আলোকচিত্রী হিসেবে কাজ করার সামান্য অভিজ্ঞতা থেকে জানি ঝড়, বৃষ্টি, দুর্বিপাক, মন্বন্তর, মহামারি, কার্ফুর মধ্যে দায়িত্বে অবিচল থেকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করে চলেন সাংবাদিক ও চিত্রসাংবাদিকরা। বিশেষ করে চিত্রসাংবাদিকদের কাজ এই দিনগুলিতে যেন আরও বেড়ে যায়। তাদের ছবিগুলি হয়ে ওঠে সময়ের দলিল। করোনার সময়েও এই ঘটনা ঘটছে। কিন্তু তা করতে গিয়ে যদি প্রশ্রয় পায় অতিরিক্ত নাটকীয়তা কিংবা পরিস্থিতি যা নয় সেটাকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে দেখানো তাহলে চিত্রসাংবাদিক স্বধর্ম থেকে বিচ্যুত হন। তাকে মনে রাখতে হবে তার ছবিটাই কিন্তু করোনার সময়ের অবস্থার একটা প্রামান্য নথি হয়ে থাকবে। আজ আনন্দবাজার ও এইসময় কাগজের দুটি ছবি দেখে আমার কথাগুলি মনে এল। দুটি জায়গাতেই চিত্রসাংবাদিকতার শর্ত লঙ্ঘিত হয়েছে বলে আমার বিশ্বাস।
আনন্দবাজারে প্রকাশিত ছবিটিতে দেখানো হয়েছে একজন খাবার খাচ্ছেন। ছবিটি দেখে মনে হয় শহরের রাজপথে যেন এখন এমন ক্ষুধার্ত মানুষের ভিড়। মানুষটি আদতে একজন ভবঘুরে ভিক্ষুক। রাজপথে এমন কিছু মানুষকে সবসময় দেখা যায়। এরসঙ্গে করোনার কী সম্পর্ক? দলমত নির্বিশেষে সবাই একথা স্বীকার করছেন যে করোনার সময়ে কলকাতা আবার ফিরে পেয়েছে তার চিরকালের মানবিক চেহারা। পাড়ায় পাড়ায় মানুষ নেমেছেন দুঃস্থ অসহায় মানুষদের মানবিক পরিষেবা দেওয়ার কাজে। একটি লোকও এখানে অনাহারে নেই। মানুষ কোন না কোনভাবে পাশে গিয়ে দাঁড়ায়নি এমন পরিবার খুঁজে পাওয়া কঠিন। আমি নিজে প্রতিদিন শহর ও সংলগ্ন জেলাগুলি ঘুরছি। যতটা সম্ভব মানুষের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছি। আমার চোখেও এমন কিছু পড়েনি। অথচ ছবিটা দেখে কিন্তু তাই মনে হচ্ছে। স্রেফ একটা ছবির জন্যই যেন ভবঘুরে মানুষটিকে করোনা দুর্গত সাজানো হল।
এবার বলি আজ এইসময় এ প্রকাশিত একটি হিউম্যান স্টোরির সঙ্গে প্রকাশিত একটা ছবির কথা। হাওড়া পঞ্চায়েতের সদস্য নুরজ মোল্লার করোনা ভাইরাস মোকাবিলায় দিনরাত জীবাণুনাশের কাজ স্টোরিটির বিষয়। কাজে ব্যস্ত থাকার জন্য তিনি তার সদ্যজাত সন্তানটির মুখও দেখতে পারেননি। কারণ তিনি তখন হাওড়ার বাঁকড়ায় একের পর এক বাড়িতে স্যানিটাইজেশনের কাজ করছেন। সত্যি তাকে কুর্নিশ করতে হয়। এমন স্টোরি খারাপ সময়েও আমাদের সবার মন ভালো করে দেয়। কিন্তু সদ্যজাত শিশুটির ছবি দেখে আমার মন খারাপ হয়ে গেল। কারণ এ সময় ছবি তোলা তো দূরের কথা কোন শিশুর সামনেই আলোকচিত্রীর যাওয়া উচিৎ নয়! এমনকি মোবাইলধারী উৎসাহী আলোকচিত্রীদেরও একাজ থেকে বিরত করতে হবে। এই ছবি তুলে তো যিনি পৃথিবীকে অন্য শিশুদের বাসযোগ্য করে তুলতে চাইছেন সেই নুরজকেই অসন্মান করা হল।
দায়িত্ব এড়াতে পারেন না সংশ্লিষ্ট কাগজদুটির সম্পাদকীয় দপ্তরের ভারপ্রাপ্ত কর্মীরাও। তারাই তো ছবি দুটি ছেপেছেন। করোনায় মানুষের অবস্থা, স্বাস্থ্যবিধি পালন সম্পর্কে তাদেরও তো যথেষ্ট ধারণা রয়েছে। আসলে চমকপ্রদ কিছু করে দেখানোর বাসনায় এমন ছবি তোলা হয় এবং তা ছাপাও হয়ে যায়। শুধু মানুষের মনে একটা ভুল ধারণার সৃষ্টি হয়। কিছু চ্যানেলে ব্রেকিং নিউজের নামে এমনভাবে সংবাদ পরিবেশন করা হচ্ছে যাতে আশ্বস্ত হওয়ার বদলে আতঙ্ক সৃষ্টি হচ্ছে। মানছি করোনা একটা ভয়ঙ্কর রোগ। আমাদের অভিজ্ঞতার বাইরের ব্যাপার। তবুও তো আমরা পরিস্থিতির মোকাবিলা করছি। অবস্থা এখনও আয়ত্বের বাইরে যায়নি। কিন্তু এধরণের ছবিগুলি সেই প্রচেষ্টাকে ব্যহত করতে পারে। এটা মনে রাখলেই ভালো হয়।
নিজে আলোকচিত্রী, তাই বলছি আমরাই পারি আমাদের ছবিতে করোনা পরিস্থিতিকে সবচেয়ে ভালোভাবে ধরে রাখতে। ভবিষ্যতে করোনায় শহরের কেমন চেহারা হয়েছিল তার প্রামাণ্য দলিল হিসেবে আমার বন্ধু ও সহযাত্রীদের ছবিগুলির খোঁজ পড়লে আমিই সবথেকে বেশি খুশি হবো।
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত