আর কয়েক দিন পরেই মহালয়া। বাঙালির রক্তের মধ্যে যদি কোনও সুর মিশে গিয়ে থাকে, সে সুর মহালয়ার। অন্য সময় রেডিওর সঙ্গে কোনওরকম সম্পর্ক না থাকলেও বছরের একটি বিশেষ দিনে ভোরবেলা আজও বাঙালি বাড়ি থেকে ভেসে আসে মহিষাসুরমর্দিনীর চেনা সুর। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র-বাণীকুমারের যে ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ বাঙালির ঘরে ঘরে মহালয়ার সঙ্গে সমার্থক হয়ে গিয়েছিল তার সঙ্গে স্রষ্টা হিসেবে প্রধানত তিন জনের নাম জড়িয়ে আছে। বাণীকুমার, পঙ্কজকুমার মল্লিক আর বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র কে আমরা মনে রাখলেও প্রায় ভুলেই গিয়েছি অপর নক্ষত্র শ্রী পঙ্কজকুমার মল্লিক কে। অথচ আকাশবাণী তে তাঁর অবদানও কম নয়। তাঁর অবিস্মরণীয় অবদান রয়েছে ভারতীয় সংগীত ও চলচ্চিত্র জগতে। ভারতীয় চলচ্চিত্রে প্ল্যে-ব্যাক শুরু হয় তাঁর হাত ধরেই।
একবার কে.এল. সাইগলকে কষে এক চড় মেরে বসলেন পঙ্কজ মল্লিক! তখন স্টুডিয়ো ভর্তি লোক। সবাই স্তম্ভিত। মুহূর্তে থম-মারা নীরবতা। প্রত্যেকে ধরে নিলেন, অপমানিত কুন্দন লাল সাইগলের স্টুডিয়ো ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়াটা এ বার শুধু সময়ের অপেক্ষা।
কিন্তু পরের কয়েক মুহূর্তে এ কী দেখলেন তাঁরা!
নিউ থিয়েটার্সের প্রযোজনায় ‘মাই সিস্টার’ ছবির কাজ চলছে। ‘অ্যা-এ কাতিবে তাখদির মুঝে ইতনা বাতা দে’ গানটির রেকর্ড করতে গিয়ে কিছুতেই সুর লাগাতে পারছেন না সায়গল। কথাও ভুলে যাচ্ছেন। সঙ্গীত পরিচালক পঙ্কজ মল্লিক সমেত ঘরসুদ্ধ সকলেই তত ক্ষণে বুঝে গেছেন চূড়ান্ত মদ্যপানের জেরেই সায়গলের এই বিপত্তি। ওঁর তখন বদ্ধমূল ধারণা, মদ না খেলে বুঝি গান গাইতে পারবেন না! সে দিনও তাই নেশায় চুড়।
পঙ্কজকুমার বহু ভাবে চেষ্টা করছিলেন। টুকরো টুকরো করে ভেঙে ভেঙেও রেকর্ড করতে চাইছিলেন। তাতেও সামাল দিতে না পেরে এক সময় মেজাজ হারালেন। সায়গলকে সজোরে চড় মেরে দিলেন। আর তাতেই সম্বিৎ ফিরল সায়গলের! অল্পক্ষণ থমকে ছিলেন। তার পরই বন্ধু পঙ্কজকে বুকে জড়িয়ে ধরে হাউ হাউ করে কান্না।
এর পরই ‘টেক’। এবং এক বারেই নির্ভুল রেকর্ডিং। সে-গান যে কতটা দরদ-ঢালা, গানপাগল কারওই আজ অজানা নয়।
এর আগের ঘটনাও কম চমকপ্রদ নয়।
গানের সুর করার সময় পঙ্কজকুমার প্রথমে ভেবেছিলেন নিজেই গাইবেন। পরে তাঁর সায়গলের কথা মনে হয়। প্রযোজক তো রাজি। কিন্তু সে-সময় সাইগলের যা নামডাক, তাঁকে নিতে বিস্তর খরচ। অত টাকা কী করে দেওয়া সম্ভব! নিউ থিয়েটার্সের আর্থিক অবস্থা তখন মোটেই ভাল নয়। উপরন্তু আজ বাদে কাল রেকর্ডিং। সায়গলের ব্যস্ত শিডিউলও তো কাজে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। অথচ বন্ধু পঙ্কজ মল্লিকের সঙ্গে তাঁর এতটাই হৃদ্যতা যে, সমস্ত কাজ বাতিল করে এক ডাকে প্রায় বিনা পারিশ্রমিকে গাইতে কলকাতায় চলে এসেছিলেন কুন্দন লাল সায়গল।
সাইগল-পঙ্কজকুমারের বন্ধুতায় ঘটনার অন্ত নেই। রেমিংটন কোম্পানির চাকুরে পঞ্জাবি যুবক কুন্দন লাল যখন অফিসে ছুটি নিয়ে শুধু গানের নেশায় কলকাতায় চলে আসেন, ওঁদের সম্পর্ক সেই তখন থেকেই।
সায়গল সোজা চলে গিয়েছিলেন রেডিয়ো স্টেশনে। ঘটনাচক্রে সেখানেই প্রথম আলাপ তাঁর পঙ্কজ মল্লিকের সঙ্গে। তখনও বাংলা জানতেন না সায়গল। হিন্দি-উর্দুতে গান গাইতে পারেন। প্রোগ্রাম ডিরেক্টর নৃপেন মজুমদারের নির্দেশে তাঁর অডিশন নেন পঙ্কজ মল্লিক। ওঁর গলা শুনে এতটাই অভিভূত হয়ে পড়েন তিনি যে পাশের ঘর থেকে তক্ষুনি ডেকে নেন নৃপেনবাবু আর রাইচাঁদ বড়ালকে। সে দিনই রেডিয়োর লাইভ-অনুষ্ঠানে মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয় সায়গলকে। আকাশবাণী-তে সায়গলের গানের সম্প্রচার সেই প্রথম বার। পঙ্কজ মল্লিকের সঙ্গে সম্পর্কেরও তখন শুরু।
এর পর তো সায়গলের জীবনের বহু সফল গানের সঙ্গে জড়িয়ে পঙ্কজ কুমার মল্লিক। এমনকী তাঁকে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাওয়ানোর পিছনেও ছিলেন তিনি।সায়গলকে প্রথম রবীন্দ্র-গান শেখান ‘প্রথম যুগের উদয় দিগঙ্গনে’। এর পর আরও। শুরুর দিকে গায়ক বাধ্য ছাত্রের মতো চোখ বুজে হুবহু নকল করে যেতেন তাঁর বন্ধু-শিক্ষককে।
সায়গল তখন এতটাই রবীন্দ্রসঙ্গীতে আচ্ছন্ন যে, এক-এক দিন পঙ্কজকুমারকে বাইকে বসিয়ে মধ্য কলকাতায় উড়ান দিতেন কবির গান গাইতে গাইতে।তাতে এক দিন এমনও হয়েছে, মাঝপথে বাইক থেকে মাটিতে লুটিয়ে পড়েছেন পিছনে বসা ‘শিক্ষক’। গানের নেশায় মগ্ন ‘ছাত্র’র হুঁশ হয়নি প্রথমে। টের পেয়েছেন বহু দূর গিয়ে।
‘জীবন মরণ’ ছবির সময় সায়গলকে দিয়ে দু’টি রবীন্দ্রসঙ্গীত গাওয়াবেন ঠিক করলেন।— ‘আমি তোমায় যত’ আর ‘তোমার বীণায় গান ছিল’। কবির অনুমতি আগেই নেওয়া ছিল। কিন্তু অবাঙালি সায়গলের গলায় দুটি গান এক বার অন্তত কবিকে না শুনিয়ে যেন স্বস্তি ছিল না ওঁর। কুন্দন লালের গান শুনে প্রাণ ভ’রে আশীর্বাদ করলেন রবীন্দ্রনাথ।
কবির শেষ জীবনে পঙ্কজের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক অসম্ভব নৈকট্যের। এক বার তাঁর গান শুনে রবিঠাকুর বলেন, ‘‘আমার বাকি লেখা যেগুলি রইল, যার আমি সুর করে উঠতে পারলুম না, তুমি তার সুর দিয়ো।’’
রবীন্দ্রনাথের গান গাইবার জন্যে ছটফট করতেন সায়গল। বলতেন, ‘‘তোমরা দেখো, উচ্চারণ ও এক্সপ্রেশনে আমি কোনও অবিচার করব না। তোমরা শুধু আমায় রবীন্দ্রনাথের গান গাইতে দিও।’’ ‘আমি তোমায় যত’ গানটি কয়েক বার টেক করতে হয়েছিল রেকর্ডিং-এর সময়। গানের মধ্যে থাকা ‘উঠবে যখন তারা সন্ধ্যাসাগর কূলে…’ অংশটি গাইতে গেলেই কেঁদে ফেলছিলেন সায়গল। অন্তরে এই ভাবে গেঁথে যাওয়া গান ‘জীবন মরণ’ ছবিতে তাঁর কণ্ঠে কোন অনুভূতির স্তরে পৌঁছেছিল, তার প্রমাণ আজও রয়েছে রেকর্ডে।
এর বেশ কিছু দিন আগে থেকেই পঙ্কজ মল্লিক সায়গলকে রবীন্দ্রসঙ্গীতের সঙ্গে পরিচিত করেছিলেন। তাই ছবিতে রবীন্দ্রনাথের গান গাইতে পেরে আত্মহারা হয়ে পড়েছিলেন কুন্দনলাল। কিন্তু, ‘আমি তোমায় যত….’ গান নিয়ে হঠাৎই একটা খটকা জাগল ‘জীবন মরণ’-এর পরিচালক নীতিন বসু ও সঙ্গীত পরিচালক পঙ্কজ মল্লিকের মনে। ছবিতে সায়গল এক বিরহের সিচুয়েশনে গানটি গাইবেন নায়িকা লীলা দেশাইয়ের উদ্দেশে। কিন্তু গানে এক জায়গায় আছে ‘সেই কথাটি কবি,/ পড়বে তোমার মনে…’ ‘কবি’ শব্দটি তো বেমানান হয়ে যাচ্ছে এ ক্ষেত্রে! অথচ রবীন্দ্র-বাণী পাল্টানোর কোনও প্রশ্নই নেই। সায়গল শুধু মনপ্রাণ দিয়ে গানটি যে গেয়েছেন তা-ই নয়, রেকর্ডিং হয়ে গিয়েছে, এমনকি ছবির কাজও শেষের পথে। নীতিনবাবু ও পঙ্কজবাবু, দুজনেরই মাথায় এল, যদি ‘কবি’-র জায়গায় ‘জানি’ বলা যায়, তা হলে সিচুয়েশন, চরিত্র, কাহিনি— সব কিছুর সঙ্গে খাপ খেয়ে যায়। কিন্তু রবীন্দ্র-শব্দ বদলাবে কার সাধ্য! অতঃপর গানের রেকর্ড নিয়ে পঙ্কজ মল্লিক গেলেন জোড়াসাঁকোতে। কবি তখন সেখানে। আর্জি শুনলেন। রেকর্ডও। সম্মত হলেন। রবীন্দ্রনাথ শুধু বললেন, ছবিতে ‘জানি’ বলা যেতে পারে, তবে রেকর্ডে যেন ‘কবি’ শব্দটিই থাকে। সেটাই আছে। ‘জীবন মরণ’ ছবিতে ও রেকর্ডে সায়গল-কণ্ঠে ধরা রয়েছে যথাক্রমে ‘সেই কথাটি জানি…’ আর ‘সেই কথাটি কবি…’।
ছবিটিতে সায়গলের গলায় আরও একটি রবীন্দ্রসঙ্গীত ছিল—‘তোমার বীণায় গান ছিল’। এই গানকে নিয়েও ঘটেছিল এক ঘটনা। সঠিক ভাবে গাওয়া হয়েছে কি না, জানার জন্যে এই গানটিও সে দিন রেকর্ডে রবীন্দ্রনাথকে শুনিয়েছিলেন পঙ্কজবাবু। এক বার শুনেই গানের দ্বিতীয় অন্তরাটি আরও কয়েক বার শুনতে চাইলেন কবি। এই অংশের প্রথম লাইনে আছে ‘গান তবু তো গেল ভেসে,/ ফুল ফুরালো দিনের শেষে…’। শুনে কবি বললেন, ‘‘ফুল ফুরালো দিনের শেষে, এ কেমন করে সম্ভব?’’ হতবাক পঙ্কজ মল্লিক তক্ষুনি গানের বই খুলে কবিকে দেখালেন, সেখানে ‘ফুল ফুরালো দিনের শেষে’ই ছাপা আছে।
এ বার যা হল, তা পঙ্কজ মল্লিকের বয়ানে এ রকম: ‘কবি তখন যেন একটু দূরের দিকে দৃষ্টি মেলে দিয়ে উদাস বিষণ্ণ সুরে বললেন— কী করে এটা হল জানি না, কিন্তু ওটা তো “সুর ফুরালো দিনের শেষে” হওয়াই উচিত ছিল।’ তখন ছবি ও রেকর্ডিং-এর কাজ শেষ হয়ে গেছে, কোনও কিছু পাল্টানোর আর কোনও উপায় নেই। এ গানের ক্ষেত্রেও রবীন্দ্রনাথও তাঁর অনুমোদন দিয়ে দিলেন। কিন্তু, পঙ্কজ মল্লিকের কথায়, ‘তবু ওই শব্দটি নিয়ে তাঁর বিষণ্ণতা রয়েই গেল।’ ‘জীবন মরণ’ ছবিতে ‘গান তবু তো গেল ভেসে/ ফুল ফুরালো দিনের শেষে’ গাইলেন সায়গল। আজও এটাই চলছে, গীতবিতান-স্বরবিতানেও তা-ই আছে।
এ কথা তো সত্যি, ‘গান তবু তো গেল ভেসে’-এর পরে ‘সুর ফুরালো দিনের শেষে’-ই যুক্তিপূর্ণ, যথাযথ। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ এ নিয়ে প্রশ্ন তুললেও, কেন তা অপরিবর্তিত থেকে গেল, তা সত্যিই রহস্যময়! পঙ্কজ মল্লিকের কাছেও সে দিন তা আশ্চর্য ঠেকেছিল, যা তিনি পরিষ্কার লিখেছেন তাঁর ‘আমার যুগ আমার গান’ বইয়ে,
‘আমার মনে একটা প্রশ্ন আজও থেকে গেছে। গীতবিতানে এখনো পর্যন্ত ওই “ফুল ফুরালো” কথাটি অপরিবর্তিতই থেকে গেছে। কবি কি তাহলে বিস্ময় প্রকাশ করার পরও এর পরিবর্তন করেন নি? পরে এই গানটি আমি স্বকণ্ঠেও রেকর্ড করেছি এবং গীতবিতানে যেমন ছাপা আছে তেমনই গেয়েছি। কবির সেদিনকার বিস্ময় ও বেদনার তাৎপর্য আমি আজও সম্যকভাবে বুঝে উঠতে পারিনি।’
কিন্তু একেবারে গোড়ার পর্বে?
শুধু গানের টিউশানি করে বড় পরিবারের খাঁই আর মিটছিল না। বন্ধু পশুপতির দোকানে দর্জির কাজ শুরু করলেন। রেলের অফিসে কেমিস্টও হলেন। শেষমেশ বাবার ইচ্ছেয় বড়বাজারে ‘তুলসীদাস কিষণদয়াল’-এ পাটের দালালির কাজ নিলেন পঙ্কজ কুমার!
অথচ এমনটা হওয়ার কথা ছিল না। বাবা মণিমোহন ছিলেন সে কালের নামকরা বিলেতি কোম্পানি বার্কমায়ার ব্রাদার্সের বড়বাবু। যথেষ্ট স্বচ্ছল তাঁর পরিবার। নিত্যদিন ব্রিটিশ কর্তার বিনা কারণে অপমান আর গঞ্জনা সইতে না পেরে এক সময় চাকরিটাই ছেড়ে দেন মণিমোহন। সাহেব মালিকের সঙ্গে বচসা করে চাকরি ছেড়েছেন, তাই পরাধীন ভারতে অন্যত্র ভাল কাজও পেলেন না। দিনে দিনে অবসাদে আক্রান্ত হলেন তিনি। শেষ জীবনে পুজোপাঠেই সময় কাটাতেন।
বাবা-মায়ের চতুর্থ সন্তান পঙ্কজ তখন সবে সতেরো। দাদা মনোজ কিছু দিন আগেই মারা গিয়েছেন কালাজ্বরে। আয় করার মতো সংসারে বড় আর কেউ নেই। স্নাতক হওয়ার আগেই তাই কলেজ ছাড়তে হল। তার পরেই সংসারের জোয়াল কাঁধে। অর্থাভাবে এক সময় মা মনমোহিনীর গয়নাও বেচতে হয়েছে।
সতেরো-আঠারোটা বাড়ি গান ফিরি করে বাড়ি ফিরেছেন কখনও মধ্য রাতে। ফিরে দেখতেন মা জেগে বসে আছেন না খেয়ে। সকলকে দিয়েথুয়ে অল্প একটু দুধ বাঁচিয়ে রেখেছেন ছেলের জন্য। ছেলের এ দিকে সারা দিন গান গেয়ে গলা চিরে গেছে। ওই দুধটুকু মুখে দিলেও মুখ দিয়ে রক্ত উঠত।
কালে কালে গানই হয়ে উঠল যাঁর জীবন, শৈশবে তাঁকে গান শিখতে কম চড়াই পেরোতে হয়নি। ছোট থেকেই পঙ্কজ গান-অন্ত প্রাণ। কিন্তু ছেলের এই গান-প্রীতি মণিমোহনকে চিন্তায় ফেলত। শাসন করতেন। তবু ‘গান-রোগ’ ছেলের কোনও দিন যায়নি।
মণিমোহনের জন্ম এক বণিক পরিবারে। কিন্তু ক্রমে তিনি বৈষ্ণব হয় ওঠেন। জগন্নাথের বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করেন বাড়িতেই। দীক্ষাও নেন। সেই সূত্রেই পুজোপার্বনে, বিশেষ করে রথযাত্রার সময় বাড়িতে কীর্তন, ভজন হতই। ছোট্ট পঙ্কজ সেই সব গান গলায় ধরে মা-পিসি-কাকি-জেঠিদের শোনাত। তাঁরা মুগ্ধ হতেন। ভক্তিমূলক গানে মণিমোহনের কোনও আপত্তি ছিল না।
দশের দশকের গোড়াতেই পঙ্কজের স্কুলে ভর্তি হওয়া। সিটি ইনস্টিটিউশন মাইনার স্কুল। আর প্রথম বছরেই অনেক লোকের সমাবেশে হঠাৎই গান গাওয়ার সুযোগ। ইংরেজ-রাজা পঞ্চম জর্জ ও তাঁর স্ত্রী রানি মেরী কলকাতায় আসবেন। তাঁদের সম্মান জানাতে তখন স্কুলে-স্কুলে সাজো-সাজো রব। পঙ্কজের স্কুলের এক শিক্ষক রীতিমতো রাজবন্দনা করে গান লিখে ফেললেন— ‘হে ভারত আজি রাজার চরণে কর রে ভকতি দান’। গানটি গাইবার জন্য তিনি অনেকের মধ্যে পঙ্কজকেই বেছে নিলেন।
শৈশবে এ গানের কথা ঠিক বুঝে উঠতে পারেনি পঙ্কজ। পরে বলতেন, ‘‘তখন তো গান গেয়ে অভিবাদন পাওয়া আর সেজে গুজে মার্চপাস্ট করে ঠোঙা ভর্তি মুড়ি খাওয়ার আনন্দে মশগুল।’’ বড় হয়ে যখন অর্থ বুঝেছিলেন, লজ্জা পেয়েছিলেন খুব। বিশেষ করে যখন তিনি রবীন্দ্রনাথ, চিত্তরঞ্জন দাশ, মহাত্মা গান্ধীর সান্নিধ্য পেলেন।
স্কুলে গান গেয়ে ছেলে প্রশংসা পেয়েছে শুনে বাবা এ বার আর রাগ করলেন না। বরং একটু গর্বই হল তাঁর। এই ঘটনার সময় বাড়িতে ছিলেন পঙ্কজের মেজো জামাইবাবু। তাঁর খুব গানের শখ। শ্বশুরবাড়ি এলেই তিনি শ্যালক-শ্যালিকাদের জড়ো করে আশপাশ থেকে একটা হারমোনিয়াম এনে একের পর এক গান শোনাতেন। পঙ্কজের গান গাওয়ার কথা শুনে তিনি কয়েকটি থিয়েটারের গান শেখানোর পরামর্শ দিলেন।
থিয়েটারের গান! শুনেই ছোট্ট পঙ্কজ ভয়ে একশা। বড়রা শুনলে বলবে কী! জামাইবাবু আশ্বস্ত করে বললেন, গানগুলো ঠাকুরদেবতার। ‘জয়দেব’, ‘কমলেকামিনী’, ‘বলিদান’-এর মতো উচ্চবর্ণ নাটকের। গান শেখানোর সময় জামাইবাবু লক্ষ করলেন সঙ্গীতে পঙ্কজের আশ্চর্য ক্ষমতা। ‘জয়দেব’ গীতিনাট্যের বিখ্যাত গান ‘এই বলে নুপূর বাজে’ শেখানো সবে শেষ হয়েছে, পঙ্কজ তখনই পুরো গানটা হুবহু গেয়ে দিল! স্তম্ভিত জামাইবাবু আরও কিছু গান শেখালেন থিয়েটারের। দ্বিজেন্দ্রলাল রায়েরও খানকতক। জামাইবাবু গাইতেন হারমোনিয়াম বাজিয়ে। তাঁকে দেখে পঙ্কজেরও খুব শখ হারমোনিয়াম বাজানোর। কিন্তু হারমোনিয়াম কোথায়! তখন তো আর ঘরে-ঘরে হারমোনিয়াম নেই। সে সময় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ সবে শেষ হয়েছে। পঙ্কজদের বাড়ির কাছেই থাকতেন তাঁর ছোটকাকার বন্ধু শৈলেন্দ্রনাথ ঘোষ। পঙ্কজের শৈলেনকাকা। শৈলেনবাবু তখন কিছু দিন মেসোপটেমিয়ায় (আজকের ইরাক) চাকরির জন্য যান। বিদেশে যাওয়ার আগে তাঁর ঘরের চাবিটা রেখে গিয়েছিলেন পঙ্কজের মায়ের কাছে। শৈলেন কাকার বিদেশযাত্রার কিছু পরেই পঙ্কজের খেয়াল হল, তাঁর ঘরেই একটা হারমোনিয়াম দেখেছে সে। তাতেই তো হাত পাকানো যায়! কিন্তু চাবি যে মায়ের কাছে! পঙ্কজ জানে, মা কিছুতেই চাবি দেবেন না। তাকে সাহায্য করলেন তার এক বিধবা পিসিমা। পঙ্কজের যাবতীয় আদরে-আবদারে তিনিই ছিলেন সহায়। পিসিমা সব শুনে বললেন, মায়ের আলমারি থেকে চাবি এনে দেবেন ঠিকই, কিন্তু শর্ত আছে। শৈলেনকাকার ঘরে আর কোনও জিনিসে পঙ্কজ যেন হাত না দেয়। এর পর সুযোগ পেলেই চলতে লাগল পঙ্কজের হারমোনিয়াম নিয়ে সাধনা। প্রথম দিকে কিছুতেই বাগে আসছিল না সুর। বহু কসরত করে এক সময় নিখুঁত বাজিয়ে ফেলল ‘এই বলে নুপূর বাজে’। এর পর যা যা গান শিখেছিল একে একে সব ক’টা।
তত দিনে বাড়িতে গান নিয়ে নিষেধাজ্ঞার আবহাওয়াটা একটু একটু করে শিথিল হল। গান গাইতে সরাসরি উৎসাহ হয়তো আসত না, কিন্তু তেমন বাধা আর দিতেন না কেউ। গ্রামাফোনে কলের গান শোনাও চালু হল বাড়িতেই। সকলে এক জোট হয়ে শুনতেন পান্নাময়ী, কে মল্লিক, মানদাসুন্দরী, নরীসুন্দরী…।
মেসোপটেমিয়া থেকে শৈলেনকাকা ফিরলেন। পঙ্কজ আগেই ঠিক করে রেখেছিল, যা হয় হোক, তাঁকে সব খুলে বলবে সে। পঙ্কজের কথা শুনে রাগ তো দূরের কথা, তাকে হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান শোনাতে বললেন তিনি। গাইল পঙ্কজ। এত আপ্লুত হলেন শৈলেনবাবু হারমোনিয়ামটি দিয়েই দিলেন পঙ্কজকে।
বাড়ির সব চেয়ে বড় অনুষ্ঠান রথযাত্রা। আট দিন ধরে চলত। নামী গায়করা আসতেন। কীর্তন, শ্যামাসঙ্গীত, রামপ্রসাদী, নিধুবাবুর টপ্পা হত। এমনই এক অনুষ্ঠানে বিশিষ্ট সঙ্গীতজ্ঞ দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়কে আনলেন পঙ্কজের এক পিসতুতো দাদা। তিনি তো গাইলেনই, কিন্তু অনুষ্ঠানে পঙ্কজের গান শুনে দুর্গাদাস অভিভূত। নিজে এগিয়ে গিয়ে তিনি মণিমোহনকে বললেন, পঙ্কজকে গান শেখাবেন। দুর্গাদাসের গানের ইস্কুল ‘ক্ষেত্রমোহন সঙ্গীত বিদ্যালয়’-এ শুরু হল পঙ্কজের গান শেখা। এর পর পঙ্কজের গানজীবনে এলেন রবীন্দ্রনাথ, দিনেন্দ্রনাথ থেকে কৃষ্ণচন্দ্র দে।
এরকমই এক সময় মণিমোহনের সংসারে শুরু হল আর্থিক সংকট। তবু সেই জীবনেও পঙ্কজের এক অদ্ভুত কাণ্ড ঘটে গেল।
একদিন ফিরছিলেন ‘তুলসীদাস কিষণলাল’-এর পাটের দালালির কাজ সেরে। আকাশ ভেঙে বৃষ্টি। দেখতে দেখতে কলকাতা ভেসে গেল। বড়বাজার থেকে হাঁটতে হাঁটতে কোনও ক্রমে ক্যানিং স্ট্রিট ধরে সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ মোড়ের কাছাকাছি পৌঁছলেন। বৃষ্টির তোড় তখন আরও জোর। মালকোঁচা মারা ধুতি, পাঞ্জাবি সামলে কোনও মতে একটা গাড়ি বারান্দাওয়ালা বাড়ির নীচে দাঁড়ালেন। পাশাপাশি মানুষ, কুকুর, গরু ঠাসাঠাসি করে দাঁড়িয়ে। ভিড়ের ঠেলাঠেলি থেকে বাঁচতে গাড়িবারান্দার নীচে এক ডাক্তারবাবুর ডিসপেন্সারির রোয়াকে উঠে দাঁড়ালেন পঙ্কজ। ওখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কখন যে আনমনা হয়ে গান ধরেছেন, ‘এমন দিনে তারে বলা যায়/এমন ঘন ঘোর বরিষায়’…।
হঠাৎ পিঠে আলতো টোকা। ফিরে দেখেন সাদা স্যুট পরা এক ভদ্রলোক। নাম বললেন, ডঃ রামস্বামী আয়েঙ্গার। ওই ডিসপেন্সারিরই মালিক। ভদ্রলোক পঙ্কজকে ভেতরে ডাকলেন। ঘরে বসে একটু বাদেই তিনি বললেন, অল্প আগে পঙ্কজের গলার গুনগুন করে গান তাঁর কানে গেছে। পঙ্কজ যদি পুরো গানটা তাঁকে গেয়ে শোনান। সম্পূর্ণ অপরিচিত এক জনের কাছে এমন পরিস্থিতিতে এই আব্দার, পঙ্কজকে প্রথমে একটু অস্বস্তিতে ফেললেও গানটি গাইলেন তিনি। গান শেষে আরওই অবাক হওয়ার পালা। দেখেন ডাক্তারবাবু নিজে প্রথম কলিটা গেয়ে উঠেছেন! ডাক্তারির পাশাপাশি তিনি নাকি গানেরও চর্চা করেন। ঘরোয়া অনুষ্ঠানে গাইতেও যান।। হঠাৎ চমকে দিয়ে ডাক্তারবাবু বললেন, ‘‘উড ইউ লাইক টু ব্রডকাস্ট? কলকাতায় নতুন রেডিয়ো স্টেশন হয়েছে— ইন্ডিয়ান ব্রডকাস্টিং কোম্পানি। আমার জানাশোনা আছে, যদি গাইতে চান তো বলুন।’’
এই ঘটনার সপ্তাখানেক পরেই ডা. রামস্বামীকে দেখা গেল পালকি করে উত্তর কলকাতার চালতাবাগানে যুগল কিশোর দাস লেনে মল্লিকদের বাড়ির সামনে নামছেন। লক্ষ্য, ও দিনই ও-বাড়ির ছেলে পঙ্কজকে তিনি কলকাতা হাইকোর্টের কাছে টেম্পল চেম্বারের বাড়িতে বেতার-অফিসে নিয়ে যাবেন!
তখন ম্যাট্রিকুলেশন পাস করে বঙ্গবাসী কলেজে ঢুকেছেন পঙ্কজ। পাশাপাশি গানের চর্চাও চলছে। দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের গানের ইস্কুলে।
এক রবিবারের দুপুরে দুর্গাবাবুর বাড়িতে গিয়ে একলা বসে ছিলেন তক্তপোশে। গুরুমশাই বাড়ি নেই। চোখে পড়ল বিছানায় রাখা রবীন্দ্রনাথের কবিতা সঙ্কলন ‘চয়নিকা’। পাতা উল্টোতে উল্টোতে চোখ আটকে গেল ‘চির আমি’ কবিতায়।— ‘‘যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে,/ আমি বাইব না মোর খেয়াতরী এই ঘাটে,/ …তখন আমায় নাইবা মনে রাখলে…।’’
শব্দের বাণ যেন শেল হয়ে বিঁধল বুকে! বেশ খানিকক্ষণ অসাড় শরীর নিয়ে স্তব্ধ হয়ে থাকার পর গুনগুন করে কবিতাটিতে সুর বসাতে লাগলেন। হঠাৎ করে আবিষ্কার করলেন, বেশ লাগছে! উত্তেজনায় ছিটকে বেরিয়ে পড়লেন দুর্গাবাবুর মদন বড়াল লেনের বাড়ি ছেড়ে।পাশেই গণেশ পার্ক। নিঝুম দুপুর। গাছের ছায়ায় বেঞ্চিতে বসে বাকি অংশেরও সুর দিয়ে ফেলেলেন। এর পর আর তর সইছে না। যন্ত্রে ফেলে সুরের শরীর তাঁকে দেখতেই হবে। এবং এখনই। একটু দূরেই ছিল ফকির দে লেনে সখের নাট্যদল ‘আনন্দ পরিষদ’-এর ঘর। তাঁর কর্তা লক্ষ্মীনারায়ণ মিত্র। পঙ্কজের লক্ষ্মীদা। লক্ষ্মীদার অর্গান আছে। ছুটলেন সেখানে। গুটিকয় লোক বসে। তাঁদের পাশ কাটিয়ে সোজা বসে গেলেন অর্গানে। রিড-এ হাত বুলিয়ে সুর গড়তে গড়তে কেমন যেন দাউ দাউ দাবানল লেগে গেল অন্তরাত্মায়! হঠাৎ পিছন থেকে কার গলা! চমকে তাকিয়ে দেখেন, লক্ষ্মীদা।—
‘‘সুরটা মোটামুটি ঠিকই হচ্ছিল, দু-একটা জায়গা বাদ দিয়ে।’’
পঙ্কজ শুনে অবাক। মানে কী? এ সুর তো তাঁরই দেওয়া, তার ভুল-ঠিক লক্ষ্মীদা বুঝবেন কী করে? এর ঠিক পরে লক্ষ্মীদার কথাতেই বুঝলেন, তিনি যে সুরের কথা বলছেন সেটি রবীন্দ্রনাথের দেওয়া। তার সঙ্গে প্রায় হুবহু মিলে গেছে এই সুর! এই অত্যাশ্চর্য সমাপতন পঙ্কজের নাভিমূল থেকে কাঁপন ধরিয়ে দিল!
কলেজে পড়তে পড়তে আর একটি কবিতা পেলেন— ‘শেষ খেয়া’।— ‘দিনের শেষে ঘুমের দেশে ঘোমটা পরা ওই ছায়া/ ভুলালো রে ভুলালো মোর প্রাণ…।’’
সুর বসিয়ে ফেললেন তাতেও। যত্রতত্র সেই গান গেয়েও বেড়াতে লাগলেন। এক বারের জন্যও ভাবেননি এ জন্য অন্তত কবির অনুমতি নিতে লাগে।
গোল বাধল তাতেই।
বাড়িতে লোক পাঠিয়ে জোড়াসাঁকোয় ডেকে পাঠালেন কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ।
ঠাকুরবাড়িতে পা রাখতেই মোটা মোচওয়ালা এক দারোয়ান দোতলার হলঘরের পথ দেখিয়ে দিল। দরজার ফাঁক দিয়ে দেখতে পেলেন সৌম্য সুদর্শন কবিপুত্রকে।
‘‘আপনি নাকি বাবামশায়ের কী একটা ছায়া ছায়া গান গেয়ে থাকেন?’’
শুনে গলা শুকিয়ে গেল পঙ্কজের। বললেন, ‘‘ঠিক বুঝলাম না!’’
সেই মুহূর্তে ঘরে এলেন সৌমেন্দ্রনাথের বোন রমা। রথীন্দ্রনাথ তাঁকে ঘটনাটি বলতেই রমা বললেন, ‘‘দিনের শেষে ঘুমের দেশে ঘোমটা পরা ওই ছায়া… ওটা কিন্তু আবার কবিতা। গান নয়।’’ পঙ্কজ তত ক্ষণে আন্দাজ করেছেন অন্যায় হয়ে গেছে। থতমত খেয়ে রেহাই পেতে মিথ্যে বলে দিলেন, ‘‘ওটা রবিঠাকুরেরই সুর। স্বরলিপি পেয়েছি এক বন্ধুর কাছে। সে আবার এখন কাশীতে।’’
‘‘আশ্চর্য! বন্ধু ফেরত এলে স্বরলিপির বইটা এনে দেখাবেন?’’
আশ্বাস দিয়ে সে দিন রেহাই পেলেন বটে, কিন্তু এক মাসের মধ্যে জোড়াসাঁকো থেকে রবিপুত্রের কড়া চিঠি। দিনক্ষণ জানিয়ে লিখেছেন, রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং দেখা করতে চান। এক দিকে উত্তেজনা, তাঁর ঈশ্বরদর্শন হবে বলে! অন্য দিকে শঙ্কা! না জানি কী হয়! মনকে বোঝালেন, ‘‘প্রহার করলেও আমি তা আমার অঙ্গের ভূষণ করে নিয়ে ফিরে আসব। তবে আসার আগে কেবল তাঁর কমল চরণে দুটি চোখের অশ্রুতে সিক্ত করে সব অপরাধ স্বীকার করে নেব।’’
জোড়াসাঁকো। কবির ঘর।
রথীন্দ্রনাথ গম্ভীর মুখে বসে। পঙ্কজ আসা মাত্র কোনও কথা বলার সুযোগ না দিয়ে তাঁকে তিনিই এনেছেন এই ঘরে। তাঁর হাবেভাবেই পরিষ্কার গানটির সুরকার কে, তাঁরা বিলক্ষণ জেনে গিয়েছেন। ঘরের এক পাশে একটা নিচু সুদৃশ্য তক্তপোশ। তার ওপরেই বসে কবি। লিখছেন। মাঝে মাঝে কী যেন আওড়াচ্ছেন! তাঁর সামনে রাখা বই, কাগজপত্র। কালি, কলম, নানা রঙের পেন্সিল। অন্য পাশে বিশাল হ্যামিল্টন-অর্গান। ঘরে উপস্থিত জনা আটেক। সবাই পরিবারেরই মনে হয়।
রথীন্দ্রনাথ চোখের ইশারায় অর্গানটি দেখিয়ে দিয়ে গান গাইতে বললেন। ভয়ে পঙ্কজের শরীর তখন ঘামে ভিজে উঠছে। কাঁপা কাঁপা হাত অর্গানে রেখে শুকনো গলায় গান ধরলেন, ‘‘… ও পারেতে সোনার কূলে আঁধারমূলে কোন মায়া/ গেয়ে গেল কাজ-ভাঙানো গান… দিনের শেষে…’’
গান শেষ হলে দেখলেন ঘরের প্রায় সকলেই পা টিপে টিপে বেরিয়ে যাচ্ছেন। রবীন্দ্রনাথ শুধু স্থাণু পাথর। চোখ অর্ধনিমীলিত। আত্মসমাহিত! পঙ্কজ আর দাঁড়লেন না। কোনও ক্রমে রথীন্দ্রনাথের অনুমতি নিয়ে দ্রুত পায়ে বেরিয়ে এলেন ঠাকুরবাড়ি ছেড়ে।
বহু বহু পরে যখন ‘মুক্তি’ ছায়াছবিতে এই একই গান ব্যবহার করার অনুমতি চাইতে গিয়েছিলেন পঙ্কজ, সে আরেক পর্ব! তার মাঝে কত স্রোত বয়ে গেছে। কত বাঁক পেরিয়ে! কত যে গ্লানি, দুঃখ মুখ বুজে মেনে নিতে হয়েছে!
তিরিশের দশক।
সিনেমার তখনও নির্বাক যুগ। ভারতবিখ্যাত ইম্প্রেসারিও হরেন ঘোষ সেই প্রথম বায়োস্কোপে মিউজিক করার জন্য ডেকে পাঠালেন পঙ্কজ মল্লিককে। তখন তিনি বেতারের প্রতিষ্ঠিত শিল্পী। সুরকার। কিন্তু ছবিতে কী করে সুর করা হবে কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছিলেন পঙ্কজ আর তাঁর সঙ্গী রাইচাঁদ বড়াল। তবু বহু ভাবাভাবির পর ‘ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ক্র্যাফট’ কোম্পানির সাইলেন্ট মুভি ‘চোরকাঁটা’য় আবহ করে ফেললেন। পরে আবার একটি। ‘চাষার মেয়ে’। দুক্ষেত্রেই তাঁর আশ্রয় হল রবীন্দ্রগান নির্ভর সুর। দু’টি ছবির মুক্তির পরই সবাক ছবির যুগ।
তত দিনে ‘ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম-ক্র্যাফট’ নাম বদলে হয়ে গিয়েছে ‘নিউ থিয়েটার্স লিমিটেড’। ওদের প্রথম সবাক ছবি ‘দেনাপাওনা’। কাহিনি শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। পরিচালক প্রেমাঙ্কুর আতর্থী। পঙ্কজের বুড়োদা। ক্যামেরাম্যান নীতিন বসু। সর্বজনীন পুতুলদা। ছবি মুক্তি পেল। কিন্তু, এ কী! ক্রেডিট টাইটেলে সহকর্মী রাইচাঁদের নাম বড় বড় অক্ষরে। পঙ্কজের নাম ছোট ছোট করে।
বিস্ময়! অপমান! দুঃখ! ক্ষোভ!
ভেবেছিলেন প্রতিবাদ করবেন। পরে মনে হল, কোনও লাভ নেই। বরং ক্ষতি হয়ে যেতে পারে।
কিন্তু কেন?
‘‘এক দিকে রাইবাবু ছিলেন সেই সময়কার বিশিষ্ট সঙ্গীতজ্ঞ লালচাঁদ বড়ালের পুত্র। তাঁরা ছিলেন বউবাজারের এক বিখ্যাত ধনী পরিবার এবং তাঁদের সাঙ্গীতিক ঐতিহ্যও ছিল প্রসিদ্ধ। অন্য দিকে পঙ্কজবাবু জন্মেছিলেন এক মধ্যবিত্ত সঙ্গীত বর্জিত পরিবারে, যা আবার ঘটনাচক্রে দৈন্যদশায় আক্রান্ত হয়ে পড়েছিল সেই সময়ে। এই অসমান সামাজিক পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে রাইবাবুর নাম-ই যে প্রাধান্য পাবে তাতে তো আর আশ্চর্যের ছিল না,’’ পঙ্কজ মল্লিক নিয়ে লিখতে বসে এমনই অনুমান করেছেন তাঁর দৌহিত্র রাজীব গুপ্তর।
এ ছাড়াও কারণ ছিল। বাড়িতে চল্লিশ জনের বেশি লোকের ভার তখন একা পঙ্কজের কাঁধে। বেতার থেকে আয় আর কতটুকুই’বা। তা’ও সেটা চাকরিও নয়। তাই মুখ বুজে টিকে থাকাটাই শ্রেয় মনে করেছিলেন পঙ্কজ মল্লিক। ফলে বছরের পর বছর একই কাণ্ড ঘটতে লাগল।
প্রমথেশ বড়ুয়া নিউ থিয়েটার্সে যোগ দেওয়ার পর চাকা ঘুরল। পঙ্কজের প্রতি বৈষম্য, অবিচার তাঁর চোখে পড়তেই তিনি কথা বললেন কর্ণধার বীরেন্দ্রনাথ সরকারের সঙ্গে। এখানেও দৌহিত্র রাজীবের ব্যাখ্যা, ‘‘প্রমথেশ বড়ুয়া ছিলেন অসমের গৌরীপুরের জমিদারের ছেলে। ফলে ওঁর কথা চট করে কেউ অমান্য করতে পারতেন না।’’
কয়েক বছর বাদে প্রথমেশ বড়ুয়ার ‘মুক্তি’ ছায়াছবির মুক্তি। সেই ‘মুক্তি’র পর আলাদা-আলাদা অফিস বাংলো হয়ে যায় পঙ্কজ মল্লিক ও রাইচাঁদ বড়ালের। তার সঙ্গে নতুন স্টুডিয়ো ফ্লোর। তারও আগে চলচ্চিত্রের দুনিয়ায় আরও একটি ঐতিহাসিক ঘটনায় জড়িয়ে পড়লেন পঙ্কজকুমার মল্লিক।
নিউ থিয়েটার্স স্টুডিয়ো-য় তখন ‘ভাগ্যচক্র’ ছবির কাজ চলছে। পরিচালক নীতিন বসু, সকলের সেই পুতুলদা। পুতুলদা থাকতেন উত্তর কলকাতার আমহার্স্ট স্ট্রিটে। পাশের পাড়া চালতাবাগানে পঙ্কজ। প্রতিদিন স্টুডিয়ো যাবার পথে পঙ্কজকে বাড়ি থেকে গাড়িতে তুলে নিয়ে যেতেন তাঁর পুতুলদা। এমনই এক দিন পুতুলদা গাড়ি নিয়ে এসে নীচ থেকে ডেকেই চলেছেন। পঙ্কজ আর নামেন না। তিনি তখন পাশের বাড়ি থেকে ভেসে আসা ‘পেগান লভ সং’-এ গলা মেলাচ্ছেন। রামোন নাভারোর বিখ্যাত গান— ‘হোয়্যার দ্য গোল্ডেন সানবিমস/ অ্যান্ড দ্য লেজি ল্যান্ড ড্রিমস…’। ‘দ্য পেগান’ ছায়াছবির।
বহুক্ষণ বাদে যখন পঙ্কজের বাবা এসে ডাকলেন তাঁকে, টনক নড়ল। হুড়মুড়িয়ে নীচে নেমে গাড়িতে বসলেন। পুতুলদা গম্ভীর। কোনও কথা নেই মুখে। নির্ঘাৎ দেরি করার জন্য রাগ করেছেন।
চৌরঙ্গীতে মেট্রো সিনেমার কাছে ট্র্যাফিক সিগনালে গাড়ি থামতেই আচমকা নেমে গেলেন পুতুলদা। চালক ওঁর ভাই মুকুল বসু। তাঁকে শুধু বলে গেলেন, মিউজিয়ামের সামনে যেন গাড়িটা ‘পার্ক’ করা হয়। পুতুলদা ফিরলেন বেশ কয়েকটা ইংরেজি বই আর একটা রেকর্ড নিয়ে।
স্টুডিয়োয় ঢুকেও কোনও কথা না বলে হন হন করে হাঁটা দিলেন পুতুলদা। পঙ্কজ-মুকুল পিছু নিলেন। ঘরে ঢুকেই সামনে রাখা গ্রামাফোনে সদ্য কিনে আনা রেকর্ডটা বসিয়ে দিলেন পুতুলদা। ‘পেগান লভ সং’! গান শুরু হতেই প্রচণ্ড উত্তেজিত হয়ে বললেন, ‘‘পঙ্কজ, শিগগির। গলা মেলা। ঠিক যেমন বাড়িতে মেলাচ্ছিলি। ক্যুইক, ক্যুইক।’’ কিছু না বুঝে যন্ত্রের মতো আদেশ পালন করতে লাগলেন পঙ্কজ মল্লিক। আর গান গাইতে গাইতে অবাক হয়ে দেখলেন, পুতুলদা এ দিক ও দিক থেকে তাঁকে দেখে চলেছেন। গানের শেষে যা ঘটল তাতে পঙ্কজ ভাবলেন, পুতুলদা নির্ঘাৎ পাগল হয়ে গিয়েছেন। হঠাৎ পঙ্কজকে জড়িয়ে ধরে নাচতে শুরু করে দিলেন।— ‘‘পেয়েছি রে পেয়েছি পঙ্কজ। পেয়েছি।’’
কী পেয়েছেন পুতুলদা?
‘‘কী শুভক্ষণেই না তুই তোর বাড়িতে রেকর্ডের গানের সঙ্গে গলা মেলাচ্ছিলি।’’
পঙ্কজ ধীরে ধীরে বুঝলেন পুতুলদা ‘প্লেব্যাক’-এর পদ্ধতিটা আবিষ্কার করে বসে আছেন! সেই প্রথম ‘প্লেব্যাক’ হল ভারতীয় সিনেমায়।
‘‘জীবনের মায়া একজন প্রকৃত শিল্পীকে কোনও ভাবে বশীভূত করে ফেলতে পারে না, কারণ সে শিল্পী সারাক্ষণ তার শিল্পের মাধ্যমে মুক্তির খোঁজ করতে থাকে। কে তার আপন, আর কে তার পর বুঝে উঠতে পারে না, সে যেন সারাক্ষণ কারও কোনও ডাকের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে…,’’ একটি ছবির কাহিনি শোনাচ্ছিলেন প্রমথেশ বড়ুয়া। কাহিনির অলিতে গলিতে হাঁটতে হাঁটতে কেমন যেন ঘোর লাগছিল পঙ্কজের! শুনতে শুনতেই গান এসে পড়ছিল ঠোঁটে।
‘শেষ খেয়া’র সেই গানটিও যে চলে এল কোনও এক ফাঁকে— ‘ঘরেও নহে, পারেও নহে, যে জন আছে মাঝখানে…’।
কিন্তু এ বার কবির অনুমতি চাই।
কবি তখন প্রশান্ত মহলানবীশের বাড়ি ‘আম্রপালী’-তে (আজ যেখানে ‘ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট’)। গেলেন সেখানে। কাহিনি, দৃশ্যর বর্ণনা শুনে কবি বললেন, ‘‘পঙ্কজ, আমি দেখছি তোমাদের ছবির শুরুতেই দ্বার মুক্ত। তোমাদের কাহিনির মূল চরিত্রটি যেন কীসের থেকে মুক্তি খুঁজে বেড়াচ্ছে।’’
এ কথা পরে শুনে লাফিয়ে উঠেছিলেন প্রমথেশ, ‘‘আরে পঙ্কজ, স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের মুখ থেকে আমার ছবির নাম বেরিয়ে এসেছে! তোমায় যে কী বলে ধন্যবাদ দেব! বুঝতে পারছ তো কী নাম? মুক্তি! মুক্তি! যাক, বলো আর কী কী বললেন উনি।’’
‘দিনের শেষে ঘুমের দেশে’র কথা উঠতেই মৃদু হাসি কবির।—‘‘গানটি তো আমায় না শুনিয়েই পালিয়ে গিয়েছিলে। অমন সুন্দর গলা তোমার! সে দিন পালালে কেন?’’
আনত চোখে লাজুক মুখে বসে কবির কথা শুনছিলেন পঙ্কজ।
আরও কিছু আলাপের শেষে কবি হঠাৎ বললেন, ‘‘একটু বদল করলে ভাল হত। ‘ফুলের বার নাইকো যার ফসল যার ফলল না’র বদলে ‘ফুলের বাহার নাইকো যাহার ফসল যাহার ফলল না’…লিখে নাও তো তুমি…।’’
‘মুক্তি’-তে জোর করে পঙ্কজ মল্লিককে দিয়ে অভিনয়ও করালেন প্রমথেশ। কিছুতেই রাজি হচ্ছিলেন না! প্রমথেশ নাছোড়। শেষে তাঁর জেদের কাছে হার মানতেই হল।
এর পর আরও আরও অনেক ছবিতে অভিনয় করলেন তিনি। হিন্দি, বাংলা দুই-ই। একে বারে স্বেচ্ছাবসর নেওয়া অবধি। পুরোপুরি অভিনয় ছেড়ে দেওয়ার পরও ‘অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি’ করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছিলেন এক প্রযোজক। আর রাজি করানো যায়নি।
সুরের নেশা তখন ওঁকে আরওই যেন পাগল করে দিয়েছে। সেই নেশার জালে একে একে ধরা দিয়ে চলেছেন কাননদেবী, গীতা দত্ত, শচীন দেব বর্মন, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় … কে নন! পঙ্কজ-সুরের মোহ এমনই যে অদ্ভুত অদ্ভুত সব কাণ্ড ঘটতে লাগল সিনেমা হলেও। ‘যাত্রিক’-এ যেমন। তীর্থস্থানকেন্দ্রিক ছবি। ভক্তিরসের গান। লোকমুখে গল্প শুনে দর্শক ভাবরসে ডুবে থাকত ছবি দেখার আগে থেকেই। জুতো খুলে হলে ঢুকতেন তাঁরা। এক দিকে এই ভাববিহ্বলতা। অন্য দিকে অদ্ভুত অদ্ভুত সব এফেক্টসের ছোঁওয়া!
‘ডাক্তার’ ছবিতে গীতিকার অজয় ভট্টাচার্যের লেখা গান ‘ওরে চঞ্চল’। তারই হিন্দি রূপান্তর ‘চলে পবন কী চাল’। শুট্যিং হচ্ছিল ডায়মন্ডহারবারে। রাস্তায়। ঘোড়ায় গাড়ি চালিয়ে। এ দিকে সিনেমায় ঘোড়ার ক্ষুরের শব্দ আনার মতো আধুনিক যন্ত্র তখন কই! নারকোলের খোল বাজিয়ে হুবহু সেই আওয়াজ আনলেন সাউন্ডট্র্যাকে।
পঙ্কজ মল্লিকের নামে তখন ভূ-ভারত নড়েচড়ে বসে!
বারবার ডাক আসতে লাগল বম্বে থেকে। তিনি কিছুতেই যাবেন না। এক বার তো রাজকপূর নিজে এসে বললেন, ‘‘চাচা, আপনার টেবিলে আমি ব্ল্যাঙ্কচেক রেখে যাচ্ছি, যা মনে আসবে ভরে নেবেন। আমার ছবিতে কিন্তু আপনাকে চাই।’’ তাও না।
জার্মান পরিচালক পল জিলস্ ডাকলেন। রবীন্দ্রনাথের ‘চার অধ্যায়’ নিয়ে হিন্দিতে ‘জলজলা’ বানাবেন। বম্বেতে। দেব আনন্দ, গীতা বালি অভিনয় করছেন। গান গাইবেন গীতা দত্ত। সঙ্গীত পরিচালনা করে দিতে হবে। তাতেও এক কথা, ‘‘না।’’
জিলস্ অবশ্য হার মানলেন না। গীতাকে নিয়ে সোজা কলকাতায় চলে এলেন। সেবক বৈদ্য স্ট্রিটের নিজের বাড়িতে গীতা দত্তকে নিয়ে মহলা দিয়ে পঙ্কজ মল্লিক গান রেকর্ড করালেন নিউ থিয়েটার্সে।
কিন্তু বম্বে গেলেন না।
এ দিকে তখন দলে দলে শিল্পীরা বাংলা ছাড়ছেন। নিউ থিয়েটার্স-এর সরকার সাহেবও বললেন, ‘‘সবাই তো চলে যাচ্ছে। আপনিও যান। এত টাকা দেবার ক্ষমতা যে আমার নেই! সুযোগ হারাবেন কেন?’’ পঙ্কজ বললেন, ‘‘আপনি আমার অসময়ে পাশে থেকেছেন, আজ এই দুঃসময়ে আপনাকে ছেড়ে চলে যাব!’’ সরকারসাহেবের এর পর আর কী করার থাকে, চোখের জলে ভেসে যাওয়াটুকু ছাড়া!
কিছু পরে বি এন সরকার নিজেই বন্ধ করে দিলেন নিউ থিয়েটার্স। তখনও তাঁর পুরনো ঘরকে ভুলতে পারেননি পঙ্কজ মল্লিক। বাংলা ছাড়লেন না কিছুতেই। কোম্পানি বন্ধ হওয়ার বছর দুয়েক আগে যুক্ত হয়ে ছিলেন ‘লোকরঞ্জন শাখা’য়। মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়ের ডাকে। তাও সে গ্রামে গ্রামে সরকারের উন্নয়ন প্রকল্পে বিনোদনের কাজে যোগ দিতে। রঙিন জীবন থেকে দূরে। বহু দূরে। দেশজ টানে তিনি যে বরাবর আত্মহারা!
নিউ থিয়েটার্সে থাকাকালীন অসংখ্য হিন্দি, উর্দু, তামিল ছবিতেও সুর দিয়েছেন পঙ্কজ। রাষ্ট্রীয় পুরস্কার চালু হওয়ার পর ‘যাত্রিক’, ‘মহাপ্রস্থানের পথে’ এবং ‘রাইকমল’ ছবির জন্য শ্রেষ্ঠ সঙ্গীত পরিচালক বিবেচিত হন, ১৯৭২ সালে প্রথম সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে দাদাসাহেব ফালকে সম্মান পান। ভারতের জাতীয় সঙ্গীত ‘জন গণ মন’ তিনিই প্রথম গেয়ে রেকর্ড করেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁকে বলেছিলেন, জীবদ্দশায় যে সব গানে তিনি সুর করে যেতে পারবেন না, সেগুলিতে সুরযোজনার দায়িত্ব যেন পঙ্কজকুমার মল্লিক নেন। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত কবিগুরুর এই আশীর্বাদকে তিনি সব পুরস্কার ও সম্মানের ঊর্ধ্বে মনে করতেন।’
আর ছিল রেডিয়ো। আকাশবাণী। তার সম্পর্ক কি এক-আধ দিনের! সেই ’২৭ সাল থেকে।
আকাশবাণী তখন টেম্পল চেম্বার্স-এর বাড়িতে। স্টেশন ডিরেক্টর স্টেপলটন সাহেব। প্রোগ্রাম ডিরেক্টর নৃপেন মজুমদার। ডাক্তার রামস্বামী আয়েঙ্গারের পালকি গাড়ি করে গিয়ে সেই যে সে-বাড়ির মায়ায় জড়িয়ে ছিলেন, যত দিন গেছে তাতে আরওই মজেছেন। প্রাণভোমরার মতো আগলে বে়ড়িয়েছেন বেতারকে। গান, নাটক, কথিকা, গল্পদাদুর আসর…। অনেক ভালবাসায় মুড়ে চালু হওয়া ‘সঙ্গীত শিক্ষার আসর’, ‘মহিষাসুরমর্দিনী’।
রেডিওতে ৫০ বছরের কার্যকালে পঙ্কজ মল্লিক অগণ্য অবদান রেখে গিয়েছেন, তার মধ্যে দু’টি অনন্যসাধারণ— প্রতি রবিবার সকালের ‘সঙ্গীতশিক্ষার আসর’ এবং মহালয়ার ভোরের বিখ্যাত অনুষ্ঠান ‘মহিষাসুরমর্দিনী’। টানা প্রায় ৪৭ বছর একা তিনি সঙ্গীতশিক্ষার আসরের সঞ্চালনা ও পরিচালনা করেছেন। তখনও বাড়ির মেয়েদের বাইরে গিয়ে গান শেখার চল তেমন হয়নি, কিন্তু তাঁর অনুষ্ঠানের সূত্রে অজস্র নারী-পুরুষ উপকৃত হয়েছেন, তাঁদের কেউ কেউ আজ প্রথিতযশা শিল্পীও! পঙ্কজ মল্লিকই প্রথম ব্যক্তি যিনি রবীন্দ্রনাথের গানকে সমাজের সব স্তরে জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন এবং সঙ্গীতশিক্ষার আসর ছিল তার অন্যতম মাধ্যম। ১৯৩১ সাল থেকে ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ প্রচারিত হতে আরম্ভ করে, আজও তার জনপ্রিয়তায় বিন্দুমাত্র ভাটা পড়েনি। বাণীকুমারের সৃষ্ট এবং রচিত এই বীথিটি বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের স্তোত্রপাঠে সজ্জিত ও পঙ্কজ মল্লিকের সুরে অলঙ্কৃত। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের সম্পূর্ণ গ্রন্থনাটি তাঁর সুরে বাঁধা এমনকী, গোড়ার দিকের অনেক বছর সব ক’টি গানও তিনিই গাইতেন!
সেই ভালবাসার গর্ভগৃহেই যে এক দিন চূড়ান্ত অপমানিত হতে হবে, কোনও কালে ভাবেননি। অথচ তাই-ই হল। তা’ও জীবনের একেবারে উপান্তে।
উপর্যুপরি দু-দুটো ঘটনা ঘটল।
দীর্ঘ কাল ধরে চলে আসা তাঁর স্বপ্নের ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ হঠাৎ এক বার বন্ধ করে নতুন আকার দিয়ে সম্প্রচার করা হল। এমনটা যে হবে, ঘুণাক্ষরে আগে থেকে জানতেন না তিনি। ১৯৭৬ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর, মহালয়ার দিন৷ ভোরবেলা আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্র থেকে বেজে উঠেছিল সেই চিরাচরিত ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ নয়, ‘দেবীং দুর্গতিহারিণীম্’৷ বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ সেই এক মহালয়াতেই বাতিল হয়েছিল। এসেছিল ওই নতুন অনুষ্ঠান৷ যার প্রধান ভাষ্যপাঠক ছিলেন উত্তমকুমার।
কিন্তু কী ছিল সেই ‘দেবীং দুর্গতিহারিণীম্’? স্ক্রিপ্ট লিখেছিলেন ধ্যানেশনারায়ণ চক্রবর্তী। গান লিখেছিলেন শ্যামল গুপ্ত। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সুরে গান গেয়েছিলেন প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়, নির্মলা মিশ্র, বনশ্রী সেনগুপ্ত, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, অসীমা ভট্টাচার্য, অনুপ ঘোষাল, অপর্ণা সেনগুপ্ত, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় এবং লতা মঙ্গেশকর ও আশা ভোঁসলে। বাংলা ও সংস্কৃত ভাষ্যপাঠে ছিলেন উত্তমকুমার, বসন্ত চৌধুরী, পার্থ ঘোষ, ছন্দা সেন, মাধুরী মুখোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় প্রমুখ।
শ্রোতার প্রবল দাবিতে যদিও ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ আবার ফিরল।
‘মহিষাসুরমর্দিনী’র নাম প্রথম থেকেই ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ ছিল না। বাণীকুমারের লেখা থেকেই তার ইতিহাসটা পড়া যাক:
‘১৯৩০-এর ১লা এপ্রিল সরকারী পরিচালনাধীনে এসে ভারতীয় বেতারের নতুন নামকরণ হলো ‘ইন্ডিয়ান স্টেট ব্রডকাস্টিং সার্ভিস’। কলকাতা বেতার প্রতিষ্ঠানে স্বভাবতই তাই জেগে উঠলো জনচিত্তের পরে আকর্ষণী-শক্তি সবিশেষ বিস্তার করবার অদম্য উৎসাহ। চললো নব নব অনুষ্ঠান-সম্ভার সাজাবার অক্লান্ত আয়োজন। এরই ফলে জন্ম নিলো ‘বেতার বিচিত্রা’। সাধারণত সংগীত-বহুল অনুষ্ঠানই বৈচিত্র্যে অধিক আদরণীয় ছিলো। সেই সূত্রে শ্রীশ্রী মার্কণ্ডেয় চণ্ডীর বিষয়বস্তুর উপর ভিত্তি করে ‘বসন্তেশ্বরী’ নামে একটি চম্পূ রচনা করি ১৩৩৮ বঙ্গাব্দ অর্থাৎ ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে। ওই বছর চৈত্রের শুক্লা অষ্টমীর প্রভাতে বাসন্তী ও অন্নপূর্ণা পূজার সন্ধিক্ষণে সম্প্রচারিত হয় ‘বসন্তেশ্বরী’।’
এই বসন্তেশ্বরীর পরে ১৯৩২ সালেরই মহাষষ্ঠীর প্রভাতে বাণীকুমারের লেখা আর একটি গীতি-আলেখ্য প্রচারিত হয়, যার বিষয় ছিল মহিষাসুর বধ। তখন তার নাম ছিল ‘শারদীয় বন্দনা’। তারই ভাষ্যকে এর পরে আরও পরিমার্জিত করে ১৯৩৪ সালের ৮ই অক্টোবর, মহালয়ার দিন সকালে প্রচারের ব্যবস্থা হয়। আর ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ প্রথম শোনা যায় ১৯৩৬ সালে। সেই প্রথম মহিষাসুরমর্দিনী কিন্তু মহালয়ায় নয়, মহাষষ্ঠীর দিন প্রচারিত হয়েছিল। পরে তার প্রচারসময় স্থির হয় মহালয়ার দিন সকালে। কিন্তু সেই প্রথম প্রচারের প্রস্তুতি বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের কলমে ভীষণ আকর্ষক:
‘‘পঙ্কজ সুর তুলে ও সুরারোপ করে তখনকার শ্রেষ্ঠ শিল্পীদের কণ্ঠে গান তোলাতে লাগলেন। রাইচাঁদও এক বিরাট অর্কেস্ট্রা পরিচালনার জন্য প্রস্তুত হতে লাগলেন। সেকালের সবচেয়ে বড় বাজিয়েরা গানের সঙ্গে সহযোগিতা করতে এগিয়ে এলেন।’’
এ হেন মহাযজ্ঞ যে মহিষাসুরমর্দিনী চল্লিশ বছর ধরে আকাশবাণীতে হয়ে আসছিল, যার প্রতিটি সম্প্রচারের দিন আকাশবাণীতে উপস্থিত থাকতেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ সেই অনুষ্ঠান না বাজিয়ে নতুন অনুষ্ঠান বাজানোর নির্দেশ এসেছিল দিল্লি থেকে। কিন্তু শ্রোতাদের প্রবল আপত্তিতে পরের বছর থেকেই ফিরে আসে মহিষাসুরমর্দিনী। প্রবল আপত্তি মানে অজস্র চিঠি, টেলিফোন।
১৯৭৬ সাল। আকাশবাণীর কর্তৃপক্ষ ঠিক করলেন চিরাচরিত ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ বীরেন্দ্রকৃষ্ণর বদলে উত্তমকুমারকে দিয়ে করাবেন। তাঁদের গোপন বৈঠকে বাদ পড়লেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র।
এই নতুন উদ্যোগ ঘুণাক্ষরেও টের পাননি বীরেন্দ্র কৃষ্ণ। কিছু জানানো হয় নি পঙ্কজকুমার মল্লিক কেও। পরিবর্তিত ‘মহিষাসুরমর্দিনী’র স্ক্রিপ্ট লিখেছিলেন ডঃ গোবিন্দগোপাল মুখোপাধ্যায়। ভদ্রলোক ছিলেন বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃতের বিভাগীয় প্রধান। নির্দিষ্ট দিনে রেডিয়োয় বাজল নতুন অনুষ্ঠান ‘দেবীং দুর্গতিহারিণীম্’। এবং চূড়ান্ত ফ্লপ।
সমালোচনার ঝড় উঠল। বেতার অফিস ভাঙচুর হল। অফিসের সামনে লোকে গালিগালাজ করতে লাগল। অনেকের এমনও মনে হয়েছিল যে মহালয়ার পুণ্য প্রভাত কলুষিত হল! এ বার বুঝি অমঙ্গল কিছু ঘটবে!
উত্তমকুমার কিন্তু এ দায়িত্ব নিতে চাননি। তিনি বীরেন্দ্র কৃষ্ণের কাছে গিয়ে তাঁর অস্বস্তি ও অযোগ্যতার কথাও বলেছিলেন। বীরেন্দ্র কৃষ্ণ অবশ্য তাঁকে আশ্বস্ত করে উৎসাহই দিয়েছিলেন।
সম্প্রচারের দিন খাটে বসে ছেলের সঙ্গে মন দিয়ে তিনি শুনেছিলেন উত্তমকুমারের মহালয়া। সবটা শোনার পরে তিনি নাকি শুধু এটুকুই বলেছিলেন, “লোকে যদি নেয় নিক।” এ কথা জানা যায় বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের পুত্র প্রদ্যোৎকুমার ভদ্রের কাছ থেকে।
বেতার কর্তৃপক্ষ একেবারে গোপনে তাঁকে কিছু না জানিয়ে এই নতুন অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা করায় তিনি খুবই কষ্ট পেয়েছিলেন। বলেছিলেন, “ওরা একবার আমায় জানালোও না। আমি কি নতুন কিছুকে কোনও দিন বাধা দিয়েছি?”
মহিষাসুরমর্দিনী না-বাজানো সম্পর্কে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের বক্তব্য ছিল,
“আমি তো অমর নই, একদিন না একদিন অন্যদের তো এগিয়ে আসতেই হবে এ কাজে।”
কিন্তু এ কথা মিথ্যে প্রমাণিত হয়েছে। প্রতি বছর মহালয়াতে বাঙালির ভোর হয় মহিষাসুরমর্দিনী দিয়েই। আর সেই অনুষ্ঠান বাঙালির চিরকালের ঠাকুরঘরই৷ ‘দেবীং দুর্গতিহারিণীম’-এর অশেষ দুর্গতি-র পরে দুর্গতির কারণ বলতে গিয়ে উত্তমকুমার যে নিজেই বলেছিলেন,
‘‘ঠাকুর ঘরকে রিনোভেট করে ড্রয়িং রুম বানালে যা হয়, তাই-ই হয়েছে।’’
বহু মানুষের চাহিদায় সে বছরই ষষ্ঠীর দিন আবার বীরেন্দ্রকৃষ্ণর মহিষাসুরমর্দিনী সম্প্রচার করা হয়। আশ্চর্যের কথা হল, এই সম্প্রচার হবে শুনে অভিমান, ক্ষোভ সব ভুলে বীরেন্দ্র কৃষ্ণ পুনরায় কাজে নেমে পড়েছিলেন। সাথে ছিলেন পঙ্কজকুমার মল্লিক।
পঙ্কজকুমার মল্লিকের জায়গায় হেমন্ত মুখোপাধ্যায় কাজ করায় দু’জনের মধ্যে কি কোনও দ্বৈরথ সৃষ্টি হয়েছিল? পঙ্কজকুমার মল্লিকের পৌত্র শ্রী রাজীব গুপ্ত সাম্প্রতিক অতীতে সংবাদমাধ্যম কে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন, “পঙ্কজকুমার ও হেমন্ত, দু’জনেই খুব নম্রভাষী মানুষ ছিলেন। আমার দাদু অর্থাৎ পঙ্কজকুমার ছিলেন অত্যন্ত বিনয়ী, সারাজীবনে কারও সঙ্গে উঁচু গলায় কথা বলেছেন কিনা জানা নেই।’’ সেই সঙ্গে তিনি এটাও জানিয়েছিলেন, সে সময়ে গোটা বিষয়টি নিয়ে কেউ কিছুই জানাননি পঙ্কজকুমারকে, এবং এই বিষয়টিই তাঁর সবচেয়ে খারাপ লেগেছিল।
কিন্তু ক্ষত তো রয়ে গেল পাঁজরে!
তার আগে ‘সঙ্গীত শিক্ষার আসর’! বহু দশক ধরে রেডিয়োর যে অনুষ্ঠানে প্রাণ ভ’রে গান শেখাতেন তিনি। তার পরিণাম?
আত্মজীবনী-তে পঙ্কজ মল্লিক লিখছেন, ‘‘আসরে শেষ রবীন্দ্রসঙ্গীত শিখিয়েছিলাম ‘তোমার শেষ গানেরই রেশ নিয়ে যাও চলে’। … তখন কি জানতাম এই গানই আমার আসরের শেষ গান হয়ে দাঁড়াবে! … মীরাবাঈ ভজন শেখাতে আরম্ভ করেছিলাম। এমন সময় অকস্মাৎ এক দিন আমার বাসভবনের ঠিকানায় এল এক চিঠি, পত্রলেখক কলকাতা বেতার কেন্দ্রের তদানীন্তন স্টেশন ডিরেক্টর। … অনুষ্ঠান প্রচার বন্ধ করে দেওয়া হল। এক বোবা যন্ত্রণা আমাকে নির্বাক করে দিয়েছিল।… যে মীরাবাঈ ভজনটি শেখাতে আরম্ভ করেছিলাম সেটিকে, বলা বাহুল্য, শেষ হতে দেওয়া হল না।’’
এই বিষয়ে পঙ্কজকুমার মল্লিকের পৌত্র শ্রী রাজীব গুপ্ত’র বক্তব্য, “অল ইন্ডিয়া রেডিওর পক্ষ থেকে জানানো উচিত ছিল। সে সময় অল ইন্ডিয়া রেডিওতে দাদুর দুটো অনুষ্ঠান হত। প্রথমটি ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ আর দ্বিতীয়টি ‘সঙ্গীতশিক্ষার আসর’। ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ বন্ধ করার পনেরো দিন আগে সঙ্গীতশিক্ষার আসর অনুষ্ঠানটিও বন্ধ করে দেওয়া হয়। সঙ্গীতশিক্ষার আসর বন্ধ হয়ে যাওয়ায় দাদু একটা ধাক্কা পেয়েছিলেন। সে সময় উনি যে গানটি শেখাতে শুরু করেছিলেন, সেটাও ওঁকে শেষ করতে দেওয়া হয়নি। তার পনেরো দিনের মধ্যেই ‘মহিষাসুরমর্দিনী’র ঘটনাটা ঘটে। একদম শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত দাদু জানতেন না, মহিষাসুরমর্দিনীর পরিবর্তে অন্য একটা অনুষ্ঠান হতে চলেছে। অথচ সবার সঙ্গেই দেখাসাক্ষাৎ, কথাবার্তা হত। পরপর দুটো ঘটনা ঘটে যাওয়ায় দাদুর একটা হার্ট অ্যাটাক হয়। কিন্তু হেমন্তবাবুর সঙ্গে পঙ্কজকুমার মল্লিকের সম্পর্ক এমন ছিল না যাতে দু’জনের মধ্যে ঝগড়াঝাঁটি হতে পারে। হেমন্তবাবু ওঁর সন্তানতুল্য ছিলেন। তাই দাদুর একটা ক্ষোভ থেকে থাকতে পারে, হেমন্তবাবু সব জেনেও ওঁকে কিছু জানাননি। কিন্তু ঝগড়া বা তর্কাতর্কি কিছুই হয়নি। হেমন্তবাবুও কখনওই দাদুর প্রতি অশ্রদ্ধা দেখাননি। আসলে এই বিষয়টা এতটাই জটিল যে এক কথায় উত্তর দেওয়া সম্ভব নয়।’’
প্রান্তবেলায় সন্তান হারানোর মতো এ শোক ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছিল গানসাধক প্রবীণ মানুষটিকে।
এও কি তাঁর পাওনা ছিল!
(তথ্যসূত্র:
১- আমার যুগ – আমার গান, পঙ্কজ কুমার মল্লিক, কলকাতা ফার্মা কে এল এম প্রাইভেট (২০১২)।
২- আনন্দবাজার পত্রিকা, ৩রা অক্টোবর ২০১৫ সালে প্রকাশিত দুটি প্রবন্ধ।
৩- আনন্দবাজার পত্রিকা, ১০ই ফেব্রুয়ারি ২০১৯ সাল।
৪- আনন্দবাজার পত্রিকা, ২০শে সেপ্টেম্বর ২০১৪ সাল।
৫- https://m.femina.in/…/the-life-and-times-of-pankaj-kumar-mu…)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত