১৮৯৪ সাল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
তৎকালীন পত্র-পত্রিকায় যাঁকে দুরন্ত ঝঞ্ঝা আখ্যা দেওয়া হয়েছিল, সেই স্বামী বিবেকানন্দ একদা কিন্তু বেশ মুশকিলে পড়ে গিয়েছিলেন। জনপ্রিয়তা ও খ্যাতির কিছু কিছু বিড়ম্বনা তো থাকেই, তা বোঝা যায়, কিন্তু এই তরুণ সন্ন্যাসীটি তখন বুঝতে পারেননি যে, তাঁর এই জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগাবার জন্য এক শ্রেণীর ব্যবসায়ী তাঁকে কুক্ষিগত করে ফেলবে।
শিকাগোর বিশ্ব ধর্ম সম্মেলনের শুধু উদ্বোধনী ভাষণে নয়, তারপরে আরও অনেকগুলি আলোচনা চক্রে প্রমাণিত হয়ে গিয়েছিল যে স্বামী বিবেকানন্দের বক্তৃতায় এক দারুণ আকর্ষণী শক্তি আছে। যে-সব সভায় অনেক বক্তা, সে-সব সভায় বিবেকানন্দেব ডাক পড়ত সবচেয়ে শেষে। অন্যান্যদের বক্তৃতা শুনতে শুনতে শ্রোতারা যখন ঝিমিয়ে পড়তেন, অনেকে উঠে চলে যেতে শুরু করতেন, তখন উদ্যোক্তারা ঘোষণা করতেন, ‘আপনারা বসুন, বসুন, এর পরে বলবেন স্বামী বিবেকানন্দ!’ অমনি সভামণ্ডপে নতুন উৎসাহের সঞ্চার হত।
বিবেকানন্দ লিখিত ভাষণ পাঠ করতেন না, তাঁর সমস্ত কথাই ছিল স্বতঃস্ফূর্ত। তাঁর ইংরেজি উচ্চারণে কিছুটা আইরিশ টান থাকলেও স্পষ্ট বোঝা যেত, অহেতুক উদ্ধৃতি বা পাণ্ডিত্যের কচকচি কোনও দিন ছিল না তাঁর বক্তৃতায়, তাঁর চোখের দৃষ্টির মতনই তাঁর মুখেব বাক্যও ছিল প্রবল আত্মবিশ্বাসে পরিপূর্ণ। ধর্মীয় দর্শন এবং ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে মানুষের জীবন, এই ধরনের গুরুতর বিষয় নিয়ে আলোচনা করলেও তিনি উৎকট গুরুগম্ভীর ভাব কদাপি করতেন না। তাঁর গুরুর নির্দেশ মতনই তিনি রসেবশে থাকতেন, শুকনো সন্ন্যাসী তিনি ছিলেন না।
শুধু প্রকাশ্য জনসভায় নয়, বিভিন্ন ঘরোয়া আসরেও তাঁর ডাক পড়ত, বিশিষ্ট ব্যক্তিরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা মন্ত্রমুগ্ধের মতন তাঁব কথা শুনতেন।
আমেরিকায় প্রতিটি মানুষের জীবনেই সময়ের দাম আছে। এটা স্বামীজী যখন সেখানে গিয়েছিলেন তখনও ছিল আর বর্তমানেও আছে। যে যে কাজই করুক না কেন, সে তাঁর প্রতিটি মিনিটের জন্য দাম আগেও পেত ও এখনও পায়, কিংবা তাঁকে আগেও দাম দিতে হত আর এখনও দাম দিতে হয়। বক্তৃতা, বিনা পয়সায় হয় না, বক্তা যেহেতু সময় ব্যয় করছেন, তাই সেই সময়ের দাম তাঁর প্রাপ্য। তখন সেখানে যাঁরা কোনও বক্তৃতা শুনতে আসতেন, তাঁরাও সেটির জন্য দাম দিতে দ্বিধা করতেন না। আজও আমেরিকায় এই পদ্ধতি বর্তমান।
তখন স্বামী বিবেকানন্দের জনপ্রিয়তা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে দেখে শিকাগোর শ্লেটন লাইসিয়াম ব্যুরো নামে একটি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান তাঁর সঙ্গে তিন বৎসরের একটা চুক্তি করে ফেলেছিল। স্বামীজীর সাথে তাদের চুক্তি ছিল যে, তারা আমেরিকার বিভিন্ন শহরে এই ভারতীয় সন্ন্যাসীর বক্তৃতায় ব্যবস্থা করবে, টিকিট বিক্রির টাকা বক্তা ও উদ্যোক্তাদের মধ্যে ভাগাভাগি হবে।
আপাতদৃষ্টিতে এটি বিবেকানন্দের পক্ষে বেশ উপযোগী ছিল। তিনি ভারতের ধর্ম ও বাণী প্রচার করার জন্য সে-দেশে গিয়েছিলেন, সহসা ফিরে যাওয়ার কোনও মানে ছিল না। তাঁর পক্ষে নানা শহরে ঘুরে ঘুরে হল ভাড়া করা, কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে শ্রোতা সংগ্রহ কিংবা টিকিট বিক্রির ভার নেওয়া সম্ভব ছিল না। সে সব দাযিত্ব অন্যের ওপর চাপানোই ছিল শ্রেয়। তিনি বক্তৃতা দেবার পর কোথাও আশি ডলার, কোথাও একশো সাতাশ ডলার পেয়ে মনে করছিলেন বেশ ভালই উপার্জন হচ্ছে। একদা স্বামীজী ডেট্রয়েটে এক দিনের বক্তৃতার জন্য পেয়েছিলেন ন’শো ডলার! ডলারের দাম তখন ভারতীয় মুদ্রায় ছিল তিন টাকা, সেই অনুযায়ী হিসেব কষলে সেটা ছিল অনেক টাকা! তখন ভারতে অনেক শিক্ষিত ব্যক্তিও সারা বছরে সাতাশ শো টাকা রোজগার করতে পারতেন না।
কিন্তু সন্ন্যাসীর পক্ষে এবকম ভাবে অর্থ উপার্জন করা কি নীতিসম্মত? প্রশ্নটি তিনি নিজেই নিজেকে করতেন। আর এই প্রশ্নটি তাঁকে সবসময় বিদ্ধ করত। চুক্তিটি করার সময় বিবেকানন্দ আমেরিকায় তাঁব নবলব্ধ বন্ধুদের কারও সঙ্গে পরামর্শ করেননি, এমনকি দেশেও কাউকে জানাননি।
দেশের সঙ্গে, বিশেষত বাংলার গুরু-ভাইদের সঙ্গে তখন তাঁর অনেকদিন যোগাযোগ ছিল না। শিকাগোর ধর্ম সম্মেলনে স্বামী বিবেকানন্দ নামে এক হিন্দু সন্ন্যাসীর জয়বার্তা যখন একটু একটু করে কলকাতায় পৌঁছায়, তখনও শ্রীরামকৃষ্ণেব গৃহী বা সংসারত্যাগী শিষ্যরা কেউ বুঝতে পাবেননি যে, এই দিগ্বিজয়ী তাঁদের সেই নরেন। বিবেকানন্দ নামটাও ছিল তাঁদের কাছে অপরিচিত, নরেনের সমুদ্র পাড়ি দেবার ঘটনাও ছিল তাঁদের কাছে অজ্ঞাত। বিবেকানন্দ চিঠিতে যোগাযোগ বাখতেন শুধু তাঁব মাদ্রাজি ভক্ত আলাসিঙ্গা, খেতড়ির রাজা অজিত সিং ও আরও দু একজনের সঙ্গে। পরে অবশ্য বিবেকানন্দের সঙ্গে তাঁর গুরু-ভাইদের যোগাযোগ শুরু হয়।
অর্থ উপার্জন করার ব্যাপারে বিবেকানন্দ একটা যুক্তি তৈরি করে নিয়েছিলেন। ভারতে একজন সন্ন্যাসী কেবলমাত্র গাছতলায় শুয়ে রাত কাটিয়ে দিতে পারেন, আমেরিকার মতন শীতের দেশে সেটা কখনও সম্ভব নয়। ভারতে সাধু-সন্ন্যাসীদের দেখলেই সাধারণ মানুষ পুণ্য সঞ্চয়ের আশায় তাঁদের আহার্যের ব্যবস্থা করে দিত। সে রকম প্রথা আমেরিকায় ছিল না। এর মধ্যে তিনি বিভিন্ন পরিবারে আতিথ্য নিয়েছিলেন বটে, কিন্তু দিনের পর দিন তা সম্ভব ছিল না। মাঝে মাঝেই তিনি হোটেলে থাকতে বাধ্য হতেন। তাও সাধারণ হোটেল তাঁকে স্থান দিত না, দামি হোটেলেই তাঁকে উঠতে হত, সে খরচ তাঁকে কে দেবে! এছাড়া তাঁর কিছু কিছু ব্যক্তিগত ব্যয়ও ছিল। তামাকের নেশা তখন তিনি কিছুতেই ছাড়তে পারছিলেন না। দেশে হুঁকো টানা বেশ সস্তার ব্যাপার ছিল, কিন্তু ওদেশে চুরুটের খুব দাম, তেরো ডলার দিয়ে তিনি একটা পাইপ কিনে ফেলেছিলেন। তিরিশ ডলার খরচ হয়ে গিয়েছিল একটা কালো রঙের কোট কেনার জন্য। তা ছাড়া তাঁর চিন্তা ছিল যে, অনেক টাকা জমাতে হবে, সেই টাকা তিনি দেশে পাঠাবেন। শিল্প স্থাপন করতে না পারলে ভারতের দারিদ্র্যদশা কোনও দিন ঘুচবে না। তিনি মার্কিনদেশীয় বন্ধুদের বলতেন, ‘আমি এ দেশে এসেছি দেশ দেখতে নয়, তামাশা দেখতে নয়, নাম করতে নয়, আমার দেশের দরিদ্র মানুষদের জন্য উপায় দেখতে।’ মনে মনে তিনি দেশে গিয়ে মানুষের সেবার জন্য প্রতিষ্ঠান গড়ার কথাও ভাবছিলেন, তার জন্যও তো অর্থের প্রয়োজন।
কিন্তু দু-এক মাস যেতে না যেতেই বিবেকানন্দ বুঝলেন, ওই রকম একটা চুক্তির জালে আবদ্ধ হওয়া মারাত্মক ভুল হয়েছে। মার্কিনদেশের ব্যবসায়ীরা ধর্ম বোঝে না, মানুষের সেবাকার্য নিয়ে মাথা ঘামায় না, তাঁরা বোঝে শুধু মুনাফা। আর বিবেকানন্দের মতন একজন বিদেশি, অসংসারী, অনভিজ্ঞ মানুষকে ঠকিয়ে অতিরিক্ত লাভ করাও তাঁদের পক্ষে সহজ। বিবেকানন্দকে তাঁরা চরকির মতন ঘোরাতে লাগল এক শহর থেকে আর এক শহরে, দিনের পর দিন বক্তৃতা দিতে দিতে তিনি ক্লান্ত, বিধ্বস্ত হতে লাগলেন, কিন্তু তাতে পকেট ভরতে লাগল ওই ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানেরই। এক সময় তিনি টের পেয়েও গেলেন যে, তিনি প্রতারিত হচ্ছেন। প্রশংসা ও নিন্দে দুটোই বাড়ার ফলে তাঁকে নিয়ে যত বিতর্ক জমছিল, ততই তাঁর সম্পর্কে লোকের কৌতূহল বাড়ছিল, দলে দলে লোক ছুটে আসছিল তাঁর বক্তৃতা শুনতে। এক জায়গায়-টিকিট বিক্রি হয়েছিল আড়াই হাজার ডলার, তার থেকে স্বয়ং বক্তা পেয়েছিলেন মাত্র দুশো ডলার।
অথচ এই চুক্তির জাল ছিন্ন করে বেরিয়ে আসার কোনও উপায় ছিল না। তা হলে তাঁকে অসম্ভব ক্ষতিপূরণ দিতে হত। তিনি বুঝেছিলেন যে, তিন বছর ধরে যদি তাঁকে এরকম পরাধীন ভাবে বক্তৃতা দিয়ে ছুটে বেড়াতে হয়, তা হলে তাঁর জীবনীশক্তির কিছুই আর অবশিষ্ট থাকবে না।
শিকাগো থেকে ম্যাডিসন ও মিনিয়াপোলিস, আয়ওয়া সিটি ও ডিময়েন, মেমফিস, সেখান থেকে একবার শিকাগোয় ফিরে আবার ঘোর শীতের মধ্যে ডেট্রয়েট, ওহায়োর আড়া নামে শহর, মিশিগানের বে সিটি ও স্যাগিননা, তারপর দক্ষিণের কিছু কিছু শহরে ঝঞ্ঝার মতনই ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন এই তরুণ সন্ন্যাসী। তাঁর জীবনীশক্তি অপরিমিত হলেও এত পরিশ্রম সহ্য হত না। মাঝে মাঝে অসুস্থ হয়ে পড়তেন। কিন্তু চুক্তিবদ্ধ বলে তাঁকে বক্তৃতা দিয়েই যেতে হত।
বক্তৃতা দিয়ে মানুষকে মুগ্ধ করার ক্ষমতা ছিল তাঁর, ভারতের শাশ্বত বাণী সেই দেশের মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া ছিল তাঁর কাছে তাঁর জীবনের ব্রত, তবুও এক এক জায়গায় শ্রোতারা এমনই অদ্ভুত ছিল যে, সেখানে কোনও গুরুত্বপূর্ণ কথা বলাই যেত না। তখন আমেরিকার অধিবাসীরা জাগতিক ব্যাপারে প্রভূত উন্নতি করেছিল বটে, কিন্তু অধিকাংশ আমেরিকানই জগৎ সম্পর্কে অতিশয় অজ্ঞ ছিল। ভারতবর্ষের মতন এতবড় একটি দেশ সম্বন্ধে দু’চারটি খারাপ কথা ছাড়া তাঁরা কিছুই জানত না। সম্রাট অশোক বা আকবর কিংবা রাজা রাজমোহনের নাম শুনেছে, এমন লোকের সংখ্যা ছিল মুষ্টিমেয়। ভারতীয়রা দরিদ্র, অতিশয় দরিদ্র, এইটুকুই তাঁরা জানত। কিন্তু এককালের ঐশ্বর্যময় ভারত তখন কেন দরিদ্র, তাঁদের জাতভাইরাই যে ভারতের শোষণকারী, তা নিয়ে তাঁরা মাথা ঘামাত না। এই ভারতেরই অনেক মানুষই যে স্বেচ্ছায় সংসারের সুখ সম্ভোগ ছেড়ে সন্ন্যাসীর জীবন বরণ করে, সে সম্পর্কে তাঁদের কোনও ধারণাই ছিল না।
বিবেকানন্দের নাম সঠিকভাবে উচ্চারণ করতে প্রায় কেউই পারত না। কেন একজন মানুষের এরকম নাম, তা বোঝারও চেষ্টাও তাঁরা করত না। তাদের ধারণা ছিল, এই লোকটির নাম হচ্ছে ‘বিব’, এবং এর পদবি ‘কানন্দ্’। তাঁরা ‘মিঃ কানন্দ্! মিঃ কানন্দ্!’ বলে স্বামীজী কে সম্বোধন করত। বিবেকানন্দ তাঁদের অনেকবার বোঝাবার চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিয়েছিলেন।
সেই ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানটি মাঝে মাঝেই ইচ্ছে করেই কোনও খনি বা কল কারখানার নিকটবর্তী অঞ্চলে বক্তৃতার ব্যবস্থা করত। সেখানকার শ্রমিক বা কর্মচারীরা প্রাচ্যদেশীয কোনও মানুষ দেখেইনি। মাথায় পাগড়ি পরা একটি অদ্ভুত প্রাণী দেখার জন্যই তাঁরা দলে দলে এসে টিকিট কাটত। তাঁদের সামনে কোনও গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ উত্থাপন করাই যেত না।
বক্তৃতা শুরু করতে না করতেই সেই সব শ্রমিক বা কর্মচারী শ্রোতাদের মধ্য থেকে কেউ না কেউ চেঁচিয়ে বলে উঠত, ‘হেই মিঃ কানন্দ্, ওসব বড় বড় কথা শুনতে চাই না। তোমাদের দেশে শুনেছি, মায়েরা সন্তানের জন্মের পর নদীতে ছুঁড়ে ফেলে দেয় কুমিরদের খাওয়াবার জন্য! একথা সত্যি?’
বক্তৃতা থামিয়ে বিবেকানন্দ একটুক্ষণ চুপ করে থাকতেন। তারপর স্মিতমুখে বলতেন, ‘আমার মা যে আমাকে জলে ছুঁড়ে ফেলে দেননি, তা তো দেখতেই পাচ্ছেন!’
এটা শুনে ভিড়ের মধ্যে থেকে অন্য কেউ বলতেন, ‘ছেলেদের ছুড়ে দেয় না, শুধু মেয়েদের ফেলে দেয়।’
বিবেকানন্দ বলতেন, ‘তাই নাকি। তা হলে নিশ্চয়ই কুমিররা মেয়ে সন্তানদেরই বেশি পছন্দ করে। মেয়েদের মাংস খুব নরম আর সুস্বাদু লাগে বোধহয় ওদের কাছে।’
এতে একদল হেসে উঠলেও অনাদল সন্তুষ্ট হত না। তাঁরা বলত, ‘হ্যাঁ, তোমাদের দেশের বাচ্চা মেয়েদের জলে ফেলে দেওয়া হয়, আমরা জানি। তুমি এড়িয়ে যাচ্ছ।’
বিবেকানন্দ উত্তর দিতেন, ‘না, এড়িয়ে যাচ্ছি না। আমি ভাবছি, সব মেয়েই যদি কুমিরের পেটে যায়, তা হলে পুরুষ সন্তানরা জন্মায় কী করে?’
আবার কেউ উঠে দাঁড়িয়ে সবজান্তার ভঙ্গিতে বলত, ‘বাচ্চা মেয়েদের জলে ফেলে দেওয়া হোক বা না হোক, স্বামী মরে গেলে তোমাদের দেশের বিধবাদের জোর করে পুড়িয়ে মারা হয়, এটা সত্যি। নিশ্চয়ই সত্যি। আমি অনেক বইতে ছবি দেখেছি।’
বিবেকানন্দ বলতেন, ‘হ্যাঁ, এটা মিথ্যে নয়। এখন আইনত নিষিদ্ধ করা হয়েছে, এক সময় কিছু কিছু বিধবা স্বামীর চিতায় পুড়ে মরেছেন, এ কথা সত্যি। দু চার জায়গায় জোর করা হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাঁদের বুঝিয়ে নিরস্ত করার চেষ্টা হত। তবু কোনও বিধবা মোহের বশে জেদ ধরলে তাঁকে আগে আগুনে হাত দিয়ে পরীক্ষা দিতে হত। আমি এ ব্যাপারটা মেনে নিচ্ছি। এবার প্রশ্ন করি, আপনারা জোয়ান অফ আর্কের নাম শুনেছেন নিশ্চয়ই? এই তো মাত্র সেদিন ফরাসিদেশে তাঁকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়েছিল! তাই না?’
এরা কেউই জোন অফ আর্কের নাম জানত না, তাই চুপ করে যেত।
বিবেকানন্দ আবার বলতেন, ‘মধ্যযুগের ইউরোপের খ্রিস্টানরা কত শত শত অসহায় মেয়েদের ডাইনি বলে কাঠের দণ্ডে বেঁধে পুড়িয়ে মেরেছে। তাদের কথা শোনেননি?’
দর্শকদের মৃদু গুঞ্জনের মধ্যে তিনি আবার জোর দিয়ে বলে উঠতেন, ‘এই ধরনের ধর্মান্ধতা সব দেশেই আছে শুধু এবম দু’ একটি ঘটনা দিয়ে কোনও দেশকে বিচার করা যায় না। একজন ফরাসি বা ইংরেজকে দেখলেই কেউ এখন জোয়ান অফ আর্কের কথা জিজ্ঞেস করে না। একজন ভারতীয়কে দেখলেই বা কেন সতীদাহের প্রসঙ্গ তোলা হবে!’
শুধু খনি-শ্রমিক বা কারখানার মানুষরাই নয়, অনেক গির্জায়, অনেক উচ্চাঙ্গের ক্লাবে, অনেক শিক্ষিতদের সমাবেশেও এই ধরনের প্রশ্ন নিক্ষিপ্ত হত তাঁর দিকে। একদল লোক এই সব প্রশ্নের উত্তরও চাইত না, ভারত সম্পর্কে কুৎসাগুলি অন্যদের শোনানোই ছিল তাঁদের মূল উদ্দেশ্য। একদিন বিবেকানন্দ এই রকম একটি সমাবেশে বলে ফেলেছিলেন, ‘পশ্চিমি দেশগুলির একদল অত্যুৎসাহী প্রাচ্যদেশ সম্পর্কে যত নিন্দা আর অপপ্রচার করেছে, ভারত মহাসাগরের তলদেশের সমস্ত কাদা পাশ্চাত্যের দিকে ছুঁড়ে মারলেও তার যথেষ্ট প্রতিশোধ হয় না। কিন্তু আমি এ দেশে কাদার বদলে কাদা ছুঁড়তে আসিনি।’
বহু যথার্থ ভোগবাদবিমুখ নারী-পুরুষ অবশ্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিবেকানন্দের অধ্যাত্মবাদের কথা মন দিয়ে শুনতেন এবং তাঁর ভক্ত হয়েছিলেন। কিন্তু ভক্তের সংখ্যা বাড়লে শত্রুর সংখ্যাও যে বাড়ে।
শিকাগোর ধর্মসভায় অন্য যে-সব ভারতীয় যোগ দিতে এসেছিলেন, তাঁরাও বিভিন্ন জায়গায় বক্তৃতা দিয়েছিলেন এবং শ্রোতাও পেয়েছিলেন। কিন্তু বিবেকানন্দের মতন তাঁরা এমন স্পষ্ট বক্তা ছিলেন না, তাঁরা উচ্চাঙ্গের কথা বলতেন বটে কিন্তু বিবেকানন্দর মতন এমন মতবিরোধের সৃষ্টি করেননি, এমনভাবে মিশনারিদের সঙ্গে জ্বালা ধরাননি। তখন বিবেকানন্দ আমেরিকার পত্র-পত্রিকায় সবচেয়ে বেশি আলোচ্য ছিলেন। আমেরিকার প্রায় সব গির্জায় গিজায় তাঁর বিরুদ্ধে বিষোদগার চলেছিল। এই সবই তাঁর জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি করেছিল, এবং তাতে অন্য বক্তাদের ঈর্ষান্বিত হয়ে ওঠাও অস্বাভাবিক ছিল না। তা ছাড়া বিবেকানন্দ বক্তৃতা দিয়ে অর্থ উপার্জন করেছিলেন অনেক। প্রতাপ মজুমদার প্রথম দিকে বিবেকানন্দের প্রতি স্নেহ প্রদর্শন করেছিলেন, পরে বিবেকানন্দকে নিয়ে এতটা বাড়াবাড়ি তাঁর ঠিক সহ্য হয় নি। তিনি তাঁর কাছাকাছি মানুষদের বলে বেড়াতে শুরু করেছিলেন যে, ও ছেলেটা তো গাঁয়ে মানে না আপনি মোড়ল, ওর কথাগুলি তো সমস্ত ভারতীয় হিন্দুদের মনোভাবের প্রতিফলন হতে পারে না, কারণ হিন্দু সমাজের পক্ষ থেকে ওকে তো প্রতিনিধি করে পাঠানো হয়নি। ও একটা ভূঁইফোড়!
প্রতাপ মজুমদার দেশে ফিরে আসার পর দেশের দু’একটি পত্র-পত্রিকায় বিবেকানন্দ সম্পর্কে কটু কথা প্রকাশিত হতে লাগল। নরেন দত্ত নামে একটি ছোকরা ব্রাহ্মদের থিয়েটারে গান গাইত, ওর আবার ধর্মীয় নেতা হবার যোগ্যতা হল কী করে? কেশবচন্দ্র সেনও থিয়েটারে অভিনয় করেছিলেন, তাঁর ধর্মগুরু হতে কোনও আপত্তি ওঠেনি, সে কথা কেউ মনে রাখল না। বিবেকানন্দ সম্পর্কে আরও বলাবলি হতে লাগল যে, সন্ন্যাসীর ভেক ধরে সে আমেরিকায় ব্যভিচারী হয়েছে, সর্বদা চুরুট ফোঁকে। পানাহারের কোনও বাছ-বিচার নেই, অখাদ্য কুখাদ্য খায়, নারীঘটিত দুর্বলতাও আছে।
এসব খবর বিবেকানন্দের কাছে এসে পৌঁছেছিল, তিনি প্রতিবাদ করতে চান নি, কিন্তু ব্যথিত হতেন। তাঁর মনে পড়ত, বৃদ্ধা মায়ের কথা। মা শত আপত্তি সত্ত্বেও ছেলেকে ব্রহ্মচারী হতে দিয়েছিলেন, এই জ্যেষ্ঠ সন্তানটির প্রতি তাঁর অনেক আশা-ভরসা, এখন যদি মা শোনেন যে সেই ছেলে দূর বিদেশে গিয়ে অনাচারী হয়েছে, তা হলে তিনি কষ্ট পাবেন। মা কি বিশ্বাস করবেন শেষ পর্যন্ত?
আর একজন ভারতীয় সেই একই সময়ে আমেরিকায় বেশ প্রভাব বিস্তার করেছিলেন। তিনি ছিলেন একজন মহিলা, সবাই তাঁকে বলত পণ্ডিতা রমা বাঈ। মহারাষ্ট্রের এক ব্রাহ্মণ পরিবারে এই রমা বাঈয়ের জন্ম হয়েছিল। তাঁর পিতা তাঁকে উত্তমরূপে সংস্কৃত শিখিয়েছিলেন এবং যৌবনের উদগমেই রমা বাঈ উন্নত মেধার পরিচয় দিয়েছিলেন। কলকাতায় এসে তিনি একটি বাঙালি যুবকের প্রেমে পড়েন, সে যুবকটি ছিল অব্রাহ্মণ। এক অব্রাহ্মণ তনয়ের সঙ্গে এক ব্রাহ্মণ কন্যার প্রণয় বিবাহে এক সময় বেশ শোরগোলের সৃষ্টি হয়েছিল, কিন্তু তাঁদের বিবাহিত জীবন দীর্ঘস্থায়ী হয়নি, যুবকটি অকালে মারা যায়। বিধবা রমা বাঈ কিছুদিন পরে ইংল্যান্ডে চলে আসেন এবং সেখানে আরও বিদ্যাচর্চা করে তাঁর পণ্ডিতা উপাধিটি সার্থক করেন এবং খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিতা হয়ে যান। দেশে ফিরে এসে তিনি হিন্দু বিধবাদের দুরবস্থা নিবারণের কাজে মন-প্রাণ ঢেলে দেন।
রমা বাঈয়ের সেই সেবামূলক কাজ অবশ্য মহারাষ্ট্রের অনেকে সুনজরে দেখেনি। বিধবা আশ্রম গড়ার জন্য তাঁকে খ্রিস্টান মিশনারিদের কাছ থেকে অর্থ সাহায্য নিতে হত, এবং মিশনারিদের প্রভাবে অনেক বিধবাই হিন্দু ধর্ম ছেড়ে খ্রিস্ট ধর্ম গ্রহণ করতে শুরু করেছিলেন। অর্থাৎ এটাই প্রতিভাত হতে শুরু হয়েছিল যে, হিন্দু বিধবাদের দুঃখ-কষ্ট মোচনের একমাত্র উপায় ধর্মান্তর। মহারাষ্ট্রের গোঁড়া হিন্দুদের এটা পছন্দ হবার কথা ছিল না, আর হয়ও নি। বাল গঙ্গাধর তিলক তাচ্ছিল্যের সঙ্গে মন্তব্য করেছিলেন, ‘ওকে সবাই পণ্ডিতা বলে কেন, ওর নাম হওয়া উচিত রেভারেন্ডা রমা বাঈ!’
আমেরিকায় তখন রমা বাঈয়ের কাজের সমর্থনে ও সাহায্যকল্পে অনেকগুলি কেন্দ্র গড়ে উঠেছিল। রমা বাঈ সার্কল নামে এ রকম পঞ্চান্নটি প্রতিষ্ঠান ছিল। তারা ঘন ঘন প্রকাশ্য জনসভা ও আলোচনাচক্রে ভারতীয় বিধবাদের দুরবস্থার কথা বর্ণনা করে চাঁদা তুলত ভারতে পাঠাবার জন্য। চাঁদা তুলতে গেলে নানারকমের মর্মন্তুদ কাহিনীর অবতারণা করতে হত। সেইসব কাহিনীর মধ্যে অনেক রগরগে গল্পও এসে পড়ত। সেগুলো শুনতে শুনতে উপস্থিত জনসাধারণ শিউরে উঠত। তাঁরা মনে করত, ভারত এমনই এক বর্বরদের দেশ, যেখানে লক্ষ লক্ষ বাল্যবিধবা পুরুষদের পায়ের তলায় নিষ্পেষিত হয়।
বিবেকানন্দর বক্তৃতার আসরে কিছু লোক কুমিরের মুখে শিশু বিসর্জন, সতীদাহ, ইত্যাদি বিষয়ের সঙ্গে সঙ্গে বিধবাদের প্রতি অত্যাচারের প্রসঙ্গও তুলত। এগুলো তো মিথ্যে হতে পারে না, বিবেকানন্দর স্বদেশবাসীরাই তো এইসব কথা বলেছে, শুধু রমা বাঈয়ের দল নয়, ব্রাহ্মরাও এগুলো বলে।
বিদেশে এসে স্বদেশের নানা দূর্বলতার কথাই শুধু তুলে ধরা স্বামীজীর ছিল ঘোর অপছন্দের। নিজের দেশের কিছু কিছু কুৎসিত রীতিনীতির কথা স্বীকার করতে তাঁর লজ্জা ছিল না, কিন্তু সেই সঙ্গে তাঁর প্রশ্ন ছিল, পাশ্চাত্য দেশগুলিতেও তো কত খারাপ প্রথা আছে, তাও বলা হবে না কেন? যিশুর নামে করুণার বাণী যারা প্রচার করে, সেই খ্রিস্টানরা বর্বর শক্তি দিয়ে এক একটা দেশকে পদানত করেনি? ধর্মের নামে বারবার রক্ত গঙ্গা বইয়ে দেয়নি? এই খ্রিস্টানরাই বিজ্ঞানের অগ্রগতিতে বাধা দেয়নি? গ্যালিলিও-কে বন্দি করেছিল কারা? এরাই ভারতে মদ আর চিনে আফিং-এর প্রচলন করায়নি ব্যবসার স্বার্থে?
আমেরিকানরা ধনমদে মত্ত হয়ে চূড়ান্ত নীতিহীনতার পরিচয় দেয়, তাঁরাই আবার অন্য দেশের ধর্মান্ধতা ও কুসংস্কারের নিন্দা করে কোন মুখে! বিবেকানন্দ এক এক সময় তীব্র ভাষায় বলে উঠতেন, ‘হ্যাঁ, আমাদের দেশে ধর্মান্ধতা আছে, কুসংস্কার আছে। আমরা যখন ধর্মান্ধ হই, আমরা জগন্নাথদেবের বিরাট রথের চাকার সামনে লাফিয়ে পড়ে নিজেরাই নিষ্পেষিত হই, নিজেদের গলায় ছুরি দিই কিংবা কণ্টকশয্যায় শুই। আর তোমরা যখন ধর্মান্ধ হও, তখন তোমরা অপরের গলায় ছুরি চালাও, অন্যদের আগুনে পোড়াও, তাদের জন্য কণ্টকশয্যা তৈরি করো। নিজেদের চামড়া তোমরা সাবধানে বাঁচিয়ে চলো।’
বিধবাদের প্রসঙ্গেও বিবেকানন্দ বলতেন, ‘হ্যাঁ, বহুকাল ধরে ভারতের বিধবাদের ওপর অত্যাচার করা হয়েছে, তা মিথ্যে নয়। কিন্তু তা বলে অতিরঞ্জন আমি সহ্য করব না। অবস্থা কি কিছু পাল্টায়নি? আইন অনুযায়ী বিধবাদের ব্যক্তিগত সম্পত্তি থাকতে কোনও বাধা নেই। অন্য উত্তরাধিকারী না থাকলে স্বামীর সম্পত্তিতেও তাঁদের জীবনস্বত্ব থাকে। সমাজের উঁচু শ্রেণীতে বিধবাদের বিয়ে হয় না, কারণ সেখানে পুরুষদের সংখ্যা বেশি, পুরুষের ক্ষমতাও বেশি, কিন্তু নিম্নস্তরে বিধবাদের আকছার বিয়ে হয়। এখন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের চেষ্টায় বিধবা বিবাহ কি সারাদেশেই আইনসম্মত হয়নি? উঁচু-নিচু যে-কোনও স্তরের বিধবাদেরই আবার বিয়ে হতে পারে। বিধবাদের অবস্থা বর্ণনা করার সময় এসব কথাই বা বলা হবে না কেন?’
এরপরেই রমা বাঈ চক্রের সঙ্গে স্বামীজীর ঘোর বিরোধ শুরু হয়ে গেল।
বিধবাদের অবস্থা যদি অতটা ভয়াবহ ও বীভৎস মনে না হয়, তা হলেই চাঁদা কম ওঠে। সুতরাং ওই বিবেকানন্দ নামে উটকো লোকটা, ভারতে যার নাম কেউ কোনওদিন শোনেনি, তাঁর মুখ বন্ধ করা দবকাব।
স্বামীজীর বিরুদ্ধে অপপ্রচার বাড়তে বাড়তে চূড়ান্ত জায়গায় পৌঁছল। এমনও বলা হল যে ওই লোকটা একটা বোহেমিয়ান, আত্মসংযম বলতে ওর কিছু নেই। শ্রীমতী ব্যাগলি শিকাগোর এক বিশিষ্ট পরিবারের মহিলা, তিনি বিবেকানন্দকে কিছুদিন আশ্রয় দিয়েছিলেন। বিবেকানন্দ এমনই দুশ্চরিত্র যে ও-বাড়ির একটি যুবতী চাকরানি তাঁর অত্যাচারে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়।
শ্রীমতী বাগলি অবশ্য এই অভিযোগ শুনে আকাশ থেকে পড়েছিলেন। একাধিক চিঠিতে তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছিলেন যে ওই অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যে তো বটেই, বিবেকানন্দের মতন এমন উন্নত চবিত্রের মানুষ আর তিনি দেখেননি। তাঁর দাস-দাসীরা কেউ কোনওদিন তাঁদের ছেড়ে যায়নি, অভিযোগকারীরা যে তরুণীর নাম করেছে, ওই নামে কাউকে তিনি চেনেন না, ওরকম কোনও দাসী ও তাঁর বাড়িতে কখনও কাজ করেনি।
অর্থই যত অনর্থের মূল। মিশনারিরাও বিবেকানন্দের ওপর খড়্গহস্ত হয়েছিল, তার কারণ তাদেরও চাঁদা কমে যাচ্ছিল হু হু করে। বিবেকানন্দর বক্তৃতা শুনে অনেকেরই ধারণা হচ্ছিল যে, যে-দেশে এমন উচ্চ ধর্মীয় ভাব আছে, সে দেশের মানুষকে ধর্মান্তরিত করার জন্য মিশনারি পাঠাবার কী দবকার? চাঁদার পরিমাণ এক বৎসরে কমে গিয়েছিল প্রায় দেড় কোটি টাকা। খ্রিস্টান মিশনাবিদের আয় কমে যাচ্ছে, আর বিবেকানন্দ ঘুরে ঘুরে বক্তৃতা দিয়ে প্রচুর ডলার পকেটস্থ করছে! লোকটাকে প্রাণে মারলেও যেন গায়ের ঝাল মেটে না। একজন সন্ন্যাসীকে বাতিল করার শ্রেষ্ঠ উপায় তাঁর চরিত্রহনন। পাদ্রিরা বিভিন্ন পরিবারে বেনামি চিঠি পাঠাতে লাগল, খবরদার ওই দুশ্চরিত্র লোকটাকে তোমাদের বাড়িতে স্থান দিয়ো না।
অন্যরা যখন ভাবছিল বিবেকানন্দ বক্তৃতা দিয়ে অনেক টাকা উপার্জন করছেন, কিন্তু তিনি নিজে যে এ কাজ আর একেবারেই পছন্দ করছিলেন না, তা কেউ জানত না। তখন সার্কাসের ক্লাউনের মতন ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানটি তাঁকে বিভিন্ন জায়গায় ঘোরাচ্ছিল। বক্তৃতার পর বক্তৃতা দিতে গিয়ে যেন মুখে রক্ত উঠে আসছিল তাঁর। আবার একটা নতুন শহরে গিয়ে বক্তৃতা দিতে হবে ভাবলেই বিভীষিকা জাগত তাঁর মনে। রাত্রে ভাল ঘুম হত না। তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় তিনি পরবর্তী বক্তৃতার বিষয় আওড়াতেন। তাঁর মাথায় তখন একটাই প্রশ্ন ঘুরত, এই চুক্তির হাত থেকে রেহাই পাবার কি কোনও উপায় নেই?
বক্তৃতা দেবার সময় শুধু যে উদ্ভট প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হত, তাই-ই নয়, অন্য রকম বিপদও ঘটত। একবার পশ্চিমের একটি শহরের বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতার সময় বিবেকানন্দ বলেছিলেন, ‘প্রকৃত সত্যের উপলব্ধি যার হয়, তিনি পারিপার্শ্বিকের প্রভাব থেকে মুক্তি লাভ করেন, বাইরের কিছুতেই তিনি বিচলিত হন না।’ ছাত্রদের মধ্যে ছিল কিছু কাউ বয় গোত্রীয় ছাত্র। তাঁরা ওই কথা শুনতে শুনতে বলল, বটে! তাই নাকি?
পরীক্ষা করার জন্য তাঁরা স্বামীজীর বক্তৃতা চলাকালীনই মঞ্চে উঠে এল। তারপরে কোথা থেকে একটা মস্ত বড় কাঠের টব জোগাড় করে এনে সেটা উল্টে দিয়ে বলল, ‘মশাই, এটার ওপর দাঁড়িয়ে আপনার ওই সব বড় বড় ভাবের কথা শোনাতে পাববেন?’
স্বামীজী দেখলেন আপত্তি করে লাভ নেই। মোঘলের হাতে পড়লে যেমন এক সঙ্গে বসে খানা খেতেই হয়, সেই রকমই কোমরবন্ধে পিস্তল ঝোলানো কাউবয়দের কথা অগ্রাহ্য করা চলে না। টবের ওপর উঠে তিনি টের পেলেন যে সেটা নড়ছে। এই অবস্থায় মনঃসংযোগ করে কথা বলা যায় না। বিবেকানন্দ বুঝেছিলেন যে এই দুর্দান্ত প্রকৃতির ছেলেগুলি তাঁকে আরও কিছু বিপদে ফেলার চেষ্টা করবে। বক্তৃতা শোনার জন্য এরা পয়সা দিয়েছে, তা উশুল না করে ছাড়বে না।
তিনি দু পা ফাঁক করে দাঁড়িয়ে শুরু করলেন ভাষণ।
হঠাৎ দুম করে একটা শব্দ হল, তাঁর কানের পাশ দিয়ে একটি পিস্তলের গুলি বেরিয়ে গেল। বিবেকানন্দ বিচলিত হবার কোনও লক্ষণ দেখালেন না। এরা যদি তাঁকে মেরে ফেলতে চাইত, তা হলে একটি গুলিই যথেষ্ট ছিল, কারণ কাউবয়দের হাতের টিপ অব্যর্থ হয়। স্বামীজী জানতেন ভয় দেখানোই এদের উদ্দেশ্য, আর ভয় পাওয়া মানেই পরাজয়।
ঠিক এর কিছুদিন আগে রবার্ট ইঙ্গারসোল নামে এক প্রসিদ্ধ বক্তার সঙ্গে বিবেকানন্দের আলাপ হয়েছিল। ইঙ্গারশোল ছিলেন প্রচণ্ড নাস্তিক এবং মানুষের মন থেকে ধর্মের নামে নানাবিধ সংস্কার দূর করাই ছিল তাঁর জীবনের ব্রত। তাঁর এই ধরনের বক্তব্য প্রচার করতে গিয়ে বহুবার তাঁকে বিপদের সম্মুখীন হতে হয়েছিল। কিন্তু তিনি ছিলেন আমেরিকান, সেদেশের বুকে দাঁড়িয়ে তিনি মানুষের চিন্তার স্বাধীনতা ও মতামত প্রকাশের দাবি করতে পারতেন সদর্পে। বিদেশি হয়ে বিবেকানন্দ কখনও আমেরিকানদের জীবনযাত্রা পদ্ধতির সমালোচনা করেন শুনে তিনি চিন্তিত হয়ে বলেছিলেন, ‘স্বামীজি, আপনি একটু সাবধানে থাকবেন। পঞ্চাশ বছর আগে হলে আপনাকে এরা ফাঁসিকাঠে ঝুলিয়ে দিত কিংবা পুড়িয়ে মারত। এখনও অনেক জায়গায় লিঞ্চিং হয়। অশ্বেতকায়দের দক্ষিণাঞ্চলে পাথর ছুঁড়ে মারে যখন তখন।’
বিবেকানন্দ হেসে বলেছিলেন, ‘আমি আপনার মতন ধর্মদ্বেষী নই। যিশুখ্রিস্টকেও আমি বিশেষ শ্রদ্ধা করি। আমাকে এরা মারবে কেন?’
সেদিন গুলি চলার পরেও স্বামীজীর মুখের একটি রেখাও কুঞ্চিত হয় নি। বিবেকানন্দ সেই বেপরোয়া কাউবয়দের সমাবেশে ভাষণ চালিয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর বক্তব্যকে তিনি সাধারণ পর্যায়ে নামিয়ে আনেন নি, তিনি বলেছিলেন উচ্চ মার্গের জীবনদর্শনের কথা। তাঁরা কেউ বুঝুক বা না বুঝুক, তিনি কিন্তু বিচ্যুত হন নি তাঁর কেন্দ্র থেকে।
তারপরে আরও কয়েকবার বিকট শব্দে গুলি ছুটে গিয়েছিল তাঁর মাথার দুপাশ দিয়ে। শেষের দিকে তিনি যেন সে শব্দ আর শুনতেই পেলেন না, গুরুর নাম স্মরণ করে একাগ্র হয়ে ছিলেন তিনি।
বক্তৃতা শেষ হবার পর সেই যুবকরা পিস্তল খাপে গুঁজে ছুটে এসেছিল এই হিন্দু স্বামীজির সঙ্গে করমর্দন করার জন্য। প্রকৃত সাহসীর সম্মান তাঁরা দিতে জানত।
তাঁদের সঙ্গে হাত মেলাতে মেলাতে বিবেকানন্দ মৃদু হাস্য করেছিলেন। আর নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করেছিলেন, ‘আর কত পরীক্ষা দিতে হবে?’
(তথ্যসূত্র:
১- বিবেকানন্দ চরিত, সত্যেন্দ্রনাথ মজুমদার, আনন্দ পাবলিশার্স (২০১৫)।
২- অচেনা অজানা বিবেকানন্দ, শংকর, পোদ্দার বুকস্ ইন্টারন্যাশনাল।
৩- The mind of Swami Vivekananda, Gautam Sen, Jaico Publishing House (২০১৭)।
৪- অবিশ্বাস্য বিবেকানন্দ, শংকর, সাহিত্যম (২০১৭)।
৫- স্বামী বিবেকানন্দ: নতুন তথ্য নতুন আলো, শঙ্করীপ্রসাদ বসু, আনন্দ পাবলিশার্স (২০১৪)।
৬- স্বামী বিবেকানন্দ: এক অনন্ত জীবনের জীবনী, সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়, দে’জ পাবলিশিং।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত