মাসখানেক আগেই যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয়কে কেন্দ্র করে হওয়া গণ্ডগোলের জেরে গোটা ক্যাম্পাস জুড়ে রীতিমতো তান্ডব চালিয়েছিল এবিভিপি। সেদিন মুখ্যমন্ত্রীর শত অনুরোধের পরেও রাজ্যপাল জগদীপ ধনকড় যেভাবে ঘটনাস্থলে গিয়ে গোটা ঘটনায় নিজেকে ‘জড়িয়েছিলেন’ এবং পরিস্থিতি আরও ঘোরালো করে তুলেছিলেন— তাকে মোটেই ভাল চোখে দেখেনি নবান্ন। তারপর মুর্শিদাবাদের জিয়াগঞ্জে নৃশংস খুনের ঘটনায় প্রশাসনের বিরুদ্ধে গাফিলতির অভিযোগ করায় প্রশাসনের সঙ্গে সংঘাত বেঁধেছিল তাঁর। এবার ফের শুরু হয়ে গেল রাজ্যপালের সঙ্গে তৃণমূলের সঙ্ঘাত। ফোন ও হোয়াটসঅ্যাপ-এ আড়িপাতা বিতর্কে এ রাজ্যকে জুড়ে দিয়ে তাঁর, ‘এখানে ব্যক্তিগত গোপনীয়তা নষ্ট হচ্ছে বলে আমার কাছে অনেকেই অভিযোগ করেছেন।’
প্রসঙ্গত, ফোন ও সামাজিক মাধ্যমে নজরদারির অভিযোগে শনিবার সরব হয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের দিকে আঙুল তুলে মুখ্যমন্ত্রী অভিযোগ করেন, তাঁদের (বিরোধীদের) ব্যক্তিগত গোপনীয়তার অধিকার সুরক্ষিত নয়। কেন্দ্রীয় সরকারের পাশাপাশি দু’টি রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট করে আড়িপাতার অভিযোগ করেছিলেন মমতা। মুখ্যমন্ত্রীর দাবি, তার মধ্যে একটি বিজেপি শাসিত। আড়ি পাতা নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর এই অভিযোগ সম্পর্কে প্রশ্নের জবাবে রাজ্যপাল বলেন, ‘মুখ্যমন্ত্রীর কাছে এ ব্যাপারে কী তথ্য আছে, তা আমি জানি না। তবে ব্যবসায়িক, রাজনীতিক, আমলা— নানা স্তরের লোক আমার কাছে আসেন। তাঁরা বলেন, এখানে তাঁদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ক্ষুণ্ণ হচ্ছে।’ রাজ্যপালের এই মন্তব্যে কড়া প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে তৃণমূল।
দলের তরফে তাঁর তীব্র সমালোচনা করে তৃণমূল মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘অধিকাংশ ঘটনাই রাজ্যপাল জানেন না। মুখ্যমন্ত্রী শনিবার বলেছেন, তাঁর ফোনে আড়ি পাতা হচ্ছে। হোয়াটসঅ্যাপ, মোবাইল ও ল্যান্ডফোনও আর নিরাপদ নয়। রাজ্যপাল তো এসব ব্যাপারে কিছুই জানেন না। তিনি বলেছেন, তাঁর কাছেও অনেকে ফোনে আড়িপাতা নিয়ে অভিযোগ করেছেন। ওঁর কাছে কারা কারা এই কথা বলেছেন, উনি সেই তালিকা প্রকাশ করুন। দেখা যাবে, সবাই বিজেপি দলের লোক। উনি যে যে কারণে সাংবিধানিক পদে এসেছেন, সেই কারণের বদলে অন্য কারণে বেশি মাথা ঘামাচ্ছেন। উনি রাজনৈতিক দলের মুখপাত্রের কাজ করছেন। এটা কাম্য নয়। একটি বিষয় বুঝতে পারছি না, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী যখন এই কথা বলেছেন, সঙ্গে সঙ্গে তাঁর পাল্টা বলার কী দরকার? এই কাজ তো রাজনৈতিক নেতারা করেন।’
এই সপ্তাহে শুরু হচ্ছে কলকাতা ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল। সেখানে তাঁকে আমন্ত্রণ করা হয়নি বলেও অনুযোগ করেছেন রাজ্যপাল। তাঁর দাবি, ‘আমি দেশের একমাত্র রাজ্যপাল, যাঁকে সেই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী দীপাবলির শুভেচ্ছা জানাননি। রাজ্য সরকারের অনুষ্ঠানে আমাকে আমন্ত্রণ করা হয় না। আমি ব্যথিত। রাজ্যে আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব হচ্ছে। কত দেশ অংশগ্রহণ করছে। কিন্তু সেখানে রাজ্যপাল নেই।’ ঘটনা হল, রাজ্যপালকে মুখ্যমন্ত্রী তাঁর বাড়ির কালীপুজোয় নিমন্ত্রণ করেছিলেন। সেখানে সস্ত্রীক ধনকড়ের সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ সময়ও কাটান তিনি। মমতার এই সৌজন্যের পরেও রাজ্যপাল দীপাবলির শুভেচ্ছার প্রসঙ্গ তোলায় বিস্মিত তৃণমূল নেতারা। কারণ ফেরার আগেও মমতার সাধারণ জীবনযাত্রা এবং তাঁর বাড়ির পুজোর প্রশংসা করতে দেখা গিয়েছিল রাজ্যপালকে। কিন্তু রাজভবনে ফিরে গিয়ে আবার সরকারের বিরুদ্ধে মন্তব্য করা শুরু করেন।
রাজ্যপালের মন্তব্য নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে পার্থ বলেন, ‘রাজ্যপাল যে ধরনের মন্তব্য করছেন, তা বিস্ময়কর। জানি না, কেন তিনি ছেলেমানুষি করছেন। বারবার সরকারের বিরুদ্ধে বিজেপি রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষের মতো বিবৃতি দিচ্ছেন। তাঁর মুখ সরিয়ে নিলে মনে হবে একজন বিজেপি নেতা সরকারের বিরুদ্ধে বক্তব্য রাখছেন। রাজভবনে থেকে এসব করা যায় না।’ এর সঙ্গেই পার্থর সংযোজন, ‘এই ধরনের কথা বলে কী উপকার হচ্ছে জানি না। তবে সাধারণ মানুষের আস্থা মমতার ওপর রয়েছে। তাঁরা কেউ রাজ্যপালের উল্টোপাল্টা মন্তব্য মেনে নেবেন না।’ তাঁর মতে, ‘মতবিরোধ থাকতেই পারে। কিন্তু তা রাজভবনের চার দেওয়ালের মধ্যেই রাখা উচিত। আমরা রাজ্যপালের বিরুদ্ধে আগ বাড়িয়ে কিছু বলি না। তাঁর চেয়ারকে সম্মান করি। অথচ তিনি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে মাঠেঘাটে গিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে বলছেন। তিনি নিজের মুখ একবার আয়নায় দেখুন।’