হিন্দু গৃহিণী মানেই সিঁথিতে সিঁদুর, হাতে শাঁখা, পলা, লোহা— একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়েও এবার এই ধারণাতেই আইনি সিলমোহর দিল গুয়াহাটি হাইকোর্ট! যা নিয়ে ইতিমধ্যেই শোরগোল পড়ে গিয়েছে দেশজুড়ে। কোনও হিন্দু মহিলা যদি শাঁখা-সিঁদুর না পরেন, তবে তিনি নিজেকে বিবাহিত মনে করেন না। আর যিনি নিজেকে বিবাহিত মনে করেন না, সেই মহিলাকে বিবাহবন্ধনে বেঁধে রাখার কোনও মানে নেই। এ কথা জানিয়েই এক দম্পতির বিবাহবিচ্ছেদকে মান্যতা দিয়েছে আদালত।
প্রসঙ্গত, স্ত্রীয়ের সঙ্গে বিচ্ছেদ চেয়ে আসামের এক ব্যক্তি হাই কোর্টে ডিভোর্সের আবেদন করেন। এর আগে তিনি আসামেরই এক পারিবারিক আদালত ডিভোর্সের আবেদন করেছিলেন। তাঁর বক্তব্য ছিল, তাঁর স্ত্রী শাঁখা ও সিঁদুর পরতে চান না। ওই ব্যক্তির স্ত্রীও সেই কথা অস্বীকার করেননি। কিন্তু পারিবারিক আদালের তরফে জানানো হয়, স্ত্রী তাঁকে কোনওরকম অত্যাচার করেননি। তাহলে ডিভোর্স কেন? ওই আদালতে বিবাহবিচ্ছেদের মামলা খারিজ হয়ে যায়।
কিন্তু হাইকোর্টে পারিবারিক আদালতের সিদ্ধান্তকে বাতিল ঘোষণা করা হয়। হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি অজয় লাম্বা ও বিচারপতি সৌমিত্র শইকিয়ার বেঞ্চ জানায়, ওই মহিলা শাঁখা-সিঁদুর পরতে চান না মানে তিনি নিজেকে বিবাহিত মনে করেন না। এই রকম পরিস্থিতিতে স্বামীকে স্ত্রীর সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে বাধ্য করা হেনস্তার নামান্তর। এই যুক্তি দেখিয়েই দম্পতির ডিভোর্সকে মান্যতা দেয় হাই কোর্ট।
প্রসঙ্গত, ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারিতে বিয়ে হয় তিনসুকিয়া জেলার ডিগবয়ের বাসিন্দা ভাস্কর দাস ও রেণু দাসের। এক মাস পর স্ত্রী এক আলাদা থাকার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। যার ফলে প্রায়শই দম্পতির মধ্যে তর্ক চলত। স্বামীর মতে, তাঁর স্ত্রী সন্তান ধারণ করতে সক্ষম না হওয়ায় তাঁদের বৈবাহিক সম্পর্ক আরও খারাপ হয়েছিল। ২০১৩ সালে, মহিলা তাঁর শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে চলে যান। স্বামী এবং তাঁর পরিবারের বিরুদ্ধে ভারতীয় দণ্ডবিধির ৪৯৮এ’ ধারায় মামলা করেন।
তিনি তাঁর স্বামী এবং তাঁর পরিবারের বিরুদ্ধে যৌতুক ও হয়রানির অভিযোগ তোলেন। বলেন, শ্বশুরবাড়িতে তাঁকে খাবার এবং চিকিৎসা নিয়ে সমস্যা ভোগ করতে হত। তবে তাঁর অভিযোগ আদালতে টেকেনি। ওই মামলায় ওই ব্যক্তি ও তাঁর পরিবারের লোকেরা হাই কোর্টে নির্দোষ সাব্যস্ত হন। এরপর ওই ব্যক্তি আলাদাভাবে বিবাহবিচ্ছেদের জন্য আবেদন করেন।
বিচারপতি লাম্বা ও বিচারপতি শইকিয়ার বেঞ্চের পর্যবেক্ষণ, জিজ্ঞাসাবাদের সময় স্ত্রী স্পষ্ট জানিয়েছিলেন, তিনি কে আর স্বামী হিসেবে মানেন না। তাই শাঁখা-সিঁদুর পরা ছেড়ে দিয়েছেন। বেঞ্চের মতে, হিন্দু বিবাহ আইন অনুযায়ী বিয়ে হওয়া মহিলা হিন্দু শাস্ত্রের রীতি-নীতি মেনেই বিয়ে করেন। এই মামলায় স্ত্রী সেই কথা অস্বীকার করেননি। বরং তিনি স্পষ্ট জানিয়েছেন, ভাস্করকে স্বামী হিসেবে স্বীকার করেন না বলেই তিনি শাঁখা-সিঁদুর পরছেন না।
হাইকোর্টের মতে, রেণুদেবীর শাঁখা-সিঁদুর না পরার অর্থ নিজেকে অবিবাহিত হিসেবে দেখানো। এ থেকেই স্পষ্ট হয়ে যায় স্ত্রী আর স্বামীর সঙ্গে থাকতে চাইছেন না ও বিয়ে মানছেন না। বিচারপতিদের পর্যবেক্ষণ, ‘শাঁখা-সিঁদুর না-পরা মানে নিজেকে অবিবাহিতা মনে করা বা সেই বিয়ে মেনে না নেওয়া।’
বিচারপতিদের এ হেন মন্তব্য নিয়েই তৈরি হয়েছে বিতর্ক। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নীলাঞ্জনা গুপ্তর মতে, ‘যে কোনও পার্সোনাল ল’য়েরই ভিত্তি ধর্ম। সেই সব আইনে মনে করা হয় না যে, মহিলাদের আলাদা কোনও আইনি সত্তা রয়েছে।’ গুয়াহাটির কটন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক প্রশান্ত চক্রবর্তী বলেন, ‘উজানি আসামে শাঁখা পরার চল নেই। বিবাহিত হওয়ার প্রমাণ হিসেবে নারীকে শাঁখা বা সিঁদুর পরে থাকতেই হবে, এমন মনোভাব সমর্থনযোগ্য নয়।’
কলকাতা হাইকোর্টের আইনজীবী অয়নাভ রাহা আবার জানাচ্ছেন, হিন্দু বিবাহ আইনে বিয়ের সময়ে সপ্তপদী ও তৎসংক্রান্ত আচার মানার কথা রয়েছে, তবে শাঁখা-সিঁদুরের কোনও উল্লেখ নেই। অসমের সাহিত্যিক অনুরাধা শর্মা পুজারী বলেন, ‘মহামান্য আদালত লিঙ্গসাম্য প্রতিষ্ঠা করে। মানবাধিকার রক্ষা করে। কিন্তু সেই আদালতই যদি বিয়ের চিহ্ন হিসেবে শাঁখা-সিঁদুর পরা বাধ্যতামূলক বলে মনে করে, তা দুর্ভাগ্যজনক।’