সিংহের চামড়া পরা গাধার লাফঝাঁপ দেখে ভয় পেয়েছিলেন কিছু মানুষ। রাজ্যের তিনটি উপনির্বাচনের ফল বেরোতে দেখা গেল গাধার আসল রূপটা বেরিয়ে পড়েছে। মানুষই সম্পদ, মানুষই শক্তির উৎস এতে আমার কোন অবিশ্বাস নেই। বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও এই জয়ের জন্য রাজ্যের মানুষকে ধন্যবাদ দিয়েছেন। এই সত্য স্বীকার করে নিয়েও আমি বলছি বাংলায় বিজেপির বাড়বাড়ন্ত আটকে দেওয়ার এই লড়াইয়ে দিদির কৃতিত্বও কিন্তু কোনভাবেই কম নয়। না, কোন আবেগ বা অচলাভক্তি থেকে আমি একথা বলছি না। দেশ ও রাজ্যের রাজনৈতিক বাস্তবতাই আমাকে একথা বলতে বাধ্য করেছে।
অনেকেই বলছেন এনআরসি তিনটি কেন্দ্রের উপনির্বাচনে একটা বড় ইস্যু হয়েছে, তাই বিজেপি ভোট পায়নি। আমার প্রশ্ন, এনআরসি’র বিরোধিতা তো সিপিএম এবং কংগ্রেসও করেছিল। তাহলে তারা এই বিরোধিতার ফসল ঘরে তুলতে পারলো না কেন? কেনই বা দেশের দুটি প্রাচীন দলের মিলিত ভোট আরও কমে গেল? আর সেই ভোট জমা পড়লো তৃণমূলের বাক্সে? এর একটাই উত্তর – মানুষ তাদের নিছক মৌখিক প্রতিবাদ ও দ্বিচারিতা বিশ্বাস করেনি। তারা মনে করেছেন, রাজ্যের বিজেপি বিরোধী লড়াইয়ে আসল শক্তি তৃণমূল কংগ্রেস। কারণ, বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর মত কেউই স্পষ্টভাবে বলতে পারেননি – এ রাজ্যে আমি এনআরসি করতে দেবো না। বহু পরীক্ষিত লড়াইয়ের নেত্রী মুখ্যমন্ত্রীর এই কথা মানুষ বিশ্বাস করেছেন। তারা ভরসা পেয়েছেন বলেই মানুষের ভোট চলে গেছে তৃণমূলের দিকে।
এই ভরসা দেওয়ার শক্তি বাংলার মুখ্যমন্ত্রী লড়াইয়ের মধ্যে দিয়েই অর্জন করেছেন। তার লড়াই সিপিএম ও কংগ্রেসের নেতাদের মত নিছক তর্জনগর্জন, বিবৃতি আর পথসভাতেই আটকে থাকেনি। তার দিকে তাকালে আমার মনে হয়, তিনি যেন এক বটবৃক্ষ। যার ছায়াতে এসে মানুষ ভরসা পায়, আশ্বস্ত হয়। বটবৃক্ষের মতই তিনি যেন বাংলার মানুষকে সবরকম সমস্যা থেকে রক্ষা করার কাজ করে চলেছেন। ৪০ বছরেরও বেশি সময় ধরে আমি সাংবাদিকতা করছি। রাজ্য তো বটেই সারা দেশের মুখ্যমন্ত্রী থেকে শুরু করে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী আমি কম দেখিনি। কিন্তু কাউকেই আমি বন্যা থেকে শুরু করে ভয়াবহ প্রাকৃতিক বিপর্যয় কিংবা দুর্ঘটনার খবর শোনামাত্র এভাবে ঝাঁপিয়ে পড়তে দেখিনি।
উপনির্বাচনে মানুষের বিজেপিকে প্রত্যাখানের আরেকটা কারণ হল, তাদের ঔদ্ধত্য। বাংলার মানুষ সবকিছু সহ্য করতে পারে কিন্তু ঔদ্ধত্য আর অহংকার নয়। এক লাফে দুই থেকে আঠারো হওয়ার পর পাড়ার ক্লাবের সেক্রেটারি হওয়ারও যোগ্যতা নেই একশ্রেণীর স্বনির্বাচিত বিজেপি নেতারাও নোটবন্দী, এনআরসি, সাম্প্রদায়িকতা ইত্যাদি নানা ইস্যুতে মানুষের মৃত্যু ও দুর্ভোগকে উপেক্ষা করে যেন কিছুই হয়নি গোছের হাবভাব করছিলেন, তা মানুষ ভালোভাবে নেয়নি। বাংলার মত দেশভাগ ও দাঙ্গাবিধ্বস্ত জনপদের আবার মানুষকে ভিটেমাটি ছাড়া করার ঘোষণা মেনে নিতে পারেননি তারা। সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম নিয়ে তৃণমূল নেত্রীর লড়াইয়ের কথা মনে পড়ে গেছে তাদের। মুখ্যমন্ত্রীকে তারা এই সঙ্কটের ত্রাতা হিসেবে দেখেছেন। তৃণমূলের জয় এসেছে সেই কারণেই।
এই উপনির্বাচন প্রমাণ করেছে কংগ্রেস ও সিপিএমের ভোট ভাগের রাজনীতি এই রাজ্যে আর কাজ করবে না। কালিয়াগঞ্জ, করিমপুর, খড়গপুর তিনটি কেন্দ্রেই বাম ও কংগ্রেসের একটা নির্দিষ্ট ভোট ছিল। দেখা যাচ্ছে এখন সেই ভোটেও ভাঙন ধরেছে। সাধারণ মানুষ তো বটেই এমনকি দলের নিচুতলার কর্মী ও সমর্থকরাও তাদের নেতাদের বিশ্বাস করছেন না। তাদের ভোটও তৃণমূলের বাক্সে জমা পড়েছে। এককথায় বাংলায় সিপিএম ও কংগ্রেস দুটি দলই প্রাসঙ্গিকতা হারিয়েছে।
একশ্রেণীর সংবাদমাধ্যম বলতে শুরু করেছিলেন ২১শে রাজ্যে বিজেপি আসবে। আমি খুব অবাক হয়ে লক্ষ্য করেছি তারা বলছেন বাংলায় এবার পদ্ম ফুটবে। ঘটনা ঘটছে তার ঠিক উল্টোটা। জীবনের অভিজ্ঞতায় মানুষ দেখছেন শিল্প, কৃষি, ব্যবসা সবক্ষেত্রেই দলটা পুরোপুরি ব্যর্থ। বিজেপি নামক দলটি আদতে দেশবিরোধী, মানুষ বিরোধী এবং মানুষের মৌলিক অধিকারেরও বিরোধী। দেশের কোন সমস্যার সমাধান না করে তারা কিছুদিন পরপর জিএসটি, নোটবন্দী, কাশ্মীর, এনআরসি, অনুপ্রবেশের মত নানা ইস্যু তৈরি করে মানুষের নজর অন্যদিকে ঘোরাতে চাইছেন। এই খেলাটা মানুষ কিন্তু ধরে ফেলেছেন। এই উপনির্বাচন জানিয়ে দিল বিজেপির শেষের শুরু হয়ে গেছে।
তবে এই জয়ে আত্মসন্তুষ্টির কোন অবকাশ নেই। পায়ে পায়ে এগিয়ে আসছে একুশ, এবার লড়াই সামনাসামনি। বাঁচতে হলে বিজেপিকে সত্যিই গোল্লায় পাঠাতে হবে আমাদের। তা না হলে দেশ ব্যাপারটাই থাকবে না। উপনির্বাচনে জয়ের সেলিব্রেশনের বদলে আসুন আমরা নিই একুশেতে বিজেপিকে উৎখাত করার শপথ।
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত