সঙ্গীতকার সুশীল বন্দ্যোপাধ্যায়, ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যর বিশেষ বন্ধু। তিনি তাঁর ছাত্রীকে নিয়ে এলেন ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যর কাছে। সকাল এগারোটা-সাড়ে এগারোটা বাজে। গরমকাল। ফ্রক পরা একরত্তি মেয়েটির গলায় মাফলার। মাম্পস্ হয়েছে। সুশীলবাবু আলাপ করিয়ে দিলেন, ‘‘ওর নাম আরতি। এ বারে মারফি রেডিয়োর প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছে। তোমায় প্রণাম করবে। আশীর্বাদ করো। তোমায় গানও শোনাতে চায়।’’ সেই প্রথম আরতি মুখোপাধ্যায়ের ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যকে কাছ থেকে দেখা। ধনঞ্জয় বললেন, ‘‘তুমি গান গাইতে পারবে? গলায় যে ব্যথা!’’ ক্ষীণ গলায় উত্তর, ‘‘পারব।’’ তখন ‘মামলার ফল’ ছায়াছবির কাজ চলছে। পরের পর দিন রেকর্ডিং। ধনঞ্জয় তখনই ফোন করলেন ছবির সঙ্গীত পরিচালককে, ‘‘আমার সঙ্গে একটি বাচ্চা মেয়ে ডুয়েট গাইবে। আপনি পরিচালক-প্রযোজকের সঙ্গে কথা বলে জানান।’’ পরক্ষণেই পরিচালকের ফোন, ‘‘কী ব্যাপার দাদা?’’ বললেন সব। উত্তর এল, ‘‘কিন্তু ছবিতে এমন কোনও সিচ্যুয়েশন নেই যে!’’ ধনঞ্জয় বললেন, ‘‘নেই তো কী হয়েছে! তৈরি করে নিন।’’ ওই এক কথাতেই স্ক্রিপ্ট পাল্টে গেল। বাবার গলায় গাইলেন ধনঞ্জয়। তাঁর বাচ্চা ছেলের লিপে আরতি মুখোপাধ্যায়। আরতি তখন এতই ছোট, রেকর্ডিং-এর সময় টেবিলের ওপর তাকে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হল মাইকের সামনে মুখ ধরতে। সেই প্রথম আরতি মুখোপাধ্যায়ের সিনেমায় গান করতে যাওয়া।
বিদ্যাপতি ছবির কাজ হচ্ছে। ভি বালসারা সঙ্গীত পরিচালক। ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য গাইছেন। লতা মঙ্গেশকরও গাইবেন। রেকর্ডিং-এর দিন ধনঞ্জয় গান গেয়ে বাড়ি ফিরে এসেছেন। তার দু’দিন পর টেলিফোন। পুরুষকণ্ঠ। পরিচয় দিলেন, ‘‘হৃদয়নাথ মঙ্গেশকর। দিদি আপনার কাছে যাবে দাদা।’’ পর দিনই লতা মঙ্গেশকর এলেন। বালসারার অ্যাসিসটেন্ট গাড়ি করে নিয়ে এলেন। ধনঞ্জয় বলে রেখেছিলেন বাড়িতে, কেউ যেন লতাকে গান গাইতে না বলে। লতা এলেন। ঘরে বসে এ কথা, সে কথা। কিছুক্ষণ বাদে ধনঞ্জয়-জায়া রেখাদেবী অন্য সবার জোরাজুরিতে বলে ফেললেন, ‘‘বহিনজি, তুমি আমার বাড়িতে এলে অথচ গান শুনব না!’’ লতা হেসে বললেন, ‘‘আমার যে গানের বই লাগবে।’’ রেখাদেবী বললেন, ‘‘বই তো নেই। তুমি তো শুনেছি ঠাকুরের কাছে রোজ গান গাইতে বসো। সে-গানই করো না।’’ তাই-ই শোনালেন লতা মঙ্গেশকর। পাশে বসে হারমোনিয়ামে সঙ্গত করলেন ধনঞ্জয়। ঘণ্টা দুই থেকে চলে গিয়েছিলেন লতা মঙ্গেশকর।
মীরাবাঈ ছবির গানের রেকর্ডিং। ভারতলক্ষ্মী স্টুডিয়োয়। রেকর্ডিং শেষে স্টুডিয়োর কর্ণধার বাবুলাল চুখানিকে ধনঞ্জয় বললেন, ‘‘আমার টাকা চাই না। আপনার দেওয়ালে ওই যে মদনমোহনের (গোপাল) ছবিটি টাঙানো আছে, ওটি আমায় দিয়ে দিন।’’ বাবুলাল কিছুতেই রাজি নন। ধনঞ্জয়ও নাছোড়। এক সময় তাঁর চোখে জল চলে এল। টাকা না নিয়েই স্টুডিয়ো ছেড়ে চলে গেলেন। সন্ধের দিকে ঝমঝমে বৃষ্টি কলকাতায়। রাত আটটা কী ন’টা বাজে। বাবুলাল তাঁর ছেলেকে ডেকে বললেন, ‘‘জগদীশ, তুমি ছবিটা খুলে ওঁকে দিয়ে এসো। আমি ওঁর ভক্তির কাছে হার মেনেছি। পাগলটা ছবি না পেলে আজ সারা রাত হয়তো জেগেই বসে থাকবে।’’ জগদীশ গেলেন ধনঞ্জয়ের বাড়ি। মদনমোহন হাতে পেয়ে বুকে জড়িয়ে ধরলেন ধনঞ্জয়। যেন সাত রাজার ধন মানিক! বললেন, ‘‘জানো জগদীশ, আমি জানতাম, এ ছবি আমি পাবই।’’
ছিলেন পাঁড় মোহনবাগানি। মোহনবাগানের খেলা থাকলে মাঠে যাবেনই যাবেন। মোহন-ইস্ট ম্যাচের দিন অনুষ্ঠান থাকলে উদ্যোক্তারা প্রার্থনা করতেন, যেন মোহনবাগান জেতে, নইলে ধনঞ্জয় যে কী করবেন বলা মুশকিল! ময়দানেও তাঁর ভক্ত কম ছিল না। পিকে বন্দ্যোপাধ্যায়, চুনী গোস্বামী কে না! কোচিং করার সময় মাঠ থেকে টেন্টে ফিরে নিজের ঘরে বসে নিজেকে হাল্কা করতে পিকে বন্দ্যোপাধ্যায় প্রায়ই ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যর গান ভাঁজতেন। মোহনবাগানের ধীরেন দে এক বার তাঁকে ফুটবল-সচিব করবেন বলে উঠে পড়ে লেগেছিলেন। রাজি হননি ধনঞ্জয়। উঠতি অভিনেতা বিশ্বজিৎ চট্টোপাধ্যায় যখন হাতিবাগানের থিয়েটারে ‘এক্সট্রার’ রোল করছেন, থাকতেন মির্জাপুরের মেসে (যে মেসে জহর রায়ও থাকতেন)। ময়দানে খেলা দেখতে গেলে বিশ্বজিৎ ফিরতেন ধনঞ্জয়ের গাড়িতেই। ওঁর সঙ্গে ধনঞ্জয়ের সম্পর্ক ছিল দাদা-ভাইয়ের মতো। বিশ্বজিৎ যখন ‘ছোট্ট জিজ্ঞাসা’ (প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের প্রথম ছবি) করবেন, ওঁর স্ত্রী রত্নাদেবী কলকাতায় এসে এক বার শুধু বলেছিলেন, ‘‘দাদা আপনাকে কিন্তু গাইতে হবে।’’ এক কথায় ‘হ্যাঁ’ বলেছিলেন ধনঞ্জয়।
’৪৬ কী ’৪৭ সাল। বাংলাদেশ। যশোরে অনুষ্ঠান। লঞ্চে করে অনেকটা গিয়ে, তবে গাড়িতে যেতে হবে। যশোরের ঠিক আগে কোত্থেকে এক দল ছাত্র এসে ধুপধাপ করে লঞ্চ দাপিয়ে বেড়াতে লাগল। যেন কাউকে ওরা খুঁজে বেড়াচ্ছে। পাচ্ছে না। হঠাৎ ধনঞ্জয় শুনলেন, ওদেরই কেউ বলছে, ‘‘এই লঞ্চেই আইতাসে। খুঁজ খুঁজ। দ্যাখ কেডার ডাইন হাতে ঘড়ি, গালে পান।’’ ধনঞ্জয়ের আর বুঝতে বাকি রইল না, ওরা কাকে খুঁজছে। ডান হাতে ঘড়ি, গালে পান যে তারই ট্রেডমার্ক। খুব ভয় পেয়ে গেলেন। কী করবে এরা! মেরে ফেলবে না তো? ঘড়ি ডান থেকে বাঁ হাতে নিলেন। গালের পান ফেলে দিলেন। কিছুক্ষণ বাদে যশোর চলে এল। হোটেলে নিয়ে ওঠালেন ওখানকার লোকজন। যত্নের কোনও ত্রুটি নেই। ভয়-আশঙ্কা তখন গেল। সন্ধেয় অনুষ্ঠান। কাল ফিরে যাওয়া। স্ত্রী তখন সন্তানসম্ভবা। তাঁর জন্য চিন্তাতেও আছেন। এ দিকে দুপুর থেকে শুরু হল বৃষ্টি। এত বৃষ্টি এত বৃষ্টি যে সে দিন অনুষ্ঠান হতেই পারল না। এ বার উদ্যোক্তাদের অনুরোধ, ‘‘দাদা কাইল থাইক্যা, প্রোগ্রাম কইরা পরশু যান।’’ সে কী করে সম্ভব! বাড়ির ওই অবস্থা। বললেন, ‘‘আপনারা টাকা ফেরত নিন। আমায় যেতে দিন।’’ কর্মকর্তারা তাতেও রাজি নন। এ বার সেই ছাত্রর দল হোটেলে চড়াও। — ‘‘আপনের তো খুব জেদ দ্যাখতাসি। প্রোগ্রাম করবেন না, ট্যাকাও ফিরত দিয়া দিবেন! দেখি আপনার যাওয়া কী কইরা হয়! আমরা শুইয়া পড়ুম রাস্তায়। যাইতে হইলে আমাগো পাড়াইয়া যাইতে হইব।’’ শেষে বাধ্য হলেন ধনঞ্জয়। টাকা নিয়ে তবে ছাড় পেলেন। যখন লঞ্চে উঠছেন, দেখেন সেই ছাত্রর দল একটু দূরেই দাঁড়িয়ে। হাউ হাউ করে কাঁদছে ওরা। ওঁর চোখও ভেসে গেল জলে!
“প্রধানমন্ত্রীর চিঠি না পেলে আমি গাইতে যাব না।’’
উদ্যোক্তাদের সটান বলে দিয়েছিলেন ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য।
প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলের জন্য বিরাট অনুষ্ঠান। কলকাতায়। বাংলার প্রায় সব নামী শিল্পী থাকবেন। সেখানে যেতে অমনই এক শর্ত দিয়ে বসলেন তিনি।
অনুষ্ঠান যখন প্রধানমন্ত্রীর নামে, তাঁকেই অনুরোধ জানিয়ে চিঠি পাঠাতে হবে। উদ্যোক্তাদের মাথায় হাত।
তখন ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য বলতে গেলে বাংলা গানের জগতে উল্কা। তাঁকে ছাড়া কোনও অনুষ্ঠান ভাবা যায় না। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর চিঠি? সেটা পাওয়াও তো দুঃসাধ্য ব্যাপার! উপায়? খবর গেল মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়ের কাছে। ধনঞ্জয়ের গানের ভক্ত তিনিও। দেখা হলেই বলতেন, ‘‘তোমার গয়াগঙ্গা প্রভাসাদি গানটা গাও তো।’’ শেষ জীবনে এক বার গাইতে ডেকে ছিলেন বাড়িতে। ছেলের অসুখের জন্য যেতে পারেননি ধনঞ্জয়। আর অদ্ভুত ব্যাপার, সে দিনই খবর পান, ডা. বিধানচন্দ্র রায় আর নেই! এই আফশোস শেষ দিন পর্যন্ত ওঁকে তাড়িয়ে বেড়িয়েছে। ধনঞ্জয় প্রধানমন্ত্রীর চিঠি চেয়েছেন শুনে বিধান রায় বললেন, ‘‘এ ছেলের গাট্স আছে! বাঙালির এই চরিত্রটারই বড় অভাব। ওকে বলো গান গাইতে। আমি জওহরলালের চিঠি আনিয়ে দেব।’’ তাই হয়েছিল। কথা রেখেছিলেন বিধানচন্দ্র রায়। গানও গেয়েছিলেন ধনঞ্জয়।
মা অন্নপূর্ণার কোলে সদ্যোজাত ধনঞ্জয়কে দেখে দাদামশাই বলেছিলেন, ‘‘জাতকের মুখাবয়বে অনেক সুলক্ষণ দেখতে পাচ্ছি। যদি বাঁচে, একদিন স্বনামধন্য কৃতী পুরুষ হবে।’’
১৯২২ সালের ১০ই সেপ্টেম্বর, রবিবার, হাওড়ার বারেন্দ্রপাড়ায় জন্ম হয় ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যের। ভট্টাচার্য পরিবারের আদিবাস ছিল হাওড়ায়। ওঁরা ছিলেন পায়রাটুঙ্গির জমিদার। পূর্বপুরুষের প্রচুর সম্পত্তি বংশানুক্রমে পান ধনঞ্জয়ের বাবা সুরেন্দ্রনাথ। সম্পত্তি নিয়ে শুরু হয় জ্ঞাতি-কুটুম্বদের সঙ্গে অশান্তি। তাতে সুরেন্দ্রনাথ ওখানকার পাট গুটিয়ে চলে যান হাওড়ার আমতায়। ওঠেন ভাড়াবাড়িতে। বালির বাগানতলার বারেন্দ্রপাড়ায় জমি কেনেন। সুরেন্দ্রনাথ চাকরি করতেন বিএনআর-এ। বড় ছেলে লক্ষ্মীকান্তও তাই। দু’জনেই এস্রাজ বাজাতেন। তাঁদের চোখ এড়িয়ে দুপুরবেলা এস্রাজে হাত পাকাতে গিয়ে ধরা পড়ে যান ধনঞ্জয়। তখন বয়স কতই’বা, সবে পাঁচ। এস্রাজ গেল। কিন্তু গলা থাকতে গান নেবে কে? মাঝিমাল্লার গান, বাউল-বোষ্টমের গান, কীর্তন, পালার গান, তরজা, পাঁচালি যখন যা পেয়েছেন গলায় ধরেছেন। আর ছিল মা অন্নপূর্ণার মিঠে গলার ঘুমপাড়ানি, ছেলেভুলানো যত গান। মাত্র চার মাসের তফাতে সুরেন্দ্রনাথ-লক্ষীকান্ত দু’জনেরই অকালমৃত্যু হয়। অন্নপূর্ণার তখন জেরবার দশা। এগারোটি সন্তান। সম্বল বলতে বালির জমি। ধনঞ্জয় তখন সাত বছর। পান্নালাল সাত মাসের মাতৃগর্ভে। এক-এক দিন এমনও গেছে, ঘরে খাবার-আনাজপাতি বলতে কিছু নেই। মাঠঘাট থেকে গাছগাছালি কুড়িয়ে অন্নপূর্ণা ফুটিয়ে খেতে দিয়েছেন ছেলেমেয়েদের। নিজে সেই ফোটানো জলটুকু মুখে দিয়েছেন। ধনঞ্জয় ছিলেন মা বলতে অজ্ঞান। মা একাদশী করবেন, উপোসি থাকবেন, তা’ও তার সয় না। ওই সাত বছর থেকে মায়ের সঙ্গে ছেলেরও একাদশী শুরু হল। পড়াশুনো করতেন রিভার্স টমসন স্কুলে। পরে যার নাম হয় শান্তিরাম স্কুল। মেধাবী ছাত্র ছিলেন। পরীক্ষায় বরাবর ফার্স্ট, না হয় সেকেন্ড। কিন্তু টাকাপয়সার তখন এমন টানাটানি, পড়া বন্ধ হয়ে যায় আরকী! মাস্টারমশাইদের মধ্যে খুব ভালবাসতেন সুধাংশু স্যার। তাঁর চেষ্টায় স্কুলের মাইনে মকুব হল। ম্যাট্রিক পরীক্ষা। তখন আবার ফি দেওয়ার পয়সা নেই। শিক্ষকরাই চাঁদা তুলে ধনঞ্জয়ের ফি দিয়ে দিলেন। সুধাংশু স্যারেরই উদ্যোগে প্রথম গান শিখতে যাওয়া। স্যার সাইকেলে চাপিয়ে ছাত্রকে নিয়ে গান শেখাতে যেতেন উত্তরপাড়ায়। এর পর একে একে ধনঞ্জয়ের গানজীবনে শিক্ষক হয়ে আসেন অনেকে। কিন্তু গানের প্রথম গুরু কে, বললেই বলতেন, ‘‘বাড়ির সামনে গান গেয়ে ভিক্ষা করছিল এক ভিক্ষুক। ‘একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি’। ওই আমার প্রথম শিক্ষাগুরু। অনেক পরে ‘ক্ষুদিরাম’ ছবিতে গেয়েছিলাম ওই গান। অনেক প্রশংসা পেয়েছি। অর্থ পেয়েছি। কিন্তু গুরুকে আমার কিছুই দেওয়া হয়নি।’’ ’৪৫ সালে ধনঞ্জয় বিয়ে করেন রেখাদেবীকে। শ্বশুরমশাইয়ের হোটেলের ব্যবসা। কলেজ স্ট্রিটের কাছে সেই হোটেল। এক সময় তারই দেখাশোনা করতে রেখাদেবীকে চলে আসতে হয় কলকাতা। সঙ্গে ধনঞ্জয়কেও। ’৪৮ থেকেই শুরু হয় ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যর কলকাতা-জীবন।
জেদ। শক্তপোক্ত শিরদাঁড়া। সম্মানবোধ। জীবন জুড়ে ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য তাঁর গানের মতোই এ সব যত্নে বয়ে বেড়িয়েছেন।
ওঁর সঙ্গে শচীনদেব বর্মনের হৃদ্যতার শুরু অনেকটা এই স্বভাবের কারণেই। ‘‘বাংলা গান গাইতাছ, দরদ নাই ক্যান? বাংলা গান গাইবার কায়দাই শিখো নাই।’’ প্রথম সাক্ষাতে শচীনকর্তার মুখে এমন কথা শুনে খুব ভেঙে পড়েছিলেন সদ্য যুবক ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য। ছোটবেলা থেকে তাঁকেই যে ধ্রুবতারা মানেন! ডাক পেয়েছিলেন ‘জীবনসঙ্গিনী’ ছবির প্লে-ব্যাকের জন্য। সঙ্গীত পরিচালক হিমাংশু দত্ত। টাইটেল মিউজিকে থাকবেন তিন জন— শচীনদেব বর্মন, সুপ্রভা সরকার (তখন ঘোষ)। সঙ্গে সতেরো বছরের তরুণ ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য। শচীনদেব সে সময় খ্যাতির শীর্ষে। সুপ্রভাকে ডাকা হয় বাংলার ‘আশা ভোঁসলে’। তরুণ ছেলেটির গান পছন্দ হয়নি কর্তার। মুখের ওপর জানিয়ে দিয়েছিলেন। কষ্ট পেয়েছিলেন খুব। এর আগে হিন্দুস্থান কোম্পানির অডিশন দিতে গিয়েছিলেন ধনঞ্জয়। কুন্দনলাল সায়গল আর কমল দাশগুপ্ত তাঁকে খারিজ করে দেন। কষ্ট তখনও পেয়েছিলেন। কিন্তু এ বারেরটা যেন পুরনো সব ক্ষতকে ছাপিয়ে গেল। মনে মনে ঠিক করে নিলেন, এক দিন না এক দিন কর্তাকে মুগ্ধ করবেনই তিনি।
বছর কয়েক বাদের ঘটনা।
তত দিনে প্রথম বেসিক গানের রেকর্ড বেরিয়ে গেছে।— ‘‘যদি ভুলে যাও মোরে জানাবো না অভিমান।’’ সারা বাংলা ধন্য-ধন্য করছে। সে সময়ই ইউনিভার্সিটি হলে গানের আসর। গাইবেন কর্তা। শিল্পী হিসেবে ধনঞ্জয়ও আছেন। তখনও তিনি কলকাতার বাসিন্দা নন। আসতেন বালি থেকে। কর্মকর্তারা বার বার অনুরোধ জানাচ্ছেন মঞ্চে উঠতে। তিনি কিছুতেই উঠবেন না। শচীনকর্তা না এলে গাইতেই বসবেন না। তাঁকে শোনানোর জন্যই তো ছুটে আসা।
রাত বাড়ছে। তাও কর্তার দেখা নেই। ফিরতে হবে বালিতে। বাড়িতে মা না খেয়েদেয়ে ছেলের অপেক্ষায় বসে থাকেন রোজ। ফলে আর দেরি করা চলে না। শেষে মঞ্চে উঠতেই হল। চোখ বুজে সেই অতিপরিচিত ভঙ্গিতে গাইতে গাইতে এক সময় তন্ময় হয়ে পড়লেন। হঠাৎ শোরগোল। একটু চাইতেই দেখেন দলবল নিয়ে কর্তা ঢুকছেন। সে দিন যে কী ভর করেছিল গলায়! রত্নভাঁড়ারের সব ক’টি দরজা খুলে যেন গাইতে বসেছিলেন ধনঞ্জয়। মঞ্চের পাশ দিয়ে সিঁড়ি বেয়ে গ্রিনরুমে যেতে গিয়ে শচীনদেব থমকে গেলেন। পর পর ছ’টি গান গাইলেন ধনঞ্জয়। আর এই সময়টাতে সিঁড়ির কাঠের রেলিঙে হাত রেখে স্থানু হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন কর্তা। গান থামলে জড়িয়ে ধরলেন ধনঞ্জয়কে। মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, ‘‘গলাডারে রাইখ্যো ধনঞ্জয়, গলাটারে রাইখ্যো।’’ এর পর শচীনকর্তার সঙ্গে এতটাই ঘনিষ্ঠতা হয়ে গেল যে, মুম্বই থেকে কলকাতায় এলে ধনঞ্জয়ের সঙ্গে দেখা না করলে কর্তার চলত না। দু’জনেরই ছিল মাছ ধরার শখ। তার জন্য কোথায় না কোথায় চলে যেতেন ওঁরা। আর মাঝে মাঝেই বলতেন, ‘‘বোম্বে চইল্যা আয় ধনা। পকেট ভইরা টাকা দিমু। অগো দ্যাখাইতে লাগে ভার্সেটাইল ভয়েস কারে কয়!’’ প্রতিবারই এক উত্তর, ‘‘বাংলা মায়ের আঁচল ছেড়ে পাদমেকং ন গচ্ছামি।’’
একবারই যেতে হয়েছিল মুম্বই। তা’ও পাকেচক্রে। গাইতেও হয়েছিল। সে ’৫২ সালের কথা।
সুরকার রাইচাঁদ বড়াল তখন প্রকাশ পিকচার্সের হিন্দি ছবি ‘মহাপ্রভু শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য’র সুর করছেন। তখনই হঠাৎ তাঁর টেলিগ্রাম এল কলেজ স্ট্রিটে ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যের সিসিল হোটেলের বাড়িতে।— ‘‘ধনু প্লিজ কাম।’’ প্রচণ্ড দুশ্চিন্তায় পড়লেন। রাইচাঁদকে পিতৃবৎ শ্রদ্ধা করতেন। ভাবলেন, ‘‘নিশ্চয়ই কোনও বিপদ রাইদার।’’ সে দিনই রওনা দিলেন ট্রেনে। গিয়ে শুনলেন আসল ব্যাপারটা! ছবিতে দুটি কীর্তনাঙ্গের গান আছে। ও দুটি গাইতে হবে। একটা একক। অন্যটা তিনজনে— মহম্মদ রফি, লতা মঙ্গেশকরের সঙ্গে। এ দিকে যে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে বসে আছেন, ওখানে তিনি গাইবেন না! কিন্তু ‘রাইদা’-কে সে কথা বলবেন কী করে! শেষে অনেক কুণ্ঠা, দ্বিধা নিয়ে বলেই ফেললেন, ‘‘আমি গাইতে পারব না, রাইদা। আমায় ফিরিয়ে দিন কলকাতা।’’ প্রাণপ্রিয় ধনঞ্জয়ের কাছ থেকে এমন প্রত্যাখ্যান স্বপ্নেও কল্পনা করেননি রাইচাঁদ। রাগে, অভিমানে, কষ্টে বললেন, ‘‘বেশ, তাই হোক।’’ কিন্তু রাইচাঁদের চোখমুখের তখন যা অবস্থা হল! দেখে নরম হলেন ধনঞ্জয়। বললেন, ‘‘ঠিক আছে, গাইছি। কিন্তু এই প্রথম, এই শেষ বার।’’ গেয়েছিলেন। গান তোলাতেও হয়েছিল লতা, আশা, মুকেশ, রফি, তালাত মামুদ আর গীতা দত্তকে। দু’মাস থাকতে হয়েছিল শুধু ওই কাজের জন্য। সেই প্রথম, সেই শেষ।
এই সময় বালির বাড়ি থেকে স্ত্রী চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘‘ওঁরা যখন এত করে চাইছেন, তখন তো থেকে যেতে পারো বোম্বেতে।’’ উত্তর এসেছিল, ‘‘হ্যাঁ, থাকতেই পারি। অনেক টাকা পাব। অঢেল স্বাচ্ছন্দ্য, ভোগ, বিলাস। রোজ গভীর রাতে বাড়ি ফিরব। উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাপন করব। এমন কি তুমি চাও? হ্যাঁ, কি না জানাও।’’ এর পর স্ত্রী পুরো পাতা জুড়ে বড় বড় অক্ষরে একটা শব্দই লিখে পাঠিয়েছিলেন—‘‘না।’’
চল্লিশের দশকে মুম্বই যাওয়ার প্রথম অফার ছিল তখনকার বিখ্যাত প্রযোজক ‘কারদার প্রোডাকশন’ থেকে। পাঁচশো টাকা মাসোহারা। সঙ্গে গাড়ি, বাড়ি সব কিছু। নির্দ্বিধায় ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। এর পর একে একে কারা বলেননি যেতে! মহম্মদ রফি বলেছেন। সলিল চৌধুরীকে দিয়ে লতা মঙ্গেশকর অনুরোধ পাঠিয়েছেন, ‘‘উনকো লে আইয়ে না দাদা।’ সামনাসামনি দেখা হলেও বলেছেন বারবার। কারও কথায় কর্ণপাত করেননি। সলিল নিজে বহুবার বলেছেন। তাতেও না। সলিল চৌধুরী এক জায়গায় লিখছেন, ‘‘তিন দশক ধরে বোম্বাই প্রবাসী থেকে তখন যোগাযোগ প্রায় ছিন্ন। এক দিন ধনাদা বললেন, আমাকে দু’খানা গান করে দিতে হবে। আমি ধন্য হলাম। দু’খানা গান দু’জাতের করব, তখন থেকেই মাথায় ছিল। একটা হবে রাগাশ্রয়ী। অন্যটা কাব্যগীতি। তাঁর অসাধারণ কণ্ঠগুণে এবং রসবোধে গান দুটি যেন নতুন জন্ম পেল— ‘ঝনন ঝনন বাজে’, ‘অন্তবিহীন এই অন্ধরাতের শেষ’।’’
সলিল বলতেন, ‘‘ধনুদা মহম্মদ রফি, তালাত মামুদের সমান, কিছু ক্ষেত্রে তার চেয়েও বড়। তা সত্ত্বেও মানুষটা নিজেকে নির্বাসিত করে রাখলেন বাংলায়। আর বাংলা ওঁকে ঠিকমতো কাজে লাগাতে পারল না।’’
যাটের দশকে হঠাৎ এক দিন বম্বে থেকে রাহুলদেব ফোন করে বসলেন, ‘‘বাবার চারটে গান পুজোয় করব। তুমি কিন্তু না করতে পারবে না।’’ রাহুলকে তিনি সে দিন চিনলেন, এমন নয়। ছোট্ট পঞ্চম এক গাদা মাদুলি পরে বাবার হাত ধরে যখন বাড়িতে আসত, তখন থেকে তিনি তাঁর বড় সোহাগের। সম্পর্কটা এত দিনের! এত নৈকট্যের! তবু সেই পঞ্চমের আব্দারেও একই কথা।— ‘‘বম্বে যেতে পারব না কিন্তু। এইচএমভি স্টুডিয়োতে কর। আমি আছি।’’ ‘‘আচ্ছা, ঠিক আছে। ভালই হবে। যে ক’দিন রেকর্ডিং চলবে, তোমার হাতের রান্না খেতে পারব।’’ জবরদস্ত রান্না করতেন ধনঞ্জয়। মটন কষা, সরষে ইলিশ, পুঁই শাক-কাঁকড়া থেকে চিঁড়ের পোলাও, চিতল মাছ। সে কালে সঙ্গীত মহলের প্রায় সব্বাই সে সবের স্বাদ পেয়েছেন। ব্যস্ততার দরুন সে বার আর কলকাতায় আসা হয়নি রাহুলদেবের। ফলে রেকর্ডিংও হয়নি। রাহুলদেব-ধনঞ্জয় যুগলবন্দি অধরা স্বপ্ন হয়েই থেকে গেছে।
মুম্বই যেতে চাননি। কিন্তু বাংলায়?
ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যের গানের মালঞ্চে ঝাঁকে ঝাঁকে ফুল ফুটেছে। তার মোহে কে না কে মুগ্ধ হয়েছেন! তা’ও সে কোন কাল থেকে! শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় দিয়ে শুরু।স্কুলবেলার ঘটনা। পড়তেন বালির রিভার্স টমসন স্কুলে। ক্লাসে টিফিনের সময় বন্ধুদের চাপাচাপিতে গান করতে হত। এক দিন গাইছেন কৃষ্ণচন্দ্র দে’র বিখ্যাত গান ‘স্বপন যদি মধুর এমন’। সেই গানের রেশ পৌঁছল মাস্টারমশাইদের কানে। এর পর থেকে তাঁরাই উদ্যোগ নিয়ে এক-দু’ জায়গায় ধনঞ্জয়কে গাইবার ব্যবস্থা করে দিতে থাকলেন। দেখতে দেখতে স্কুলেরই বার্ষিক অনুষ্ঠান। একক গাইলেন ছোট্ট ধনঞ্জয়— ‘পাগলা মনটারে তুই বাঁধ’ আর ‘ভাইয়ের দোরে ভাই কেঁদে যায়’। দর্শকের আসনে বসে কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র উচ্ছ্বসিত। গান শেষে আসন ছেড়ে উঠে এসে আশীর্বাদ করলেন গায়ক-বালককে। হাতে দিলেন পাঁচ টাকার একখানি নোট। এর পরে বহু পুরস্কার পেয়েছেন। কিন্তু এই আশীর্বাদকে আমৃত্যু জীবনের শ্রেষ্ঠ বলে মেনেছেন।
পঙ্কজ মল্লিক তখন ‘মহাপ্রস্থানের পথে’ ছবির কাজ করছেন। সুরকার তিনিই। নিউ থিয়েটার্সের কর্ণধার বিএন সরকারের ডাক পেলেন ধনঞ্জয়। গান তুলে দিচ্ছিলেন সহকারী সঙ্গীত পরিচালক বীরেন বল। ধনঞ্জয়ের অনুরোধে গানটি বার কয়েক গেয়ে শোনালেন পঙ্কজকুমার মল্লিক স্বয়ং। রেকর্ডিং হল। পূর্ণ সিনেমা হলে কোম্পানির কর্তাদের উপস্থিতিতে সেই রেকর্ড বাজানোও হল। গান শুনে স্তম্ভিত পঙ্কজ মল্লিক—‘‘এ কী! এ যে হুবহু আমারই গলা!’’
দিলীপকুমার রায়েরও ক্ষেত্রেও একই ঘটনা। ‘মাথুর’ ছবির রেকর্ডিং। এমপি স্টুডিয়োয়। সঙ্গীত পরিচালক দিলীপকুমার রায় তখন কলকাতায় ছিলেন না। পণ্ডিচেরি গিয়েছিলেন। তাঁর সহকারী গান তুলিয়ে দিলেন। সেই রেকর্ড শুনে চমকে উঠেছিলেন সঙ্গীতসাধক দিলীপকুমার। এ যে একেবারে তাঁর নিজস্ব গায়কি!
কাননদেবী। তাঁরই নিজস্ব কোম্পানি ‘শ্রীমতী পিকচার্স’-এর প্রায় সব ছবিতেই ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যের গান। সে বার ‘মেজদিদি’ ছবির গানের রেকর্ডিং। ‘জনম মরণ পা ফেলা আর’। ফ্লোরে ঢুকলেন কাননদেবী। কালীপদ সেন সঙ্গীত পরিচালক। রেকর্ডিং হল। কালীপদবাবু বললেন, ‘‘সব ঠিক আছে তো দিদি?’’ কাননদেবী কিছু বলছেন না। স্কোরিং-এ বসে থেকে থেকে ধনঞ্জয়ও উঠে এসে জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘কোনও অসুবিধে হল কি?’’ জীবনে এই মানুষটিকে রি-টেক দিতে হয়নি। যাঁর গান শুনে একবার সুরকার সুবল দাশগুপ্ত বলেছিলেন, ‘‘যে দিন তোমাকে একটা গান রেকর্ডিং করতে দ্বিতীয় বার গাইতে হচ্ছে দেখবে, জানবে শেষ হয়ে গেছো।’’ সেই ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যকে সে দিন কাননদেবী বললেন, ‘‘আরেক বার যদি গাওয়া যেত…।’’ কোনও কথা না বলে দ্বিতীয় বার গাইলেন তিনি। শুনে কাননদেবী যেন আকাশ থেকে পড়লেন। বললেন, ‘‘আগের বারও ভাল হয়েছিল। ভাবলাম, যদি দ্বিতীয় বারে উনিশ-বিশ আরও ভাল হয়। কোথায় কী! এ বারেও এক্কেবারে এক।’’
শুধু আধুনিক জগতের মানুষজন নন, ধ্রুপদী শিল্পীরাও একসময় ছিলেন ধনঞ্জয়ের একনিষ্ঠ ভক্ত।
পণ্ডিত রবিশঙ্কর একবার কলকাতায় এলেন। খিদিরপুরের সন্ধের জলসা। উনি আছেন। উস্তাদ বড়ে গোলাম আলি আছেন। উস্তাদ আল্লারাখাও। অনুষ্ঠান দেখতে গিয়ে রবিশঙ্করের সঙ্গে দেখা ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যর। পণ্ডিতজি বলেছিলেন, ‘‘আমি আপনার গানের খুব ভক্ত, জানেন!’’
ওঁর গায়কি, ওঁর মার্গ সঙ্গীতের অনায়াস যাতায়াতে মুগ্ধ ছিলেন অনেকেই। চিন্ময় লাহিড়ী, এ কানন দেখা হলেই বলতেন, ‘‘তোমাকে দেখে আমাদের খুব রাগ হয়। কেন যে তুমি আমাদের ছেড়ে আধুনিকে গেলে!’’
উস্তাদ বিলায়েৎ খানের সঙ্গে তো সেই কত কালের বন্ধুত্ব। বিলায়েতকে যখন ওঁর বাবা কলকাতায় রেখে গেলেন, তখন থেকেই ওঁর কাছে যাতায়াত। কলকাতার জলসায় বিলায়েৎ খান বাজাচ্ছেন, আর দর্শক-আসনে ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য নেই, এ ছিল বড়ই বিরল দৃশ্য।
ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যর ধ্রুপদের ওপর দখল যে কী প্রচণ্ড অনায়াস ছিল! ‘তানসেন’ ছবি তৈরির সময়কার গল্প। সুরকার রবীন চট্টোপাধ্যায়। ধামারে একটি গান বাঁধলেন তিনি। পণ্ডিত ভীমসেন যোশীকে ডেকেও গাওয়ানো হল। পছন্দ হল না রবীনবাবুর। বিষ্ণুপুর ঘরানার বিখ্যাত শিল্পী রমেশ বন্দ্যোপাধ্যায় গাইলেন। তাতেও হল না। এ বার ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যর ডাক। দিন কয়েকের অনুশীলন। তার পর রেকর্ডিং। গান শুনে ধনঞ্জয়কে বুকে জড়িয়ে ধরলেন সুরকার।
রাগরাগিণীর মধ্যে কোনটি প্রিয়, জানতে চাইলে বলতেন, ‘‘ভৈরবী।’’
নিজের ধ্রুপদ গান নিয়ে একটি অদ্ভুত গল্প শুনিয়েছিলেন এক বার। — ‘‘সুন্দরবনে শিকারি বন্ধুদের সঙ্গে বেড়াতে গিয়েছি। জ্যোৎস্না রাতে দরবারী কানাড়ায় গান ধরেছি। নৌকোর সামনে হরিণের দল স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। তারা জানে এটা শিকারিদের নৌকো। এখনই গুলি আসতে পারে। তবু তারা গান শুনে দাঁড়িয়েছিল, না দাঁড়িয়ে পারেনি বলে। আমি বন্ধুদের অনুরোধ করলাম অন্তত সে রাতে যেন কোনও পশু বধ না করা হয়। মনটা এমনই অভিভূত হয়েছিল।’’
এক সময় বাংলা গানে ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর বলা হত জগন্ময় মিত্র, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় আর ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যকে। তিন জনের বন্ধুত্বও ছিল দেখার মতো। একসঙ্গে ওঁরা জলসায় গেলে এতই গল্পে মশগুল থাকতেন, স্টেজে তোলাই তখন দায়। এমনই এক বার কর্তাব্যক্তিরা বেশি জোরাজুরি করাতে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় বলে দিয়েছিলেন, ‘‘শুনুন, আপনাদের কোনও চিন্তা করতে হবে না। যাঁরা গান শুনতে এসেছেন, তাঁরা আমাদের গান না শুনে যাবেন না। আমাদের আরেকটু না হয় আড্ডা দিতে দিন।’’ বন্ধুত্ব ওঁদের যাই-ই থাক, ভক্তদের মধ্যে ভাগাভাগি ছিল। কিন্তু ঘুণাক্ষরে তার রেশ কোনও দিন তাঁদের সম্পর্কে আঁচড়টুকুও ফেলতে পারেনি। পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় এক জায়গায় লিখেছেন, ‘‘যদি কেউ চাটুকারি প্রবৃত্তি নিয়ে ওঁকে (ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য) বলতেন, আপনার ‘যদি ভুলে যাও মোরে’ কিংবা ‘রাধে ভুল করে তুই’ গানটা কি হেমন্ত গাইতে পারতেন? ভীষণ রেগে চেঁচিয়ে বলতেন, ‘কথা কয়ো নাকো শুধু শোনো’ কিংবা ‘কিৎনা দুখ ভুলায়ে’ও আমি গাইতে পারব না। হেমন্তবাবু হেমন্তবাবুই।’’
এত শ্রদ্ধা! এতটাই মুগ্ধতা!
বারবার বলতেন, গানের জন্য জীবনে দু’জনকে ঈর্ষা করে থাকেন, তাঁদের একজন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। দ্বিতীয় জন তাঁর ছোট ভাই পান্নালাল।
ভাই ছিল যেন বুকের পাঁজর! পান্নালাল যখন সাত মাসের মাতৃগর্ভে, তখন ওঁদের বাবা সুরেন্দ্রনাথ মারা যান। আজন্ম ভাইকে আগলে বেড়িয়েছেন তাঁর মেজদা ধনঞ্জয়। তাঁকে এইচএমভি-তে নিয়ে যাওয়া, জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের কাছে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের তালিম দেওয়ানো, বড় ভাই প্রফুল্ল ভট্টাচার্যকে দিয়ে মেগাফোনের জেএন ঘোযের কাছে পাঠানো…।
ধনঞ্জয় বুঝেছিলেন, পঞ্চাশের দশকে কে মল্লিক, ভবানী দাস কী মৃণালকান্তি ঘোযের পর ভক্তিগীতিতে একটা ভাটা এসেছে। সেখানেই তাঁর ভাই পানু কিছু করতে পারবে। যে জন্য নিজে পরের পর ছবিতে অসংখ্য হিট গান গাওয়ার পর, হাজার অনুরোধেও ভক্তিগীতি গাইতে চাইতেন না। —‘‘ওটা পানুর জায়গা। আমার নয়।’’ যা কিছু ভক্তিগীতি গেয়েছেন, সব ভাইয়ের অকাল মৃত্যুর পর।
উল্টো দিকে ভাই?
দাদা বলতে অজ্ঞান। তার প্রকাশ যে কী তীব্র ছিল, তা নিয়ে বড়সড় উপন্যাস লেখা যায়। এক টুকরো বলা যেতে পারে।
’৬৬ সাল। পান্নালাল রেকর্ড করলেন ‘অপার সংসার, নাহি পারাপার’। বাড়িতে ফিরলে স্ত্রী জানতে চাইলেন, ‘‘কেমন গাইল পানু?’’ বললেন, ‘‘বাঁদরটার কাছে যা চেয়েছিলাম, তার ষাট ভাগ পেলাম।’’ শুনে পান্নালাল বলেছিলেন, ‘‘শোনো মেজদা, তুমি যেটা চেয়েছিলে, সেটা যদি পেতে, তা হলে আমি হতাম ধনঞ্জয়, তুমি হতে পান্না।’’
সেই পান্না এক দিন বুক খালি করে চলে গেল চিরদিনের জন্য। সন্তানহারা পিতার মতো দুমড়েমুচড়ে গিয়েছিল জীবনটা। আস্ত একটা মহীরুহ প্রলয় ঝড়ে নুয়ে পড়ল যেন!
তাও ঘুরে দাঁড়লেন। ’৮৭-র জানুয়ারিতে আবার ধাক্কা। স্ত্রী রেখাদেবী চলে গেলেন। এ বার শুধু অবসাদ আর অবসাদ। হারমোনিয়াম একলা পড়ে থাকে। তানপুরায় ধুলো জমে। কেবল ছাত্রছাত্রী এলে গান। আর ক্কচিৎকদাচিৎ জলসায় যান। বাকি সময়ের বেশিটাই কাটে ঠাকুরঘরে।
‘‘এ মাটি ছিনিয়ে নিতে কত বার ঝড় এসেছে
এ মাটি ভাসিয়ে দিতে কত বার বান ডেকেছে…।’’
তিন ছেলে, পুত্রবধূ কঙ্কনা, নাতনি দীপাঙ্কনাকে নিয়ে ভরাট সংসার। তবু ভিড়ের মধ্যেও তিনি যেন একা। নিঃসঙ্গ। খাঁ খাঁ করা প্রান্তরে একমাত্র মরূদ্যান পেতেন ওই নাতনিকে কাছে পেলে। এক এক সময় বিছানা নিতেন। শিয়রে বসে সেবা করতেন পুত্রবধূ। অস্ফুটে বলতেন, ‘‘আর জন্মে তুমি বোধ হয় আমার মা ছিলে গো!’’
’৯২-এর মার্চে শ্রীরামপুর গেলেন এক ভক্তিমূলক গানের আসরে। সেই শেষ বার। ডায়াবেটিক নেপ্রোপ্যাথি ওঁকে কুরে কুরে খেয়ে নিচ্ছিল।
১৮ই ডিসেম্বর শেষ বারের মতো কলেজ স্ট্রিটের বাড়ি ছেড়ে ভর্তি হলেন উত্তর কলকাতার এক নার্সিংহোমে। আর ফেরা হল না। ডিসেম্বরের ২৭ তারিখে নিভে গেল বাংলা গানের ধনঞ্জয়-শিখা!
নিথর কলকাতা নতজানু হয়ে তাঁর শেষযাত্রায় গিয়েছিল,
“… মাটিতে জন্ম নিলাম, মাটি তাই রক্তে মিশেছে
এ মাটির গান গেয়ে ভাই জীবন কেটেছে
আকাশের অঝোর ধারে বনানীর শ্যামল ভারে
অরুণের সোনার রঙে আমার মাটি আজ সেজেছে …”
(তথ্যসূত্র:
১- অনন্য ধনঞ্জয়, নিতাই মুখোপাধ্যায়, আনন্দ পাবলিশার্স (২০১৫)।
২- ১২ই সেপ্টেম্বর ২০১৫ সালে আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত তিনটি প্রবন্ধ।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত