বড়াে যন্ত্রণা নিয়ে শেষ হলাে আমার এই কুমায়ুন যাত্রা।এই যন্ত্রণা মনেতে,দেহতে নয়। প্রথমে কাঠগােদাম সেখান থেকে রানীবাগ এ ফিয়েস্তা হােটেলে পৌঁছালাম,এটা পাহাড়ের উপরে অবস্থিত।এখানে দুপুরে খাবার খেলাম ও নৈনিতাল এর উদ্দেশে রওনা হলাম।১ ঘন্টা ৩০ মিনিট জার্নি করে ৩২ কিমি ড্রাইভ করে নৈনিতাল লােকের উপর দাঁড়িয়ে থাকা খুব সুন্দর লােকেশন এ হােটেল শালিমার এ বিকেল ৫টাতে পৌছালাম।কথিত আছে সতীর দেহ আর দেবীর নয়ন জোড়া এসে পড়ে এই স্থানে।এবং তার ফলেই সৃষ্টি হয় নয়নাকৃতি এই বিশাল লেক।তাই এই লেকের নাম নৈনিতাল ও পাশের নয়নাদেবীর মন্দির।
জিম করবেট এর শহর নৈনিতাল।নৈনিতাল শহরে তার জন্ম হয়।ভিক্টোরিয় যুগে এখানে মূলত ইংরেজ প্রশাসকগণই এই পাহাড়ি শহরটিতে বাস করতেন।এখানকার বিভিন্ন স্থাপত্যে এর ছাপ আজও রয়ে গেছে।
লেকের উপর যেন হােটেল টা দাঁড়িয়ে আছে।ভাড়া ১২৫০ টাকা DAB।পরদিন নৈনিতালের আশপাশ তাল্লিতাল,নইনি মন্দির,কেভ গার্ডেন টিফিনটপ,ভিউ পয়েন্ট,সাত্তাল,ভীমতাল এই সব সাইট সিন করে তৃতীয় দিন ১২০ কি মি অতিক্রম করে এলাম কৌশানি,এখানে শিভয় হােটেল ১২০০ টাকা প্রতি দিন প্রতি দুজনের হিসাবে থাকলাম।কৌশানির কথা আর কি বলবাে,এখানকার সূর্যোদয় যে অতি প্রতি দুজনের হিসাবে থাকলাম।কৌশানির কথা আর কি বলবাে,এখানকার সূর্যোদয় যে অতি মনােরম তা সকলেই জানে।আমি সকাল ৫ টা নাগাদ আমার ছােট্ট ব্যাগটি পিঠে ঝুলিয়ে বেরিয়ে পড়লাম,আমার সঙ্গী হলাে হােটেলের রাতের চার পেয়ে প্রহরী ‘শেরু।রাস্তাঘাট সুনসান,একটা জনমানব রাস্তায় নেই,শুধু আমি আর শেরু।এর আগে গান্ধী আশ্রম থেকে সূর্যোদয় দেখেছিলাম এবার তাই ঠিক করলাম একটা নতুন জায়গা থেকে সূর্যের জেগে ওঠার মুহুর্তগুলাে ক্যামেরা বন্দি করবাে।৫.৩০ মানে পাহাড়ে অন্ধকার,ঠান্ডা বেশ ভালােই লাগছিলাে,ব্যাগে ফ্লাস্কে চা ছিল,চা খেতে খেতে ভাবছিলাম,বছর ২৫ আগে এই কৌশানি তে যখন এসেছিলাম তখন এখানে কিছুই ছিলােনা।সেদিনের সেই হারিয়ে যাওয়া কলেজের বন্ধুরা আর আমার ছােট্ট ছেলেটা তাদের কথা মনে পড়ছিলাে।ছেলেকে খুব মিস করছিলাম।ও আমার খুব ভালাে বন্ধু।এখন বড় হয়েছে,অনেক দায়িত্বের কাজ করে তাই যখন তখন এই বুড়াে বুড়ির সাথে আসতে পারেনা।বাচ্চারা ছােট বয়সে যেমন অপেক্ষায় থাকে,কখন বাবা অফিস থেকে বাড়ি আসবে,তেমনি বৃদ্ধ বয়সে বাবা মা কেও অপেক্ষায় থাকতে হয় কখন সন্তান বাড়ি ফিরবে।এ এক অদ্ভুত প্রতিমুহুর্ত।
এর মধ্যে পূর্ব আকাশ ফর্সা হলাে আর উত্তরের আকাশে একটা সদ্য নিভে যাওয়া দেশলাই কাঠির বারুদের মাথার মতাে একটু বড় আগুনের বিন্দু দেখতে পেলাম।এটাই হিমালয়ের বুকে দাঁড়িয়ে থাকা ত্রিশুল,কমেট ও পঞ্চচুল্লি এর রেঞ্জ।ধীরে ধীরে সব কটা চূড়া ভেসে উঠলাে।রক্তিম হয়ে ওঠা হিমালয়ের রেঞ্জ দেখে আমি মুগ্ধ নয়নে।মহাদেবের হাতে ধরা ত্রিশুল দেখছিলাম।
একদম চোখের সামনে,হাত ছোঁয়া দূরত্বে যেন দাড়িয়ে আছে আমাদের দিকে তাকিয়ে।একসময় কৌশানির একমাত্র আশ্রয় ছিল গান্ধি আশ্রম বা অনাসক্ত আশ্রম।এখানে কিছুটা কম খরচে থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা আছে।ফোন – ০৫৯৬২২ ৫৮০২৮।এছাড়া কুমায়ুন মণ্ডল বিকাশ নিগমের রেস্টহাউস।ফোন – ০৫৯৬২ ২৫৮০০৬ ।প্রাইভেট হােটেলও অনেকগুলাে আছে তবে এখনও ভােরের সূর্যোদয় দেখতে গান্ধি আশ্রমের সবাই আসে।১৯২৯ সালে মহাত্মা গান্ধি কৌশানি এসেছিলেন।এর রূপে মুগ্ধ হয়ে গান্ধীজি কৌশানিকে আখ্যা দিয়েছিলেন ‘দ্য সুইজারল্যান্ড অব ইন্ডিয়া’।হােটেলে ফিরলাম।স্নান ও ব্রেকফাস্ট করে বেরিয়ে পড়লাম চৌকরির উদ্দেশ্যে,বাগেশ্বর হয়ে ৮৬ কিমি পেরিয়ে ৫ ঘন্টায় চৌকরি পৌছালাম।হােটেল শিখর রাজ এ উঠলাম।DAB প্রতি দিন ১২০০ টাকা।এখানে KMVN এর টুরিস্ট লজটা ভীষণ সুন্দর,লন জুড়ে ৮খানা কটেজ ও মূল লজেও অনেকগুলাে রুম আছে।ভাড়া ২৩০০ থেকে ৪০০০ টাকা ঘর প্রতি,দিন প্রতি।
বিকেল থেকে সন্ধ্যা অবধি লন চেয়ার এ বসে পকোড়া চা ও কফি নিয়ে জমিয়ে আড্ডা সাথে জমাট ঠান্ডা।আর হিমালয়ের সৌন্দর্যএর কথা কি আর বলবাে আকাশ পরিষ্কার থাকায় সন্ধ্যাতেও মনে হচ্ছিলাে কামধেনু যেন তার দুগ্ধ ধারায় হিমালয়কে স্নান করাচ্ছে।হিমালয় এ এর আগে এতাে সাদা চেহারায় পাইনি।কুমায়ুন যেন প্রকৃতির এক অভূতপূর্ব দৃশ্যের কোলাজ।
পরদিন সকালে ৩৫কিমি ড্রাইভ করে দুঘন্টায় পৌছালাম পাতাল ভুবনেশ্বর।৯০ফুট গভীরে ৮২তা ধাপ পেরিয়ে পাতাল স্বর্গ।এখানে সত্যি নাকি ভগবান থাকেন।তিন ফুট সুড়ঙ্গতে কি করে মানুষ নামে তা চোখে না দেখলে বিশ্বাস হয়না।আমি ওই সুড়ঙ্গে যেতে পারিনি তবে আমাদের টিমের দুই মহিলা সাথী নেমে ছিল।সত্যি সাহসী বটে এরা। আশপাশের গাছ থেকে তখন রাতপাখির আড়মোড়া ভাঙার শব্দ। দূরে পাহাড়ে একটা-দুটো করে জ্বলজ্বলে তারা নেমে আসছে। কুমায়ুন পাহাড়ের কোলে, সবুজের ছায়া ধরে ধাবমান উচ্ছল জলধারা। ইট, কংক্রিট আর ধুলোর জগতে ফেরার আগে, রোমকূপে ভরে নিলাম হিমালয়ের শীতল স্পর্শ।