নবপত্রিকা বাংলার দুর্গাপূজার একটি বিশিষ্ট অঙ্গ। দুর্গা পূজার সময় যদি আমরা মণ্ডপে গিয়ে শ্রী গণেশ কে দেখি, ত দেখতে পাই তাঁর পার্শ্বে লাল পেড়ে শাড়িতে ঘোমটা তে ঢাকা একটি কলা বৃক্ষ দেখি। অনেকে এটি কে ‘কলা বৌ’ ও ‘শ্রী গণেশের স্ত্রী’ হিসাবে বলে থাকেন। কিন্তু আদৌ এটি ‘শ্রী গণেশের বৌ’ নয়। এটিকে ‘নবপত্রিকা’ বলা হয়। এটি মা দুর্গা। অর্থাৎ গণেশের জননী। শাস্ত্রমতে গণেশের দুই স্ত্রী এবং তাঁদের নাম নাম ‘রিদ্ধি’ ও ‘সিদ্ধি’।
নবপত্রিকা শব্দটির আক্ষরিক অর্থ নয়টি গাছের পাতা। তবে বাস্তবে নবপত্রিকা নয়টি পাতা নয়, নয়টি উদ্ভিদ।
“রম্ভা কচ্চী হরিদ্রাচ জয়ন্তী বিল্ব দাড়িমৌ।
অশোক মানকশ্চৈব ধান্যঞ্চ নবপত্রিকা।।”
অর্থাৎ: কদলী বা রম্ভা (কলা), কচু, হরিদ্রা (হলুদ), জয়ন্তী, বিল্ব (বেল), দাড়িম্ব (ডালিম), অশোক, মানকচু ও ধান।
একটি সপত্র কলাগাছের সঙ্গে অপর আটটি সমূল সপত্র উদ্ভিদ একত্র করে একজোড়া বেল সহ শ্বেত অপরাজিতা লতা দিয়ে বেঁধে লালপাড় সাদা শাড়ি জড়িয়ে ঘোমটা দেওয়া বধূর আকার দেওয়া হয়। তারপর সিঁদুর দিয়ে সপরিবার দেবীপ্রতিমার ডান দিকে দাঁড় করিয়ে পূজা করা হয়। প্রচলিত ভাষায় নবপত্রিকার নাম কলাবউ।
নবপত্রিকার নয়টি উদ্ভিদ আসলে দেবী দুর্গার নয়টি বিশেষ রূপের প্রতীকরূপে কল্পিত হয়,
১) কদলী বা রম্ভা: কদলি গাছ এর অধিষ্টাত্রী দেবী ব্রহ্মাণী;
২) কচু: কচু গাছের অধিষ্টাত্রী দেবী কালিকা;
৩) হরিদ্রা: হরিদ্রা গাছের অধিষ্টাত্রী দেবী উমা;
৪) জয়ন্তী: জয়ন্তী গাছের অধিষ্টাত্রী দেবী কার্তিকী;
৫) বিল্ব: বিল্ব গাছের অধিষ্টাত্রী দেবী শিবা;
৬) দাড়িম্ব: দাড়িম্ব গাছের অধিষ্টাত্রী দেবী রক্তদন্তিকা;
৭) অশোক: অশোক গাছের অধিষ্টাত্রী দেবী শোকরহিতা;
৮) মান: মান গাছের অধিষ্টাত্রী দেবী চামুণ্ডা;
৯) ধান: ধান গাছের অধিষ্টাত্রী দেবী লক্ষ্মী।
একটি সপত্র কলাগাছের সাথে অপর আটটি সপত্র উদ্ভিদ একত্র করে দুটি বেলের সাথে সাদা অপরাজিতা লতা দিয়ে বেঁধে লাল পাড় সাদা শাড়ি পড়িয়ে ঘোমটা দিয়ে বধূর আকার দেওয়া হয়। তারপর তাতে সিঁদুর দিয়ে দুর্গা দেবীর ডান পাশে রাখা হয়। এটি গণেশের ডান পাশে দেখা যায়।
এই নয় দেবী একত্রে “নবপত্রিকাবাসিনী নবদুর্গা” নামে ‘নবপত্রিকাবাসিন্যৈ নবদুর্গায়ৈ নমঃ’ মন্ত্রে পূজিতা হন।
“ রম্ভাধিষ্ঠাত্রী ব্রহ্মাণী, কচ্বাধিষ্ঠাত্রী কালিকা, হরিদ্রাধিষ্ঠাত্রী উমা, জয়ন্ত্যাধিষ্ঠাত্রী কার্তিকী, বিল্বাধিষ্ঠাত্রী শিবা,
দাড়িম্বাধিষ্ঠাত্রী রক্তদন্তিকা, অশোকাধিষ্ঠাত্রী শোকরহিতা, মানাধিষ্ঠাত্রী চামুণ্ডা ও ধান্যাধিষ্ঠাত্রী লক্ষ্মী”
মহাসপ্তমীর দিন সকালে নিকটস্থ নদী বা কোনো জলাশয়ে (নদী বা জলাশয়ে না থাকলে কোনো মন্দিরে) নিয়ে যাওয়া হয়। পুরোহিত নিজেই কাঁধে করে নবপত্রিকা নিয়ে যান। তাঁর পিছন পিছন ঢাকীরা ঢাক বাজাতে বাজাতে এবং মহিলারা শঙ্খ ও উলুধ্বনি করতে করতে যান। শাস্ত্রবিধি অনুযায়ী স্নান করানোর পর নবপত্রিকাকে নতুন শাড়ি পরানো হয়। তারপর পূজামণ্ডপে নিয়ে এসে নবপত্রিকাকে দেবীর ডান দিকে একটি কাষ্ঠসিংহাসনে স্থাপন করা হয়। পূজামণ্ডপে নবপত্রিকা প্রবেশের মাধ্যমে দুর্গাপূজার মূল অনুষ্ঠানটির প্রথাগত সূচনা হয়। নবপত্রিকা প্রবেশের পর দর্পণে দেবীকে মহাস্নান করানো হয়। এরপর বাকি দিনগুলিতে নবপত্রিকা প্রতিমাস্থ দেবদেবীদের সঙ্গেই পূজিত হতে থাকে। বিশেষভাবে লক্ষণীয় হল, নবপত্রিকা প্রবেশের পূর্বে পত্রিকার সম্মুখে দেবী চামুণ্ডার আবাহন ও পূজা করা হয়। পত্রিকাস্থ অপর কোনো দেবীকে পৃথকভাবে পূজা করা হয় না।
নবপত্রিকা কি ভাবে দুর্গা পূজার সাথে মিশে গেলো – তা নিয়ে পণ্ডিত গনের নানা মত।
গবেষকদের মতে, নবপত্রিকার পূজা প্রকৃতপক্ষে শস্যদেবীর পূজা। ডঃ শশিভূষণ দাশগুপ্ত লিখেছেন,
“এই শস্যবধূকেই দেবীর প্রতীক গ্রহণ করিয়া প্রথমে পূজা করিতে হয়, তাহার কারণ শারদীয়া পূজা মূলে বোধহয় এই শস্য-দেবীরই পূজা। পরবর্তীকালের বিভিন্ন দুর্গাপূজার বিধিতে এই নবপত্রিকার বিভিন্ন ব্যাখ্যা দেওয়া হইয়াছে। … বলাবাহুল্য এই সবই হইল পৌরাণিক দুর্গাদেবীর সহিত এই শস্যদেবীকে সর্বাংশে মিলাইয়া লইবার একটা সচেতন চেষ্টা। এই শস্য-দেবী মাতা পৃথিবীরই রূপভেদ, সুতরাং আমাদের জ্ঞাতে-অজ্ঞাতে আমাদের দুর্গাপূজার ভিতরে এখনও সেই আদিমাতা পৃথিবীর পূজা অনেকখানি মিশিয়া আছে।”
ডঃ জিতেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে,
“Another important aspect of the Devi is her concept as the personification of vegetation spirit, which is emphasised by her name Sākambhari already noted. This finds clear corroboration in the present day Navapatrikāpraveśa ceremony in autumnal worship of Durgā in Bengal.”
তবে হংসনারায়ণ ভট্টাচার্য দুর্গাপূজার সঙ্গে শস্যদেবীর পূজার অনুষঙ্গটি স্বীকার করলেও, শাকম্ভরী তত্ত্বটিকে নবপত্রিকার উৎসরূপে মানেননি। যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি লিখেছেন,
“আমি নবপত্রিকার উৎপত্তি ও প্রয়োজন বিন্দুমাত্র বুঝিতে পারি নাই। নবপত্রিকা নবদুর্গা, ইহার দ্বারাও কিছুই বুঝিলাম না। দেবীপুরাণে নবদুর্গা আছে, কিন্তু নবপত্রিকা নাই।… নবপত্রিকা দুর্গাপূজার এক আগন্তুক অঙ্গ হইয়াছে।… বোধ হয় কোনও প্রদেশে শবরাদি জাতি নয়টি গাছের পাতা সম্মুখে রাখিয়া নবরাত্রি উৎসব করিত। তাহাদের নবপত্রী দুর্গা-প্রতিমার পার্শ্বে স্থাপিত হইতেছে।”
উল্লেখ্য, মার্কণ্ডেয় পুরাণে নবপত্রিকার উল্লেখ নেই। কালিকাপুরাণে নবপত্রিকার উল্লেখ না থাকলেও, সপ্তমী তিথিতে পত্রিকাপূজার নির্দেশ রয়েছে। ওদিকে দেবী ভাগবতে নব দুর্গার উল্লেখ থাকলেও নবপত্রিকার উল্লেখ নেই।
কৃত্তিবাস ওঝা বিরচিত রামায়ণে রামচন্দ্র কর্তৃক নবপত্রিকা পূজার উল্লেখ রয়েছে,
“বাঁধিলা পত্রিকা নব বৃক্ষের বিলাস।”
গবেষকরা অনুমান করেন যে, সম্ভবত শবর জাতি গণ কোন এক সময় নয়টি গাছ দিয়ে নব দুর্গার পূজা করতেন। সেই থেকে এই রীতি হয়তো দুর্গা পূজোতে প্রবেশ করেছে। আবার শস্য দেবীকে দুর্গা দেবীর সাথে মিশিয়ে দেবার জন্য এই রীতির আয়োজন।
(তথ্যসূত্র:
১- মহিষাসুরমর্দিনী দুর্গা, দেব সাহিত্য কুটীর।
২- দুর্গা রূপে রূপান্তরে, পূর্বা সেনগুপ্ত, মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স প্রাঃ লিঃ।
৩- দুর্গা দেবীর তথ্য প্রশ্ন ও মন্ত্র সাধারণ জ্ঞান, প্রেমেন্দ কুমার সাহা, অর্পিতা প্রকাশনী (২০১৬)।
৪- দুর্গা পূজা পদ্ধতি, নন্দী কেশ্বর পুরাণোক্ত, বুক চয়েস।
৫- কালিকাপুরাণোক্ত: শ্রী শ্রী দুর্গাপূজা পদ্ধতি, প্রবীরকুমার চট্টোপাধ্যায়, পারুল প্রকাশনী প্রাইভেট লিমিটেড।
৬- উইকিপিডিয়া।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত