নদী নেই, যেখানে আমি না ঘুরেছি। ছুটি ও পড়াশুনার ফাঁকে আমি গান সংগ্রহ করতাম।’’ গায়ক ও সংগীত পরিচালক হিসেবে শচীন কত্তার খ্যাতি যখন শীর্ষে তখন তাঁকে বলতে দেখা গেল, ‘‘আমার এখনকার যা কিছু সংগ্রহ যা কিছু পুঁজি সে সবই ওই সময়কার সংগ্রহেরই সম্পদ। আজ আমি শুধু ওই একটি সম্পদেই সমৃদ্ধ, সে সম্পদের আস্বাদন করে আমার মনপ্রাণ আজও ভরে ওঠে। যে সম্পদের জোরে আমি সুরের সেবা করে চলেছি – তার আদি হলো আমার ওইসব দিনের গানের সংগ্রহ ও স্মৃতি।’’ এখানে উল্লেখ করতে হয়, শচীন কত্তার সঙ্গে যিনি দীর্ঘকাল তবলাসংগত করেছেন, সেই ব্রজেন বিশ্বাসের কথা। ১৯২৪ সালে তাঁর কুমিল্লা জেলাতেই জন্ম। দৃষ্টিহীন এই সুরসাধক বাঁশের একটি অপূর্ব বাদ্যযন্ত্র তৈরি করেছিলেন যার নাম শচীন কত্তা দিয়েছিলেন ‘ব্রজতরঙ্গ’। এই বাদ্যযন্ত্র দিয়ে ‘ছদ্মবেশী’ ছবিতে ‘প্রিলিউড মিউজিক’ তৈরি করেন শচীন কত্তা। তারপর গাইলেন অজয় ভট্টাচার্যের লেখা সেই বিখ্যাত গান ‘বন্দর ছাড়ো যাত্রীরা সবে জোয়ার এসেছে আজ’।
মুম্বাই (তৎকালীন বম্বে) থেকে কলকাতায় এসেছেন কত্তা। আড্ডা জমেছে সাউথ অ্যান্ড পার্কের বাড়িতে। গান বাজনা জগতের অনেক লোক এসেছেন। কথা বলতে বলতে হারমোনিয়াম বাজাচ্ছিলেন কত্তা। হঠাৎ বাজনা থামিয়ে বললেন, ‘‘আরে জাননি, শক্তি একটা ছবি করতাছে। আমারে কইল সুর দিতে। আরও কইল একটা সেক্সের গান করতে হইব। কী হইল জান, অনেককাল আগের একটা কথা মনে পইড়্যা গেল। এক ব্যাটার বাড়িতে গ্যাছলাম। তারে ডাকতাছি। সাড়া দেয় না। অনেক পরে ঘরের থেইক্যা বাইরইয়া আইল। দিলাম ব্যাটারে বকা। কয় কী, ‘কর্তা মাফ করবেন। পোলাডারে বিয়া দিমু আইজকা, তাই কাপড় পরাইতাছিলাম।’ যখন আমাগো কথা হইতাছে, একটা ছোট্ট মাইয়া দেখি ঝিক লইয়া খেলতাছিল। পোলাডারে সাজাইন্যা দেইখ্যা মাইয়াডা হাইস্যা উঠল। আমি কইলাম, ‘এইটুকু পোলারে বিয়া দিবি কি?’ ব্যাটায় কয়, ‘অহন দেওয়ান-ই ভালা। নইলে বিগড়াইয়া যাইতে পারে।’ শুইন্যা ওই একফোঁটা মাইয়ার কী হাসি। হাসতে হাসতে মাইয়া গাইয়া উঠল, কালকে যাব শ্বশুরবাড়ি/আহ্লাদে খাই গড়াগড়ি/দেখব তোরে প্রাণভরে সুন্দরী।’ শক্তির কথা শুননের পর ওই গানডার কথা আমার মনে পইড়্যা গেল। ঠিক কইর্যাু ফালাইলাম, গানডারে কাজে লাগামু। লয়ডারে কমাইয়া কিশোইরারে গাইতে কমু। আর কমু জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফালাইবি। তাইলেইত সেক্সের গান হইয়া যাইব।’’ কী সেই গান? আরাধনা ছবির ‘রূপ তেরা মস্তানা।’ কেমন করে গানে সুর করতেন শচীন কত্তা? ২০০০ সালের পয়লা অক্টোবর কত্তার জন্মদিনে মান্না দে সংবাদমাধ্যম কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘‘সুর তৈরি করে সকাল, দুপুর, সন্ধে গাইতেন। পাঁচদিন, ছ’দিন, সাতদিন। বেছে বেছে লোকেদের শোনাতেন। কম কাজ নিতেন।’’ তাঁর কম কাজ নেওয়ার বিষয়ে একটা ঘটনার কথা উল্লেখ্য। সেটা লিখেছিলেন গীতিকার পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়। পুলক তখন মুম্বাইয়ে শচীন কর্তার বাড়িতে গিয়েছিলেন। তাঁর চোখের সামনেই ঘটনাটি ঘটেছিল। যেভাবে পুলক লিখেছিলেন, ‘‘এক ভদ্রলোক আমার সামনেই তাঁর হাতের ছোট টিনের সুটকেস খুলে ওঁকে দেখালেন নোটের গোছা। শচীনদা ওঁর ভঙ্গিতে বললেন, ‘তুম জিতনা রূপাইয়া দেখাও হাম তুমারা পিকচার নেহি করেঙ্গা।’ ওই ভদ্রলোকের অনেক কাকুতি-মিনতি উপেক্ষা করে শচীনদা তাঁকে বিদায় দিলেন। ঘরের মধ্যে বসা অন্য এক ভদ্রলোক বললেন, দাদা, সাত সকালে এতগুলো টাকা ছেড়ে দিলেন? উনি বললেন, কুয়া জান? পাতকুয়া? পাতকুয়া থেকে একসঙ্গে সব জল তুলে নিলে কুয়া শুকিয়ে যায়। কুয়াতে জল জমবার সময় দিতে হয়। মিউজিক ডিরেকশনও তাই। টাকার লোভে একগাদা ছবিতে কাজ করলে আমি ফুরিয়ে যাব। আমার ইয়ারলি কোটা আছে। তার বেশি আমি কাজ করি না। আমার এবছরের কোটা কমপ্লিট। যে যত টাকাই দিক এবছরে আর আমি ছবি করবো না।’’
কলকাতায় ফেরা যাক। ১৯৩০ সালে বাবা নবদ্বীপ চন্দ্র মারা যাওয়ার পর শচীন কর্তা ‘ত্রিপুরা প্যালেস’ ছেড়ে দিয়ে একটা একখানা ঘরের বাড়ি ভাড়া নিলেন। গানের টিউশনি নিলেন। আর সারাক্ষণ রেওয়াজ, ওস্তাদসঙ্গ ও গানবাজনা শুনে সময় কেটে যায়। সংগীতের দুই ঘরানায় শচীন কর্তার দখলদারি। লোকগান ও ধ্রুপদী গানের ঘরানা। ১৯৩২ সালে তাঁর প্রথম গানের রেকর্ড বেরলো। একপিঠে হেমেন্দ্রকুমার রায়ের লেখা গান, ‘ডাকলে কোকিল রোজ বিহানে’, অন্যপিঠে শৈলেন রায়ের লেখা গান ‘এপথে আজ এস প্রিয়া’। দু’টো গানেই সুর দিয়েছেন শচীন কর্তা। প্রথম গানটিতে লোকগানের সুর। দ্বিতীয় গানে ধ্রুপদী সংগীতের সুর। এই রেকর্ড নিয়ে একটা মজার কাহিনি আছে। ভিন্নতর কাহিনিও আছে। ভিন্নতর কাহিনি হলো এই, এইচ এম ভি-তে গান করতে চেয়েছিলেন শচীন কর্তা। ‘অনুনাসিক’ গায়কী বলে বাদ গেলেন। ত্রিপুরার নরেন ঠাকুর ‘হিন্দুস্থান মিউজিক্যাল প্রোডাক্টস’-এর চণ্ডীচরণ সাহার কাছে নিয়ে গেলেন। গান রেকর্ড হলো। রেকর্ড নিয়ে শচীন কর্তা কুমিল্লা গেলেন। এবার মজার কাহিনি শুরু। কুমিল্লার পরিচিতজনদের দেখালেন। বাবা বেঁচে নেই। থাকলে নিশ্চয়ই খুশি হতেন। তারপর রেকর্ড নিয়ে আগরতলা এলেন। তখন মহারাজা বীরবিক্রম মাণিক্যের রাজত্বকাল। আগরতলা ঠাকুরবাড়ির এক বিশিষ্ট চরিত্র জ্যোতিষচন্দ্র দেববর্মণ। শচীন কর্তার পরিচিত। রেকর্ডটি হাতে নিয়ে তারপর বগলে চেপে দৌড় লাগালেন। শচীন কর্তা তখন পেছনে পেছনে ছুটছেন আর বলছেন, ‘‘আরে এইডা একটা মাত্র কপি, ভাইঙ্গা গেলে আর পাইমু না।’’ গোড়ার দিকে টিউশনির পাশাপাশি কয়েকটি নাটকের গানে সুর দিয়েছেন শচীন কর্তা। তখন নাটকের অভিনেতাদের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে। এরা কেউ কেউ ছবির বিখ্যাত অভিনেতা ছিলেন। পরিচালক মধু বসুর পত্নী সাধনা বসুকে গান শেখাতেন শচীন কর্তা। তাঁর পরিচালনায় ‘সেলিমা’ নামের এক ছবিতে ভিখারির চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন শচীন কর্তা। ভিখারি সেজে একটি গান করেছিলেন। এই ছবিতে অভিনয় করেন গুল হামিদ খান (১৯০৫-১৯৩৬), রাধা, মাজহার খান, মাধবী, নন্দকিশোর মেহরা, ইন্দুবালা দেবী, গুলাম রসুল, হাসান দীন, বসন্ত রাও পেহলওয়ান ও শচীন দেববর্মণ। অভিনয়ের কথা রাজ পরিবারের লোকেরা জানতে পারলে ছিঃ ছিঃ করবে সকলে, এই ভয় তাঁর ছিল। মধু বসু বলেছিলেন, এমন সাজিয়ে দেব যে বুঝতেই পারবে না। মধু বসুর লেখা ‘আমার জীবন’ বইয়ে এসব কথা আছে। নজরুল ইসলামের কথা আমরা শচীনদেবের লেখা থেকে জানতে পারি। নিজেকে তিনি কাজী নজরুলের ‘স্নেহধন্য শিল্পী’ বলেছেন। আর বলেছেন, ‘‘তিনিও আমার গান ও সুর খুবই পছন্দ করতেন। আমার বাড়িতে আসতেন। মুগ্ধ করতেন কবিতা ও গানে। … তাঁর রচিত গান রেকর্ড করতে আমাকে আদেশও দিয়েছিলেন। আমার জন্যই বিশেষভাবে সেগুলি রচনা করেছিলেন তিনি। আমি তা রেকর্ডও করেছিলাম … অনেকেই আমার গাওয়া ‘চোখ গেল, চোখ গেল কেন ডাকিস রে – চোখ গেল পাখিরে’ গানটি শুনেছেন। এটি কাজীদার রচিত। পাঁচ মিনিটের মধ্যে লিখেছিলেন আমার জন্য, সুর দিয়ে। আমি কাজীদাকে বলেছিলাম, ‘ঝুমুরের ধরনে একটু টিকলিশ সুরে গান দিন আমাকে।’ কাজীদা প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই দিলেন এই গানটি উপহার।’’ নজরুল ইসলামের লেখা চারটি গানের রেকর্ড করেছেন শচীন কর্তা।
স্ত্রী মীরা দেববর্মণের সঙ্গে চারটি গান, একক কণ্ঠে ১২৭টি গান, মোট ১৩১টি বাংলা গান গেয়েছেন শচীন দেববর্মণ। সবচেয়ে বেশি গানের গীতিকার অজয় ভট্টাচার্য। ৪১টি গান। মীরা দেববর্মণের লেখা ১৬টি গান গেয়েছেন তিনি। পরে গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার অনেক গান লিখে দিয়েছেন। তাঁর লেখা ১৮টি গান করেছেন শচীন কর্তা। শিল্পী শচীন দেববর্মণ অন্য সুরকারের গান বেশি করেননি। তাছাড়া চলচ্চিত্রে যে কটি নেপথ্য সংগীত গেয়েছেন, কোনও অভিনেতাকে ‘লিপ’ করতে দেননি। চলচ্চিত্রে গান গাওয়ার এটিই প্রাথমিক শর্ত ছিল। বাংলা চলচ্চিত্রে সংগীত পরিচালনা করেননি শচীন কত্তা, এটা কথা নয়। আসল কথা, বাংলা চলচ্চিত্র জগৎ তাঁকে স্বাগত জানায়নি। নির্মম হলেও এই ঘটনা সত্যি। দুঃখ করে বলেছিলেন, কোনও চলচ্চিত্র সংস্থা তাঁকে বাংলায় সংগীত পরিচালনার তেমন সুযোগ দিল না। বাংলার মাটি ছেড়ে, কলকাতা শহর ছেড়ে তিনি মুম্বাই যেতে চাননি। ১৯৪২ সালে মুম্বাই চলচ্চিত্র জগতে বিখ্যাত প্রযোজক ও পরিচালক চণ্ডুলাল শাহ তাঁর ‘রঞ্জিত স্টুডিওজ’-এ যোগ দিতে আমন্ত্রণ জানান শচীন কত্তাকে। শচীন কত্তা সেই আমন্ত্রণ ফিরিয়ে দেন। মুম্বাই চলচ্চিত্র জগতের একসময় অভিভাবক ছিলেন চণ্ডুলাল। ১৯৪৪ সালে আবার আমন্ত্রণ এলো শচীন কত্তার কাছে। স্ত্রী মীরা দেববর্মণ ও ছয় বছরের পুত্র রাহুলকে নিয়ে তখন তাঁর সংসার। এবার আমন্ত্রণ জানিয়েছেন মুম্বাইয়ের আরও একজন বিখ্যাত প্রযোজক শশধর মুখার্জি। ১৯৪৩ সালে বিখ্যাত সুরকার মদন মোহনের পিতা রায়বাহাদুর চুনীলাল কোহলি, অশোক কুমার, চলচ্চিত্র পরিচালক জ্ঞান মুখার্জি ও শশধর মুখার্জি মিলে তৈরি করেছিলেন ‘ফিল্মিস্তান’ স্টুডিও। এঁরা সকলে শচীন কত্তাকে পেতে চাইছেন। এবার আর আমন্ত্রণ ফিরিয়ে না দিয়ে মুম্বাইয়ের পথে পাড়ি দিলেন শচীন দেববর্মণ। কলকাতায় দশটি চলচ্চিত্রে সুর দিয়েও শচীন কত্তাকে মুম্বাইয়ে চলে আসতে হলো, শুরুতে এই দুঃখ তাঁর ছিল। কলকাতায় নিজের রেকর্ডের গান তাঁর হিট, সুপারহিট। চলচ্চিত্রের গান জনপ্রিয়তা অর্জন করতে পারছে না। সময়টা ছিল ভারতীয় গণনাট্য সংঘের উন্মেষের যুগ। গণনাট্য সংঘের একজন প্রকৃত শুভানুধ্যায়ী হয়ে উঠছিলেন শচীন কত্তা। গণনাট্য সংঘ যখন কোনও নাটক বা নৃত্যানুষ্ঠান প্রযোজনা করছে, সাংস্কৃতিক জগতের যে বিশিষ্ট ব্যক্তিরা প্রশংসা করতেন সেই তালিকায় ছিলেন উদয়শঙ্কর, শিশিরকুমার ভাদুড়ি, নরেশ মিত্র, হরেন ঘোষ, সতু সেন ও শচীন দেববর্মণ। সুধী প্রধান তাঁর সম্পাদিত ‘মার্কসিস্ট কালচারাল মুভমেন্ট ইন ইন্ডিয়া’ গ্রন্থের প্রথম খণ্ডে একথা উল্লেখ করেছেন। এই বইয়েরই অন্য এক জায়গায় সুধী প্রধান লিখেছেন, ‘‘… দু’জনের কথা আলাদা করে বলতে হয়। একজন মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য ও অন্যজন শচীন দেববর্মণ। এঁরা কখনও আমাদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকেননি। আমরা কাজের চাপে অথবা সংগঠনগতভাবে বিষয়টিকে নজর দিইনি।’’ পরে অবশ্য পরিস্থিতির বদল হয়েছে। কেউ কেউ সংগঠনে এসেছেন। শচীন দেববর্মণ ভারতীয় গণনাট্য সংঘের লোকসংগীত শাখার সভাপতি পদে সম্মতি জানিয়েছিলেন। ১৯৩৯-৪০ সালে শচীন কত্তা সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। এই সান্নিধ্যের কারণে বাণিজ্যিক চলচ্চিত্র নির্মাণ সংস্থা বা স্টুডিও শচীন কত্তাকে জায়গা না-ও দিয়ে থাকতে পারে, এ আমাদের অনুমান মাত্র। ফিল্মিস্তান-এর ‘শিকারী’ ছবিতে সুর দান করে মুম্বাইয়ের জগতে শচীন কত্তার হাতেখড়ি হলো। তারপর একের পর এক ছবিতে সুর দিতে থাকলেন। নজর কাড়া প্রশংসা এলো না তেমন। এদিকে দেবানন্দ, চেতন আনন্দ, বিজয় আনন্দ আর গুরু দত্ত মিলে তৈরি করেছেন ‘নবকেতন ফিল্মস’। তাঁদের প্রযোজনায় সুর দিচ্ছেন শচীন কত্তা। সুরের জগতে মুম্বাইয়ের চলচ্চিত্রে তিন দশক ধরে এক অবিসংবাদিত সম্রাট ছিলেন শচীন দেববর্মণ। কিশোরকুমার, মহম্মদ রফি, মুকেশ, মান্না দে, লতাজী, আশাজী – কেউই রেহাই পেতেন না। রেহাই পেতে চাইতেনও না, এটাই সবচেয়ে বিস্ময়ের।
১৯০৬ সালের অক্টোবরের প্রথম দিনে তাঁর জন্ম। ১৯৭৫ সালের অক্টোবরের শেষদিনে সত্তর বছর বয়সে তিনি পৃথিবী ছেড়ে চলে যান। সুরের মূর্ছনা ছাড়া সভ্যতা বেঁচে থাকতে পারে না। সুরের অনুষঙ্গে চাই যথাযথ গানের কলি। বহু গানের কলি ও সুরে প্রাণদান করেছেন, চিরজীবী করেছেন শচীন কত্তা।
(তথ্যসূত্র:
১- Incomparable Sachin Dev Burman, R K Chowdhury, Toitambur.
২- সুরের কুমার: শচীন দেব বর্মন, মুস্তাফা জামান আব্বাসী, অনন্যা।
৩- শচীন দেববর্মনের গান ও জীবন, অমলেন্দু কুমার দাশ, অনুপম প্রকাশনী।
৪- আমার জীবন, মধু বসু, প্রতিভাস।
৫- জীবনের জলসাঘরে: পূর্ণাঙ্গ আত্মকথা, মান্না দে, আনন্দ পাবলিশার্স (২০০৫)।
৬- S. D. Burman: The Prince-Musician, Anirudha Bhattacharjee and Balaji Vittal, Tranquebar (২০১৮)।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত