আমরা ৯০’এর প্রজন্মের ছেলেমেয়ে। আমাদের সময় একটাকায় পাওয়া যেত পেপসি আর টিকটিকির ডিম পাওয়া যেত লজেন্স হিসেবে৷ আমাদের সবার হাতে বন্দুক থাকতো ক্যাপের আর সূর্য গ্রহণ দেখার থাকতো নেগেটিভ চশমা।
আমাদের সময় দেশাত্মবোধ আর সাম্প্রদায়িকতার সহজ
দিক্ষা দিয়েছিল রোজা আর বম্বে বলে দুটো ছবি। কাশ্মীরে কি হচ্ছে, কারা ভালো একজন ইঞ্জিনিয়ারকে অপহরণ করে নিয়ে যাচ্ছে দুষ্টু সন্ত্রাসীদের ছাড়িয়ে নিয়ে যেতে ড্যাব ড্যাব করে দেখতাম। মনে পরে রোজা ছবির ওই মন্দিরে নারকেল ফাটানোর দৃশ্যটা? এক শব্দেই চারপাশ থেকে সেনাবাহিনীর জাওয়ানেরা ঘিরে ধরেছিল বোম ফেটেছে ভেবে?
দেখতাম কিভাবে বদমাইস সন্ত্রাসীরা আমাদের দেশের পতাকায় আগুন জ্বালিয়ে দিচ্ছে আর নায়ক জান প্রাণ দিয়ে ওটা নেভাচ্ছে। সারা শরীর পুড়ে যাওয়ার ভয় থাকলে ও শিখেছিলাম দেশের পতাকা আগে। ওটা না থাকলে আমাদের ভারতীয় হওয়া হয়না। ওটাকে বাঁচাতে হবে। ওই সময়ই তো সেই অমোঘ গান, ভারত হম কো জান সে প্যারা হে, সব সে ন্যারা গুলিস্তান হামারা হে। খুব রাগ হতো যখন ‘আজাদি’ নামে ছোট ছোট ছেলেদের হাতে বন্দুক তুলে দিত বদমাশ গুলো আর আমাদের নায়ককে বন্দুকের বাঁট দিয়ে মারতো। খুব খারাপ লাগতো রোজার জন্য যখন দেখতাম নেতা-মন্ত্রী-সেনা-পুলিশের দরজায় দরজায় ভিক্ষা চাইছে কিন্তু দেশ আগে। হুট করে আবেগে পরে এসব সিদ্ধান্ত রাষ্ট্র নিতে পারে না। হ্যাঁ, রোজা সিনেমাটা শিখিয়েছিল।
রোজা সিনেমাতেই তো রক্ত- মাংসের সেনাবাহিনীকে দেখেছিলাম। যাদের খারাপ লাগছে রোজার জন্য কিন্তু কিচ্ছু করার নেই। একজন সন্ত্রাসী নেতাকে এভাবে ছেড়ে দিলে বারবার ছাড়তে হবে। ‘রোজা’ আমাকে জাতীয়তাবাদের পাঠ পড়িয়েছিল।
‘বম্বে’ ও তো আমাদের প্রজন্মকে শিখিয়েছিল সাম্প্রদায়িকতা কি ভয়ানক বিষ। কিভাবে পরিবারে-পরিবারে, পাড়ায়-পাড়ায় আগুন লাগাতে পারে ধর্ম ব্যাপারীরা।
আমরা যারা দাঙ্গা দেখিনি তখনো তাদের দাঙ্গা কি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছিল। দেখিয়েছিল হিন্দু বা মুসলিম না আসল পরিচয় মানুষ হিসেবে বাঁচা। বুঝিয়েছিল যে ভালোবাসাতে ধর্ম আসেনা। পারস্পারিক শ্রদ্ধা আসে। তখনো আমরা লাভ জিহাদ কি জানিনা। তখনো আমাদের ঘৃণা করতে শেখানো হয়নি রোজ। বম্বে আমাদের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি কাকে বলে শিখিয়েছিল ওই বয়সে৷
‘রোজা’ আর ‘বম্বে’ প্রত্যেক স্বাধীনতা আর প্রজাতন্ত্র দিবসে দেখানো হতো। বছরের পর বছর দেখানো হতো। আমরা দুপুরে খেয়েটেয়ে ঠিক টিভির সামনে এসে বসতাম দেশাত্মবোধের রোদ পোয়াতে৷ তখন ফেসবুক টুইটার নেই। রাগী হনুমান ও নেই।
‘রোজা’ আর ‘বম্বে’ যে মানুষটা বানিয়েছিল তার নাম মনিরত্নম। প্রবাদপ্রতিম পরিচালক। সাতে পাঁচে খুব একটা থাকেনা। সিনেমা বানানো ছাড়া ও আর একটা কারণে ইতিহাসের পাতায় নাম থাকবে। মনিরত্নমই সেই মানুষটা যে এ.আর. রহমানকে সিনেমার জগতে এনেছে। রহমানের সেরা গানগুলো কিন্তু মনিরত্নমের ছবিরই।
সেই মনিরত্নমের নামে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা দায়ের হয়েছে। ভারতজুড়ে ক্রমবর্ধমান গণপিটুনির ঘটনা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে খোলা চিঠি দিয়েছিলেন মনি সহ ৪৭ বিশিষ্টজন। ওই পারমাণবিক বোমার সমান চিঠির জেরে একটি এফআইআর দায়ের করা হয়েছে বিহারের মুজফ্ফরপুরে। অভিযোগ এরা ভারতের ভাবমূর্তি নষ্ট করেছে, বিচ্ছিন্নতাবাদকে আস্কারা দিয়েছে, কায়েমি স্বার্থে প্রধানমন্ত্রীকে অপমান করেছে। এ সবই দেশদ্রোহিতার সমান।
এই অসহিষ্ণুদের উপত্যকা আমার দেশ না যেখানে মনিরত্নমকে দেশদ্রোহী বলা হয়। যে আমাদের সিনেমার মাধ্যমে দেশকে ভালোবাসতে শেখালো তাকেই দেশ দেশদ্রোহী তকমা দিলো।
অবশ্য ‘রোজা’তে সন্ত্রাসীর মানবিক মুখ ও দেখানো হয়েছিল। ‘হাউস দা জোশ’ না বলে ও যে প্রবলভাবে দেশপ্রেমিক হওয়া যায় তা দেখানো হয়েছিল। বম্বেতে হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে মানুষ মারে দেখানো হয়েছিল৷ মুসলিমদের জ্যন্ত পুড়িয়ে মারা যায় দেখানো হয়েছিল। ওসব আজকের দিনে বানালে জেলে যেতে হতো। একে অপরের চোখ খুবলে নেওয়ার, সংখ্যালঘুকে পিটিয়ে মেরে বীরত্ব দেখানোর মাদারি কা খেল চলছে। ভারত হম কো জান সে প্যারা হে গান শান্ত হয়ে শোনার সময় কই?
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত