চারিদিকে সব্বাই গায়ে হলুদ মাখছেন কিন্তু তাও সাদা কালোয় সুশান্ত সিং রাজপুতকে রোজ মনে পড়ছে?ইদানিং ঘুম আসতে দেরি হচ্ছে? রোজ ওর ভুবনভোলানো হাসি মুখটা ঝলমল করছে তো চোখের সামনে? এপাশ ওপাশ, অনিচ্ছাকৃত ওর ছবি, ওর ভিডিও ক্লিক করা, সারাদিন কিরকম একটা মনখারাপ যেন, খারাপ চিন্তা…হচ্ছে তো?
স্বতঃস্ফূর্তভাবে এভাবেই বোধহয় জাতীয় শোক পালিত হয়। এভাবেই বোধহয় এক সমুদ্র সমান মনখারাপে ডুবতে ডুবতে দম রাখার চেষ্টা চলে। এভাবেই বোধহয় স্বজনহানির শোক পালন করে সহনাগরিক। এভাবেই বোধহয় মনুষ্যত্ব ঝালিয়ে নেওয়া হয় সম্মিলিত মনখারাপে। চেনা নয়, দেখা হয়নি কখনো অথচ মনে দাগ কেটে গেল কী সাংঘাতিক! সবটা কী ওর ফ্যান হিসেবে? না বোধহয়।
কারো অপঘাতে মৃত্যুর পরেই আমরা দুই এ দুই এ চার খুঁজি৷ প্রেমে দাগা খেয়েছিল? জটিল রোগ ছিল নাকি? নেশার ওভারডোস? ধারদেনা চলছিল তো? একের পর এক ব্যর্থতা? সাফল্য না আসা? রেপ কেস? পারিবারিক অশান্তি? ডিপ্রেশন? ডিপ্রেশনটা এখনো আমাদের প্রায়োরিটি লিস্টে শেষে থাকে৷
একটা ও মনমতো উত্তর না পেলে আমাদের অস্বস্তি বাড়ে। এর যে কোন একটা হলেই আসলে মনকে আশ্বাস দেওয়া যায়। “ইশ বেচারা” বলে move on করা যায়! সুশান্ত আসলে এটাই হতে দিচ্ছে না। তাই আমাদের গলার কাঁটা, বুকের পাথর হয়ে বসে আছে পাঁচদিন ধরে।
প্রেমিকা ছিল, এত্তোগুলো প্রাক্তন ছিল, সদ্য বানানো কোম্পানি ছিল, কোটি টাকা ব্যাংকে ব্যালেন্স ছিল, চোখ ধাঁধানো সিনেমা ছিল, মাসে চার লাখ টাকা ভাড়ার ফ্ল্যাট ছিল, তিন কোটির মাসেরাতি গাড়ি ছিল, চাঁদে কেনা জমি ছিল, অত্যাধুনিক টেলিস্কোপ ছিল, আদুরে পোষ্য ছিল, মধ্যবিত্ত পরিবার ছিল তাও এতো আগে জীবন শেষ করতে হলো। আসলে আমরা চিন্তিত সুশান্তকে নিয়ে না। নিজেদের নিয়ে। সুশান্তের মৃত্যুটা আমাদের বেঁচে থাকাটা প্রশ্নচিহ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে যেন, বাঁচা মরার কারণগুলো নিরর্থক করে দিচ্ছে যেন। এতো কিছু পাওয়ার পরে ও মরে যাওয়া যায়?
সুশান্ত অজান্তে আসলে আমাদের মনের রোদ্দুরটা শুষে নিচ্ছিল। ওই ফ্রুটির টেট্রাপ্যাক শেষ হওয়ার পরে ও পাইপ দিয়ে টানলে যেরকম আওয়াজ হয় সেরকম। ব্ল্যাক হোলের মতো সবটা আনন্দ, উচ্ছ্বাস কেড়ে নিচ্ছিল অজান্তে।
অনেকে খুব অসন্তুষ্ট, কেন দুদিন ডিপ্রেশন নিয়ে কথা বলে তৃতীয় দিন অন্য কিছু নিয়ে বলছি৷ এই যে সুশান্তের জন্য এতোগুলা আত্মহত্যা হলো তা নিয়ে কেন কোন কথা নেই। সুশান্তের মুখটা কেমন ছিল মৃত্যুকালে তার কেন কোন বিবরণ নেই। যেন সারাদিন এই অন্ধকারাচ্ছন্ন জিনিসগুলো নিয়ে কথা বললেই ডিপ্রেশন কমে যায়। যারা বলে বা ভাবে তাদের সুস্থতা কামনা করি৷ তারপর পজিটিভিটির ঝুল বারন্দায় এসে মনে রোদ পোয়াই৷ মনে এই কয়েকদিনে বড্ড স্যাঁতলা জমেছে। নৃশংসরকম ঠান্ডা, ফ্যাকাশে, দমবন্ধ একটা ঘুপচি ঘরের মতো।
আজ একটা লোককে দেখলাম গাড়িতে বসে এক পাখি বিক্রেতাকে ডাকলো। খাঁচায় যতোগুলো পাখি ছিল সবকটা পাখি কিনে উড়িয়ে দিলো এক এক করে, একটা সিগারেট ধরিয়ে সুখটান দিলো, তারপর সোজা ড্রাইভ করে বেড়িয়ে গেল। দুটো বাচ্চা দেখলাম কাদায় লুটোপুটি খাচ্ছে আর প্রাণ খুলে খিলখিল করে হাসছে। অপলক দৃষ্টিতে দিনের পর দিন তাকিয়ে ওদের হাসির শব্দ শোনা যায়। প্রথম বৃষ্টির ফোঁটার মতো কিছু বাচ্চা ভূমিষ্ট হয়েছে। পাশের বাড়ির বারান্দায় দুটো চড়াই পাখি খুনসুটি করছে আর একটা মেয়ে ফোনে খুব ঝগড়া করছে কারো সাথে। ভোরবেলা বেড়িয়ে দেখলাম স্কুলবাস থেকে একটা মেয়ে একটা মন্ড পাকানো কাগজ ছুঁড়ে দিলো একটা ছেলের দিকে তাক করে। রতনদা দেখলাম শত দারিদ্র, দুর্দশা কাটিয়ে আজ ও চায়ের দোকান খুলেছে, চারটে পেপার কিনে সাজিয়ে রেখেছে খদ্দের এলে পড়বে বলে। বাজারে ইলিশ উঠেছে, দুর্গা পুজোর আর কয়েক মাস বাকি।
জীবনটা দীর্ঘ না বড় হওয়া উচিৎ বাবুমশাই। ধুপ করে একদিন চলে যেতে হবেই। তার মাঝে যার যতটুকু সময় সুযোগ আছে, আসুন না প্রাণ খুলে বাঁচি৷ আপ্রাণ চেষ্টা করি রোজ ফুরফুরে এক রোদের জন্মদিন উদযাপন করতে৷ রোজ মনের উষ্ণতা কোথায় তার খোঁজ করি।
অর্থ চুরি যাক, গান চুরি যাক, গল্প চুরি যাক, প্রেম চুরি যাক, নোবেল চুরি যাক, পুকুর চুরি যাক কিন্তু মনের রোদটা যেন চুরি না যায়। ওটা থাকলে বাকি সব চারাগাছ থেকে মহীরুহ সমান হবার স্পর্ধা রাখে। জীবনের প্রতি ভরসা রাখে।
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত