৩০শে জুন ১৯৩১ সাল।
ফাঁসির সাত দিন আগে আলিপুর সেন্ট্রাল জেল থেকে তাঁর মা কে তিনি চিঠিতে লেখেন,
“মা,
যদিও ভাবিতেছি কাল ভোরে তুমি আসিবে, তবু তোমার কাছে না লিখিয়া পারিলাম না।
তুমি হয়তো ভাবিতেছ, ভগবানের কাছে এত প্রার্থনা করিলাম, তবুও তিনি শুনিলেন না! তিনি নিশ্চয় পাষাণ, কাহারও বুক-ভাঙা আর্তনাদ তাঁহার কানে পৌঁছায় না।
ভগবান কি আমি জানি না, তাঁহার স্বরূপ কল্পনা করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু তবু এ-কথাটা বুঝি, তাঁহার সৃষ্টিতে কখনও অবিচার হইতে পারে না। তাঁহার বিচার চলিতেছে। তাঁহার বিচারের উপর অবিশ্বাস করিও না, সন্তুষ্ট চিত্তে সে বিচার মাথা পাতিয়া নিতে চেষ্টা কর। কি দিয়া যে তিনি কি করিতে চান, তাহা আমরা বুঝিব কি করিয়া?
মৃত্যুটাকে আমরা এত বড় করিয়া দেখি বলিয়াই সে আমাদিগকে ভয় দেখাইতে পারে। এ যেন ছোট ছেলের মিথ্যা জুজুবুড়ির ভয়।
যে মরণকে একদিন সকলেরই বরণ করিয়া লইতে হইবে, সে আমাদের হিসাবে দুই দিন আগেয়াসিল বলিয়াই কি আমাদের এত বিক্ষোভ, এত চাঞ্চল্য?
যে খবর না দিয়া আসিত, সে খবর দিয়া আসিল বলিয়াই কি আমরা তাহাকে পরম শত্রু মনে করিল? ভুল, ভুল-মৃত্যু ‘মিত্র’ রূপেই আমার কাছে দেখা দিয়াছে। আমার ভালোবাসা ও প্রণাম জানিবে।
– তোমার নসু
আলিপুর সেন্ট্রাল জেল
৩০. ৬. ৩১. কলিকাতা।”
১৯৩১ সালের ৭ জুলাই।
ফাঁসির তারিখে তিনি ভোরবেলা স্নান করে ফাঁসির পোশাক পরলেন। অতঃপর হাসতে হাসতে সার্জেন্টকে বললেন,
“এবার যাওয়া যেতে পারে।”
ধীর গম্ভীর পদক্ষেপে ফাঁসিমঞ্চের দিকে অগ্রসর হলেন মৃত্যুঞ্জয়ী।
ফাঁসির মঞ্চে উপস্থিত করার আগে সার্জেন্ট তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, “তোমার কিছু বলার আছে কি বন্দি?”
তিনি উত্তর দিলেন,
“প্লিজ স্টপ। আমাদের বলার অধিকার যে কারা কেড়ে নিয়েছে, সে কথা তোমরাই ভাল জান। ডু ইওর ডিউটি, আই এম রেডি।”
কয়েক মুহূর্ত পরে তিনি ফাঁসির মঞ্চে উঠে নিজ হাতে ফাঁসি-রজ্জু গলায় পরেন।
তাঁর উচ্চ কণ্ঠের ‘বন্দেমাতরম’ ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে ওঠে কারাগার।
‘বন্দেমাতরম’ বলতে বলতে ফাঁসিরজ্জুতে তাঁর শেষ নিঃশ্বাস থমকে যায়। সেই সাথে নিভে যায় তাঁর জীবন প্রদীপ।
বিপ্লবী দীনেশ গুপ্ত।
ফাঁসির দণ্ড কার্যকর করার সময় তাঁর বয়স ছিল মাত্র ১৯ বছর ৭ মাস ১ দিন।
অগ্নিযুগের সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনের সূচনা থেকেই ঢাকার অনুশীলন সমিতি, যুগান্তর পার্টি, চট্টগ্রামের দি ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি, বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স, মালামার বিপ্লবী দল, কলকাতার অনুশীলন সমিতি, মেদিনীপুর বিপ্লবী দল, বিপ্লবী কমিউনিস্ট সংগঠন, স্বরাজ পার্টিসহ অন্যান্য বিপ্লবী দল স্বাধীনতা সংগ্রামে সবচেয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। এসব দলের অসংখ্য বিপ্লবী সদস্যরা ভারতমাতার স্বাধীনতার জন্য জীবন বলিদানের মন্ত্র সানন্দে গ্রহণ করেন এবং তাদের মধ্যে অনেকেই জীবন উৎসর্গ করেন। বিপ্লবী দীনেশ গুপ্তও এই জীবন উৎসর্গকারীদের একজন।
বিপ্লবী দীনেশ গুপ্ত জন্মেছিলেন ১৯১১ সালের ৬ই ডিসেম্বর (বাংলা ১৩১৮ সনের ২০ অগ্রহায়ণ)। তৎকালীন অবিভক্ত বঙ্গের ঢাকা জেলার (বর্তমান মুন্সিগঞ্জ জেলা) যশোলঙে। তাঁর পিতার নাম ছিল সতীশচন্দ্র গুপ্ত। আর মা ছিলেন বিনোদিনী দেবী। ছোটবেলায় দীনেশ গুপ্তের ডাকনাম ছিল ‘নসু’। চার ভাই ও চার বোনের মধ্যে দীনেশ গুপ্ত ছিলেন বাবা-মা’র তৃতীয় সন্তান।
দীনেশ গুপ্তের পিতা সতীশচন্দ্র ছিলেন ডাক বিভাগের কর্মচারী। চাকুরি সূত্রে তিনি একবার পরিবার নিয়ে বেশ কিছুদিন গৌরীপুরে ছিলেন। গৌরীপুরেই দীনেশ গুপ্ত একটি পাঠশালাতে পড়াশুনার হাতেখড়ি নেন। এরপর তাঁরা পিতার চাকুরির কারণে ঢাকায় বদলি হয়ে আসেন। তখন দীনেশ গুপ্ত নয় বছরে পা দিয়েছেন।
ঢাকায় আসার পর তাঁকে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি করানো হয়। এসময় দীনেশ গুপ্ত ঢাকার গেন্ডারিয়া অঞ্চলে তাঁর দাদুর বাড়িতে বসবাস করতেন। কিছুদিন পর পৈত্রিক বাসভবন ওয়ারীতে চলে আসেন।
ছোটবেলা থেকেই দীনেশ গুপ্ত ছিলেন নির্ভীক ও দুরন্ত প্রকৃতির। পড়াশুনার পাশাপাশি খেলাধুলায়ও পারদর্শী ছিলেন তিনি। স্কুলজীবন থেকেই দীনেশ গুপ্ত স্বদেশপ্রেম ও রাজনীতির বিষয়ে সচেতন হয়ে উঠতে থাকেন। কারণ ওই সময়ে সমগ্র ভারতে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। যা প্রতিটি সচেতন পরিবারের সদস্যরা জানতো এবং সন্ধ্যার পরে পাড়া-মহল্লায় ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন নিয়ে নানা আলোচনা হতো। এই আলোচনার মাঝে ক্ষুদিরাম, প্রফুল্ল চাকী, বাঘা যতীনসহ আরো অনেক বিপ্লবীর বিপ্লবী জীবনের কথা উঠে আসতো। তখন ওই সমস্ত পরিবারের কিশোর-তরুণরা খুব মনোযোগ দিয়ে এসব কিংবদন্তি বিপ্লবীদের জীবন কাহিনী শুনতেন, কিশোর-তরুণরা বিপ্লবীদের নিয়ে লেখা বই-পুস্তকও বেশ আগ্রহ সহকারে পড়তেন। দীনেশ গুপ্তও ছিল সেইসব তরুণদের একজন।
১০ম শ্রেণিতে পড়াশুনাকালীন সময়ে তিনি বেঙ্গল ভলেন্টিয়ার্স (বিভি) নামে একটি গুপ্ত বিপ্লবী সংগঠনের সংস্পর্শে আসেন।
১৯২৬ সালে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল থেকে (ঢাকা বোর্ড) ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হন। পরীক্ষার পরে তিনি মেদিনীপুরে বেড়াতে যান। সেখানে বড়দা বড়দা জ্যোতিষচন্দ্র গুপ্ত থাকতেন। দীনেশের দাদা জ্যোতিষ গুপ্ত ছিলেন মেদিনীপুর আদালতের স্বনামধন্য আইনজীবী।
মেদিনীপুর জেলা ছিল বাংলার বিপ্লবীদের আরেক তীর্থস্থান। মেদিনীপুরের বিপ্লবীদের সাথে ভারতের প্রায় সকল বিপ্লববাদী দলের কমবেশি সম্পর্ক ছিল। এই সময় দীনেশ গুপ্ত মেদিনীপুরের বিপ্লবী কার্মকাণ্ডে যুক্ত হওয়ার কথা দলকে জানিয়েছিলেন। কিন্তু দল তাঁকে মেদিনীপুরে কাজ করার অনুমতি দেয়নি। বরং তাঁকে ঢাকায় গিয়ে কাজ করতে বলা হয়। ঢাকায় ফিরে দীনেশ গুপ্ত, ঢাকা কলেজে আইএসসি’তে ভর্তি হন। পড়াশুনা ও বিপ্লবী কাজকর্মে মনোনিবেশ করেন। এক পর্যায়ে তিনি পড়াশুনার চেয়ে বিপ্লবী দলের কাজকর্মের উপর বেশি গুরুত্ব দেন। ১৯২৮ সালে তিনি ঢাকা কলেজ থেকে আইএসসি পরীক্ষা দেন। কিন্তু পড়াশুনার চেয়ে বিপ্লবী দলের কাজকর্মের উপর বেশি গুরুত্ব দেওয়ার কারণে তিনি আইএসসি’তে পরীক্ষা দিয়ে কৃতকার্য হতে পারেননি।
ওই বছর নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু নতুনভাবে বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স বাহিনীকে গড়ে তোলেন। যার চরিত্র ছিল সামরিক। বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স বাহিনীতে নারী ও পুরুষ বিপ্লবী ছিল। তাঁর উদ্যোগে বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স বাহিনীকে সামরিক মানসিকতায় শিক্ষা প্রদান করা হয় এবং স্বাধীনতার জন্য যে কোনো ত্যাগ স্বীকারে বিপ্লবীদের মানসিকভাবে প্রস্তুত করা হয়। দীনেশ গুপ্ত ঢাকা কলেজে পড়াশুনাকালীন সময়ে সুভাষ চন্দ্র বসু’র নতুনভাবে গড়া বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্সের সাথে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত হন।
১৯২৮ সালের মাঝামাঝি সময়ে দীনেশ গুপ্ত মেদিনীপুরে গিয়ে পড়াশুনা করার সিদ্ধান্ত নেন। এরপর তিনি দলের অনুমতি নিয়ে মেদিনীপুরে চলে যান। সেখানে গিয়ে মেদিনীপুর বিপ্লবী দলের সাথে যোগাযোগ রাখতে শুরু করেন। সাথে সাথে তিনি ওইখানে বিভি’র শাখা স্থাপনের কাজ শুরু করেন। তখন দীনেশ গুপ্ত পড়াশুনা করার জন্য ভর্তি হলেন মেদিনীপুর কলেজে। থাকতেন আইনজীবী দাদা’র কাছে। এসময় তিনি বিপ্লবী দলের সদস্য সংগ্রহের পাশাপাশি পড়াশুনা চালিয়ে যেতে থাকেন। দীনেশ মেদিনীপুরের বহু স্কুল-কলেজের ছাত্রকে বিপ্লবী দলে টেনে এনেছিলেন।
সে সময় বাংলাসহ সারা ভারতের বিপ্লবীদের ওপর ইংরেজ শাসকগোষ্ঠী নির্মমভাবে অত্যাচার-নির্যাতন চালাতে শুরু করে। একের পর এক বিপ্লবীকে ধরে নিয়ে জেলখানায় আটক রেখে পাশবিক নির্যাতন চালায়। যে কারণে অনেক বিপ্লবী মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন হয়ে যায়। ক্ষুদিরামের ফাঁসির পর ব্রিটিশ সরকার দৃঢ়ভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে, যারা সশস্ত্র বিদ্রোহের মাধ্যমে ব্রিটিশ-শাসনকে উচ্ছেদ করতে চাইবে, তাঁদের মধ্যে যারা ফাঁসিকাষ্ঠ থেকে রেহাই পাবে, তাঁদেরকে আন্দামানে পাঠানো হবে। বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে চল্লিশের দশক পর্যন্ত ব্রিটিশ সরকারের ফাঁসিকাষ্ঠ থেকে রেহাই পাওয়া প্রায় সকল সশস্ত্র বিপ্লবীকে আন্দামানে যেতে হয়েছিল। আর আন্দামান সেলুলার জেল ছিল ভারতের স্বাধীনতার ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়ংকার জেল। এক কথায় বলা যায়, মৃত্যুফাঁদ।
এসমস্ত ঘটনার কারণে ব্রিটিশদের চরম শিক্ষা দেওয়ার জন্য সুভাষ চন্দ্র বসু তখন ‘বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স’কে অ্যাকশনধর্মী বিপ্লবী সংগঠন হিসেবে গড়ে তোলেন। শুরু হয় বিপ্লবীদের আগ্নেয়াস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণ। এই প্রশিক্ষণে দীনেশ গুপ্তও বিপ্লবীদের প্রশিক্ষণ দিতেন। এক পর্যায়ে সুভাষ চন্দ্র বসু’র নেতৃত্বে এই সংগঠনের বিপ্লবীরা কুখ্যাত ব্রিটিশ পুলিশ অফিসারদের হত্যা বা নিশ্চিহ্ন করার পরিকল্পনা করেন। ১৯২৯-৩০ সালের মধ্যে দিনেশ গুপ্তের প্রশিক্ষিত বিপ্লবীরা ‘ডগলাস’, ‘বার্জ’ এবং ‘পেডি’, মেদিনীপুরের এই তিনজন কুখ্যাত ব্রিটিশ জেলা ম্যাজিস্ট্রটকে হত্যা করেছিল।
১৯৩০ সালে ইংরেজ শাসকগোষ্ঠীর অত্যাচার-নির্যাতন আরো বহুগুণে বেড়ে যায়। শতশত রাজনৈতিক নেতা-কর্মী ও বিপ্লবীদের গ্রেফতার করে জেলে আটক রেখে নির্যাতন চালায়। এই সময় ব্রিটিশ পুলিশ সুভাষচন্দ্র বসু, যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত এবং সত্য বকসীর মত নেতৃত্বকেও গ্রেফতার করে আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে আটক রাখে। একের পর এক নেতা-কর্মীকে গ্রেফতার করে আলিপুর সেন্ট্রাল জেল ভরিয়ে ফেলা হচ্ছিল। এইসব বন্দিদের মধ্যে ছিলেন অসংখ্য সশস্ত্র বিপ্লবী দলের সদস্য এবং অহিংস আন্দোলনের স্বেচ্ছাসেবকরা। একপর্যায়ে আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে নতুন বন্দিদের জায়গা দেওয়া যাচ্ছিল না। জেলের মধ্যে সৃষ্টি হল এক অসহনীয় অবস্থা। রাজবন্দিদের মধ্যে বিক্ষোভ দানা বেঁধে উঠেছিল। তাঁরা জেলকোড অনুযায়ী কয়েকটি দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন। অতঃপর পাগলা ঘণ্টি বাজানো হল। এই আন্দোলন দমানোর জন্য ব্রিটিশ পুলিশ তাঁদের ওপরে বেদমভাবে লাঠিচার্জ করে। রাজবন্দিদের ওপর চলল নির্মম-নিষ্ঠুর অত্যাচার। সুভাষচন্দ্র, যতীন্দ্রমোহন এবং সত্য বকসীরাও বাদ গেলেন না নির্মম-নিষ্ঠুর অত্যাচার থেকে। এ ঘটনার খবর ছড়িয়ে পড়ল জেলের ভেতরে। জানা গেল এই নির্মম-নিষ্ঠুর অত্যাচারের পিছনে রয়েছে ইন্সপেক্টর জেনারেল কর্নেল এন. এস সিম্পসন সাহেব।
বিপ্লবীরা প্রস্তুতি নিলেন অত্যাচারী সিম্পসনকে উচিৎ শিক্ষা দেওয়ার জন্য। পরিকল্পনা হল শুধু সিম্পসন নয়, ইংরেজ আমলাদের বুঝিয়ে দিতে হবে যে, বাঙালিরাও লড়তে জানে, মারতে জানে। কাঁপিয়ে দিতে হবে বিদেশি সাম্রাজ্যবাদকে।
বিপ্লবীরা জেলের ইন্সপেক্টর জেনারেল কর্নেল এন. এস সিম্পসনকে টার্গেট করেছিলেন। সিম্পসন জেলখানার বন্দিদের ওপর পাশবিক নির্যাতনের জন্য কুখ্যাত ছিলেন। শুধু সিম্পসন নয়, রাইটার্স ভবনে আক্রমণ করে ব্রিটিশ অফিসারদের হত্যা করে ওদের অত্যাচার-জুলুমের জবাব দিতে হবে। কলকাতার ডালহৌসি স্কোয়ারে অবস্থিত ছিল ব্রিটিশ শাসকদের সচিবালয়। যার নাম রাখা হয়েছিল রাইটার্স ভবন। এই ভবনেই উচ্চপদস্থ ব্রিটিশ আমলারা অফিস করতেন।
‘রাইটার্স বিল্ডিং’ আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হল। আক্রমণের জন্য সকল প্রস্তুতি গ্রহণ করা হল। খুব সতর্ক অবস্থায় তাদের প্রশিক্ষণের কাজও সমাপ্ত হল। বিনয়-বাদল-দীনেশ বিপ্লবী নেতৃবৃন্দের সাথে আলোচনা করে বিদায় নিলেন।
৮ই ডিসেম্বর, ১৯৩০ সাল।
‘রাইটার্স বিল্ডিং’ এর একটি কক্ষে কারা বিভাগের সর্বময় কর্তা ইন্সপেক্টর জেনারেল কর্নেল সিম্পসন তাঁর কাজকর্ম পরিচালনা করছেন। তাঁর ব্যক্তিগত সহকারী জ্ঞান গুহ তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে আলোচনা করছেন।
বেলা ঠিক ১২ টা।
সাহেবী পোশাক পরে তিনজন বাঙালি যুবক এসে কর্নেল সিম্পসনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আগ্রহ প্রকাশ করেন।
তাঁরা সিম্পসনের চাপরাশিকে (সহকারী) ঠেলে কামরার ভেতরে প্রবেশ করেন। হঠাৎ পদধ্বনি শুনে কর্নেল তাঁদের দিকে তাকান। বিস্ময়-বিমূঢ় চিত্তে দেখতে পান সম্মুখে সাহেবী পোশাক পরে তিনটি বাঙালি যুবক রিভলবার হাতে দণ্ডায়মান।
মুহূর্তের মধ্যে বিনয়ের কণ্ঠে ধ্বনিত হয়,
“প্রে টু গড কর্নেল। ইওর লাস্ট আওয়ার ইজ কামিং।”
কথাগুলি উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে তিনটি রিভলবার হতে ছয়টি বুলেট সিম্পসনের দেহ ভেদ করে। প্রাণহীন সিম্পসন মুহূর্তে লুটিয়ে পড়েন মেঝের উপর।
এরপরই বিপ্লবীদের ছোঁড়া বুলেটের আঘাতে আহত হন জুডিসিয়াল সেক্রেটারি মি. নেলসন। এলোপাথাড়ি বুলেটবর্ষণ করতে করতে বিপ্লবীরা পরবর্তী লক্ষ্য হোম সেক্রেটারি আলবিয়ান মারের কক্ষের দিকে অগ্রসর হন।
বুলেটের মুহুর্মুহু শব্দে তখন রাইটার্স বিল্ডিং কেঁপে উঠছে। নিজেদের প্রাণ বাঁচাতে মরিয়া লোকজন যে যেখানে পারছেন সেখানে ছুটছেন।
এই আক্রমণ প্রতিরোধের জন্য ছুটে আসেন পুলিশ-ইন্সপেক্টর জেনারেল মি. ক্র্যাগ ও সহকারি ইন্সপেক্টর জেনারেল মি. জোনস। তাঁরা কয়েক রাউন্ড গুলিও ছোঁড়েন। কিন্তু বিনয়-বাদল-দীনেশের বেপরোয়া গুলির মুখে তাঁরা দাঁড়াতে পারলেন না। প্রাণ নিয়ে পালালেন।
সমস্ত ‘রাইটার্স বিল্ডিং’ জুড়ে তখন এক বিভীষিকাময় রাজত্ব। চারিদিকে শুধু ছুটাছুটি। কে কোন দিকে পালাবে দিশা খুঁজে পাচ্ছিলেন না। শুধু কলরব-কোলাহল-চিৎকার। শুধু এক রব, বাঁচতে চাও তো পালাও।
‘রাইটার্স বিল্ডিং’ আক্রমণের সংবাদ পেয়ে এবারে পুলিশ কমিশনার টেগার্ট উপস্থিত হলেন। ডেপুটি কমিশনার গার্ডন উপস্থিত হলেন সশস্ত্র বাহিনী নিয়ে। পাদ্রী রেভারেন্ড জনসন ‘ড্রেন-পাইপে’র মধ্য দিয়ে পালিয়ে বাঁচলেন। জুডিসিয়াল সেক্রেটারি মি. নেলসন, মি. টয়নয় প্রমুখ অনেক ইংরেজ রাজপুরুষ আহত হলেন। আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য ডেকে আনা হল গুর্খাবাহিনী।
অন্যদিকে তিনটি বাঙালি তরুণ, হাতে শুধু তিনটি রিভলবার। আর অপরদিকে রাইফেলধারী সুশিক্ষিত গুর্খাবাহিনী। আরম্ভ হল ‘অলিন্দ যুদ্ধ’। ইংরেজ মুখপত্র ‘স্টেটসম্যান’ পত্রিকার ভাষায় ‘বারান্দা বেটল’। দীনেশের পিঠে একটি বুলেটবিদ্ধ হল। গলাতেও একটি বুলেট বিঁধলো। তিনি তাতে ভ্রুক্ষেপও করলেন না। অসংকোচে গুলিবর্ষণ করতে লাগলেন শত্রুকে লক্ষ্য করে। যতক্ষণ পর্যন্ত বিনয়-বাদল-দীনেশের হাতে গুলি ছিল, ততক্ষণ কেউই তাদের আক্রমণ করে প্রতিহত করতে পারেননি।
একপর্যায়ে তাঁদের বুলেট নিঃশেষ হয়ে এল। গুর্খা ফৌজ অনবরত গুলিবর্ষণ করে চলল। তিনজন বিপ্লবী একটি শূন্য কক্ষে প্রবেশ করলেন। বাদল সঙ্গে আনা সায়েনাইডের পুরিয়া মুখে দিলেন। বাদল শহীদ হলেন। বিনয় ও দীনেশ নিজেদের রিভলভারের শেষ বুলেট দুটি ব্যবহার করলেন নিজেদের মস্তক লক্ষ্য করে। বিনয় ও দীনেশ সাংঘাতিক আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে মেঝের উপর পড়ে রইলেন। দুজনেই আহত হয়ে ধরা পড়লেন। গুরুতর আহত বিনয় ও দীনেশকে পুলিশ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠিয়ে দিল।
ভীষণভাবে আহত বিনয় ও দীনেশকে একটু সুস্থ করে তাঁদের ওপর চলল প্রচণ্ড অত্যাচার। উভয়কেই পুলিশ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয়। পুলিশ কমিশনার টেগার্ট এতদিন পরে বিনয়ের ওপর আক্রোশ মিটানোর সুযোগ পেলেন। অচেতন বিনয়ের হাতের আঙুলের উপর সবুট পদক্ষেপে সবগুলি আঙুল ভেঙে ফেলে বীরত্ব প্রদর্শন করলেন।
বিনয় ছিলেন মেডিকেল স্কুলের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র। তিনি জানতেন মৃত্যুর পথ। হাসপাতালে অবস্থানকালে তিনি ১৪ ডিসেম্বর রাত্রে আকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুকে বরণ করার জন্য মস্তকের ‘ব্যান্ডেজে’র ভিতর আঙুল ঢুকিয়ে স্বীয় মস্তিষ্ক বের করে আনেন এবং মৃত্যুকে বরণ করে নেন।
অন্যদিকে ডাক্তার ও নার্সদের আপ্রাণ চেষ্টায় দীনেশ ক্রমশ সুস্থ হয়ে উঠেন। সুস্থ হওয়ার পর দীনেশের উপর চলে প্রচণ্ড অমানবিক নির্যাতন। এভাবে দীর্ঘদিন নির্যাতন ও চিকিৎসার পর তাঁকে হাসপাতাল থেকে ‘কনডেমড’ সেলে নেয়া হয়। দীনেশের বিচারের জন্য আলীপুরের সেশন জজ মি. গ্রালিকের সভাপতিত্বে ব্রিটিশ সরকার এক ট্রাইবুন্যাল গঠন করে। দীনেশের ফাঁসির আদেশ দেয়া হয়। উক্ত ট্রাইবুন্যালে বিচারের নামে চলে প্রহসনের নাটক। অবশেষে ইংরেজ সরকার ১৯৩১ সালের ৭ জুলাই দীনেশের ফাঁসি কার্যকর করার নির্দেশ দেয়।
(তথ্যসূত্র:
১- আমাদের গর্ব বিনয় বাদল দিনেশ, চিন্ময় চৌধুরী, দে’জ পাবলিশিং।
২- https://www.bongodorshon.com/…/letter-of-the-revolutionary-…)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত