একের পর এক বাড়ি তাসের ঘরের মত ভেঙে পড়ছে বউবাজারে। সেই ভাঙন অপলক দৃষ্টিতে দেখছেন বাসিন্দারা। বিপর্যয় এখনও অব্যাহত। এবার ফাটল ধরল হিদারাম ব্যানার্জী লেনের একাধিক বাড়িতে। জলের বেগে সরে যাচ্ছে মাটি। আর তার জেরেই কেএমআরসিএল-এর আগাম বসিয়ে যাওয়া বাঁশের খুঁটি বা লোহার সাপোর্টে আর কাজ হচ্ছে না। বউবাজার এলাকার মাটি যে তরল তা বহু এক প্রকল্পের সময় বুঝতে পেরেছিল কলকাতা পুরসভা। মেট্রোও যদি তা বুঝতে পারত তাহলে হয়ত এতগুলো মানুষ এক নিমেষে ভিটেমাটি ছাড়া হতেন না, এমনটাই মত সকলের।
মাটি অত্যন্ত দুর্বল হওয়ার কারণে আজ থেকে প্রায় ৯ বছর আগে বৌবাজারে ‘ট্র্যাভেলেটর’ বা চলমান ফুটপাত করার প্রস্তাব বাতিল করেছিল কলকাতা পুরসভা। বলা হয়েছিল, ওই ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় মাটির ‘লিক্যুইফ্যাকশন’ (জলের সামান্য সংস্পর্শে এলেই মাটি তরল হওয়ার আশঙ্কা) অত্যন্ত বেশি। তাই প্রকল্পের ‘ভার’ মাটি নিতে পারবে না! প্রশ্ন উঠেছে, কলকাতা পুরসভা যা বুঝতে পারল, মেট্রোর বিশেষজ্ঞেরা তার আগাম আঁচ পেলেন না?
এই প্রশ্ন উঠে আসতেই আরও বিপাকে মেট্রো কর্তৃপক্ষ। মাটির যে দুর্বলতার কারণে ২০০৯-১০ সালে পুরসভা প্রকল্প বাতিল করেছিল, দুর্গা পিতুরি লেন ও স্যাকরাপাড়া লেনে সুড়ঙ্গ কাটার আগে সেই চরিত্রগত বিষয়টিকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল কি? বৌবাজারের মতো ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় টানেল বোরিং মেশিন যে গতিতে চালানোর কথা ছিল, তা কি সেই মতই হয়েছিল? এক ভূতত্ত্ববিদের কথায়, ‘‘কোন এলাকায় কত জোরে মেশিন চালানো যাবে, তা নির্ভর করে মাটির চরিত্রের উপরে। মাটি ভঙ্গুর হলে মেশিনের কম্পন উপরের যাবতীয় কাঠামোর ভয়াবহ ক্ষতিও করতে পারে।’’
কলকাতা পুরসভার নগর পরিকল্পনা দফতরের তৎকালীন ডিরেক্টর জেনারেল দীপঙ্কর সিংহ বলেন, ‘‘ওখানকার মাটি চরিত্রগত ভাবে খুবই দুর্বল। মাটির নীচে নিকাশি, জলের পাইপলাইন, বিদ্যুতের লাইন রয়েছে! তার পর ট্র্যাভেলেটর! এত কিছু করা যাবে না বলে বেসরকারি সংস্থার প্রকল্প বাতিল করে দিয়েছিলাম।’’ এই মুহূর্তে যে প্রশ্নগুলি উঠছে মেট্রোর দিকে তার কোনো সদুত্তর নেই।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘কনস্ট্রাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং’ বিভাগের ভিজ়িটিং প্রফেসর বিশ্বজিৎ সোম জানান, মূল বিপর্যয় মাটির উপরে ঘটছে! কারণ, মাটি ও কোনও বাড়ির ভিতের ‘অন্তর্বর্তী সম্পর্ক’ বা ‘নন-লিনিয়ার সয়েল ফাউন্ডেশন স্ট্রাকচার ইন্টারঅ্যাকশন’ পুরোপুরি বিপর্যস্ত। ফলে বাড়ি ভেঙে পড়ার ঘটনা অব্যাহত। বিশ্বজিৎবাবু বলেন, ‘‘মাটি যে শুধু বসে যাচ্ছে তাই নয়, যে কোনও দিকে মাটির সরণ-ও শুরু হয়েছে। যা বিপজ্জনক করে তুলেছে বিপর্যয় সংলগ্ন গোটা এলাকাকে। এক দিন ভারী বৃষ্টি হলে পুরো এলাকায় বড়সড় বিপদ ঘটতে পারে।’’