১৮৬০ সাল। শীতের প্রারম্ভে বৃক্ষ থেকে খসে পড়া পাতার মতন তখন অনবরত চিঠি আসছে মধুসূদনের কাছ থেকে। বিদ্যাসাগরকেই তখন একমাত্র অবলম্বন করেছেন মধুসূদন, প্রবাসে গ্রহ-বৈগুণ্যে বিষম দারিদ্র্য ও অসহায় অবস্থার মধ্যে পড়ে তিনি বুঝেছেন, ঐ জেদী ব্ৰাহ্মণটি শুধু বিদ্যার সাগর নন, করুণাসাগরও বটে। আর যাঁদের তিনি বন্ধু বলে মনে করেছিলেন, তাঁরা সবাই বিমুখ করেছেন, একমাত্র বিদ্যাসাগরের কাছ থেকেই সাহায্য এসেছে বিনা শর্তে।
রাজা দিগম্বর মিত্র ছিলেন মধুসূদনের বাল্য সুহৃদ, দেশের বিষয়সম্পত্তির ব্যাপারে মধুসূদন তাঁর ওপরেই নির্ভর করেছিলেন সবচেয়ে বেশী, সেই দিগম্বর মিত্রই তাঁর সর্বনাশের পথ সুগম করেছিলেন। অর্থ প্রেরণ করা তো দূরের কথা, একটা চিঠিরও উত্তর তিনি দিতেন না। অথচ এই রাজা দিগম্বর মিত্রকেই তিনি মেঘনাদবধ কাব্য উৎসর্গ করেছিলেন!
স্ত্রী-পুত্র-কন্যাকে দেশে রেখে একাই লণ্ডনে পাড়ি দিয়েছিলেন মধুসূদন। স্ত্রী হেনরিয়েটার সংসারের ভরণপোষণের জন্য যে অর্থ বরাদ করে দিয়ে গিয়েছিলেন সম্পত্তির পত্তনীদারদের কাছে, তাঁরা সে অর্থ নিয়মিত দিত না। তাই নিরুপায় হয়ে হেনরিয়েটা পুত্র-কন্যাকে নিয়ে চলে গেলেন লণ্ডনে। বিপদ তাতে বৃদ্ধি পেল শতগুণ। মধুসূদনের ব্যারিস্টারি পড়ার ব্যয় ছাড়াও এত বড় একটি সংসার চালানো একেবারে অসম্ভব হয়ে পড়লো। নিতান্ত খাদ্যচিন্তা ছাড়া আর কোনো চিন্তার অবকাশ রইলো না। ইংল্যান্ডের তুলনায় ফরাসী দেশে জীবনধারণ-ব্যয় কিঞ্চিৎ কম বলে মধুসূদন সদলবলে চলে এসেছিলেন ভার্সেই তে। কিন্তু যখন হাতে একটি মুদ্রাও থাকে না, তখন কোন দ্রব্যের মূল্য কত সে বিচারে লাভ কী? অবস্থা পৌঁছলো একেবারে চরমে। শিশু পুত্র-কন্যা অনাহারের কষ্টে রোদন করে, পিতা হয়ে মধুসূদনকে তা দর্শন করতে হয়। তিনি রাজনারায়ণ দত্তের পুত্র, মুখে সোনার চামচ নিয়ে যাঁর জন্ম, যিনি যৌবনে-কৈশোরে খোলামকুচির মতন দু হাতে মুদ্রা ছড়িয়েছেন, তখন তাঁর নিজ সন্তান-সন্ততির এই দশা! যদিও তখনও দেশে তাঁর যথেষ্ট সম্পত্তি ছিল, সুন্দরবনের এক আবাদ থেকেই বার্ষিক আয় হত দশ সহস্ৰ মুদ্রা। কিন্তু, শুধু স্বদেশবাসীর বিশ্বাসঘাতকতায় বিদেশে তিনি মরণাপন্ন হলেন। ‘দত্ত কারো ভৃত্য নয়’, এই দম্ভোক্তি যাঁর মুখে সর্বদা শোনা যেত, তখন সেই তাঁকেই সামান্য ভিখারীর মতন চ্যারিটেবল সোসাইটিতে গিয়ে হাত পাততে হয়।
নিজস্ব জিনিসপত্র বিক্রয় ও বন্ধকী দিতে দিতে আর কিছুই বাকি ছিল না। নবীনকুমার সিংহ প্রদত্ত একটি রৌপ্য পাত্র ছিল মধুসূদনের অতি প্রিয়, সেটি শেষ পর্যন্ত রেখে দিয়েছিলেন। স্বদেশে তাঁর কাব্য রচনার স্বীকৃতিতে একমাত্র সংবর্ধনা সভায় তিনি এটা পেয়েছিলেন। তবু একদিন সেটিকেও তাঁকে নিয়ে যেতে হয়েছিল বন্ধকী দোকানে। সেটির বিনিময়ে যে অর্থ পাওয়া গিয়েছিল, তাতে পুত্র-কন্যাদের কয়েকদিনের দুগ্ধের খরচ সঙ্কুলান হয়েছিল।
অন্য সকলের কাছ থেকে হতাশ হয়ে তারপরই মধুসূদন সাহায্যের আবেদন করেছিলেন বিদ্যাসাগরের কাছে। কিন্তু এমন যে অপ্রত্যাশিত ফল হবে, তিনি তা স্বপ্নেও আশা করেন নি। কোনো রকম জামিন ছাড়াই তাঁকে টাকা পাঠিয়েছিলেন বিদ্যাসাগর। কলকাতায় তখন এত সব মহা মহা ধনী ব্যক্তি, তাঁদের তুলনায় বিদ্যাসাগর কী আর! অতি লোভনীয় সরকারী চাকুরি ছেড়ে দিয়ে বসে আছেন বিদ্যাসাগর, তখন তাঁর যাবতীয় আয় শুধু গ্ৰন্থ বিক্রয় থেকে। জমিদার বা ধনীরা কেউ নয়, গদ্য গ্ৰন্থকার বিদ্যাসাগরই শুধু সাহায্য করেছিলেন কবি মধুসূদনকে। কিন্তু তাতেও যে চলে না। বিদ্যাসাগরের কাছ থেকে দুই তিন সহস্র টাকা আসত, আর দু-এক মাসের মধ্যেই তা উড়ে যেত। তখন আবার তাঁকে লিখতে হত কাকুতি-মিনতিপূর্ণ পত্র। তখন মধুসূদনের সমস্ত প্রতিভা নিয়োজিত হয়েছিল করুণা-নিষ্কাষণী পত্র রচনায়। বিদ্যাসাগরকে খুশী করবার জন্য তিনি ইংরেজি চিঠির মধ্যে মধ্যে কয়েক ছত্র লিখতেন বাংলা অক্ষরে, বিদ্যাসাগর ভারতচন্দ্রের কাব্য পছন্দ করতেন বলে প্রায়ই ভারতচন্দ্রের রচনার উদ্ধৃতি দিতেন। ফ্রান্সের শীতের বর্ণনা দিতে গিয়ে ভারতচন্দ্রের ভাষায় বলেছিলেন, ‘বাঘের বিক্রম সম মাঘের হিমানী’। বিলাতি পত্র-পত্রিকায় কখন কোথায় বিদ্যাসাগর সম্পর্কে সংবাদ প্ৰকাশিত হয়, সে খবরও জানতেন সাগ্রহে। একদিন প্যারিসের এক দোকানে দেখেছিলেন বিদ্যাসাগরের লেখা কয়েকটি বই। দারুণ গর্ব হয়েছিল মধুসূদনের। দোকানদারকে বলেই ফেলেছিলেন, এই লেখক আমার বিশিষ্ট বন্ধু। তাই শুনে দোকানদার বলেছিলেন, ‘এই লেখক এখন জীবিত নেই!’মধুসূদন আঁতকে উঠে বলেছিলেন, ‘কী সাঙ্ঘাতিক কথা! না, না, তাঁর দেশ এবং তাঁর সুহৃদরা তাঁর বিয়োগ সহ্য করতে পারবেন না।’
সনির্বন্ধ পত্র প্রেরণ করলে বিদ্যাসাগর ঠিক নির্দিষ্ট সময়ে টাকা পাঠাবেনই, এরকম একটা সংস্কারের মতন বদ্ধমূল বিশ্বাস শেষপর্যন্ত হয়ে গেল মধূসূদনের। তখনকিছুদিনের জন্য তিনি সপরিবারে এসে রয়েছেন ভাসাঁই নগরীতে, বিদ্যাসাগর প্রেরিত অর্থ দ্রুত নিঃশেষিত হতে চলেছে, আবার সাহায্যের আবেদন করে পাঠানো হয়েছে পত্র।
এক সকালে মধুসূদন কিছু পড়াশুনোর চেষ্টা করছেন, এমন সময় হেনরিয়েটা অশ্রুপরিত নয়নে এসে বললেন, ‘আর যে পারি না! এভাবে আর কতদিন বেঁচে থাকতে হবে!’ নতুন কী আবার হলো? ব্যাপার অতি সামান্য, কিন্তু বড়ই মর্মভেদী। তাঁদের বাসগৃহের সন্নিকটেই ধুমধাম করে একটি বেশ বড় মেলা বসেছে। পল্লীর সব শিশুরা ছুটে চলেছে সেদিকে। তাই দেখে হেনরিয়েটার পুত্র-কন্যাও সেই মেলায় যাবার জন্য বায়না ধরেছে। অবোধ শিশু, ওদের কীভাবে নিরস্ত করা যাবে? কিছু না ভেবেই মধুসদন বললেন, ‘যাবে না কেন, যাক না। মেলা দেখে আসুক।’ হেনরিয়েটার বিলাপ উচ্চতর হলো। তাঁর হাতে রয়েছে মাত্র তিন ফ্রাঁ, তা দিয়ে কিছু কেনাকাটা তো দূরের কথা, মেলার প্রবেশ মূল্যই যে ওর চেয়ে বেশী।একটুক্ষণ গুম হয়ে বসে রইলেন মধুসূদন। তিনি অক্ষম পিতা, আজ প্রাতে নিজের সন্তানদের মুখে হাসি ফোটাবার মতন সাধ্য তাঁর নেই। উপায়ান্তর না দেখে তিনি বলে উঠলেন এক সময়, ‘একটু অপেক্ষা করো, দেখো, আজই নিশ্চিত বিদ্যাসাগরের নিকট থেকে অর্থ এসে পৌঁছোবে! তিনি কি যে সে মানুষ! তাঁর প্রতিভা ও প্রজ্ঞা প্রাচীন ঋষিদের মতন, তাঁর কর্মোদ্যম ইংরেজদের মতন আর তাঁর হৃদয়খানি বাঙালী মায়ের মতন! তিনি ঠিকই বুঝবেন!’ এমনই কাকতালীয় যোগাযোগ, এক ঘণ্টার মধ্যেই ডাকে এলো বিদ্যাসাগরের এনভেলাপ, তার মধ্যে দেড় হাজার টাকা!
নিয়মিত বিদ্যাসাগর প্রেরিত অর্থে মধুসূদন সাংসারিক অনটন কিছুটা সামলে উঠে আবার পড়াশুনোর কথা ভাবতে লাগলেন। ইতিমধ্যে কয়েকটি ভাষা শিক্ষা করেছিলেন শখ চরিতার্থ করবার জন্য, কিন্তু তাতে তো উদরান্নের সংস্থান হবে না! অনিশ্চিতকাল ধরে প্রবাসে থাকাও সম্ভব নয়, আর দেশে ফেরার আগে ব্যারিস্টারি পাশ না করলে ফিরে গিয়েও তো সেই একই অবস্থায় পড়তে হবে।
দেবেন্দ্রনাথ পুত্র সত্যেন্দ্র সসম্মানে আই সি এস পরীক্ষায় পাশ করে সকলকে চমকিত করে দিয়েছিলেন। সাহেবদের সঙ্গে পরীক্ষা দিয়ে তিনিই প্রথম ভারতীয় আই সি এস হন। সত্যেন্দ্ৰ যথেষ্ট মেধাবী ছিলেন বটে, তা ছাড়া ধনীর সন্তান, তাঁকে পড়াশুনোর সময় অর্থচিন্তা করতে হয়নি। সত্যেন্দ্রনাথের এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার পরে একটা খবরও রটেছিল যে, সত্যেন্দ্ৰ আই সি এস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ায় ইংরেজ কর্তৃপক্ষ নাকি শঙ্কিত হয়ে ঐ পরীক্ষার মান আরও কঠিন করার কথা চিন্তা করছেন। ভারতীয়রা করবে ইংরেজদের সঙ্গে সমান পদে চাকুরি!
মধুসূদন সেটা শুনে ভয় পেলেন, তা হলে কি ব্যারিস্টারি পরীক্ষাও আরও কঠিন হয়ে যাবে? ভারতের বিভিন্ন নগরে, বিশেষত কলকাতার সুপ্রিম কোর্টে ইংরেজ ব্যারিস্টারদের তখন উপার্জন যথেষ্ট, সেখানে কি তাঁরা সহজে ভারতীয়দের প্রতিযোগিতায় নামতে দেবে? সুতরাং, দ্রুত ব্যারিস্টারি পাশ করতে গেলে বিদ্যাসাগরের কাছ থেকে আরও অর্থ চাই। তাঁর সমস্ত সম্পত্তি বিক্রয় বা বন্ধক দেবার অধিকার দিয়ে বিদ্যাসাগরের নামে পাঠিয়ে দিলেন এক ওকালতনামা।
ওদিকে মধুসূদনের চিঠিপত্র এবং সংবাদাদি পাঠ করে শুধু করুণ রস নয়, মাঝে মাঝে কৌতুকও পেতেন বিদ্যাসাগর। একদিন তিনি কয়েকজন বন্ধুকে বললেন, ‘ওহে, তোমাদের অমিত্ৰাক্ষরের কবির আর একটি নতুন খবর শুনেছে? ফরাসী দেশের পুলিস নাকি তাঁকে পলাতক ধুন্ধুপন্থ নানাসাহেব বলে সন্দেহ করেছে!’ সকলে বিস্মিত।
যদিও কাহিনীটি একেবারে অলীক ছিল না। ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের প্রধান নায়ক নানা সাহেবকে তখনো বন্দী করতে পারে নি ব্রিটিশ ফৌজ। প্রায়ই তাঁর সম্পর্কে বিভিন্ন প্রকার গুজব রটে। বিদ্রোহ প্রশমনের পর সাত-আট বৎসর পার হয়ে গেলেও ইংরেজ সরকার তখনও তাঁর অনুসন্ধানে তল্লাসী চালিয়ে যাচ্ছিল। পাওনাদারবৃন্দের ভয়ে মধুসূদন প্রায় সময়ই গৃহের মধ্যে লুকিয়ে থাকতেন, বাইরে নির্গত হতেন কদাচিৎ। সেইজন্য ফরাসী পুলিসের মনে সন্দেহের উদয় হলো। এই কৃষ্ণবর্ণ, স্থূলকায়, মুখ গুম্ফ-দাড়িতে ভরা ব্যক্তিটিই ছদ্মবেশী নানাসাহেব নন তো!
মধুসূদনের আর এক পত্রে বিদ্যাসাগর জানতে পারলেন যে, প্রখ্যাত পণ্ডিত গোল্ডস্ট্রকার সাহেব মধুসূদনকে অনুরোধ করেছেন, লণ্ডন ইউনিভার্সিটি কলেজে বাংলার অধ্যাপক পদ গ্রহণ করবার জন্য। পদটি অতি সম্মানের হলেও অবৈতনিক।
ব্যারিস্টারি পাঠ শেষ করার জন্য মধুসূদন তখন প্যারিস থেকে চলে এসেছেন লণ্ডনে। কিন্তু গোল্ডস্ট্রকার মহোদয়ের অনুরোধ মান্য করা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। শুধু সম্মান নিয়ে তিনি ধুয়ে খাবেন! এক প্রকার বিষাক্ত কীটের আক্রমণে ব্রিটেনে গবাদি পশুর মড়ক শুরু হয়েছে বলে বর্তমানে সকল প্রকার মাংসই অগ্নিমূল্য, অন্তত মাসিক সাড়ে তিনশো টাকার কমে সংসার চালানো দুঃসাধ্য। এই টাকা তাঁকে কে দেবে?
চিঠিখানি পড়ে বিদ্যাসাগর একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিলেন। লণ্ডন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে বাংলা অধ্যাপকের পদ অলংকৃত করবেন একজন বিশিষ্ট বাঙালী কবি, এটাই তো স্বাভাবিক, কিন্তু ইংরেজ সরকার সে জন্য কোনো পারিশ্রমিক দিতে অপরাগ! আর এ দেশ থেকেই বা কে সাহায্য করবেন। তিনি কতকাল একার চেষ্টায় চালিয়ে যেতে পারবেন? সে চেষ্টাও অবাস্তব।
মধ্য কলকাতার লোয়ার সার্কুলার রোড সেমেটরিতে এত সবুজ, চোখের আরাম হতে বাধ্য। মধুকবি, মাইকেল মধুসূদন দত্তের সমাধি খুঁজে পেতে অসুবিধে হয় না, টালি-ফেলা পথের ধারে বড় ফলকের গায়ে লেখা ‘মধু-বিশ্রাম পথ’, ‘বাংলার গৌরব কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের সমাধিস্থলে যাবার রাস্তা’। লোহার রেলিং-ঘেরা এক টুকরো জমি। ছোট্ট গেট দিয়ে ঢুকতেই আবক্ষ মর্মরমূর্তি, নীচে সেই বিখ্যাত এপিটাফ: ‘দাঁড়াও পথিকবর, জন্ম যদি তব/ বঙ্গে! তিষ্ঠ ক্ষণকাল!…’ দু’পাশে নানা রঙের পাতাবাহার পেরিয়ে পাশাপাশি সমাধিতে শুয়ে আছেন মধুসূদন-হেনরিয়েটা। শান্ত, চুপচাপ।
অথচ ৪৯ বছরের জীবনে (১৮২৪-১৮৭৩) কী অশান্তই না ছিলেন ‘দত্ত কুলোদ্ভব কবি শ্রীমধুসূদন’! উনিশ শতকের প্রথমার্ধে বঙ্গের ঘটনাবহুল ছটফটে মেজাজটা তাঁর স্বভাবের সঙ্গে খাপ খেয়ে যায়। রাজা রামমোহন রায় বই লিখছেন, বিলেত যাচ্ছেন, অর্থবান হিন্দু ঘরের ছেলেদের সাহেবি শিক্ষায় শিক্ষিত করতে কলকাতায় শুরু হচ্ছে হিন্দু কলেজ, অদূরে শ্রীরামপুর থেকে বেরোচ্ছে প্রথম বাংলা খবরকাগজ, কলকাতার বাঙালি সমাজকে ঝাঁকিয়ে দিচ্ছেন হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজ়িয়ো, নিষিদ্ধ হচ্ছে সতীদাহ, খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করছেন উচ্চবর্ণের বা নামডাকওয়ালা বাঙালি ঘরের কেউ কেউ— এই সমস্তটা নিয়ে একটা যুগের যে দুরন্ত ঘূর্ণি, তার মধ্যিখানে এসে পড়ছেন যশোরে কপোতাক্ষ-তীরের সাগরদাঁড়ি গ্রামের মধুসূদন দত্ত। পয়সা আর ঠাঁটবাটওয়ালা ঘরের ছেলে সাহিত্যটা মন দিয়ে পড়েছিলেন হিন্দু কলেজে। প্রত্যেক সফল পুরুষের পিছনে এক নারীর অনিবার্য উপস্থিতি যদি বা তর্কযোগ্য, এক জন সুশিক্ষকের অবদান নিয়ে কেউ প্রতিবাদ করবেন বলে মনে হয় না। হিন্দু কলেজে মধুসূদন ডিরোজ়িয়োকে পাননি বটে, তবে পেয়েছিলেন ডেভিড লেস্টার রিচার্ডসনকে। সাহিত্যের অধ্যাপক, পরে কলেজের অধ্যক্ষ এই মানুষটির ব্রিটিশ রোম্যান্টিক পোয়েট্রির ক্লাস মুগ্ধ করেছিল তারুণ্যের দোরগোড়ায় পা রাখা মধুসূদনকে। বায়রন ছিলেন তাঁর স্বপ্নের কবি, সাময়িক রোল মডেলও— নইলে যে যুগে দেবেন্দ্রনাথ-বিদ্যাসাগর থেকে রাম-শ্যাম-যদু সক্কলকে কৈশোর না পেরোতেই বিয়ে দেওয়াটা দস্তুর, সে কালে বায়রন-পড়া ‘মধু’ ব্যতিক্রম। তাঁর সোজা কথা— বিলিতি কায়দায় কোর্টশিপ না করলে সে কি আর প্রেম, আর প্রেম করে বিয়ে না করলে সে কি আর বিয়ে!
প্রেম-বিয়ের মতো কাণ্ডকারখানায় অযৌক্তিক, ব্যাখ্যাতীত কাণ্ডটাণ্ড থাকে। মধুসূদনের সঙ্গে এক জমিদারবাড়ির নাবালিকা মেয়ের বিয়ে ঠিক করলেন তাঁর বাবা রাজনারায়ণ দত্ত। মধু সেই বিয়ে আটকাতে মরিয়া হয়ে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করলেন— মধুসূদন-আলোচনার বৃত্তে এই ব্যাখ্যার বিস্তর ঘোরাঘুরি। কিন্তু আসল কথা, মধুসূদনের আগে ‘মাইকেল’ জুড়ে যাওয়ার নেপথ্যে তাঁর বড় কবি হওয়ার ইচ্ছের ভূমিকাও বিরাট। হিন্দু কলেজে পড়তে পড়তেই যে প্রতিভাবান ছাত্রটি দেখছেন তাঁর মাস্টারমশাই নিজে কবিতা লেখেন, সম্পাদনা করেন ইংরেজি কবিতাবই, তাঁর মনেও কবিতা লেখার, ছাপানোর এবং সবচেয়ে বড় কথা— কবি হওয়ার ইচ্ছে ঘাই মারবে বইকি! মধুসূদনের গোড়ার দিকের ইংরেজি কবিতা সেকেলে কলকাতার ‘লিটারারি গ্লিনার’, ‘লিটারারি গেজেট’, ‘কমেট’, ‘বেঙ্গল হেরাল্ড’, ‘ওরিয়েন্টাল ম্যাগাজ়িন’-এ বেরিয়েছে, আশায় বুক বেঁধে তিনি কবিতা পাঠিয়েছেন লন্ডনের বিখ্যাত ‘বেন্টলিজ় মিসেলেনি’তে। কিন্তু দিনের শেষে বুঝেছেন, তাঁর সময়ে ইংরেজি ভাষায় (তখনও তাঁর বাংলায় লেখালিখির ভাবনা ভবিষ্যৎ-গর্ভে) বড় কবি হতে গেলে তাঁকে কলকাতায় পড়ে থাকলে চলবে না, সাগর পাড়ি দিয়ে বিলেত যেতে হবে এবং তা যে কোনও মূল্যে। তাঁর কবিতায় তাই অতলান্তিক পেরিয়ে সুদূর অ্যালবিয়নের তীরে সুউচ্চ পর্বত, শ্যামল উপত্যকা দেখার আকুলিবিকুলি, স্বজনহীন প্রবাসে এক নামহীন সমাধির জন্য দীর্ঘশ্বাস। এই ছেলে কলেজের প্রিয় বন্ধুকে চিঠিতে লেখে কবি আলেকজ়ান্ডার পোপের উক্তি— কবি হতে গেলে প্রয়োজনে বাবা-মা, ঘর… সব ছাড়তে হবে। বন্ধুর কাছে খুলে দেয় স্বপ্নের পুঁটুলি— এক দিন বিরাট কবি হবে সে। সে দিন যেন তাঁর প্রিয় বন্ধু গৌরচন্দ্র বসাক সেই মহাকবির জীবনী লেখে! নিছক যৌবনোচিত আবেগ? এই ছেলের উচ্চাকাঙ্ক্ষাকেও সমীহ করতে হয়।
নিজের শর্তে বাঁচতে ক’জন পারে? মধুসূদনও পারেননি, তা বলে ইচ্ছেটা মরে যায়নি। শিল্পের দুনিয়ায় বহু প্রবল প্রতিভাও জীবনে ঠোক্কর খেয়ে, চেয়েও না পেয়ে চুপ করে গিয়েছেন, আপস করে নিয়েছেন সময়ের সঙ্গে— উদাহরণ বিস্তর। মধুসূদন করেননি। তাঁর কতকগুলো ইচ্ছে পূরণ হয়েছে। বড় কবি হওয়ার ইচ্ছে ছিল, হয়েছেন। আরামে-বিলাসে জীবন কাটানোর ইচ্ছে ছিল— খানিকটা পেরেছেন। খ্রিস্টান হওয়ার পরে যে কলেজ তাঁর ঠিকানা হয়েছিল, সেই বিশপ’স কলেজে সাদা আর কালো ছাত্রের আলাদা পোশাক-নীতি ছিল। সাহেব শিক্ষকদের লেখা চিঠিতে জানা যায়, মধুসূদন কলেজে সাহেবি পোশাক পরে যাওয়ায় হইচই পড়ে গিয়েছিল। এ তো পরের কথা, এর আগেই তাঁর বাড়ি গিয়ে গৌরদাস ও অন্য বন্ধুরা দেখেছেন, বাবার সামনে ধূমপান করছেন মধুসূদন। এমনকি বাবা-ছেলে একত্রে মদ্যপানও করছেন!
সেই ছেলেই খ্রিস্টান হওয়ার সময়ে বাবাকে রেয়াত করেননি। কলকাতার আর্চডিকন যে দিন ব্যাপটাইজ় করলেন মধুসূদনকে, চার্চের বাইরে গোরা সৈন্য নিয়োগ করতে হয়েছিল, পাছে রাজনারায়ণ দত্ত লেঠেল পাঠিয়ে ছেলেকে ছাড়িয়ে আনার চেষ্টা করেন। তবে তাতেও লাভ হত বলে মনে হয় না। কারণ মধুসূদন যা বিশ্বাস করেন, তা ভাঙার সাধ্যি কারও নেই। মানুষ বাড়ির লোক না হোক ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের অন্তত জানায়, আমি এটা করতে যাচ্ছি। মধুসূদনের খ্রিস্টধর্ম গ্রহণের সিদ্ধান্ত তাঁর কাছের বন্ধুরাও জানতেন না, এমনকি গৌরদাস বসাক— যাঁকে লেখা একের পর এক চিঠিতে মধুসূদনের ভালবাসা আর নির্ভরতার প্রমাণ উজ্জ্বল, তিনিও না। এ এক অদ্ভুত, নিশ্চল লক্ষ্যের মানুষ। আমি কবি হব, কবি হতে হলে আমাকে বিলেত যেতে হবে, খ্রিস্টান হলে বিলেত যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল, অতএব এই মুহূর্তে আমি ঘর, বাপ-পিতেমোর ধর্মও ছাড়ব। বাবা কী বলল, মায়ের কী হবে, সমাজে কতটা ঢি-ঢি পড়ল, থোড়াই কেয়ার! আগুপিছু না ভেবে ঝাঁপালে পস্তাতে হয়। মধুসূদনের জীবনও কম কষ্টে কাটেনি— কিন্তু তিনি তো মাইকেল মধুসূদন দত্ত, বিদ্রোহ তাঁর রক্তকণিকায়। ছেড়ে গেলে কষ্ট পেতে হবে, কিন্তু কষ্ট পেতে হবে বলে ছেড়ে যাব না কেন, এ আত্ম-প্রশ্ন তাঁর আমরণ।
খ্রিস্টান হয়ে হিন্দু কলেজে পড়ার অধিকার হারালেন মাইকেল। নিরাপত্তাও দরকার তখন, তাই ঠিকানা হল ফোর্ট উইলিয়াম। নিয়মকানুন কড়া, বন্ধুরাও সহজে আসতে পারেন না। আর হিন্দু ঘরের ছেলেরা ধর্মচ্যুত মতিভ্রষ্ট ছেলের কাছে গেলে মানসম্মানও গোল্লায় যাবে। মাইকেল পড়তে গেলেন বিশপ’স কলেজে। পড়াশোনার দিগন্ত আরও প্রসারিত হল এখানে। পেলেন গ্রিক, ল্যাটিনের আস্বাদ।
বিলেত যাওয়া কিন্তু হল না। মনে হতে পারে, এই ছেলে আসলে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেছে সামাজিক প্রতিষ্ঠার সিঁড়িটা ধরার মতলবে। কবিযশ, সম্মান, বৈভব-বাসনা তাঁর ছিল, এ যেমন ঠিক কথা, তেমনই সত্য— মাইকেল খ্রিস্টধর্মকে অন্তত তখন মন থেকেই ভালবেসেছিলেন। নিজের ব্যাপটিজ়ম উপলক্ষে তাঁর ইংরেজি প্রার্থনাগান রচনা নিছক আবেগী প্রকাশ নয়। কয়েক বছর পরে, মাদ্রাজে থাকাকালীন ‘দি অ্যাংলো স্যাক্সন অ্যান্ড দ্য হিন্দুজ়’ নামে এক বক্তৃতা দিয়েছিলেন, সেখানেও তাঁর মত স্পষ্ট— হিন্দুধর্মের তুলনায় খ্রিস্টধর্ম উন্নততর। হিন্দুধর্মকে শ্রেষ্ঠ মনে করেন যাঁরা, তাঁরা রক্তচক্ষু ও খড়্গহস্ত হলেও মধুসূদনের ‘মাইকেল’ নাম ও তাঁর ব্যক্তিগত বিশ্বাস ঐতিহাসিক সত্য হয়েই থেকে যাবে। ঠিক যেমন থেকে যাবে মাত্র কয়েক বছরের লেখালিখিতেই তাঁর বাংলা ভাষা, বিশেষত তার কাব্য ও ছন্দকে মোড় ফিরিয়ে দেওয়ার অসামান্য কীর্তি।
যশোর, কলকাতা, মাদ্রাজ, লন্ডন, ভার্সেই… যশোর না হয় তাঁর পিতৃভূমি, শৈশবের কয়েক বছরের ঠিকানা। বাকি প্রত্যেকটি জায়গায় তাঁর থাকা বা ছেড়ে যাওয়াও নিজস্ব সিদ্ধান্তে। বিশপ’স কলেজে খরচ প্রচুর, ছেলে খ্রিস্টান হওয়া সত্ত্বেও বাবা সেই খরচ জোগাচ্ছিলেন। ভবিষ্যতে চার্চের কাজে জীবন উৎসর্গ করবে, ছেলেরা এমন কথা দিলে কলেজ তাদের খরচ মকুব করে দিত। রাজনারায়ণ দত্ত কিন্তু ছেলের খরচ দিয়ে যাচ্ছিলেন, ছেলের মিশনারি হয়ে যাওয়া আটকাতে। মনে তখনও ক্ষীণ আশা, প্রায়শ্চিত্ত করিয়ে যদি ঘরে ফেরানো যায়! কিন্তু মধুসূদন তো লোক-দেখানো ‘মাইকেল’ হননি, খ্রিস্টধর্মে তাঁর আন্তরিক প্রতীতি জন্মেছে। ছেলেকে ফেরানো যাবে না বুঝে বাবা টাকা দেওয়া বন্ধ করলেন। পয়সা না দিলে কোন কলেজ ছেলে পড়বে? হিন্দু কলেজে পড়াশোনা শেষ হয়নি, বিশপ’স কলেজের দরজাও যখন বন্ধ হওয়ার মুখে, মাইকেল শহর ছাড়লেন। এ বার নিজের জীবন, রোজগারপাতির ব্যবস্থাও নিজের। গন্তব্য তখনকার মাদ্রাজ। এই যাওয়া নিয়েও বন্ধু কি বাড়ির লোক, কাউকে কিচ্ছু বলেননি। বিশপ’স কলেজের এক মাদ্রাজবাসী অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান বন্ধুর সাহায্যে মাদ্রাজের অরফ্যান অ্যাসাইলাম স্কুলে একটা চাকরি জুটল। আজকের স্কুলশিক্ষকেরা গর্ববোধ করতে পারেন, ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ রচয়িতা তাঁদের পেশাতেই ছিলেন। দু’-দুটো স্কুলে পড়িয়েছেন!
এই স্কুলেরই ছাত্রী ছিলেন রেবেকা— মধুসূদন-ঘরণি। পিতৃহীন মেয়েটি থাকতেন স্কুলেই, হয়তো মধুসূদনের ছাত্রীও ছিলেন তিনি। বছর ছয়েকের ছোট মেয়েটির সঙ্গে ভালবাসার সম্পর্ক গড়ে ওঠে মাইকেলের আর ১৮৪৮-এর জুলাই-শেষে বিয়েও হয়। এই বছরটা মাইকেলের জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। সে কালের রাজনীতি-সমাজ-সংস্কৃতিজগতের কেন্দ্র কলকাতা ছেড়ে তুলনায় অজ-পাড়া মাদ্রাজে আসা, প্রথম চাকরি, প্রেম, বিয়ে। প্রথম কাব্য ‘দ্য ক্যাপটিভ লেডি’ রচনাও এ বছরই, বই হয়ে বেরোয় পরের বছর। বইটি ছেপেছিল মাদ্রাজের এক মুদ্রক। এই বই নিয়ে গৌরদাস বসাককে যে চিঠি লিখেছিলেন মাইকেল, পড়লে দরদে মন ভিজে যায়। লিখছেন, বন্ধুদের মধ্যেই কয়েক জন যদি দু’টাকা দিয়ে বইটা কেনেন, আর গৌরদাস যদি আরও জনা চল্লিশেক গ্রাহক জোগাড় করতে পারেন, তা হলে তাঁর বই ছাপার খরচটুকু উঠে আসে। প্রথম বই বলে কথা, ভাল রিভিউ বেরোক, কোন লেখক না চায়! মাইকেলও চেয়েছিলেন। বই পাঠিয়েছিলেন ‘অ্যাথেনিয়াম’ আর কলকাতার ‘বেঙ্গল হরকরা’ পত্রিকায়। ‘অ্যাথেনিয়াম’ ভাল বলল, ‘হরকরা’ ধুয়ে দিল। বেথুন সাহেবকেও বই পাঠিয়েছিলেন মাইকেল, তাঁরও ভাল লাগল না। তিনি বললেন, ইংরেজিতে না লিখে মাতৃভাষায় সাহিত্যচর্চা করলে নেটিভ লিখিয়েদের কাজে দেবে বেশি। মাইকেলের মন ভাঙল, কিন্তু লাভটা হল ভবিষ্যৎ বাংলা সাহিত্যের। ইংরেজিতে এর পরে আর কাব্য লেখেননি তিনি, তাঁর জীবনে এল বাংলা কাব্য, সাহিত্য।
তারও আগে আর একটা জীবন আছে মধুসূদনের। সে তাঁর সাংবাদিক-জীবন। একে ছেলে ভাল লিখতে পারে, তায় আবার সংসার চালানোর টাকা দরকার, দুইয়ে মিলে উনিশ শতকের মাদ্রাজ সাক্ষী হল সাংবাদিক মাইকেল মধুসূদন দত্তের। ‘ইউরেশিয়ান’ আর ‘মাদ্রাজ হিন্দু ক্রনিকল’— এই দুটো পত্রিকার সঙ্গে ওতপ্রোত জড়িয়ে ছিলেন তিনি। পরে সহকারী সম্পাদক হয়েছিলেন ‘মাদ্রাজ স্পেকটেটর’ কাগজেরও। লিখতেন সাহিত্যের লেখা, সম্পাদকীয়, এমনকি খবরও! ‘ইউরেশিয়ান’-এই বেরিয়েছিল তাঁর নাটক ‘রিজিয়া’। যে ব্ল্যাঙ্ক ভার্স বা অমিত্রাক্ষর ছন্দের জন্য তিনি অমর, ‘রিজিয়া’ সেই ছন্দেই লেখা। মধুসূদনের সাংবাদিক-জীবন স্বল্পায়ু, মাত্র কয়েক বছরের। কাজটা ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন, কারণ তত দিনে তিনি চাকরি পেয়েছেন মাদ্রাজ ইউনিভার্সিটিতে! শুনতে দারুণ মনে হলেও, মাইনে ছিল শ্বেতাঙ্গ শিক্ষকদের চেয়ে ঢের কম। পড়াতেন ইংরেজি, ইতিহাস, ভূগোল।
চেনা পরিবারবৃত্ত থেকে বহু দূরে এক তরুণ দু’হাতে সামলাচ্ছেন চাকরি আর সংসার। ছেলেপুলে হয়েছে, পরপর দুই মেয়ে— বার্থা আর ফিবি। তার পরে দুই ছেলে জর্জ আর মাইকেল। এরই মধ্যে কী করে প্রেম এল আবার? বছর সতেরোর একটি ইংরেজ মেয়ে, এমেলিয়া হেনরিয়েটা সোফিয়া হোয়াইট— হেনরিয়েটা নামেই চেনে সবাই। মা-মরা মেয়ে, বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করে ঘরে এনেছে যাকে, তার বয়স হেনরিয়েটার আশপাশে। ঘরের দেওয়াল গিলে খেতে এলে ‘বাইরের লোক’-এর কাছে বরং মনের ঝাঁপি উপুড় করে স্বস্তি পায় মন। হেনরিয়েটার জীবনে সেই ‘বাইরের লোক’টা মাইকেল ধীরে ধীরে হয়ে উঠল মনের মানুষ। রোম্যান্সটুকু বাদ দিলে যে নিয্যস নৈতিক সত্যিটা পড়ে থাকে, তা হল— মাইকেল মধুসূদন দত্ত জড়িয়ে পড়েছেন এক পরকীয়া সম্পর্কে! এমনই সে ভালবাসা যে, ১৮৫৬-র জানুয়ারিতে মাদ্রাজ ছেড়ে কলকাতা চলে আসার পরে স্ত্রী রেবেকা আর নিজের সন্তানদের সঙ্গে যোগাযোগই করছেন না আর (বছর দুয়েকের শিশুপুত্র মাইকেল মারা গেলেও না)। পরিবারকে নিয়ে আসছেন না কলকাতায়। বরং মাইকেল চলে আসার বছর আড়াই পরে যিনি কলকাতা এসে পৌঁছচ্ছেন আর বাদবাকি জীবনটা থেকে যাচ্ছেন এই ব্যাখ্যাতীত ভাবে অবিবেচক মানুষটার সঙ্গে, তাঁর নাম— হেনরিয়েটা।
মনে হচ্ছে তো, এই লোকটা সুবিধের নয় একদম! যখন যাকে খুশি ছেড়ে চলে যেতে পারে, যখন যা মনে হয় করে বসে! অনেকাংশেই সত্যি কথা। মাইকেল মধুসূদন দত্ত এমন এক জীবনের নাম, যাকে খুঁটিয়ে পড়লে হাসি কান্না রাগ অভিমান ক্ষোভ দুঃখ ঈর্ষা করুণা… সমস্ত অনুভূতির সঙ্গে মোলাকাত হয়ে যায়। রেবেকার সঙ্গে আইনি বিবাহবিচ্ছেদ হয়নি মাইকেলের, আবার হেনরিয়েটাকেও কোনও দিন বিয়ে করেননি তিনি। তাতে কী! হেনরিয়েটা তাঁর জীবনের সমস্ত সুখ এই মাত্রাছাড়া দিশেহারা পাগলপারা লোকটার জন্যই জলাঞ্জলি দিয়েছিলেন বা বলা যায়, মধুসূদনই হয়ে উঠেছিলেন এই মেয়েটির একমাত্র সুখ। তিনটি সন্তানের মা হয়েছেন, অবর্ণনীয় দুঃখ ও দারিদ্র্য যাপন করেছেন, বিদেশ-বিভুঁইয়ে বা এ শহরেও কপর্দকশূন্য দিন কাটিয়েছেন। তবু কোনও দিন ছেড়ে যাননি মধুসূদনকে।
মাদ্রাজ-ফেরত মধুসূদন কলকাতায় জেরবার হয়ে ছিলেন পৈতৃক সম্পত্তির মালিকানা আদায় নিয়ে। বাবার খিদিরপুরের বাড়ি, যশোরের তালুক, মায়ের অলঙ্কারের উত্তরাধিকার নিয়ে মামলা-মোকদ্দমায়। এ সব কাজে সময়, শ্রম ও অর্থ খরচ হয় বিস্তর, কিন্তু পেটটাও তো চালাতে হবে। তাই কলকাতার পুলিশ কোর্টে ১২৫ টাকার জুডিশিয়াল ক্লার্কের চাকরি নিতে বাধ্য হলেন। এরই মধ্যে কলকাতা, বাংলা তথা ভারতে ঘটনার ঘনঘটা— ১৮৫৬-র জুলাইয়ে বিধবাবিবাহ আইন পাশ, পরের বছরেই সিপাহি বিদ্রোহ, তার পরে নীল বিদ্রোহ। দীনবন্ধু মিত্র লিখলেন ‘নীল দর্পণ’, জেমস লং-এর প্রচেষ্টায় তার ইংরেজি অনুবাদ হল, সে অনুবাদ নাকি মধুসূদনেরই করা! সেই নিয়েও একপ্রস্ত গন্ডগোল।
মধুসূদনের জীবনে এই সময়টা খুব গুরুত্বপূর্ণ, কারণ বাংলায় তাঁর নাট্য ও কবিপ্রতিভা স্বপ্নের উড়াল দিয়েছিল এ সময়েই। পাইকপাড়ার জমিদাররা বেলগাছিয়া থিয়েটারে অভিনয় করাবেন বলে সংস্কৃত-আশ্রয়ী ‘রত্নাবলী’ নাটক লিখিয়েছিলেন রামনারায়ণ তর্করত্নকে দিয়ে। মধুসূদন পড়ে বললেন, এ অতি বাজে। নিজেই লিখে ফেললেন নাটক ‘শর্মিষ্ঠা’ (যে নাটকের ও চরিত্রের নামে হেনরিয়েটার গর্ভজাত মেয়েরও নাম রেখেছিলেন তিনি)। তুমুল ‘হিট’ হল সেই নাটক, আর মধুসূদনের সবচেয়ে বড় লাভটা হল এই— বাংলা ভাষায় লেখালিখির তুঙ্গস্পর্শী আত্মবিশ্বাসটা পেয়ে গেলেন তিনি। কলম থেকে একের পর এক বেরোল নাটক ‘পদ্মাবতী’, জোড়া প্রহসন ‘বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ’ আর ‘একেই কি বলে সভ্যতা?’, যতীন্দ্রমোহন ঠাকুরের সঙ্গে বাজি ধরে অমিত্রাক্ষর ছন্দে লেখা ‘তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য’, এ ছাড়াও ‘ব্রজাঙ্গনা কাব্য’, ‘কৃষ্ণকুমারী’ নাটক। এগুলির কোনওটিই লিখতে খুব বেশি সময় নেননি, কিন্তু যে সৃষ্টির জন্য তিনি আজও চিরস্মরণীয়, সেই ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ লিখেছেন প্রায় এক বছর ধরে। প্রতিষ্ঠিত ও প্রামাণ্যকে প্রান্তিক করে, প্রান্তবর্তীকেই কেন্দ্রে নিয়ে আসার প্রবণতা একুশ শতকের সাহিত্য-সংস্কৃতিতে বহুচর্চিত। কিন্তু আজ থেকে প্রায় ১৬০ বছর আগে রামকে দূরে ঠেলে রাবণকে আপন করছেন এক কবি, লিখছেন নতুন ভাব-ভাষা-রূপকল্পে, এ জিনিস অকল্পনীয়।
১৮৬১ সালে, রবীন্দ্রনাথের জন্মের মাস কয়েক আগে প্রথম পাঁচটি সর্গ নিয়ে মেঘনাদবধ কাব্যের প্রথম খণ্ড বেরোল যখন, তখন বাংলা ভাষা পেয়ে গিয়েছে সে সময়ের শ্রেষ্ঠ কবিকে। পণ্ডিতরা ধন্য ধন্য করলেন, অনেকে তুলনা টানলেন মিল্টনের ‘প্যারাডাইস লস্ট’-এর সঙ্গে। কবিযশ-আকাঙ্ক্ষা তো মধুসূদনের ষোলো আনা, কিন্তু মিল্টনের সঙ্গে তুলনা গায়ে মাখেননি তিনিও। চিঠিতে লিখছেন, ‘…মিল্টনের থেকে ভাল আর কিছুই হতে পারে না; অনেকে বলছে (মেঘনাদবধ কাব্যে) কালিদাসের স্বাদ, তাতে আমার আপত্তি নেই। ভার্জিল, কালিদাস, টাসো-র সমকক্ষ হওয়া অসম্ভব নয়। ওঁরা মহিমাময় হলেও জাগতিক কবি, মিল্টন ঐশ্বরিক।’ কালীপ্রসন্ন সিংহের নেতৃত্বে ‘বিদ্যোৎসাহিনী সভা’ সংবর্ধনা দিল মধুসূদনকে, উপহার দিল রুপোর সুদৃশ্য পানপাত্র।
মধুসূদনের জীবন এই মানুষটি ছাড়া অসম্পূর্ণ। মধুসূদন পঞ্চাশ পেরোননি, বিদ্যাসাগরের দাক্ষিণ্য না থাকলে আরও আগেই হয়তো মারা যেতেন তিনি— না খেয়ে, সপরিবার, বিদেশে। কম পয়সায় তাঁর জীবন চলে না। তাই বিপুল কবিখ্যাতি পাওয়ার পরেও প্রথম বাঙালি ব্যারিস্টার হওয়ার বাসনায় মধুসূদন গেলেন বিলেতে। এই পর্বটাই অবর্ণনীয় জীবনযন্ত্রণায় কাটানোর অধ্যায়। কারণ দেশ থেকে মধুসূদনের পৈতৃক সম্পত্তিজাত হকের টাকা পাঠানোর কথা যাঁর, তিনি আর টাকা পাঠাচ্ছেন না। চিঠিরও উত্তর নেই। মধুসূদন আর কাকে বলবেন, করুণাসাগরকে ছাড়া? বিদ্যাসাগর বহু বার টাকা পাঠিয়েছেন, সেই টাকায় মধুসূদনের জীবন চলেছে— লন্ডনে আর ভার্সেইতেও। বেশি পাঠাতেন না, মধুসূদনের স্বভাব জানতেন বলে। বিদ্যাসাগরকে লেখা মধুসূদনের চিঠিগুলো পড়লে স্তম্ভিত হতে হয়। দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া একটা মানুষ অনুরোধ, মিনতি, প্রার্থনার স্তরগুলো পেরিয়ে যা বলছে, তার সারমর্ম— বাঁচান, আপনি না দেখলে বাঁচব না। চিঠিতে লিখছেন, ‘আমার সব আশা আপনার উপরে, আমি নিশ্চিত আপনি আমাকে হতাশ করবেন না। আর যদি করেন, তবে ভারতে ফিরে দু’-এক জন লোককে সুকৌশলে পরিকল্পিত ভাবে খুন করে আমাকে ফাঁসিতে ঝুলতে হবে।’ বিদ্যাসাগর মধুসূদনের কথায় কখনও তাঁর সম্পত্তি মর্টগেজ করে, কখনও অন্যের কাছ থেকে স্রেফ ধার করে টাকা পাঠিয়েছেন মধুসূদনকে। মধুসূদন ব্যারিস্টারি পাশ করেছেন (প্রথম বাঙালি ব্যারিস্টার অবশ্য হতে পারেননি, তবে তাঁর ‘চতুর্দশপদী কবিতাবলী’র বেশির ভাগই এ সময়েই লেখা), দেশে ফিরেছেন, হাইকোর্টে আমল পাননি। তাই আবারও বিদ্যাসাগরের শরণাপন্ন হয়েছেন রেকমেন্ডেশন লেটারের জন্য। সে ব্যবস্থাও করে দিয়েছেন বিদ্যাসাগর। তার পরে যখন এই শহরেও মধুসূদনের কেরিয়ার আর জীবন পাখা মেলছে না, ক্রমশই ডুবে যাচ্ছেন ঋণে এবং বারংবার টাকা চাইছেন সেই বিদ্যাসাগরের কাছেই, তখন বিদ্যাসাগরও থামলেন। আর কত করবেন তিনি!
আট-নয় বছর বয়েসে গ্রামেই মধুসূদনকে ফার্সি শেখানোর ব্যবস্থা করা হয়। মধুসূদন দ্রুত এই ভাষা শিখে নেন। সেই সঙ্গে গজল শেখেন। পরে হিন্দু কলেজের বন্ধুদের তিনি গজল শোনাতেন। ১৮৪১ সালের শেষ দিকে হিন্দু কলেজে মধুসূদন একটি হাতে লেখা পত্রিকা প্রকাশ করেন। যা টিকে ছিল তিন থেকে চার মাস। হিন্দু কলেজে বাংলা পড়াতেন রামতনু লাহিড়ী। তাঁর পটলডাঙ্গার বাড়িতে মধুসূদন সহ অন্য ছাত্ররা নিয়মিত যাতায়াত করতেন। এই আড্ডাতেই মধুসূদন অনর্গল মিল্টন ও শেক্সপিয়র থেকে আবৃত্তি করতেন। খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করার আগে হিন্দু কলেজের শেষ পরীক্ষায় মধুসূদন পেয়েছিলেন পঞ্চাশের মধ্যে তিরিশ। তিনি অষ্টম হয়েছিলেন। প্রথম হয়েছিলেন গোবিন্দ দত্ত, তিনি পেয়েছিলেন উনপঞ্চাশ। দ্বিতীয় হয়েছিলেন প্যারীচরণ সরকার। পেয়েছিলেন সাতচল্লিশ। ধর্মান্তরের সন্ধ্যায় চার্চে গাইবার জন্য মধু নিজেই একটি ‘হিম’ রচনা করেছিলেন। ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ উৎসর্গ করেছিলেন দিগম্বর মিত্রকে। তিনি মধুসূদনকে বিদেশে প্রতিশ্রুতি মতো টাকা পাঠাননি, ফলে মধুসূদন বিপদে পড়েছিলেন। ব্যারিস্টারি পড়বার জন্য ভর্তি হয়েছিলেন ‘গ্রেজ ইন কলেজ’-এ। সেখানে ভর্তির রেজিস্টারে নিজের বয়স লিখেছিলেন ৩১। অথচ তাঁর তখন বয়স ছিল ৩৮। মাদ্রাজ থেকে মাইকেল কলকাতা চলে আসেন মিস্টার হোল্ট ছদ্মনামে। সকলের ধারণা, রেবেকার চোখে ধুলো দিতে তিনি এই নাম নিয়েছিলেন, কিন্তু তাঁকে এই নামে ঠাট্টা করে ডেকেছিলেন জাহাজের কর্মীরা এবং তারাই রিপোর্টে মধুসূদনের নাম মিস্টার হোল্ট করে দিয়েছিলেন। ১৮৭২ সালের ফ্রেব্রুয়ারি মাসে মাইকেল পুরুলিয়া যান। একটি মামলার কারণে। বরাকর থেকে পুরুলিয়া ৪২ মাইল পথ তাঁকে পালকিতে যেতে হয়। যাত্রা পথে দেখেছিলেন পরেশনাথ পাহাড়। একটি সনেটে এই পাহাড়ের কথা তিনি উল্লেখ করেন।
খিদিরপুরের রাজনারায়ণ দত্ত ছিলেন তমলুকের রাজপরিবারের উকিল। একবার একটা মামলার সূত্র ধরে তাঁকে যেতে হবে তমলুকে। পুজোর সময় যাওয়া। বিশেষ একটি ঘটনায় একমাত্র পুত্র মধুর সঙ্গে তখন তাঁর বিবাদ চলছে। রাজনারায়ণ এতটাই বিরক্ত যে পুত্রকে বলে দিয়েছেন তাঁকে এ বার গ্রামের বাড়ি সাগরদাঁড়িতে গিয়ে থাকতে হবে। উদ্বিগ্ন পিতা ছেলেকে তাঁর কলকাতার বন্ধুদের থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে চেয়েছিলেন। তিনি আশা করেছিলেন এতেই মধুর ‘রোগ’ সেরে যাবে। যে-রাতে মধুকে যশোরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করতে হয়েছিল, সে দিন সকালে মনমরা মধুসূদন প্রিয়তম বন্ধু গৌরদাসকে লিখেছিলেন, ‘‘আমি যদি একবার তোমার সঙ্গে দেখা করতে পারতাম! কিন্তু আমাকে তা নিষেধ করা হয়েছে! প্রিয়, প্রিয় গৌর— প্রিয়তম বন্ধু! আমাকে ভুলে যেয়ো না!’’
কিন্তু রাজনারায়ণ মধুর মায়ের কথা ফেলতে পারলেন নি। সামনেই ছিল ছেলের পরীক্ষা। সে সময় গ্রামের বাড়িতে চলে গেলে মধুর লেখাপড়ার ক্ষতি হবে খুব — জাহ্নবীদেবী স্বামীকে বোঝাতে সমর্থ হলেন বলে মধুসূদন এত বড় ভাবি বিপদের হাত থেকে রক্ষা পেয়ে গেলেন। তাঁকে যশোর যেতে হল না। সেপ্টেম্বরের ১৯ থেকে কলেজে বার্ষিক পরীক্ষা শুরু হবার কথা। ২৮ তারিখ শেষ। মধু ও গৌর পরীক্ষা দিতে দিতেও আশঙ্কা করেছিলেন বোধহয় ২৮-এর পরে যেতে হবে যশোর, কেননা, বাবা কিছুই উচ্চবাচ্য করছেন না এ নিয়ে। অবশেষে অক্টোবরের সাত তারিখে জানা গেল, যশোরে যেতে হচ্ছে না। তার বদলে যেতে হবে তমলুকে।
কলকাতায় রাজনারায়ণ দত্ত উকিল হিসেবে তখন একটি প্রতিষ্ঠিত নাম। তাঁর ওই একটি মাত্র ছেলে। ভাল ছাত্র। স্কলারশিপ পেয়েছে। ইংরেজিতে তুখড়। ডেপুটি হবার সব রকম যোগ্যতা তাঁর ছিল। কিন্তু মাঝে মধ্যেই এই আদুরে ছেলে আজব সব আচরণ করত। ছেলের সমস্যা তিনি বুঝতে পারেন নি। আর পাঁচটা বাপের মতো করে তো তিনি ছেলের সঙ্গে মিশতেন না। বরং তাঁকে বন্ধু করে নেওয়ার চেষ্টাই করেন। এমনকী মধুর বন্ধুরা পর্যন্ত এই সময়ের শিক্ষিত ছেলেপুলে হয়েও পিতা-পুত্রের সহজ এমন সম্পর্ককে উদার মনে মেনে নিতে পারতেন না। কিছু দিন আগে তাঁদের বাড়িতে নিমন্ত্রিত ছিলেন গৌরদাস আর ভোলানাথ। এই প্রথম তাঁরা খিদিরপুরের বাড়িতে এসেছিলেন। হিন্দু কলেজের এই দুই ছাত্র সেজেগুজে মধুদের বাড়িতে এসে দেখেন, এ কী কাণ্ড! রাজনারায়ণ দত্ত আলবোলা টানছেন। তাঁর টানা শেষ হবার পরে তিনি নলটা এগিয়ে দিলেন মধুর দিকে। মধুও বেশ তৃপ্তির সঙ্গে তামাকের ধোঁয়া ছাড়ছেন। বিস্মিত গৌরদাস বন্ধুর কাছে এই বিষয়ে জানতে চাইলে মধুসুদন তাকে আরও হতবাক করে দিয়ে বলেছিলেন, তাঁর পিতা এ সব বস্তাপচা নিয়মনীতি তোয়াক্কা তো করেনই না, এমনকী তাঁরা কখনও কখনও একসঙ্গে বসে মদ্যপানও করেন। বাপ হয়ে ছেলেকে এত বন্ধুত্ব দেবার পরেও তার এমন উদ্ভট আচরেণের কোনও ব্যাখ্যা পাননি। তাই রাজনারায়ণ ঠিক করেছিলেন এ বারে তমলুকে গিয়ে তিনি কাছ থেকে মধুকে দেখবেন, সমস্যাটা ঠিক কোথায় বোঝার চেষ্টা করবেন।
১০ই অক্টোবর সপ্তমী পুজোর দিন রাজনারায়ণ নৌকো করে তমলুক যাত্রা করলেন। পৌঁছলেন ১২ তারিখ।রাজবাড়ির নবমী পুজোর হইচই। চারপাশে যেন মেলা বসেছিল। বিজয়ার শেষে হট্টগোল একটু মিটে গেলেও ১৯শে অক্টোবর বুধবারে শুরু হল লক্ষ্মীপুজোর ব্যস্ততা।রাজবাড়ি বলে কথা! কোনও কিছুই ছোট আয়োজনে হয় না। রাজনারায়ণ ছেলের সঙ্গে কথা বলার সময়টুকুও পাননি। ধনী মক্কেলের পারিবারিক মজলিশেই তাঁকে সময় কাটাতে হয়েছিল। তিনি জানতেও পারেন নি, তাঁর আঠারো বছরের পুত্র সেখানে গিয়ে প্রেমে পড়ে গিয়েছিল। পাত্রীটি ছিলেন জনৈকা বিধবা। কেউ কেউ বলেন বিধবা নয়, বিবাহিতা এক রমণী। সতেরো দিনের এই তমলুক বাসে, এক রাতে, গৌরদাসকে মধু লিখেছিলেন, ‘‘এখানে আমার একটা ছোটখাটো প্রেমের অভিজ্ঞতা হয়েছে। সুতরাং দেখতেই পাচ্ছো, বিবাগী এবং সন্ন্যাসী থেকে রাতারাতি একটা লম্পটে পরিণত হয়েছি।’’
জীবনীকারেরা বলেন, রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ের কন্যা দেবকীর প্রতি আজীবন প্রেমমুগ্ধ ছিলেন মধুসূদন। তাঁকে পাওয়ার ইচ্ছাতেই তিনি ‘খ্রিস্টান’ হয়ে যান। এটার সত্যতা নিয়ে ঘোরতর সন্দেহ ও বিতর্ক আছে। কারণ এ কথা স্মরণ করা যেতে পারে, মধুসূদন যখন খ্রিস্টান হলেন তখন দেবকীর বয়স মাত্রই পাঁচ বছর ছিল।
মধুর যখন দশ বছর বয়স, তাঁর পিতা তাঁকে নিয়ে এসেছিলেন কলকাতায়। তার আগে মধুসূদন ছিলেন কলকাতা থেকে দূরে যশোরের সাগরদাঁড়ি নামে এক অজগাঁয়ের বালক। গ্রাম থেকে হঠাৎ ছিটকে পড়লেন শহরে, প্রাথমিক উচ্ছ্বাস ও কৌতূহল কেটে গেল স্কুলে ভর্তি হবার আগেই। উপরন্তু, নতুন স্কুল জীবন তাঁর জীবনে নিয়ে এসেছিল অন্য সংকট। বালকটি স্কুলের অন্য ছাত্রদের মতো ইংরেজিতে কথা বলতে তো পারত না, বরং উদ্ভট যশুরে বাংলায় কী যে বলত! তা নিয়ে সহপাঠীদের হাসির খোরাক হত। আত্মরক্ষার জন্য মধু ধরেছিলেন ভিন্ন পথ। তাঁর পিতা যে ধনী উকিল রাজনারায়ণ দত্ত — এ কথা তিনি মাঝে মাঝেই বলতে শুরু করেন। দামি উপহার দিতেন। বাড়িতে নিমন্ত্রণ করতেন। বড়লোকি চাল দেখিয়ে হীনমন্যতা থেকে রেহাই পেতে চাইতেন। বাল্য-কৈশোরে যা ছিল আত্মরক্ষার অস্ত্র, শেষ পর্যন্ত সেটাই দাঁড়িয়ে গিয়েছিল অভ্যাসে। অকারণে অহংকারী হয়ে ওঠা। বাড়িয়ে বলা।
এই অভ্যাসেই তিনি যখন কলকাতা থেকে ‘লেডি স্টাইল’ জাহাজে করে মাদ্রাজ যাত্রা করেন, যাত্রীদের নামের তালিকায় মধুসূদন নিজেই লিখেছিলেন, ‘মি এম এম ডাট অব বিশপস কলেজ’। জাহাজের সমস্ত শ্বেতাঙ্গ যাত্রীর মধ্যে তিনি ছিলেন একমাত্র কৃষ্ণাঙ্গ, তবু তিনি যে ফেলনা নন, তা জানানোর উদ্দেশ্যেই ‘বিশপস কলেজ’ অংশটুকু জুড়ে দেওয়া। আবার মাদ্রাজে রেবেকাকে বিয়ে করার সময় চার্চের রেজিস্টারে মধু পিতৃপরিচয় লিখেছিলেন — ‘সুপ্রিম কোর্টের অ্যাডভোকেট’। অথচ রাজনারায়ণ দত্ত আদৌ অ্যাডভোকেট ছিলেন না। কলকাতায় তখন যে প্রায় চারশো প্লিডার-উকিল ছিলেন, রাজনারায়ণ ছিলেন তাঁদের অন্যতম।
বিধবার সঙ্গে প্রেমের সংবাদটি রাজনারায়ণ নিশ্চয়ই পাননি। কিন্তু মধুসূদনের ‘মনে’র সমস্যাটি আন্দাজ করতে পেরেছিলেন তমলুকে বসেই। তাই রাজনারায়ণ ঠিক করলেন, পুত্রের বিয়ে দেবেন। মেয়েটি ছিল এক জমিদার-কন্যা। পরীর মতো তাঁর রূপ ছিল বলে কথিত। তবে মেয়েটি যে কে, তা জানা যায় না। তখন মধুর বন্ধু গৌরদাস আর ভূদেবের বিবাহ হয়ে গেছে। পাশের বাড়ির রঙ্গলালের বিবাহ হয়েছিল মাত্র চোদ্দো বছর বয়সে। সেখানে মধু তখন উনিশ। তবু মধু বেঁকে বসলেন। এই বিবাহ তিনি কিছুতেই করবেন না। কেননা ভালবেসে বিয়ে করার আদর্শকে তিনি মনের গভীরে এমন শিকড় চারিয়ে দিয়েছিলেন যে সেখান থেকে হঠাৎ এই বিবাহ-প্রস্তাব তাঁর কাছে বজ্রপাতের মতো ছিল। গৌরদাসকে লেখা চিঠিতে মধুসূদন লিখেছিলেন, ‘‘এখন থেকে তিন মাস পরে আমায় বিয়ে করতে হবে— কী ভয়ানক ব্যাপার। এটা ভাবলেও আমার রক্ত শুকিয়ে যায় এবং আমার চুলগুলো সজারুর কাঁটার মতো খাড়া হয়ে ওঠে। যার সঙ্গে আমার বিয়ে হবার কথা, সে হল এক ধনী জমিদারের কন্যা। হতভাগিনী মেয়ে। অজ্ঞাত ভবিষ্যতের গর্ভে তার জন্যে কী দুঃখই যে জমা আছে!’’
কী করবেন মধুসূদন?
হিতাহিত না ভেবেই স্থির করে ফেললেন মুক্তির উপায়। খ্রিস্ট ধর্ম গ্রহণ করতে হবে। তাতে কোনও হিন্দু পিতা তাঁর সঙ্গে কন্যার বিবাহ দেবেন না। তাই বালিকা-বধূর পাণিগ্রহণ তাঁকে আর কোনও দিনই করতে হবে না, খিদিরপুরের বাড়িতে তিনি আর থাকতে পারবেন না, এমনকী ওই পাড়াতেও কেউ তাঁকে বাড়ি ভাড়া দেবে না, সাধের হিন্দু কলেজে পড়া বন্ধ হয়ে যাবে, প্রিয় বন্ধুরা কেউ কেউ সংস্পর্শ ত্যাগ করবে — তবু মধুসূদনের চিন্তার স্রোতে এ সব কণামাত্র তরঙ্গ তুলল না। তবে খ্রিস্টান হবার শর্ত হিসেবে মিশনারিদের কাছে তিনি দাবি করেছিলেন— তাঁকে বিলেত পাঠানো হোক, সে-শর্তে রাজি হয়ে গেলেন চার্চের কর্তৃপক্ষ। খ্রিস্ট ধর্মে দীক্ষা নেবার তারিখ ঠিক হয়েছিল ৯ই ফেব্রুয়ারি। ২রা ফেব্রুয়ারি মধূসুদন এক মোহরের বিনিময়ে ফিরিঙ্গি-ধাঁচের চুল ছাঁটিয়েছিলেন। হিন্দু কলেজে এসে বন্ধু ভূদেবকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন – ‘‘বলো কেমন হয়েছে আমার চুলের নতুন ছাঁট?’’ ভূদেবের ভাল লাগেনি। মধু ঝগড়া করেননি। কারণ একমাত্র তিনিই জানতেন যে আর কিছু দিন পরে তিনি খ্রিস্টান হবেন, বিলেতেও যাবেন, তাই এমন সাজসজ্জা। ৩রা ফেব্রুয়ারি মধু বাড়ি থেকে উধাও হলেন। পরিচিতদের মধ্যে শেষবার তাঁকে দেখেছিলেন দিগম্বর মিত্রের ছোট ভাই মাধব মিত্র। তবে দুই দিন পর মধুর খোঁজ মিলেছিল। তিনি ছিলেন ফোর্ট উইলিয়ামে। কলকাতার সুপ্রিম কোর্টের একজন নামী উকিলের পুত্র এবং হিন্দু কলেজের অন্যতম সেরা ছাত্রকে খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষা দেওয়া হবে — মিশনারিদের কাছে এটা একটা বড় জয় ছিল। কিন্তু রাজনারায়ণ যদি লাঠিয়াল পাঠান মধুকে কেড়ে নেবার জন্য? তাই দুর্গে লুকিয়ে রাখার ফন্দি করা হয়েছিল। কেউ তাঁর সঙ্গে দেখা করতে পারছিলেন না। তবে শেষ পর্যন্ত দেখা করতে পারেন মধুর জ্যাঠতুতো ভাই প্যারীমোহন, হিন্দু কলেজের শিক্ষক রামচন্দ্র মিত্র এবং বন্ধু গৌরদাস বসাক। তাঁরা অনেক বুঝিয়েছিলেন। মধু অনড় ছিলেন। ৯ই ফেব্রুয়ারি সন্ধেবেলায় ওল্ড চার্চে ‘মাইকেল’ হয়ে গেলেন মধুসূদন দত্ত। প্রায় ছ’বছর কেটে যাবার পরে মধু বুঝেছিলেন সমাজের মার কাকে বলে! হিন্দু কলেজ থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। মা-বাবার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন, কিন্তু থাকতে পারেননি। রাজনারায়ণ মনে মনে ভেবেছিলেন কিছু দিন যাক, প্রায়শ্চিত্ত করিয়ে ছেলেকে আবার স্বধর্মে ফিরিয়ে আনবেন। এত কিছুর মধ্যেও মধু পড়াশুনোটা চালিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। তাই বিশপস কলেজে তাঁকে ভর্তি করে দেওয়া হয়েছিল। খরচপত্র রাজনারায়ণই দিচ্ছিলেন, যদিও বাপ-ছেলের মধ্যে অশান্তি লেগেই ছিল। ক’দিন বাদে তারই জেরে কলেজের শেষ বছরের পরীক্ষায় বসতে পারেননি মধুসূদন। বাবা টাকা দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছিলেন বলে কলেজ ছাড়তে হয়েছিল তাঁকে।
১৮৪৮ সালের ১৮ই জানুয়ারি, মঙ্গলবার, ‘লেডি সেইল’ নামের জাহাজটি মাদ্রাজে পৌঁছেছিল। জাহাজ থেকে নেমেছিলেন ‘মাইকেল মধুসূদন ডাট’। বিশপস কলেজের সহপাঠী এডবার্গ কেনেটের দাক্ষিণ্যে শিক্ষকতার চাকরি জুটেছিল অরফ্যান অ্যাসাইলাম বয়েজ স্কুলে। নামে বয়েজ স্কুল হলেও সেখানে ফিমেল অরফ্যান অ্যাসাইলামের মেয়েরাও পড়তেন। ‘রেবেকা ম্যাকটাভিশ’ থাকতেন ফিমেল অ্যাসাইলামে, পড়াশুনো করতেন অরফ্যানের বয়েজ স্কুলে। মাইকেল ছাত্রী হিসেবে সেখানেই রেবেকাকে পান। শিক্ষক মধুসূদন সকলের নজর কেড়েছিলেন এবং কলেজের বার্ষিক প্রতিবেদনে তাঁর সম্পর্কে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করা হয়েছিল। নীলনয়না শ্বেতাঙ্গিনী রেবেকার সঙ্গে তাঁর প্রণয় এবং পরিণামে পরিণয় হয়ে গিয়েছিল মাত্র ছয় মাসের মধ্যে, যদিও তাতে বাধাও ছিল প্রচুর। ওদিকে রেবেকার পিতৃ-পরিচয় ছিল রহস্যে ঘেরা। তাঁর পিতার নাম ছিল রবার্ট টমসন, মা ক্যাথরিন টমসন। রবার্টের মৃত্যুর পর ক্যাথরিন আশ্রয় পেয়েছিলেন ডুগান্ড ম্যাকটাভিশের কাছে এবং এই পালক পিতা ম্যাকটাভিশের নামকেই রেবেকা নিজের নামের সঙ্গে যুক্ত করে নেন। অথচ রেবেকাকে থাকতে হয়েছিল অরফ্যান অ্যাসাইলামে! তা হলে? রেবেকা কি অনাথ ছিলেন?
বিয়ের সাড়ে তিন মাসের মাথায় রেবেকা গর্ভবতী হলেন। সংসারে যথেষ্ট অভাব। সামান্য বেতনে আর চলে না। এমন পরিবেশে কাব্যচর্চা সহজ নয়। তবু এরই মধ্যে মাইকেল ‘ম্যাড্রাস সার্কুলার’ পত্রিকার জন্য ‘ক্যাপটিভ লেডি’ কাব্যটি লিখে ফেললেন। ধার-দেনা করে বই ছাপিয়ে কলকাতায় পাঠালেন তিনি। বুকে আশা, কলকাতার বুদ্ধিজীবী সমাজ এই বই গ্রহণ করবে। তাকে কবি বলে প্রতিষ্ঠা দেবে। কার্যত বইটি বিক্রি হয়েছিল মাত্র ১৮ কপি। এমনকী ‘বেঙ্গল হরকরা’ পত্রিকায় মাইকেলকে তীব্র আক্রমণ করে রিভিউ লেখা হয়েছিল, যেখানে ব্যক্তি মাইকেলকে ছিঁড়ে-খুঁড়ে ফেলেছিলেন সমালোচক। বেথুন সাহেবও কাব্য সম্পর্কে উচ্চ ধারণা পোষণ করেননি, বরং লিখেছিলেন, ‘‘…ইংরেজি চর্চার মাধ্যমে তিনি যে রুচি এবং মেধা অর্জন করেছেন, তা তাঁর নিজের ভাষার মানোন্নয়ন এবং কাব্যভাণ্ডার সমৃদ্ধ করার কাজে ব্যয় করুন।’’ এর পর মাইকেলের কবিখ্যাতি মাদ্রাজ শহরে আরও বৃদ্ধি পেয়েছিল, ‘রিজিয়া’ (সম্পূর্ণ করেননি), প্রথমে ‘ইউরেশিয়ান’, পরে একযোগে ‘ইস্টার্ন গার্ডিয়ান’ ও ‘মাদ্রাজ হিন্দু ক্রনিকল’ সম্পাদনা করেছিলেন, গ্রিক-ল্যাটিন-হিব্রু-সংস্কৃত-ইংরেজি অধ্যয়ন করেছিলেন একদম রুটিন মেনে।
ওদিকে সন্তানের জন্মের পর রেবেকার স্বাস্থ্য ভেঙে গিয়েছিল। স্বাস্থ্য উদ্ধারের আশায় রেবেকা সন্তানকে নিয়ে বেড়াতে গিয়েছিলেন নাগপুরের দিকে। এই প্রথম রেবেকার সঙ্গে মাইকেলের একটানা দীর্ঘ দিনের বিচ্ছেদ হয়েছিল। সন্তানকে কাছে না পাওয়ার যন্ত্রণা তো ছিলই— সেই সব কিছু লিপিবদ্ধ করে রেখেছিলেন মাইকেল ‘অন দ্য ডিপারচার অব মাই ওয়াইফ অ্যান্ড চাইল্ড টু দ্য আপার প্রভিন্সেস’ নামে একটি কবিতায় – ‘‘মাই হোম ইজ লোনলি — ফর আই সিক ইন ভেনফর দেম হু মেড ইটস স্টার-লাইট।”
পরের বছরের গোড়ায় মাইকেলের মা মারা যান। ‘সুদূর’ মাদ্রাজ থেকে কলকাতায় যাওয়ার মতো আর্থিক সংগতি না থাকলেও ঝটিকা সফরে তিনি কলকাতায় এসে বাবার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন। জাহ্নবী দেবীর এই অকাল মৃত্যুর জন্য রাজনারায়ণ মাইকেলকেই দায়ী করেছিলেন। মধু তাঁর পিতার মুখের ওপর বলতে পারেননি — এই মৃত্যুর জন্য রাজনারায়ণ নিজেও কম দায়ী নন। পুত্রসন্তানের আশায় তিনি আরও তিনটি বিবাহ করেছিলেন যা কম আহত করেনি জাহ্নবীকে।
নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে রেবেকার গর্ভে মাইকেলের চারটি সম্তানের জন্ম হয়েছিল — ব্যর্থা, ফিবি, জর্জ, জেমস। দুটি মেয়ে, দুটি ছেলে। ‘চমৎকার স্ত্রী এবং চারটি সন্তানের’ সংসার যখন তিনি বেশ সাজিয়ে-গুছিয়ে বসছেন, তখন ১৮৫৫ লালের ১৯শে ডিসেম্বর বুধবারে গৌরদাসের লেখা একটি চিঠি থেকে তিনি জানতে পারলেন বাবা রাজনারায়ণ দত্ত মারা গেছেন অন্তত এগারো মাস আগে— ‘‘সম্পত্তির উত্তরাধিকার নিয়ে তোমার জ্ঞাতি ভাইয়েরা কাড়াকাড়ি করছে। তোমার দুই বিধবা মাতা বেঁচে আছেন। কিন্তু তোমার লোভী এবং স্বার্থপর আত্মীয়দের বাড়াবাড়ির জন্য তাঁরা তাঁদের মৃত স্বামীর সম্পত্তি থেকে প্রায় বঞ্চিত হয়েছেন।’’ সম্পত্তি উদ্ধারের আশা আছে জানতে পেরে মাইকেল কলকাতা যাবেন মনস্থির করে ফেললেন।
রেবেকা যখন স্বাস্থ্য উদ্ধারের আশায় উত্তরে ভ্রমণ করতে গেছিলেন, তখনই মাইকেলের সহকর্মী জর্জ জাইলস হোয়াইটের স্ত্রী-বিয়োগ হয়েছিল। জর্জের তিন সন্তান ছিল – বড় মেয়ে হেনরিয়েটা, ছোট দুটি ছেলে উইলিয়াম ও আর্থার। নিজের মাকে হারিয়ে মাইকেল জানতেন যে জীবনে মাতৃবিয়োগের ব্যথা কতটা আহত করে, সহকর্মীর এই তিন সন্তানকে তিনি তাই বাড়তি সঙ্গ দিয়েছিলেন স্বাভাবিক কারণেই। স্ত্রী-বিয়োগের তিন বছর পরে জর্জ হোয়াইট দ্বিতীয়বার বিবাহ করে ফেলেছিলেন ষোলো বছর বয়েসি এমিলি জেইন শর্ট নামে এক কিশোরীকে। জর্জের বয়স তখন ছিল সাতচল্লিশ। হেনরিয়েটা তখন ছিলেন সতেরো, নতুন মা ও নববধূর থেকেএক বছরের বড়। ফলে হোয়াইট পরিবারে ঝড় উঠল। বিমাতার সঙ্গে হেনরিয়েটার পদে পদে অশান্তি শুরু হল — মাইকেল সহানুভূতি, দরদ দেখাতে গিয়ে হেনরিয়েটার সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে পড়লেন। তাঁদের প্রেম গভীর থেকে গভীরতর হল।
পিতার মৃত্যুসংবাদ পেয়ে মাইকেল যখন কলকাতা যাবেন ঠিক করে ফেললেন, তার কিছু দিন আগে তাঁর ‘সুখের নীড়ে’ ভয়ঙ্কর ঝড় বয়ে গিয়েছিল। হেনরিয়েটার সঙ্গে মাইকেলের প্রেম প্লেটোনিক ছিল না। একাধিক বার তাঁদের মিলন হয়েছিল। মাইকেল দিব্য একটি দ্বৈত সম্পর্ক চালাচ্ছিলেন — রেবেকার সঙ্গে দাম্পত্য, হেনরিয়েটার সঙ্গে প্রেম। হেনরিয়েটা মাইকেলের সাহিত্যসঙ্গিনী হয়ে উঠেছিলেন, তাঁর সঙ্গ কবি পছন্দ করতেন, তুলনায় অর্ধশিক্ষিত রেবেকা ছিলেন কবির নির্ভরতার সঙ্গী। কবি নিশ্চয়ই ভুলে যাননি, রেবেকা সহস্র বাধা অগ্রাহ্য করে অনেক ত্যাগ স্বীকার করে মাইকেলকে বিয়ে করেছিলেন। হেনরিয়েটা যদি মাইকেলকে বিয়ের ইচ্ছের কথা প্রকাশ করেও ছিলেন, স্পষ্টবাক মাইকেল নিশ্চয়ই তাঁকে জানিয়ে দিয়েছিলেন রেবেকাকে ডিভোর্স দেওয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। ওদিকে রেবেকা জানতে পেরে গিয়েছিলেন তাঁর স্বামীর নতুন প্রেমের কথা। অনুমান করা যেতে পারে, রেবেকা স্বচক্ষে, অথবা তাঁদের সন্তানদের মধ্যে কেউ একজন মাইকেল-হেনরিয়েটাকে ঘনিষ্ঠ অবস্থায় দেখে ফেলেছিলেন। এর পর পালিয়ে যাওয়া ছাড়া মধুসূদনের পক্ষে বিকল্প কোনও পথ ছিল না।
কলকাতায় পালিয়ে এলেন মাইকেল। আর কোনও দিন ফিরে যাননি রেবেকার কাছে, সন্তানদের কাছে। রেবেকা তাঁকে বিবাহ-বিচ্ছেদ দেননি। হেনরিয়েটাকে বিয়ে করে সুখে সংসার করবে মাইকেল — রেবেকা তা চাননি। মধু যখন বুঝলেন বিবাহ-বিচ্ছেদ পাবেন না, তখন হেনরিয়েটাকে কলকাতায় চলে আসতে লিখলেন। পিতার বিনা অনুমতিতে, ছদ্মনাম নিয়ে হেনরিয়েটা কলকাতায় চলে এসেছিলেন। মাইকেলের কলমে সৃষ্টির জোয়ার এসেছিল। নেশাগ্রস্থের মতো মত্ত হয়েছিলেন তিনি সৃষ্টির আনন্দে — ‘শর্মিষ্ঠা’, ‘পদ্মাবতী’, ‘কৃষ্ণকুমারী’স মায়াকানন নাটক, ‘একেই কি বলে সভ্যতা?’ ‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ’র মতো প্রহসন, ‘তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য’, ‘মেঘনাদবধ কাব্য’, ব্রজাঙ্গনা কাব্য’ ‘বীরাঙ্গনা কাব্য’— পাঁচ বছরে মাইকেল বাংলা নাটক ও কাব্যকে বলতে গেলে নিস্তরঙ্গ পুষ্করিণী থেকে পরিণত করেছিলেন মহাসমুদ্রে।
হেনরিয়েটা আর মাইকেল এক সঙ্গে ছিলেন পনেরো বছর – প্রথমে কলকাতা, পরে ইউরোপ, আবার কলকাতা। হেনরিয়েটার গর্ভে মাইকেলের চারটি সন্তান হয়েছিল — শর্মিষ্ঠা, ফ্রেডরিক, অ্যালবার্ট। তৃতীয় সন্তান একটি মেয়ে সূতিকাগৃহেই মারা যায়।
যে বিদ্যাসাগরকে তিনি একসময় ‘টুলো পণ্ডিত বলে ব্যঙ্গ করতেন, সেই বিদ্যাসাগরই তাঁর পরমবন্ধু হয়ে ওঠেন। কেবল বন্ধু নয়, ‘ত্রাতা’ বলা যায় তাঁকে। মাইকেল বিলেতে গিয়েছিলেন ব্যারিস্টার হবেন বলে। অমিতব্যয়িতা, বড়লোকি চাল দেখানো মাইকেলের বহু দিনের স্বভাব ছিল – বলা ভালো বদ-স্বভাব ছিল। এ জন্য তিনি মাদ্রাজ, কলকাতা, লন্ডন, ভার্সাই কোথাও শান্তি পাননি। পাওনাদারদের অভিযোগে তাঁকে পুলিশ-থানা পর্যন্ত যেতে হয়েছিল। শেষ পর্বে, বিশেষ করে ইউরোপ বাসকালে বিদ্যাসাগর তাঁকে যে ভাবে বারবার টাকা দিয়ে সাহায্য করেছিলেন, তার তুলনা মেলা ভার। ১৮৬৬ সালের ১৭ই নভেম্বর আনুষ্ঠানিক ভাবে ব্যারিস্টারির স্বীকৃতি পান মাইকেল। এই সুখের খবর তিনি সবার আগে জানিয়েছিলেন বিদ্যাসাগরকে – ‘‘আমি নিশ্চিত আপনি জেনে দারুণ খুশি হবেন যে, গত রাতে গ্রেজ ইন সোসাইটি আমাকে বার-এ ডেকে পাঠিয়েছিল এবং আমি অবশেষে ব্যারিস্টার হয়েছি। এর সব কিছুর জন্য আমি ঋণী প্রথমে ঈশ্বর এবং তাঁর নীচে আপনার কাছে। এবং আপনাকে আমি নিশ্চয়তা দিয়ে বলতে পারি, আমি চিরদিন আপনাকে আমার সবচেয়ে বড় উপকারী এবং সবচেয়ে খাঁটি বন্ধু বলে বিবেচনা করব। আপনি না হলে আমার যে কী হতো।… প্রিয় বিদ্যাসাগর, আপনি ছাড়া আমার কোনও বান্ধব নেই।’’
ছাত্রাবস্থায় অঙ্কে মধুসূদনের আগ্রহ ছিল না। কিন্তু ইচ্ছে করলে তিনি যে গণিতেও ভাল করতে পারতেন হিন্দু কলেজের ক্লাসে তার পরিচয় দিয়েছিলেন। অন্য ছাত্ররা যে অঙ্ক করতে পারেনি, মধু সেই অঙ্ক করে দিয়ে মন্তব্য করেছিলেন – ‘‘দেখলে তো শেক্সপিয়র ইচ্ছে করলে নিউটন হতে পারতেন, কিন্তু নিউটন ইচ্ছে করলে শেক্সপিয়র হতে পারতেন না।’’ বেহিসেবি মাইকেল জীবনের অঙ্ক কোনও দিনই মেলাতে পারেননি, ব্যারিস্টার হয়ে কলকাতায় এসে ব্যবসা শুরুর আগেই হোটেলে বিলাসী জীবন কাটানো, পরিবারকে ভার্সাইতে রেখে আসার মতো হঠকারী সিদ্ধান্ত, ধার করে ঘি খাওয়া— এই সব কিছুই তাঁর জীবনকে দ্রুত মৃত্যুর দিকে নিয়ে গিয়েছিল। বিদ্যাসাগরের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি ঘটে গিয়েছিল এই পর্বে। ও দিকে ভার্সাইতে দারিদ্র্য পীড়িত হেনরিয়েটা মদ্যপানে অভ্যস্ত হয়ে পড়েন। সন্তানদের নিয়ে কলকাতায় ফিরে এলেও তাঁদের অবস্থার কোনও উন্নতি হয়নি। এক সময় মাইকেল পঞ্চকোটের রাজা নীলমণি সিংহের ম্যানেজারির চাকরি নিয়ে অজ-পাড়াগাঁ কাশীপুরে গিয়েছিলেন। তবে মন্দ কপাল কবির। এই চাকরিও থাকে নি। এক নাপিত রাজামশাইয়ের কান ভেঙেছিলেন মাইকেলের নামে। ফলশ্রুতিতে প্রাণ বাঁচাতে রাতের অন্ধকারে পঞ্চকোট থেকে পালাতে বাধ্য হয়েছিলেন তিনি।
১৮৭৩ সালের মার্চ মাস নাগাদ কবির স্বাস্থ্য একেবারে ভেঙে পড়ে। কন্যা শর্মিষ্ঠার তখন তেরো বছর বয়স, কবি তাঁর বিয়ে দিয়ে দিলেন তাঁর দ্বিগুণ বয়েসি এক অ্যাংলো যুবকের সঙ্গে। মেয়ের বিয়ের পর সপরিবারে মাইকেল গেলেন উত্তরপাড়ায় — লাইব্রেরির ওপর তলায় উঠলেন, হাওড়ার ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে বদলি হয়ে আসা বাল্যবন্ধু গৌরদাস মধুকে দেখতে যান এবং দেখতে পান — ‘‘সে তখন বিছানায় তার রোগযন্ত্রণায় হাঁপাচ্ছিল। মুখ দিয়ে রক্ত চুঁইয়ে পড়ছিল। আর তার স্ত্রী তখন দারুণ জ্বরে মেঝেতে পড়ে ছিল।’’
পরদিন মাইকেলকে ভর্তি করানো হল আলিপুরের জেনারেল হাসপাতালে, গলার অসুখ তো ছিলই, যকৃতের সিরোসিস থেকে দেখা দিয়েছিল উদরী রোগ, হাসপাতালে কবির সঙ্গে একদিন দেখা করতে এসেছিলেন তাঁর এক সময়ের মুন্সি মনিরুদ্দিন। মাইকেল তাঁর কাছে টাকাপয়সা আছে কিনা জানতে চেয়েছিলেন। মনিরুদ্দিন জানিয়েছিলেন, দেড় টাকা আছে। ওটাই চেয়েছিলেন মধু, তারপর তা বখশিস হিসেবে দিয়ে দিয়েছিলেন তাঁর সেবারতা নার্সকে।
২৬শে জুন হেনরিয়েটা মারা যান। মাইকেল এই সংবাদ এক পুরনো কর্মচারীর কাছ থেকে জানতে পারেন।
২৯শে জুন রবিবার, মাইকেলের অন্তিম অবস্থা ঘনিয়ে এল। বেলা দুটোর সময় চিরঘুমের দেশে চলে গেলেন কবি।
এই মৃত্যুর পরেই সবকিছু শেষ হতে পারত, কিন্তু হয়নি। কবির নশ্বর দেহটা তখনও এই ধরাধামে ছিল।
মৃত্যুর পর মাইকেলের শেষকৃত্য নিয়ে সমস্যা দেখা দিল।কলকাতার খ্রিস্টান সমাজ তাঁকে সমাহিত করার জন্য মাত্র ছয় ফুট জায়গা ছেড়ে দিল না। ফলে কবির মরদেহে পচন ধরল। অবশেষে এগিয়ে এলেন অ্যাংলিকান চার্চের রেভারেন্ড পিটার জন জার্বো।বিশপের অনুমতি ছাড়াই, জার্বোর উদ্যোগে, ৩০শে জুন বিকেলে, মৃত্যুর ২৪ ঘণ্টারও পরে লোয়ার সার্কুলার রোডের কবরস্থানে মাইকেলকে সমাধিস্থ করা হয়। চার দিন আগে সেখানেই হেনরিয়েটাকে সমাধিস্থ করা হয়েছিল। কবির কবর খোঁড়া হয় তার পাশেই।
সে দিন ভক্ত ও বন্ধুবান্ধব মিলে উপস্থিত ছিলেন প্রায় এক হাজার মানুষ। কিন্তু একদিন শ্রদ্ধা ও ভালবাসায় নিজের গ্রন্থ উৎসর্গ করে যাঁদের বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে বিখ্যাত করে গিয়েছিলেন, সেই ভিড়ে ছিলেন না তাঁদের একজনও।
(তথ্যসূত্র:
১- আশার ছলনে ভুলি, গোলাম মুরশিদ।
২- মাইকেল মধুসূদন দত্ত, বিপ্লব বালা, প্রথমা প্রকাশন (২০১৫)।
৩- সেই সময় (অখণ্ড) (পটভুমিকা ১৮৪০ থেকে ১৮৭০), সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় (নীললোহিত), আনন্দ পাবলিশার্স (২০১৪)।
৪- বিদ্যাসাগর, শিবাপ্রশন্ন ভট্টাচার্য, রচয়িতা (২০১০)।
৫- বিদ্যাসাগর: নানা প্রসঙ্গ, রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য, চিরায়ত প্রকাশন (২০১১)।
৬- বিদ্যাসাগর ও বাঙালী সমাজ, বিনয় ঘোষ।
৫- যুগপুরুষ বিদ্যাসাগর, বিনয় ঘোষ।
৭- মাইকেল মধুসূদন দত্ত, বিপ্লব বালা, প্রথমা প্রকাশন (২০১৫)।
৮- মাইকেল মধুসূদন দত্ত, সুনির্মল বসু, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র (২০১৬)।
৯- একেই কি বলে সভ্যতা? সভ্যতার দুই মুখ, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, করুণা প্রকাশনী (২০১২)।
১০- মাইকেল মধুসূদন দত্ত প্রসঙ্গে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিশ্বভারতী।
১১- আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৬ই নভেম্বর ২০১৯ সাল।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত