১৯৫২ সালের ৭ই মার্চ এই যোগী আমেরিকায় যখন দেহত্যাগ করেন তখন ভারতবর্ষ থেকে প্রতিনিধি পাঠানো এবং আরও কিছু প্রশাসনিক কারণে তাঁর মরদেহ সমাধিস্থ করতে যথেষ্ট দেরি হয়ে যায়। ২০ দিন তাঁর মরদেহ কোন রাসায়নিকের ব্যবহার ছাড়াই শায়িত ছিল এবং অবশেষে ২৭শে মার্চ তাঁর দেহ যখন কফিন-বন্দী করা হয় তখনও সেটি ছিল সম্পূর্ণ সজীব ও অবিকৃত। এটা একটা অভূতপূর্ব এবং আশ্চর্য জনক ঘটনা। এর ফটোগ্রাফও রয়েছে। সেখানে যোগানন্দের মরদেহ যারা নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করেছেন সে চিকিৎসক বিশেষজ্ঞদের রিপোর্টের কিয়দংশ এখানে উধৃত করছি:
“…… The physical appearance of Paramhansa Yogananda on March 27th, just before the bronze cover of the casket was put in position, was the same as it had been on March 7th. He looked on March 27th as fresh and as unravaged by decay as he had looked on the night of his death. On March 27th there was no reason to say that his body had suffered any visible physical disintegration at all. For these reasons we state again that the case of Paramhansa Yogananda is unique in our experience.”
ফিরে যাওয়া যাক আরও পিছনে।
মহাসমুদ্রের ঢেউ কেটে এগিয়ে চলেছে একটা জাহাজ। ‘সিটি অব স্পার্টা’। ভারতবর্ষ থেকে যাত্রা শুরু, গন্তব্য আমেরিকার বোস্টন বন্দর। ১৯২০ সালের অগস্ট, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ভারত থেকে আমেরিকার পথে সেটাই প্রথম যাত্রীবাহী জাহাজ।
জাহাজে দেশি-বিদেশি অসংখ্য যাত্রীর ভিড়ে আছেন এক সন্ন্যাসীও। বয়স সাতাশ, উজ্জ্বল মুখ। সহযাত্রীদের এক জন আবিষ্কার করলেন, তরুণ সন্ন্যাসীর গন্তব্য বস্টনের ‘ইন্টারন্যাশনাল কংগ্রেস অব রিলিজিয়াস লিবার্যালস ইন আমেরিকা’, সেখানে তিনি ভারতের প্রতিনিধিত্ব করবেন। এত বড় অনুষ্ঠানে তো খানকয়েক বক্তৃতা দিতেই হবে, এখনই, এই সুদীর্ঘ জলযাত্রায় একটু মকসো করে নিলে কেমন হয়? সহযাত্রীটি চেপে ধরলেন, রটিয়েও দিলেন জাহাজে, সন্ন্যাসী রাতে বক্তৃতা দেবেন, বিষয় ‘জীবনযুদ্ধ ও তা জয়ের উপায়’।
ইংরেজিতে বক্তৃতা, ভাব ও ভাষা দুটোই গুছিয়ে নিতে হবে বইকী। সন্ন্যাসী দেখলেন, ভাবনাগুলোই আসছে না, ভাষায় তাদের বাঁধবেন কী! বহু চেষ্টার পর হাল ছেড়ে দিয়ে, গুরুর আশ্বাসবাক্য স্মরণ করে দাঁড়ালেন শ্রোতাদের সামনে। কিন্তু মুখে কথা সরে না। এক মিনিট, দু’মিনিট করে পেরোল দশ মিনিট, শ্রোতামহলের উসখুস, ফিসফিস তখন হাসাহাসিতে ঠেকেছে। খুব রাগ হল, সঙ্গে দুঃখ, অভিমান। নীরবে প্রার্থনা করছেন, মনের মধ্যে কে যেন বলে উঠল, পারবে, তুমি পারবে। মুখ খুলতেই, ভাব-ভাষা দুই-ই অনায়াসে বেরিয়ে এল ভিতর থেকে। কোথা দিয়ে কেটে গেল পঁয়তাল্লিশ মিনিট! শ্রোতারা তখন উচ্ছ্বসিত, আরও শুনতে চান তাঁরা!
এই তরুণ সন্ন্যাসীই যোগানন্দ। পরমহংস যোগানন্দ।
শ্রী নরেন্দ্রনাথ দত্ত বা স্বামী বিবেকানন্দের পরে বিশ্ব জয় করা আরেক বাঙালি, শ্রী মুকুন্দলাল ঘোষ।
ভারত ও পাশ্চাত্যে ‘যোগদা সৎসঙ্গ সোসাইটি অব ইন্ডিয়া’ ও ‘সেল্ফ রিয়্যালাইজেশন ফেলোশিপ’ সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা, পাশ্চাত্যে ‘ক্রিয়াযোগ’ প্রচার-প্রসারের প্রধান মুখ।
এই যুগে বিশ শতকের যোগগুরু আর তাঁর জীবনদর্শনের স্থান কোথায়?
যিনি বলেছিলেন, তাঁর কাজ নতুন কিছু নয়— ভারতজীবনেরই অন্তরসম্পদ যে যোগসাধনা, তাকেই ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়া ছাড়া; যে জিনিস ঘরেই আছে অথচ খবর নাই, তাকেই একটু চিনিয়ে দেওয়া ছাড়া!
১৮৯৩-এ শিকাগোর ধর্মমহাসম্মেলনে হিন্দুধর্মের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ। বাকি ইতিহাস বেদান্তের বিশ্বজয়ের ইতিহাস। আর সেই বছরেই উত্তরপ্রদেশের গোরক্ষপুরে জন্মালেন মুকুন্দলাল ঘোষ। চার ভাই চার বোনের সংসারে দ্বিতীয় পুত্র। বাবা বেঙ্গল নাগপুর রেলওয়ের বড় পদে ছিলেন, চাকরিসূত্রে ভারতের নানান শহরে ঘুরতে হয়েছে পরিবারটিকে।
যে শহরেই বদলি হন, সেখানেই বাড়ির ঠাকুরঘরে ফ্রেমে বাঁধানো একখানা ছবি থাকত— ‘লাহিড়ীমশাই’, যোগীরাজ শ্যামাচরণ লাহিড়ীর ছবি। মুকুন্দের বাবা তাঁর মন্ত্রশিষ্য ছিলেন।
শৈশব থেকেই মায়ের সঙ্গে ঠাকুরঘরে বিভোর বসে থাকত শিশুটি, একা থাকলেই ডুবে যেত তন্ময় নীরবতায়। গোরক্ষপুরের বাড়ির উঠোনে এক দিন দিদি উমা তাঁর পায়ে একটা ফোড়া হয়েছে বলে মলম লাগাচ্ছেন, মুকুন্দও খানিকটা নিয়ে হাতে লাগাল, ‘‘দেখ দিদি, আমার মনে হচ্ছে কাল আমার হাতে একটা ফোড়া বের হবে। যে জায়গায় ফোড়াটা বেরোবে, সেইখানে তোমার মলমটা লাগিয়ে দেখছি।’’ দিদি তো হেসে কুটিপাটি, মিথ্যুক কোথাকার! মুকুন্দ রেগে বলল, ‘‘খবরদার আমায় মিথ্যুক বোলো না, আমার অন্তরের প্রবল ইচ্ছাশক্তি জোরেই আমি বলছি যে, কাল আমার হাতে ঠিক এই জায়গাটিতেই বেশ বড়গোছের একটি ফোড়া বেরোবে, আর তোমার ফোড়াটি এই সাইজের ঠিক ডবল হয়ে ফুলে উঠবে, দেখো।’’ পর দিন সকালে দেখা গেল, ঠিক তা-ই হয়েছে। দিদি ছুটে গিয়ে মা’কে সব জানাতে, তিনি গম্ভীর হয়ে মুকুন্দকে বলেছিলেন, আজ থেকে জীবনে কারও ক্ষতি করার জন্য কোনও বাক্যের শক্তির অপব্যবহার কোরো না।
অলৌকিক? কাকতালীয়?
‘অটোবায়োগ্রাফি অব আ যোগী’ বা ‘যোগিকথামৃত’-বইয়ের পাতায় পাতায় আশ্চর্য এক জীবনকথা। রামকৃষ্ণকথামৃতের পাতায় মাস্টারমশাই ‘শ্রীম’ লিখে গিয়েছেন বিভূতি, সিদ্ধাইয়ের প্রতি দক্ষিণেশ্বরের ‘পাগলা বামুন’-এর বিরাগ-বিতৃষ্ণার কথা। মুকুন্দ— যাঁকে স্কটিশ চার্চ বা শ্রীরামপুর কলেজের সহপাঠীরা ‘পাগলা সন্ন্যাসী’ বলে ডাকত— সাধনমার্গের পথে চলতে চলতে সেও মুখোমুখি লোকচক্ষুতে ব্যাখ্যাতীত সব ঘটনার, দর্শনের। মৃত্যুর আগে তাঁর মা লিখে রেখে গিয়েছিলেন কাশীর লাহিড়ীমশাইয়ের কথা, দুধের শিশু মুকুন্দকে দেখে যিনি বলেছিলেন, তোমার ছেলে এক জন যোগী হবে, আধ্যাত্মিক ইঞ্জিনের মতো বহু লোককে টেনে নিয়ে যাবে। লাহিড়ীমশাইয়েরও গুরু বাবাজি মহারাজ বলে গিয়েছিলেন মুকুন্দের গুরু শ্রী যুক্তেশ্বর গিরিকে, উপযুক্ত এক শিষ্য আসছে তোমার, যে ক্রিয়াযোগ শিখে, কালে পশ্চিমে যাবে এই দর্শন প্রচার করতে। সেই শিষ্যই মুকুন্দ তথা যোগানন্দ! তাঁর জীবন ও কাজের ধারাও পূর্বনির্দিষ্ট!
ক্রিয়াযোগই গুরুপরম্পরায় বয়ে আসা সেই দর্শন, যার প্রচারে যোগানন্দ আমেরিকা জয় করলেন। এ এক শারীরমনস্তাত্ত্বিক প্রণালী, যার দ্বারা ‘‘শরীরের রক্ত অঙ্গারশূন্য হয়ে অম্লজান দ্বারা প্রতিপূরিত হয়। এই অতিরিক্ত অম্লজানের পরমাণু প্রাণধারায় রূপান্তরিত হয়ে মস্তিষ্ক আর মেরুদণ্ডের কেন্দ্রগুলিকে সঞ্জীবিত করে।’’ যোগী ক্রমশ শরীরের ক্ষয় হ্রাস বা নিবারণ করতে পারেন। ক্রিয়াযোগ চর্চায় আরও এগিয়েছেন যিনি, তিনি শরীরকোষগুলিকে রূপান্তর করতে পারেন শক্তিতে। অর্থাৎ, সাধক মহাপুরুষদের জীবনচরিত যেমন ইচ্ছেমতো আবির্ভাব বা অদৃশ্য হওয়ার ‘অলৌকিক’ কাহিনিতে ভরপুর, সেই জিনিস হতে পারে এই যোগসহায়েই! ক্রিয়াযোগ সাধনে যোগী মুক্ত হতে পারেন কার্য-কারণের শেকল থেকে, অন্য যে কোনও মানুষের মন বা চিন্তার সঙ্গে মিলিয়ে দিতে পারেন নিজেকে। কিন্তু এহ বাহ্য, আসল ও শেষ কথা, ক্রিয়া-প্রক্রিয়া-অনুষ্ঠানাদির পারে পরমাত্মার সঙ্গে ‘যোগ’।
সংসারেই সন্ন্যাসী, যোগীরাজ শ্যামাচরণ ক্রিয়াযোগের শিক্ষা পেয়েছিলেন তাঁর গুরু বাবাজি মহারাজের থেকে। তখন তিনি দুই সন্তানের পিতা, ইংরেজ সরকারের সামরিক পূর্ত বিভাগের হিসাবরক্ষকের চাকরি করেন। হিমালয়ের অন্তরাল থেকে যোগ এল ঘরে ঘরে, লাহিড়ীমশাইয়ের হাত ধরে।
সেই যোগকেই বিদেশে, বিশ্বের দরবারে প্রতিষ্ঠা দিলেন মুকুন্দ তথা যোগানন্দ। মাঝখানে আর একটি সেতু, তিনি যোগানন্দের গুরু, লাহিড়ীমশাইয়ের শিষ্য শ্রী যুক্তেশ্বর গিরি।
শ্যামাচরণ লাহিড়ির শিষ্য যুক্তেশ্বর গিরিজি খুবই উচ্চমার্গের ক্রিয়াযোগ সাধক ছিলেন। পুরীর স্বর্গদ্বারে রয়েছে তাঁর সমাধি মন্দির।
শ্রীরামপুর নিবাসী এই সন্ন্যাসীর সঙ্গে যোগাযোগও অদ্ভুত ঘটনা। স্কুলবেলা থেকেই মুকুন্দ জানেন, গুরুর সন্ধান পাবেন তিনি কোনও এক দিন। যেখানে সাধুসন্তের খোঁজ পান ধেয়ে যান। সবাই ফিরিয়ে দেন, আমরা নই, তোমার গুরু তোমার অপেক্ষায় আছেন, কালে দেখা হবে। শ্রীরামপুরে নয়, দেখা হল কাশীতেই। প্রথম সাক্ষাতে দুজনেই ভাবস্থ। স্বয়ং গুরু শিষ্যকে বলেছিলেন, আমি তোমাকে আমার নিঃস্বার্থ ভালবাসা দিলাম, আর তুমি যদি আমাকেও কখনও ভগবদ্বিচ্যুত হতে দেখো, তা হলে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করবে, প্রতিজ্ঞা করো! শ্রীরামপুর আশ্রমে কঠোরে-কোমলে গুরু তাঁকে শেখান আশ্রমের কাজ, সঙ্গে ধ্যান, সাধনা। বুঝিয়ে দেন গীতার ‘সংপ্রেক্ষ্য নাসিকাগ্রং’-এর আসল অর্থ: নাসিকাগ্রং মানে মোটেই ‘নাকের ডগা’ নয়, সাধুকে ওখানে দৃষ্টি স্থির করে ট্যারা হওয়ার উপদেশ দেওয়া হচ্ছে না। ‘নাসিকাগ্রং’ অর্থ নাসামূল, দুই ভ্রুর মধ্যস্থল— আধ্যাত্মিক দৃষ্টির স্থান। এই সন্ন্যাসী বলেন, সাধু মানে বোবা, অকর্মণ্য হয়ে থাকা নয়, অন্যকেও উঠিয়ে আনতে হবে, দিতে হবে নিজের পাওয়া আনন্দের স্বাদ। মুকুন্দ সারা দিন আশ্রমে পড়ে থাকতেন, গুরুই তাঁকে বলেন পড়াশোনা করতে হবে, আই এ, বি এ পাশ করতে হবে। কেন? কারণ তাঁকে পশ্চিমে যেতে হবে, ওখানকার মানুষ সাধুকে শিক্ষিত না দেখলে তাঁর কথা শুনবে কেন?
‘অটোবায়োগ্রাফি অব আ যোগী’ শুধুই এক আত্মকথন নয়। নিজে কী হলাম, কী পেলাম, তার খতিয়ান নয়। শুরুর দিকের অধ্যায়গুলি বিবিধ সাধু-সংবাদে পূর্ণ। ‘দুই দেহধারী সাধু’ প্রণবানন্দ, ইচ্ছেমতো যে কোনও সুগন্ধে চারপাশ ভরিয়ে দিতে পারা ‘গন্ধবাবা’, ভবানীপুরের সোহহং স্বামী, আপার সার্কুলার রোডের লঘিমাসিদ্ধ সাধু ‘ভাদুড়ীমশাই’— সবার সঙ্গে সাক্ষাৎ ও কথোপকথনের বিবরণ লিখে গিয়েছেন যোগানন্দ। তাঁর বর্ণনায় ভাল-মন্দ, আসল-গাঁজাখুরির ভ্যালু জাজমেন্ট নেই, এক আশ্চর্য নৈর্ব্যক্তিকতা আছে। সাধুদের কীর্তিবর্ণনায় তিনি অযথা তরল বা গম্ভীর, কোনওটাই হন না। বরং পাঠককে বলতে চান, মানো না মানো, এই সব কিছুই ভারতের বহু সাধকের বহু সাধনার ধারা। কেউ প্রায়-অলৌকিক শক্তি প্রদর্শন করবেন, আবার কেউ দৈনন্দিন সাংসারিকতার মধ্যে থেকেও লুকিয়ে রাখবেন বিপুল অধ্যাত্ম-ঐশ্বর্য। রামকৃষ্ণকথামৃতের রচয়িতা ‘মাস্টারমশাই’ মুকুন্দকে নিয়ে দক্ষিণেশ্বর ঘুরিয়ে দেখান, আবার ইউনিভার্সিটি বিল্ডিংয়ের সামনে ফুটপাতে হঠাৎ-স্পর্শে দেখান ‘জীবন্ত বায়োস্কোপ’, সেখানে কলকাতার কর্মচঞ্চল পথচারী, মোটর, ট্রামগাড়ি মুহূর্তে নিঃশব্দ হয়ে পথ চলতে থাকে।
শুধু কি সাধু-সন্ন্যাসী?
কলকাতায় মুকুন্দদের বাড়ির ঠিকানা ছিল ৪ নং গড়পার রোড, অনতিদূরে ছিল ১০০এ গড়পার রোডে উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর বাড়ি, যে বাড়িতে মৃত্যুশয্যায় শায়িত সুকুমার রায়কে এসে দেখে গিয়েছিলেন, গান শুনিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আবার কাছেই আচার্য জগদীশচন্দ্র বসুর বাড়ি, সেখানেও বিজ্ঞানীকে দেখতে গিয়েছিলেন তরুণ মুকুন্দ। প্রবীণ বিজ্ঞানী তাঁকে ল্যাবরেটরিতে এসে তাঁর আবিষ্কৃত ক্রেস্কোগ্রাফ দেখে যেতে বলেছিলেন। প্রেসিডেন্সি কলেজ ছেড়ে জগদীশচন্দ্র স্থাপনা করলেন বসু বিজ্ঞান মন্দির, সেই উদ্বোধন-অনুষ্ঠানেও গিয়েছিলেন মুকুন্দ। বিশদে লিখে গিয়েছেন বিজ্ঞানীর সে দিনের ভাষণ, ‘অটোবায়োগ্রাফি অব আ যোগী’ বইয়েই। পরেও গিয়েছিলেন তাঁর কাছে, দেখেছিলেন ফার্নের গায়ে ক্রেস্কোগ্রাফ লাগিয়ে দেওয়ার পর পর্দায় তার ধীর অথচ সুস্পষ্ট বেড়ে ওঠা, ক্লোরোফর্ম প্রয়োগে তার থেমে যাওয়া, তীক্ষ্ণ অস্ত্রের আঘাতে তার যন্ত্রণায় স্পন্দিত হওয়া।
অনেক পরে যখন মুকুন্দ যখন সন্ন্যাস নিয়ে যোগানন্দ হয়েছেন, রাঁচীতে তৈরি করেছেন যোগদা সৎসঙ্গ ব্রহ্মচর্য বিদ্যালয়, তখন এই কলকাতাতেই এক দিন রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর পরিচয় করিয়ে দেন সি এফ অ্যান্ড্রুজ। কবির আমন্ত্রণে শান্তিনিকেতনেও যান যোগানন্দ, যোগ অভ্যাসের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মনঃসংযোগের প্রক্রিয়া তাঁর কাছে শুনেছিলেন রবীন্দ্রনাথ।
আমেরিকা থেকে ভারতে ফেরার পর ১৯৩৫ সালে ওয়ার্ধাতে গান্ধীজির আশ্রমেও আমন্ত্রিত হয়েছিলেন যোগানন্দ। চমৎকার সেই অনুপুঙ্খ বর্ণনা। মহাত্মার মৌনব্রত, তাঁর খাওয়ার বর্ণনা, সরল আশ্রমিক জীবন, গো-পালন, সব কিছু লিখে গিয়েছেন যোগানন্দ। রাতে শোওয়ার আগে সাধুর হাতে এক শিশি লেবুর তেল দিয়ে হেসে বলেছিলেন গান্ধীজি, ‘‘ওয়ার্ধার মশারা অহিংসাটহিংসা মানে না, একটু সাবধান হয়ে শোবেন।’’ গান্ধীজি ও তাঁর কয়েক জন শিষ্য যোগানন্দের কাছে ক্রিয়াযোগে দীক্ষা গ্রহণ করেছিলেন, মহাত্মার কথায় টাউন হল-এ চারশো লোকের সামনে বক্তৃতাও দিয়েছিলেন যোগানন্দ।
১৯১৫ সালে সন্ন্যাস, তার দু’বছর পর গুরুর কথায় ‘সংগঠনের কাজ’ শুরু করেন যোগানন্দ। ছোট্ট এক গ্রামে সাতটি মাত্র ছেলেকে নিয়ে শুরু হয়েছিল বিদ্যালয়, ১৯১৮ সালে কাশিমবাজারের মহারাজার দাক্ষিণ্যে সেই বিদ্যালয় গেল রাঁচীতে। সেও একশো বছর পেরিয়েছে। ‘ইয়োগা’ থেকে ‘হট যোগা’ নিয়ে মাতামাতির এই যুগে মনে রাখলে ভাল, তিনিই প্রথম ভারতীয় যোগশিক্ষক যিনি জীবনের বহুলাংশ কাটিয়েছেন আমেরিকার মাটিতে। লব্ধপ্রতিষ্ঠ বহু বিদেশি নারীপুরুষ শিষ্যত্ব নিয়েছিলেন তাঁর। মার্ক টোয়েনের মেয়ে, সুগায়িকা ক্লারা ক্লেমেন্স গ্যাব্রিলোউইশ, অ্যালিস হেসি (‘যোগমাতা’, সেল্ফ রিয়্যালাইজেশন ফেলোশিপের প্রথম সন্ন্যাসিনী), লরি প্র্যাট (তারামাতা), ব্যবসায়ী জেমস লিন (জনকানন্দ)— তালিকা সুদীর্ঘ।
যোগানন্দ পাশ্চাত্যে ক্রিয়াযোগ প্রচারের জন্য ১৯২০ সালে আমেরিকা চলে যান এবং ১৯২৫ সালে ক্যালিফোর্ণিয়ার লস এ্যঞ্জেলসে Self-Realisation Fellowship (SRF)-এর আন্তর্জাতিক সদর দপ্তরের প্রশাসনিক ভবন স্থাপন করেন। দ্রোনগিরির কাছে অবস্থিত ‘লাহিড়ী মহাশয়ের গুহা’ এই SRF-এর উদ্যোগেই প্রচার লাভ করেছে।
দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের কাছে গঙ্গাতীরে এক প্রশান্ত পরিবেশে ১৯৩৯ সালে যোগানন্দ কর্তৃক স্থাপিত হয়েছিল যোগদা সৎসঙ্গ সোসাইটির (YSS) ভারতের রেজিস্টার্ড অফিস। সেখানে রয়েছে যোগদা মঠ। এটি সর্বসাধারণের জন্য মুক্ত। এখানে ধ্যানকক্ষের নিবিড় শান্ত পরিবেশে কিছুক্ষণ কাটালে মন বিক্ষেপ মুক্ত হয়ে আপনিই স্থির হয়ে আসে।
তাঁর মৃত্যুও অদ্ভুত সহজ। ১৯৫২ সালের ৭ই মার্চ লস অ্যাঞ্জেলেসে ভারতীয় রাষ্ট্রদূত বিনয়রঞ্জন সেনের আয়োজিত নৈশভোজে বক্তৃতা দিলেন ভারত-আমেরিকা মৈত্রী ও বিশ্বশান্তি নিয়ে, নিজের লেখা কবিতা থেকে পড়লেন, ‘যেখানে গঙ্গা, অরণ্য, হিমালয়ের গুহাকন্দর ও মানুষ ঈশ্বরকে খোঁজে, আমি ধন্য, ছুঁয়েছি সেই মাটি!’ ভ্রু-মধ্যে উত্থিত দৃষ্টি, তার পরেই ঢলে পড়ল প্রবাসে ভারতীয় যোগের অঘোষিত ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডরের শরীর।
শরীর গিয়েছে, রয়ে গিয়েছে তাঁর সাধন। ‘বিটলস’ ভারতে এলে জর্জ হ্যারিসনের হাতে রবিশংকর তুলে দিয়েছিলেন যোগানন্দেরই বই। স্টিভ জোবস নাকি ভারতবর্ষকে জেনেছিলেন ‘অটোবায়োগ্রাফি অব আ যোগী’ পড়েই। ২০১১-তে মৃত্যুর পর তাঁর স্মরণসভায় উপস্থিত সবার জন্য ‘শেষ উপহার’ ছিল এই বই, জোবসেরই ইচ্ছানুযায়ী! সংগঠনের বহতা ধারার সমান্তরালে এও তো এক প্রভাব-পরম্পরা!
(তথ্যসূত্র:
১- যোগী কথামৃত (অটোবায়োগ্রাফি অব এ যোগী), পরমহংস যোগানন্দ, যোগদা সৎসঙ্গ সোসাইটি অফ ইন্ডিয়া (২০১৫)।
২- Autobiography of a Yogi, Paramhansa Yogananda, English version, Yogoda Satsanga Society Of India (২০১৫)।
৩- How To Achieve Glowing Health And Vitality: The Wisdom Of Paramhansa Yogananda, Paramhansa Yogananda (২০১২)।
৪- Karma and Reincarnation, Paramhansa Yogananda, Ananda Sangha Publications (২০০৮)।
৫- Spiritual Relationships: The Wisdom of Yogananda, Paramhansa Yogananda, Crystal Clarity Publishers (২০০৭)।
৬- আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৭ই জুন ২০১৮ সাল।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত