(ছবিতে:
১- ক্যাপ্টেন লক্ষ্মী স্বামীনাথন সেহগল
এবং
২- জানকী থেবর)
নেতাজি আসছেন! নেতাজি আসছেন! খবরটা বাতাসে উড়ছিল। সতেরো বছরের মেয়েটাও সে কথা শুনেছে। সবাই বলে, নেতাজি দারুণ বক্তৃতা দেন! আশ্চর্য ব্যক্তিত্ব! আসল নাম সুভাষচন্দ্র বসু। মেয়ে শুনেছে, তিনি নাকি ব্রিটিশের চোখে ধুলো দিয়ে ভারত থেকে পালিয়েছিলেন। এখন তাঁর নেতৃত্বে আজাদ হিন্দ ফৌজ ভারতকে স্বাধীন করার জন্য লড়বে। সেই মানুষটা কুয়ালা লামপুরে আসবেন আর তাঁকে দেখতে যাওয়া হবে না, তা কি হয়? কিন্তু বাড়িতে বললে বড়রা ছাড়বেন? মেয়ে কোনও ঝুঁকি নিতে রাজি নয়। সোজা সাইকেলটি নিয়ে কাউকে কিচ্ছুটি না বলে মাঠে গিয়ে হাজির!
কম লোক নাকি? মেয়ে ঠেলেঠুলে সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। বক্তৃতা শেষ করে সকলের কাছে ফৌজের জন্য অনুদান চাইলেন নেতাজি। সেই মেয়ে, জানকী তার নাম, অবলীলায় কান থেকে হিরের দুল খুলে নেতাজির হাতে দিল। দেওয়ামাত্র খচ করে ক্যামেরার ক্লিক। পরের দিন কাগজে প্রথম পাতায় জানকীর ছবি।
তামিল ব্যবসায়ী পরিবারের মেয়ে জানকী থেবর। বাড়িতে জানাজানি হয়ে একদম হইহই কাণ্ড। জানকী জানে, বাঁচাতে পারেন এক জনই। অসামান্যা সুন্দরী এক দিদিকে সে দেখেছে আগের দিন। তাঁর নাম ক্যাপ্টেন লক্ষ্মী স্বামীনাথন। সেই লক্ষ্মীকেই চায়ের নেমন্তন্ন করল জানকী। লক্ষ্মী এসে বাড়ির সবাইকে রাজি করালেন।
করানো গেল। কারণ এশিয়ার প্রবাসী ভারতীয়দের মধ্যে জাতীয়তাবাদী ভাবনার প্রসার আগে থেকেই ছিল। তাঁরা ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেনডেন্স লিগ তৈরি করেছিলেন। তার উপরে ১৯৪২-এ বর্মা (এখন মায়ানমার), মালয় (এখন মালয়েশিয়া) আর সিঙ্গাপুরে জাপানের কাছে হেরে যাওয়ার পর ব্রিটিশ সেনাকে অপ্রতিরোধ্য বলে মনে হচ্ছিল না।
ফল? জানকী তাঁর সৎ বোন পাপাতি আর কয়েক জন বন্ধুকে নিয়ে ‘ঝাঁসির রানি বাহিনী’তে যোগ দিলেন। ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের বীরাঙ্গনাকে মনে রেখেই সুভাষচন্দ্র মেয়েদের নিয়ে এই কমব্যাট ইনফ্যান্ট্রি ইউনিট গড়েছিলেন। শুধু মেয়েদের নিয়ে এমন ইউনিট দুনিয়ায় এই প্রথম।
মেয়েদের কারওরই আগে কোনও সামরিক প্রশিক্ষণ ছিল না। নেতাজির আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে না-দেখা দেশের জন্য আত্মবিসর্জন দিতে তৈরি হয়েছিলেন তাঁরা। কিন্তু কারও জানা ছিল না, অন্য একটা ইতিহাসেরও জন্ম দিচ্ছেন তাঁরা। নারীরা যুদ্ধে গিয়েছেন অনেক বার। কিন্তু শুধু নারীদের নিয়ে একটি সেনা ইউনিট, দেখা যায়নি আগে।
১৯৪৩ সালে, অঞ্জলি ভৌমিকের বয়স ছিল বারো। তাঁর বাবা ধীরেন্দ্রচন্দ্র ভৌমিক ঢাকায় থাকতে ফরওয়ার্ড ব্লকের সদস্য ছিলেন। পরে চাকরি নিয়ে মালয়ে চলে যান। তাঁর দুই মেয়ে শান্তি আর অঞ্জলি যখন ঝাঁসির রানি বাহিনীতে যোগ দিল, অঞ্জলি তখন বাহিনীর কনিষ্ঠতম সদস্য।
১৯৪৩-এর ৯ই জুলাই নেতাজি যখন সিঙ্গাপুরে ৬০ হাজার ভারতীয়ের সমাবেশে বক্তৃতা দিচ্ছেন, ঝাঁসি বাহিনী গঠনের আহ্বান সেখানেই শোনা গেল। তিন দিন পরেই একটি সভায় লক্ষ্মী স্বামীনাথনের নেতৃত্বে ২০ জনের একটি মহিলা ইউনিট রাইফেল নিয়ে তাঁকে গার্ড অব অনার দিল। ইউনিফর্ম তখনও আসেনি। মেয়েরা সে দিন সাদা শাড়িই পরেছিলেন। গোটা ব্যাপারটা আইএনএ-র মধ্যে সবারই যে খুব ভাল লেগেছিল, এমন নয়।
তবু সুভাষের দীর্ঘ দিনের স্বপ্ন সত্যি করে ঝাঁসি বাহিনী যে গড়ে উঠল, তার পিছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা ক্যাপ্টেন লক্ষ্মীর। মাদ্রাজের বিখ্যাত উকিলের মেয়ে লক্ষ্মী বড় হয়েছিলেন সাহেবি কায়দায়। ওঁর মা সেই আমলে নিজে গাড়ি চালাতেন। টেনিস খেলতেন। এক বার একটি সাহেব খুনের মামলায় অভিযুক্ত ভারতীয় ছাত্রের হয়ে লড়ছিলেন লক্ষ্মীর বাবা। ছাত্রটি ছাড়া পেয়ে যায়। সাহেব উকিলরা তাই নিয়ে লক্ষ্মীর বাবাকে যা নয় তাই বলতে থাকে। লক্ষ্মীরা তার পর আর বিলিতি জামাকাপড় পরেননি। লক্ষ্মীর মা কংগ্রেসে যোগ দেন।
লক্ষ্মী নিজে ডাক্তারি পড়ছিলেন। মাঝপথে এক পাইলটের সঙ্গে প্রেম এবং পালিয়ে গিয়ে বিয়ে। বিয়েটা টেকেনি অবশ্য। কয়েক মাসের মধ্যেই লক্ষ্মী আবার পড়ায় মন দিলেন। এ বার তাঁর সম্পর্ক হল এক ডাক্তারি ছাত্রের সঙ্গে। লক্ষ্মী তাঁর সঙ্গে চলে এলেন সিঙ্গাপুর। ডাক্তারি করার পাশাপাশি যোগ দিলেন ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেনডেন্স লিগে। সেই সূত্রেই নেতাজির সঙ্গে পরিচয়। তিনি লক্ষ্মীর মধ্যে দেখতে পেলেন তাঁর ক্যাপ্টেনকে, লক্ষ্মী পেলেন তাঁর রাজনৈতিক গুরুকে। চাকরি, প্রেমিক— সব ছেড়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন আইএনএ-র কাজে।
লক্ষ্মীকে দেখে অন্য মেয়েরা সাহস পেলেন, অনুপ্রাণিত হলেন। মালয়ের রক্ষণশীল খ্রিস্টান পরিবারের দুই মেয়ে রসম্মা আর পুন্নাম্মা যেমন নেতাজির বক্তৃতা শুনে জেদ ধরল যুদ্ধে যাবে। কে বোঝাবে বাড়ির লোককে? এখানেও লক্ষ্মী।
বর্মার স্কুলে পড়াতেন প্রতিমা সেন। তিনি তাঁর ভাগ্নি মমতা গুপ্তকে তো আনলেনই, আরও বহু মেয়েকে জোটালেন। এমনিতে রেঙ্গুনে ঝাঁসি বাহিনীর সদস্য সংগ্রহের দায়িত্বে ছিলেন লীলাবতী মেটা। তাঁর দুই মেয়ে রমা আর নীলম মায়ের সঙ্গেই বাহিনীতে আসে। পুরোদস্তুর সামরিক ইউনিফর্মে রাইফেল কাঁধে পতাকা নিয়ে সকলে যখন শহরের রাস্তায় গান গাইতে গাইতে কুচকাওয়াজ করতেন, লোকে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকত।
কত জন ছিলেন ওঁরা? পূর্ণাঙ্গ তালিকা সে ভাবে পাওয়া যায় না। তবে ড্যানিশ ইতিহাসবিদ ভেরা হিলডেব্রান্ড তাঁর সাম্প্রতিক গবেষণায় বলছেন, সংখ্যাটা হয়তো সাড়ে চারশোর বেশি হবে না। এর অন্তত ষাট শতাংশ মালয়ে রবার শ্রমিক পরিবারের। দরিদ্র, নিরক্ষর। যুদ্ধের বাজারে তখন ভয়াবহ খাদ্য সঙ্কট, সঙ্গে এস্টেটের অত্যাচার। অনেকেই পেটের টানে আইএনএ-তে নাম লিখিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁদের ব্যক্তিগত বয়ান ইতিহাসে ধরা নেই।
বাহিনীর দুটো শিবির ছিল। একটা সিঙ্গাপুরে, একটা রেঙ্গুনে। মেয়েদের থাকা-খাওয়া, ইউনিফর্ম, প্রশিক্ষণ— পুরো খরচটাই বহন করতেন প্রবাসী ভারতীয়রা। ১৯৪৩-এর ২২শে অক্টোবর সিঙ্গাপুর ক্যাম্পের উদ্বোধন করলেন নেতাজি। সবাইকে একটা করে তোশক, বালিশ আর কম্বল দেওয়া হল। সরু কাঠের তক্তা দিয়ে তৈরি বিছানা। টিনের থালায় খাওয়া। শৌচাগার পরিষ্কারের দায়িত্বও নিজেদেরই। সকলকে বলে দেওয়া হল, চুল যেন কাঁধ না ছাড়ায়। গয়না পরা চলবে না। শুধু মঙ্গলসূত্রে ছাড়।
সেনা ব্যারাকে দিন শুরু হত ভোর ছ’টায়। প্রথমেই পতাকা উত্তোলন। তার পর ৪৫ মিনিট ব্যায়াম। সাড়ে সাতটায় প্রাতরাশ। তার পর দু’ঘণ্টা প্যারেড। পরের দু’ঘণ্টা চান, কাপড় কাচা ইত্যাদি। দুপুরের খাওয়ার পর এক ঘণ্টা বিশ্রাম। তার পর দু’ঘণ্টা ক্লাসরুমে। আবার দু’ঘণ্টা প্রশিক্ষণ। বেয়নেট ড্রিল, রুট মার্চ, রাইফেল-মেশিনগান চালানো। সাড়ে ছ’টায় পতাকা নামানো। সাতটায় নৈশাহার। সাড়ে ন’টার মধ্যে আলো নিবিয়ে দেওয়া। রবিবার ছুটি। সে দিন সিনেমা দেখতে যাওয়া, সমুদ্রের ধারে বেড়ানো, আইসক্রিম খাওয়া চলত। রেঙ্গুনে অনেকে নিজেদের বাড়ি থেকেও ঘুরে আসতেন।
ব্যারাকে প্রতি দিন একটা করে সাঙ্কেতিক শব্দ ঠিক করা হত। সেই সঙ্কেত বলতে পারলে তবেই কারও ক্যাম্পে ঢোকার অনুমতি মিলত। এক রাতে পাহারার দায়িত্বে মমতা। নেতাজি এসেছেন ক্যাম্পে। মমতা সঙ্কেত চাইলেন। নেতাজি বলতে পারলেন না। মমতাও তাঁকে ঢুকতে দিলেন না!
সুভাষচন্দ্র ভেবে রেখেছিলেন, আইএনএ বাহিনী বর্মা সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে ঢোকার পর তিনি মেয়েদের দেশের মাটিতে যুদ্ধ করতে পাঠাবেন। মেয়েরা মরণপণ যুদ্ধ করছেন দেখলে দেশবাসী স্থির থাকতে পারবে না। সুভাষের আশা ছিল, মেয়েদের রণাঙ্গনে দেখলে ব্রিটিশ বাহিনীর দেশীয় সেনারাও অস্ত্র ত্যাগ করবেন।
আশি জন মেয়ের একটি দলও বেছে রেখেছিলেন সুভাষ। শহিদ হওয়াই হবে যাদের কাজ। মানবতী পাণ্ডে, রসম্মার মতো মেয়েরা সে কথা জানতেন। দেশের জন্য প্রাণ দেবেন, এটা তাঁদেরও স্বপ্ন ছিল। আইএনএ-র সিক্রেট সার্ভিসেও কিছু মেয়েকে নেওয়া হয়েছিল। মমতা-প্রতিমা-মায়া-শান্তিদের কাছে সেটা ছিল বিরাট সম্মান। আঙুল কেটে নেতাজির কপালে রক্ততিলক এঁকে দিয়েছিলেন তাঁরা সবাই।
৪ঠা জানুয়ারি ১৯৪৪ আইএনএ-র সদর দফতর সিঙ্গাপুর থেকে রেঙ্গুনে সরে এল। কয়েক দিনের মধ্যে লক্ষ্মীও চলে এলেন। ঠিক হল, প্রশিক্ষণ শেষ হলেই সিঙ্গাপুর থেকে রেজিমেন্টের বাকিদেরও নিয়ে আসা হবে। জাপ-আইএনএ যৌথ বাহিনী তখন ইম্ফল জয়ের লক্ষ্য নিয়ে এগোচ্ছে। রেঙ্গুনে এসে লক্ষ্মীর প্রথম কাজ হল ক্যাম্পের জন্য একটা নতুন জায়গা দেখা।
এর পরে অনেকগুলো ঘটনা দ্রুত ঘটে গেল। ১৮ই মার্চ আইএনএ ভারতে ঢুকল। লক্ষ্মী তখন দিন কয়েকের জন্য সিঙ্গাপুরে। রেঙ্গুন থেকে মানবতী পাণ্ডের নেতৃত্বে ২০ জন মেয়ে মেমিও রওনা হয়ে গেল। ভারতের কোহিমা থেকে বর্মার মেমিও-র দূরত্ব ৩০০ মাইলের মতো। যুদ্ধ যেহেতু তখন ভারতের মাটি ছুঁয়েছে, ঘাঁটি হিসেবে মেমিও-র গুরুত্ব বেড়ে গেল। লক্ষ্মীও তত দিনে রেঙ্গুন থেকে মেয়েদের আরও একটা দলকে নিয়ে মেমিও চলে এলেন। সেখানকার হাসপাতালের দায়িত্ব নিলেন।
ও দিকে শুরু হয়ে গিয়েছে ব্রিটিশ সেনার ভারী বোমাবর্ষণ। মে মাসের শেষে সিঙ্গাপুর থেকে একটা দল রওনা হয়ে গিয়েছিল রেঙ্গুনের উদ্দেশে। প্রায় ১২০০ মাইল রাস্তা। তাইল্যান্ড অবধি তাও এক রকম। সেখান থেকে বর্মা পৌঁছনো এক অভিজ্ঞতা বটে। মালগাড়িতে কুঁকড়ে বসে চাপাচুপি দিয়ে আসা। ট্রেন চলবে শুধু রাতে। আলো ফুটলে দাঁড়িয়ে যাবে। তখন জঙ্গলে লুকোতে হবে। কোয়াই নদী পার করা সেই রেললাইন যে কেন ‘মৃত্যু লাইন’ নামে পরিচিত, সেটা মেয়েরা আগে জানতেন না। তাঁরা ভেবেছিলেন, কষ্টকর পথ বলে বুঝি ওই নাম। কিন্তু হাড় জিরজিরে যুদ্ধবন্দিরা ধুঁকতে ধুঁকতে লাইনে কাজ করছে— এই দৃশ্য দেখার পরে, যতই হোক ব্রিটিশ সেনা, আইএ অনেকেরই মনটা কেমন হয়ে গিয়েছিল।
আসল ধাক্কাটা শুরু হল অগস্ট মাস থেকে। ইম্ফল আর কোহিমায় আইএনএ বড় রকম বিপর্যয়ের মুখে পড়ল। কাতারে কাতারে সেনা আহত অসুস্থ অবস্থায় ফিরতে লাগলেন। মেমিও হাসপাতালে মেয়েরা সকলে ঝাঁপিয়ে পড়লেন নার্সিং-এর কাজে। সেপ্টেম্বরে নেতাজি মান্দালয়ে জরুরি মিটিং ডাকলেন। লক্ষ্মীকে নির্দেশ দিলেন, প্রশিক্ষিত নার্সদের রেখে মেয়েদের যেন রেঙ্গুনে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। ভারতের মাটিতে তাদের যুদ্ধে পাঠানো যে তখনকার মতো সম্ভব নয়, তিনি বুঝতে পেরেছিলেন। তাঁর লক্ষ্য ছিল স্পষ্ট। হয় মেয়েরা যুদ্ধে শহিদ হবে, নয় নিরাপদে বাড়ি ফিরবে। মাঝামাঝি কিছু নয়।
আত্মবলিদানের জন্য এত দিন ধরে প্রস্তুত হলেন, সেটা অপূর্ণ রেখেই ফিরতে হবে? সারা রাত কান্নাকাটি করে মেয়েরা মেমিও থেকে ফের রেঙ্গুন পাড়ি দিলেন। অতঃপর ৫১ জন মেয়েকে মালগাড়িতে তুলে দেওয়া হল ব্যাঙ্ককের উদ্দেশে। ইতিমধ্যে বর্মা ব্রিটিশদের পক্ষে নাম লিখিয়েছে এবং জাপানকে আক্রমণ করার জন্য তৈরি হচ্ছে। সেই অবস্থায় রেঙ্গুন থেকে ব্যাঙ্কক পৌঁছনো দুঃসাধ্য। লুকিয়েচুরিয়ে থেমে থেমে এগনো হচ্ছে। ৪ঠা এপ্রিল সিত্তাং নদীর ধার থেকে রাত্তিরে ট্রেন আবার ছাড়ল। খানিক পরে একটা ধানখেতের মধ্য দিয়ে ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি। ট্রেনের ছাদে উপুড় হয়ে রয়েছেন মেয়েরা। অন্ধকারে ট্রেন দৌড়চ্ছে। শোনা যাচ্ছে কাতরানি, নাকে রক্তের গন্ধ। কিন্তু মাথা তোলার জো নেই। খানিক পর সব শান্ত হলে সকলে টর্চ জ্বেলে দেখলেন, জোসেফিন বলে একটি মেয়ের মাথা ফুঁড়ে দিয়েছে গুলি। স্টেলা কাতরাচ্ছেন। পর দিন সকালে মারা গেলেন তিনিও। দুজনকেই জঙ্গলে কবর দেওয়া হল।
২১শে এপ্রিল নেতাজি রেঙ্গুন শিবিরে বাকি মেয়েদের সঙ্গে দেখা করলেন। পরের দিন বর্মার সমস্ত মেয়েকে টাঙ্গা ডেকে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হল। বাকি রইলেন মালয়ের মেয়েরা আর সিঙ্গাপুরের আরও কিছু।
দু’দিন পরে জানা গেল, ব্রিটিশ সেনা অনেকটাই এগিয়ে এসেছে। কিছু ক্ষণের মধ্যেই তারা রেঙ্গুনে ঢুকে পড়বে। জাপানের তরফে নেতাজিকে প্রস্তাব দেওয়া হল, তিনি যেন বিমানে ব্যাংকক চলে যান। তিনি বললেন, মেয়েদের ফেরার ব্যবস্থা না হওয়া ইস্তক এক পা-ও নড়বেন না। তখন তাঁকে বলা হল, পর দিন মেয়েদের ট্রেনে তুলে দেওয়া হবে। প্রতিশ্রুতি মতো ট্রেন এল ঠিকই। কিন্তু জাপানি সেনারা দুদ্দাড়িয়ে উঠে পড়লেন। মেয়েদের জায়গা হল না। নেতাজি রেগে বললেন, তিনিও যাবেন না।
শান্তি ভৌমিকের স্মৃতি, ২৪শে এপ্রিল তালিম সেরে বিকেলে ব্যারাকে ফিরেছেন। হঠাৎ ঘণ্টা বেজে উঠল। সকলকে বলা হল, জিনিসপত্র গুছিয়ে খেয়েদেয়ে নাও। রাত ন’টা নাগাদ ট্রাকের কনভয় রওনা হল। অল্প কিছু দূর এগোতে না এগোতেই আকাশে বোমারু বিমানের চক্কর। সকলে ট্রাক থেকে মাটিতে ঝাঁপ দিলেন। নিমেষের মধ্যে ট্রাকগুলো ছাই হয়ে গেল।
সিঙ্গাপুরের শিবির তখনও চালু ছিল। ঝাঁসি বাহিনী আনুষ্ঠানিক ভাবে ভেঙে দেওয়ার বিজ্ঞপ্তি সেখানে পৌঁছয় ১৫ই অগস্ট। এর মধ্যে অন্যরা ফিরে এলেও লক্ষ্মী থেকে গিয়েছিলেন হাসপাতালেই। ডাক্তারির কাজে ডুবিয়ে দিয়েছিলেন নিজেকে। ১৯৪৫-এর মার্চে তিনি আত্মসমর্পণ করেন। তত দিনে ক্যাপ্টেন প্রেম সেহগলের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল তাঁর। পরে ওঁদের বিয়ে হয়।
সেপ্টেম্বরে যুদ্ধ শেষ। নেতাজি নেই। ভারতও পরাধীন। যে উদ্দীপনা নিয়ে মেয়েরা সেনা দলে নাম লিখিয়েছিলেন, সেই আবহ এ বার বদলে গেল। অনেকেরই বাড়িতে বলা হল, আইএনএ নিয়ে বেশি কথা বলার দরকার নেই। চাকরি, বিয়েতে সমস্যা হতে পারে। বিশ্বের প্রথম মহিলা ইনফ্যান্ট্রির সদস্যরা অনেকে তাই স্বামীকেও জানাননি তাঁদের অভিজ্ঞতার কথা। কিন্তু প্রত্যেকেই আমৃত্যু একটা কথা মানতেন। ১৯৪৩-’৪৫ ছিল তাঁদের জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান দুটো বছর।
দিনটা ছিল ২৪শে অক্টোবর ১৯১৪ সাল। মাদ্রাজ হাইকোর্টের আইনজীবী এস স্বামীনাথন এবং সমাজকর্মী অম্মু স্বামীনাথনের কোল আলো করে জন্ম নেন লক্ষ্মী স্বামীনাথন। পরবর্তীতে যিনি ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম সক্রিয় কর্মী হিসেবে ক্যাপ্টেন লক্ষ্মী সেহগল নামে পরিচিতি লাভ করেছিলেন।
পড়াশুনা করতে করতে লক্ষ্মী ডাক্তারি পড়ার প্রতি আগ্রহী হন এবং সেইমতো মাদ্রাজ মেডিকেল কলেজে চিকিৎসাশাস্ত্র অধ্যয়নের জন্য ভর্তি হন। ১৯৩৮ সালে তিনি এমবিবিএস ডিগ্রি লাভ করেন। এর এক বছর পর তিনি গাইনোকোলজি এবং অবস্টেট্রিক্স বিষয়ে ডিপ্লোমা করেন। এবং চেন্নাইয়ের ত্রিপলিক্যাল এলাকায় কস্তুরবা গান্ধী সরকারি হাসপাতালে ডাক্তার হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। ১৯৪০ সালে লক্ষ্মীর প্রথম স্বামী পাইলট পি কে এন রাওয়ের সঙ্গে বিবাহ বিচ্ছেদ হয়। তারপরই তিনি সিঙ্গাপুরে পাড়ি দেন। সিঙ্গাপুরে তিনি একজন বিশিষ্ট গাইনোকোলজিস্ট হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। সেখানে থাকাকালীন তাঁর সঙ্গে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর ভারতীয় জাতীয় সেনাবাহিনীর সদস্যদের দেখা হয় এবং তিনি দরিদ্র, বিশেষ করে অবিভক্ত ভারতবর্ষ থেকে আগত শ্রমিকদের স্বাস্থ্য সেবার লক্ষ্যে একটি ক্লিনিক স্থাপন করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ১৯৪২ সালে সিঙ্গাপুর পতনের ফলে জাপানি বাহিনী সিঙ্গাপুর দখল করে। সেইসময় ডাঃ লক্ষ্মী আহত যুদ্ধবন্দিদের সেবা করতে গিয়ে দেখতে পান যে তারা অনেকেই ভারতীয় সেনাবাহিনী গঠনে বেশ আগ্রহী। ১৯৪৩ সালে সুভাষচন্দ্র বসু সিঙ্গাপুরে আসেন এবং সেখানে তিনি বিভিন্ন সভা সমাবেশে নারী রেজিমেন্ট গঠনের কথা উল্লেখ করেন। যেখানে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে নারীরা অংশগ্রহণ করবে। ডাঃ লক্ষ্মী এই বিষয়ে সবটা শোনেন এবং নেতাজির নারী রেজিমেন্টের খসড়া নীতিমালা সম্পর্কে সমস্ত কিছু জানতে পারেন। এরপর তিনি তাঁর লোভনীয় কর্মজীবন ছেড়ে নেতাজির তৈরি আজাদহিন্দ ফৌজের এই নারী রেজিমেন্ট, যা ইতিহাসে রানি ঝাঁসি রেজিমেন্ট হিসেবে পরিচিত পেয়েছিল, সেখানকার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। তখন থেকে ডাঃ লক্ষ্মী ক্যাপ্টেন লক্ষ্মী নামে পরিচিতি পান। নারী রেজিমেন্টের দায়িত্ব গ্রহণ করার পাশাপাশি ক্যাপ্টেন লক্ষ্মী ভারতীয় জাতীয় সেনাবাহিনীর একজন কর্মকর্তা হিসেবে এই নারী সংগঠন বিভাগের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী ছিলেন।
যাই হোক, ১৯৪৪ সালের ডিসেম্বরে আজাদহিন্দ ফৌজ জাপানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে রওনা দেয় কিন্তু ১৯৪৫ সালের মার্চ মাসে প্রবল যুদ্ধে তারা পিছু হটতে বাধ্য হয়। এর ফলে আইএনএ নেতৃবৃন্দ সিদ্ধান্ত নেয় যে, তাদের বাহিনী ইম্ফলে প্রবেশ করবে। এরপর ১৯৪৫ সালের মে মাসে ক্যাপ্টেন লক্ষ্মী ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর হাতে কারাবরণ করেন। ১৯৪৬ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত বার্মার কারাগারে তিনি বন্দি থাকেন। দিল্লিতে আইএনএ সদস্যদের বিচার প্রক্রিয়া চলাকালীন তিনি অবিভক্ত ভারতে ফিরে আসেন। এরপর ১৯৪৭ সালের মার্চ মাসে লাহোরে কর্নেল প্রেম সেহগালের সঙ্গে পুনরায় বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন এবং সবার কাছে ক্যাপ্টেন লক্ষ্মী সেহগাল নামে পরিচিতি পান। বিয়ের পর কানপুরে তাঁরা স্থায়ী আবাস গড়ে তোলেন। এবং সেখানে তিনি চিকিৎসাচর্চা ও ভারত বিভাজনের ফলে আগত ব্যাপক সংখ্যক শরণার্থীকে চিকিৎসার দ্বারা সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করেন। সেহগাল দম্পতির দুই কন্যাসন্তান জন্ম নেয়। তাঁরা হলেন সুভাষিণী আলি ও অনিশাপুরী। এদের মধ্যে সুভাষিণী আলি বড় হয়ে একজন সমাজতান্ত্রিক রাজনীতিবিদ ও শ্রমিক কর্মী হয়েছিলেন।
কানপুরে থাকাকালীন ১৯৭১ সালে লক্ষ্মী সেহগাল সিপিআই(এম)-এ যোগদান করেন এবং রাজ্যসভায় দলের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করেন। বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা সংগ্রামেও তাঁর ভূমিকা ছিল অসামান্য। তিনি উদ্বাস্তু শিবির পরিচালনা সহ কলকাতায় বাংলাদেশি শরণার্থীদের চিকিৎসা সেবা প্রদানে প্রধান ভূমিকা পালন করেন। ১৯৮১ সালে সিপিআই(এম)-এর অখিল ভারতীয় জনবাদী মহিলা সমিতির নারী শাখার প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য ছিলেন। দলীয় কর্মকাণ্ড ও প্রচারণায় প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৮৪ সালের ডিসেম্বরে ভূপালের গ্যাস দুর্ঘটনায় চিকিৎসক দলের নেতৃত্ব দেন ক্যাপ্টেন লক্ষ্মী সেহগল। এই বছরেই শিখবিরোধী দাঙ্গার প্রেক্ষাপটে শান্তি বজায় রাখার স্বার্থে কানপুরে জনসংযোগ করেন। ২০০২ সালে ভারতের চারটি বামপন্থী দল লক্ষ্মী সেহগলকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে মনোনয়ন দেয়।
৯২ বছর বয়স হওয়া পর্যন্ত তিনি কানপুরে নিয়মিতভাবে নিজের ক্লিনিকে রোগীদের চিকিৎসা করতেন। ২০১২ সালের ১৯ জুলাই ক্যাপ্টেন লক্ষ্মী সেহগল হৃদরোগে আক্রান্ত হন এবং ২৩ জুলাই সাতানব্বই বছর বয়সে কানপুরে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। এবং তাঁর দেহ কানপুর মেডিকেল কলেজে চিকিৎসাশাস্ত্রের প্রয়োজনে দান করা হয়।
নেতাজি সুভাষচন্দ্রের জীবন ও আদর্শ সংরক্ষণের কাজে নেতাজি রিসার্চ ব্যুরোর সদস্য হিসাবে লক্ষ্মী সহগলের ভূমিকা ছিল ঐকান্তিক। বলতেন, এ সব তথ্য সংগ্রহ করে রাখা জরুরি, আমরা যে এক দিন দেশের স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র সংগ্রাম করেছিলাম, পরবর্তী প্রজন্মের কাছে তা প্রেরণা হবে।
শ্রীমতী কৃষ্ণা বসু সাম্প্রতিক অতীতে সংবাদমাধ্যমে এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন, “কাজের ফাঁকে বা পারিবারিক বৈঠকে সে সব দিনের কথা লক্ষ্মীর মুখে শোনা এক অভিজ্ঞতা। এক দিন গুনগুন করে গাইছিলেন দুর্গম গিরি, কান্তার মরু দুস্তর পারাবার হে। তুমি নজরুলের বাংলা গান কোথায় শিখলে? আমার বিস্মিত প্রশ্নের জবাবে হেসে বললেন, কেন, নেতাজি শিখিয়েছিলেন। আমাদের রানি বাহিনীর কয়েক জন মেয়েকে এক লাইন করে গান গেয়ে নিজে শিখিয়েছিলেন।”
নেতাজি যখন এসে সিঙ্গাপুরে পৌঁছলেন, তখন লক্ষ্মী সেখানে তরুণী চিকিৎসক। ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেনডেন্স লিগের সভাপতি ইয়েলাপ্পা বলে পাঠালেন, নেতাজি ডেকে পাঠিয়েছেন, আজাদ হিন্দ ফৌজের নারী বাহিনী গঠনের ভার দিতে চান। ৯ই জুলাই এক বিশাল সমাবেশে ‘টোটাল মোবিলাইজেশন’-এর ডাক দিয়েছেন নেতাজি। মুক্তি সংগ্রামে সার্বিক যোগদান, মেয়েদের বাদ দিয়ে তা সম্ভব নয়। তিন দিন পরে গঠিত হল নারী বাহিনী। নেতাজি দেখতে আসবেন খবর পেয়ে জনা কুড়ি মেয়েকে তিন দিন ধরে গার্ড অব অনার দেওয়ার তালিম দিলেন লক্ষ্মী। শাড়ির আঁচল কোমরে জড়ানো, হাতে মস্ত ভারী রাইফেল, গার্ড অব অনার দিলেন।
নেতাজি এই প্রথম প্রচেষ্টায় খুশি হয়েছিলেন। তবে আলাদা করে ডেকে লক্ষ্মীকে তিনি বলেছিলেন, সব দিক ভেবে কাজে হাত দিতে। এটা কিন্তু লোকদেখানো ব্যাপার নয়, বর্মার জঙ্গলে যুদ্ধ করার জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে। কবে কাজ শুরু করতে পারবে? প্রশ্নের ঝটিতি জবাব, আগামিকাল থেকে।
নেতাজি নিজের মুখে তেমন কোনও নির্দেশ দেননি, কিন্তু মেয়েরা চুল কেটে ফেলেন। প্রাণ দেওয়ার জন্য তৈরি, চুল তো কোন ছার। দীর্ঘ কেশ স্বাধীনতা সংগ্রামে আহুতি হল। মেয়েদের ইউনিফর্ম হল জোধপুর ব্রিচেস, বুশ শার্ট, কালো বকলস দেওয়া জুতো। মিলিটারি ট্রেনিং শুরু হল। জাপানি সংস্কৃতিতে মেয়েরা গৃহিণী অথবা মনোরঞ্জনকারিণী। প্রথম দিকে ট্রেনিংয়ের গুলিবারুদ দিতে তাঁদের বিশেষ আপত্তি ছিল। পরে অবশ্য মেয়েদের সাহস ও আন্তরিকতায় জাপানি অফিসারেরা মুগ্ধ হন।
ইউরোপ থেকে পূর্ব এশিয়ার পথে সাবমেরিনে বসে মেয়েদের কাছে সশস্ত্র বাহিনীর বাপারে তাঁর বক্তব্য নেতাজি ডিকটেশন দিলেন আবিদ হাসানকে। সাবমেরিন জলের উপর সামান্য ভেসে উঠেছিল। ব্রিটিশ যুদ্ধজাহাজের চোখ পড়ে যাওয়ায় আক্রান্ত হওয়ার উপক্রম। বিপদসংকেতের মধ্যে দুলতে দুলতে সাবমেরিন জলার তলায় ডুবছে। আবিদের কানে এল নেতাজির শান্ত কণ্ঠস্বর, “আবিদ, আমি একটা লাইন দু’বার বললাম, তুমি লেখোনি।” কাঁপা হাতে লিখতে শুরু করলেন তিনি।
কী ছিল সেই বক্তব্য যা তিনি সিঙ্গাপুরে নেমেই মেয়েদের কাছে তুলে ধরলেন? আবিদ হাসান নোট নিয়েছিলেন –
“মেয়েদের হতে হবে বীরাঙ্গনা। মৃত্যু ও অসম্মানের মধ্যে ভারতীয় নারী বেছে নিয়েছে মৃত্যু। কিন্তু এখন চিতায় ঝাঁপ দিয়ে মৃত্যু নয়। অস্ত্র হাতে যুদ্ধক্ষেত্রে মৃত্যুর মুখোমুখি হতে হবে। যেমন হয়েছিলেন ঝাঁসির রানি লক্ষ্মীবাই। ইংরেজদের বিরুদ্ধে ঘোড়ায় চড়ে তলোয়ার হাতে যুদ্ধ করতে করতে প্রাণ দিয়েছিলেন তিনি। তাঁরই পুণ্য নামে হবে রানি অব ঝাঁসি রেজিমেন্ট।”
সিপাহি বিদ্রোহকে নেতাজি বলতেন, ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম। দেশের শেষ স্বাধীনতা সংগ্রামে মেয়েদের সামরিক বাহিনীর অধিনেত্রী হলেন লক্ষ্মী স্বামীনাথন (সহগল)। স্বাধীন ভারত সরকারের নেতাজির আজাদ হিন্দ সরকারের প্রথম মহিলা মন্ত্রীও তিনি।
শ্রীমতী কৃষ্ণা বসু তাঁর স্মৃতিচারণে জানিয়েছিলেন, “লক্ষ্মী আমাদের বলতেন, তোমরা যে কী সব নারীস্বাধীনতার প্রবক্তা হিসেবে বড়াই করো, নেতাজির মতো ‘ফেমিনিস্ট’ আমি আর দেখিনি। কথাটা সত্যি। তিনি লিখেছিলেন, রন্ধন আর সন্তান উৎপাদন নারীর একমাত্র জীবন নয়। দেশবন্ধুর মৃত্যুর পর চেয়েছিলেন বাসন্তী দেবী বাংলার হাল ধরবেন। তিনি রাজি না-হওয়াতে ক্ষুব্ধ হয়ে বলেছিলেন, আপনি কর্তব্যে অবহেলা করেছেন।”
ইম্ফল রণাঙ্গনে যেতে চায় মেয়েরা। তাদের সিঙ্গাপুর থেকে এগিয়ে আনা হল রেঙ্গুনে। বাছাই করা এক দলকে পাঠানো হল অগ্রবর্তী ঘাঁটি মেমিওতে। নেতৃত্বে ছিলেন লক্ষ্মী। মেমিও হেডকোয়ার্টার্স পরিদর্শনে এলেন নেতাজি। সে রাতেই চাঁদের আলোয় প্রবল বোমাবর্ষণে বিধ্বস্ত হয়ে গেল তাদের ব্যারাক। মেমিওর কাছে কালাউতে ইংরেজদের হাতে বন্দি হলেন লক্ষ্মী। জিজ্ঞাসাবাদের সময়ে মেয়েদের দাপট দেখে ইংরেজরা স্তম্ভিত হয়েছিল।
স্বাধীন ভারতে লক্ষ্মী সহগল জনসেবায় যুক্ত ছিলেন। ছিলেন সক্রিয় রাজনীতিতেও। যে বামপন্থী দল তিনি বেছে নিলেন, তারা গাঁধীজির ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলন বা নেতাজির ‘আজাদ হিন্দ আন্দোলন’ সমর্থন করেনি। বিস্মিত জিজ্ঞাসার উত্তরে তিনি অকপটে বলতেন, “নেতাজি শিখিয়েছিলেন সারা জীবন মানুষের জন্য কাজ করবে।” তিনি যখন সেই কাজের বৃহত্তর পরিধি খুঁজছেন তখন যে রাজনৈতিক সুযোগ আসে তিনি তা মন থেকে গ্রহণ করেন। এ তাঁর ব্যক্তগত অভিরুচি। কিন্তু লক্ষ্মীর জীবনে নেতাজির প্রতি আনুগত্য ছিল প্রশ্নাতীত। সকল আজাদ হিন্দ সৈনিকের মতো তিনিও বিশ্বাস করতেন ১৯৪৩ থেকে ১৯৪৫ নেতাজির সান্নিধ্যে কাটানো দুটি বছর তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়। ভারতের রাষ্ট্রপতি পদে প্রার্থী হয়েছিলেন লক্ষ্মী সহগল ২০০২ সালে।
রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের স্মৃতিচারণে শ্রীমতী কৃষ্ণা বসু জানিয়েছিলেন, “পার্লামেন্টের ৬৩ নম্বর ঘরে সহ-সাংসদদের সঙ্গে ভোটারদের লাইনে দাঁড়িয়ে আছি। আমাদের সামনে সে বার অত্যন্ত উপযুক্ত দুই প্রার্থী বিজ্ঞানী কালাম আর বীরাঙ্গনা লক্ষ্মী সহগল। সাংসদেরা বলাবলি করছিলেন, অঙ্কের হিসেবে পরাজয় অবধারিত জেনেও লক্ষ্মী সহগলের কি দাঁড়ানো উচিত হল? হতে পারতেন প্রথম মহিলা রাষ্ট্রপতি। পরাজিত হলেও মহিলাদের জন্য রাষ্ট্রপতি ভবনের দরজা কি একটু খুলে দিয়ে গেলেন না?”
পরবর্তী নির্বাচন সেই রকমই বলে।
জীবনের নানা ক্ষেত্রে পথিকৃৎ এই নারীর ছিল সহজাত সৈনিকের স্পিরিট। যে কোনও যুদ্ধে নির্ভয়, ক্যাপ্টেন লক্ষ্মী সহগলের জন্য রইল আমাদের অভিবাদন।
জয়হিন্দ।
(তথ্যসূত্র:
১- Mera Jeevan Sangharsh, Dr (Captain) Lakshmi Sahgal, Anamika Prakashan (২০১৪)।
২- A revolutionary life: memoirs of a political activist, Lakshmi Sahgal; with an introduction by Geraldine Forbes, Women Unlimited (২০১৩)।
৩- Captain Lakshmi Sahgal (1914 – 2012) – A life of struggle, article published on The Hindu on 23rd July 2012.
৪- আনন্দবাজার পত্রিকা, ৫ই মার্চ ২০১৭ সাল।
৫- ২৯শে জুলাই ২০১২ সালে আনন্দবাজার পত্রিকায় শ্রীমতী কৃষ্ণা বসু লিখিত প্রবন্ধ।
৬- বর্তমান পত্রিকা, ২৫শে আগস্ট ২০১৮ সাল।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত