বেজে উঠেছে আলোর বেণু। আগমনীর সুরে মাতছে ভুবন৷ নীলাকাশে ভেসে চলা সাদা মেঘের ভেলাগুলি ও মাঠে-ঘাটে ফুটে থাকা কাশ ফুলেরা মাথা দুলিয়ে জানান দিচ্ছে যে আর মাত্র দিনকয়েকের অপেক্ষা। তারপরেই ঘরে ফিরবে ঘরের মেয়ে। ঢাকে কাঠি পড়বে বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব শারদোৎসবের। ফলে স্বাভাবিকভাবেই শহর কলকাতার ছোট-বড় সব পুজোর শিল্পীরাই এখন ব্যস্ত তাদের মন্ডপ ও প্রতিমায় ফাইনাল টাচ দিতে। ব্যস্ততা চরমে উত্তর কলকাতার অন্যতম বড় পুজো আহিরীটোলা সর্বজনীনেও। বর্তমান কালে এক জ্বলন্ত সমস্যা পানীয় জল। যা আজ নিঃশেষের মুখে। জ্ঞানত বা অজান্তে জল অপচয় করে আমরা নিজেরাই সভ্যতাকে বিনাশের পথে ঠেলে দিচ্ছি না তো? এবার সরাসরি এই প্রশ্ন তুলেই ৮০ তম বর্ষে আহিরীটোলার থিম ‘অজান্তে’।
অজান্তে তো আমরা কত কিছুই হারিয়ে ফেলি এবং পরে তার জন্য ভুক্তভোগী হতে হয়। এরই এক জলজ্যান্ত উদাহরণ হল ‘পানীয় জল’। দুর্গাপুজো বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব। প্রতিবছর শরতেই এ সময় মায়ের মর্ত্যে আগমন ঘটে অশুভ শক্তির নাশ করে শুভ শক্তি প্রদানের জন্য। তাই এবছর মানবজাতির অজান্তে হওয়া অসচেতনতা যাতে মায়ের আশীর্বাদে সচেতনতায় পরিবর্তিত হয়, সেই প্রয়াসই নিয়েছেন আহিরীটোলা সর্বজনীনের এবারের থিম শিল্পী তন্ময় চক্রবর্তী। যাঁকে মূলত বাংলা ছবির আর্ট ডিরেক্টর হিসেবেই একডাকে সকলে চেনে। তাঁর পরিকল্পনা ও রূপায়নে এবার খোদ আহিরীটোলায় মাথা তুলবে গুজরাতের পাটনের বিখ্যাত ‘রানি কি ভাভ’। এর মাধ্যমে যথেচ্ছাচারে জল অপচয় বন্ধ করে, কীভাবে জল সঞ্চয় করতে হয় এবার সেটাই দেখাবেন শিল্পী।
এই ‘রানি কি ভাভ’ হল সরস্বতী নদীর তীরে অবস্থিত একটি কূপ। একাদশ শতাব্দীর তৎকালীন রানি উদয়মতীর তৎপরতায় ৭টি ধাপে নির্মিত বৃহদাকার এই নির্মাণটি জল সংরক্ষণের এক উল্লেখযোগ্য উদাহরণ। কারণ কূপটি এইভাবেই নির্মিত, যাতে জল মাটির তলায় নেমে গেলেও মানুষ সিঁড়ি বেয়ে নীচে নেমে জল তুলে আনতে পারে। শিল্পী তন্ময় চক্রবর্তী এখন খবরকে বলেন, “আমাদের এবারের থিম ‘অজান্তে’। আমার মাথায় এই ভাবনাটি এসেছিল ডিসেম্বরে। তবে জুন-জুলাই মাস নাগাদ অজান্তেই আমার কল্পনার সঙ্গে মিলে যায় বাস্তবের ছবিটা। যখন সামনে আসে ভারত-তথা গোটা বিশ্বেই জলস্তর ক্রমাগত নেমে যাচ্ছে। জলের জন্য হাহাকার করছে মানুষ। এই পরিস্থিতিতে বিজ্ঞানীরা বলছেন, এই মুহূর্তে যত বেশি জল সঞ্চয় করা সম্ভব হবে, তত বেশি সুরক্ষিত হবে ভবিষ্যৎ।”
এরপরই নিজের থিম সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি জানান, “আমার এই থিমটা গুজরাতের এমন একটা কূপ, বলা ভাল এমন একটা স্থাপত্য নিয়ে, ১১ শতকে যা তৈরির পিছনে এই ভাবনা ছিল যে, ভবিষ্যতে পৃথিবীর বুকে জল সংকট দেখা দিলেও রাজ্যের প্রজাদের যাতে জলের কষ্ট না থাকে। এখানে আমার ‘রানি কী ভাভ’-এর আদলে মন্ডপ করার উদ্দেশ্য মানুষকে এই বার্তা দেওয়া যে, ভবিষ্যতের কথা ভেবে জল জমিয়ে রাখুন। অজান্তে বা অবহেলায় জল নষ্ট করবেন না। যাতে আমাদের পরের প্রজন্ম জল পেয়ে বেঁচে থাকতে পারে।” কীভাবে সেই একাদশ শতাব্দীতে জল সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছিলেন রানি, নিজের চোখে তা প্রত্যক্ষ করতে যে এই একবিংশ শতাব্দীতে আহিরীটোলার ‘রানি কি ভাভ’-এ লাইন দেবেন দর্শনার্থীরা, সে কথা হলফ করে বলা যায়।