মুখে আমরা অনেক কথাই বলতে পারি, কিন্তু মানুষ আসলে যা চায় তা কোন না কোন ভাবে নিজের আচরণের মধ্যে দিয়ে ঠিক বেরিয়ে আসে। সেই মুহূর্তে সে সবচেয়ে বেশি স্বাভাবিক, সবচেয়ে বেশি সৎ। এই মুহূর্তগুলিকে নিয়েই তৈরি হতে পারে এমন একটা গল্প, একটা ছবি বা কবিতা – যা একটা সত্যকে তুলে ধরে। এই মুহূর্তগুলি আমাদের আসল ভারতবর্ষের সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়। গতকাল দুপুরে তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে এনআরসি বিরোধী মহামিছিলের সময় বেন্টিঙ্ক স্ট্রিটের মোড়ের কাছে ঠিক এমনই একটা ছবি পেয়ে গেলাম আমি। আর এমন একটা সময়ে এই প্রাপ্তিযোগ ঘটলো যখন মিছিলটা হচ্ছে দেশের সব মানুষের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের এই ছবিটাকে ধ্বংস করার প্রতিবাদেই।
রাজপথ দিয়ে এগিয়ে চলেছে মহামিছিল, রাস্তার দুপাশে ঠাসা ভিড়, মিছিল এবং দর্শক দুটোর আকারই বিশাল। আমার চোখ পড়ে গেল দড়ির ব্যারিকেড দেওয়া ফুটপাথের অপেক্ষমাণ ভিড়ের একটা জায়গায়। অধীর আগ্রহ নিয়ে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছেন একজন সন্ন্যাসী, একজন মুসলমান বৃদ্ধ ও এক তরুণী। বোঝাই যাচ্ছে ধর্ম ও সামাজিক অবস্থানের ভিন্নতা তাদের পাশাপাশি দাঁড়ানোর স্বাচ্ছ্যন্দে কোন অন্তরায় হয়নি। দিব্যি মিছিল দেখছেন তারা, কারও উপস্থিতিই কাউকে বিব্রত করছে না। এই তো ভারতবর্ষ। এটাই তো আমাদের দেশ, যা আমরা জন্ম থেকে দেখে আসছি। শান্তিপূর্ণ এই সহাবস্থানই তো আমাদের আদর্শ। এদের পিছনে দাঁড়িয়ে যারা মোবাইলে ছবি তুলছেন তাদের নিয়েও এদের চোখেমুখে কোন বিরক্তি নেই। নেই দড়ি পেরিয়ে রাস্তায় নেমে আসার উগ্রতা। এটাই নাগরিক মনন। মোদি-অমিতরা এদের কাছ থেকেই নাগরিক অধিকার কেড়ে নেওয়ার ফতোয়া জারি করেছেন।
আমার মনে হল, কোন শ্লোগান, ঘোষণা ছাড়াই এই ছবিটি হয়ে উঠেছে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের বিরুদ্ধে এক জীবন্ত প্রতিবাদ। যে মিছিল তাদের অধিকার রক্ষার দাবীতে হচ্ছে তা শান্তভাবে দেখতে রাজপথে এসে দাঁড়িয়েছেন তারা। নাগরিকত্ব সংশোধনের নামে দেশের এই ছবিটাই মুছে দিতে চাইছেন মোদি-অমিতরা। যারা নিজেরাই লাগাতার ধর্মীয় বিভাজনের রাজনীতি করে দেশের মূল সমস্যা থেকে মানুষের নজর ঘোরানোর চেষ্টা করছেন তাদের এই দৃশ্য উপলব্ধি করার ক্ষমতা ও ইচ্ছা কোনটাই নেই। এক পরিসরে দাঁড়িয়ে সবাই সবার অধিকারকে স্বীকৃতি দিচ্ছেন এটাই তো প্রকৃত নাগরিকতা। এই ছবিটাই প্রমাণ করে দিচ্ছে মানুষ দেশজুড়ে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের মধ্যে দিয়ে মোদি-অমিতদের জনবিরোধী আইন চালু করার দুঃসাহসের জবাব দেবেন।
আমার মনে পড়ে গেল পরেশ ধরের কথা ও সুরে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সেই বিখ্যাত গান – ‘শান্ত নদীটি পটে আঁকা ছবিটি’ গানটা। পটে আঁকা ছবির মতই এই দৃশ্যটি আমার বুকের গভীরে গেঁথে গেল।
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত