করোনা মহামারী সংকটজনক আকার ধারণ করেছে। এই পরিস্থিতি কাটাতে চলছে নানা আলোচনা। নেওয়া হয়েছে বিভিন্ন পরিকল্পনা। এই সংকটকাল আগে কাটুক, রাজনীতি পরে হবে। এমনটাই কাম্য। কিন্তু হচ্ছে কই?
‘বিশ্বের বৃহত্তম রাজনৈতিক দলের’ বেঙ্গল ইউনিট একজোট হেয়েছে। এই মহামারীর সময়েও ভুয়ো খবর ও গুজবের ওপর ভিত্তি করে তারা বাংলার সরকারের উপর ধারাবাহিকভাবে হামলা করে চলেছে। দিল্লীর প্রবীণ নেতা এবং মন্ত্রীরা এখনও এতে যোগদান করেননি। কিছু বলেনওনি। এভাবে তাঁরা তাঁদের বাংলা ইউনিটকে আশীর্বাদ করছেন কিনা সেটা আপনারা ঠিক করুন।
আমরা যত্নের সঙ্গে নিজেদের কাজ করছি বাংলায়। বাংলার করোনা আক্রান্তের সংখ্যা অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় ভাল জায়গায় রয়েছে এই কাজের জন্যেই। আমরা এ জন্য এই কঠোর পরিশ্রম করেছি। কঠোর প্রস্তুতি নিয়েছি। এখনও কাজ করতে হবে এবং আত্মতৃপ্তির কোনও জায়গা নেই। তবুও, গুজব এবং ভুয়ো খবরের প্রতিক্রিয়া জানাতে হবে – তথ্য, পরিসংখ্যান এবং জনস্বাস্থ্যের যুক্তি দিয়ে।
সবমিলিয়ে বাংলার বিরুদ্ধে ৪ রকমের অভিযোগ উঠছে। যার সবকটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত। অভিযোগগুলি হল –
১। কোভিড ১৯ মোকাবিলায় কাজ শুরু করতে রাজ্য সরকার দেরি করেছে।
২। এই ব্যাপক মহামারী সামলাতে রাজ্য সরকার প্রস্তুত নয়।
৩। করোনা সন্দেহ রোগীদের প্রয়োজনীয় টেস্ট হচ্ছে না।
৪। করোনায় মৃতদের তথ্য লুকনো হচ্ছে বাংলায়।
এবার এই অভিযোগগুলো নিয়ে একে একে বিস্তারিত আলোচনা করা যাক।
বাংলা কি দেরিতে জেগেছে? বাস্তব হল, ৬ মার্চ, হু করোনাকে প্যানডেমিক ঘোষণার আগেই এই নিয়ে সাংবাদিক সম্মেলন করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তৈরি করেছেন কুইক রেসপন্স টিম। আন্তর্জাতিক বিমান পরিষেবা বন্ধের জন্য আবেদন জানিয়েছেন। ৩টি প্রতিবেশী দেশের সীমানা ভাগ হচ্ছে বাংলার সঙ্গে, স্বাভাবিকভাবেই এই সিদ্ধান্ত বাংলার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পাশাপাশি প্রত্যেক জেলায় আইসোলেশন সেন্টার খুলেছে বাংলার সরকার।
কলকাতায় যখন এইরকম দৃঢ় সংকল্প দেখা গেছে, ভারত সরকার কিন্তু তখনও এই পরিস্থিতিকে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করেনি। মধ্যপ্রদেশে সরকার গঠনেই ছিল তাদের যাবতীয় লক্ষ্য। আমরা মার্চের প্রথম দিকে এই ইস্যুতে সংসদে সরব হয়েছি। কয়েকদিন পরেই, চিকিৎসকরা যে ২০ সেকেন্ডের ‘হ্যান্ডওয়াশ টেকনিক’ পালনের পরামর্শ
দিয়েছিলেন তা প্রদর্শনের অনুমতি চেয়ে আমি জিরো আওয়ারে নোটিস দিয়েছিলাম। কিন্তু তা গৃহীত হয়নি। তারপরে, মার্চের মাঝামাঝি, সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসাবে আমরা মাস্ক পরে সংসদে গিয়েছিলাম। তখন এটাকে ‘গিমিক’ বলে আমাদের উপহাস করা হয়েছিল।
ইতিমধ্যে বাংলায় আমরা বসে থাকিনি। একের পর এক সতর্কতামূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। শুধু মার্চ মাসেই ৫৮২ টি কোয়ারেন্টাইন সেন্টার খোলা হয়েছে। আক্রান্ত ব্যক্তিদের শনাক্ত এবং পৃথক করার জন্য কার্যকরি পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এতে সংক্রমণের বিস্তার কমেছে।
বাংলায় লকডাউনের মানবিক ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি পরীক্ষা, সামাজিক বিচ্ছিন্ন করা এবং চিকিৎসার উপর জোর দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি অর্থনীতি যাতে স্থায়ীভাবে ক্ষতিগ্রস্থ না হয় তাও নিশ্চিত করা হয়েছে। বাংলার প্রায় ৬৮ হাজার মানুষ হয় আক্রান্ত দেশ থেকে এসেছিলেন নয়তো করোনা আক্রান্ত রোগীর সংস্পর্শে এসেছিলেন। তাঁদের প্রত্যেককে অর্থাৎ ৬৮ হাজার মানুষকে কোয়ারেন্টাইনে পাঠানো হয়েছে।
এবার ৩ নম্বর পয়েন্ট, টেস্টিং। রাজ্য সরকার নিজে টেস্টিং কিট আমদানি করে না। একমাত্র কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রকের আওতাধীন আইসিএমআর-ই কিট আমদানি ও প্রেরণ করতে পারে। প্রাথমিক পর্যায়ে খুব অল্প কিট সরবরাহ হয়েছিল। এবং এ ব্যাপারে আইসিএমআর সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ রাজ্যগুলিকেই অগ্রাধিকার দিয়েছিল। বাংলা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থদের মধ্যে ছিল না কারণ রাজ্য সরকার এই ভাইরাস যাতে না ছড়ায় সে ব্যাপারে গুরুত্ব দিয়ে কাজ করেছিল। ফলে পর্যাপ্ত পরীক্ষার কিট বাংলা পায় নি। আর এ কারণেই নির্দিষ্ট কিছু রাজ্যের টেস্টিং সংখ্যা বেশি। উপযুক্ত প্রস্তুতির কারণে বাংলা এই সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়েছে।
পরবর্তী সময়ে, কেন্দ্রীয় সরকার বিদেশ থেকে ৭ মিলিয়ন টেস্টিং কিট অর্ডার করে। সেগুলি এখন দেশে আসতে শুরু করেছে। অর্ডার ও সংগ্রহের ক্ষেত্রে বিলম্ব হওয়ার কারণেই রাজ্যগুলিকে টেস্টিং কিট সরবরাহ করতে দেরি করেছে কেন্দ্র। অনুমান করুন, ৩১ শে মার্চ অবধি বাংলা কটা টেস্টিং কিট পেয়েছে? মাত্র ৪০ টি।
করোনা লক্ষণজনিত রোগীদের পরীক্ষার জন্য একটি কঠোর নির্দেশিকা জারি করেছিল আইসিএমআর। যার ফলে টেস্টিং প্রক্রিয়াটি আরও ঢিমেতালে এগিয়ছে। অনেক পরে, সেই নির্দেশগুলি পরিবর্তন করা হয়। বাংলাও তা কাজে লাগিয়ে আরও বেশি ল্যাবে পরীক্ষা শুরু করে। ক্লিনিকাল কর্মীদের প্রশিক্ষণ দেয়। প্রাথমিকভাবে দুটি থেকে, বাংলায় কেন্দ্র অনুমোদিত পরীক্ষাগারের সংখ্যা ৭ টিতে উন্নীত করা হয়েছে।
অবশেষে, আমরা করোনা আক্রান্ত এবং মৃত্যুর সংখ্যায় আসি। কোভিড ১৯ সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্যে সম্পূর্ণ স্বচ্ছতা রয়েছে বাংলায়। আক্রান্তের সংখ্যা থেকে মৃত্যুর হিসাব – সবকিছু পাবলিক ডোমেনে রাখা হয়েছে। এটি সত্য যে, কোনও রোগীর মৃত্যু করোনায় হয়েছে না অন্য রোগে, তার সঠিক কারণ নির্ধারণের জন্য বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা হয়েছে। মনে রাখতে হবে, এই বিশেষজ্ঞ কমিটিটি রাজনীতিবিদ বা আমলা নন, চিকিৎসকদের নিয়ে গঠিত। করোনা আক্রান্ত নির্ধারণের প্রতিষ্ঠিত নীতিমালার সঙ্গে মিলিয়েই এই টেকনিক্যাল কমিটি গঠন করা হয়েছে। কোনও রোগী কোভিড ১৯-এ নাকি অন্য কোনও রোগে মারা গেছেন তা নির্ধারন করতে পারে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটিই। ফলে করোনায় মৃত্যু নিয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করার কোনও সুযোগ থাকছে না।
এ ব্যাপারে হরিয়ানার একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। প্রায় এক সপ্তাহ আগে, গুরুগ্রামের একটি হাসপাতালে একজন প্রবীণ ইতালিয়ান পর্যটক, যিনি কোভিড ১৯-এর পরীক্ষা করেছিলেন, তিনি মারা যান। রাজ্যের স্বাস্থ্য আধিকারিকরা জানিয়েছেন, ওই ব্যক্তি কোভিড -১৯ থেকে সুস্থ হয়ে যান এবং হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। স্বাস্থ্য আধিকারিক এবং চিকিৎসকরা বিশেষজ্ঞ। আমি তাদের বিশ্বাস করি। যদি কেউ বিজেপি-শাসিত হরিয়ানায় তাদের বিশ্বাস করতে পারে তবে তৃণমূল শাসিত বাংলায় কেন নয়?
(তৃণমূলের রাজ্যসভার দলনেতা তথা প্রধান জাতীয় মুখপত্র)
মতামত ব্যক্তিগত