মেদিনীপুর জেলের কনডেম্ড সেল থেকে, তাঁর ফাঁসির একমাস কুড়ি দিন আগে, ২২শে নভেম্বর ১৯৩২ সালে তিনি তাঁর বড়বউদিকে লিখেছিলেন,
‘‘…তা ছাড়া পুনর্জ্জন্মে মৃত্যুর পর অন্যদেহ পরিগ্রহে বিশ্বাস তো আছে এবং শ্রীগীতাতে শ্রীকৃষ্ণের বাণী ‘ন হি কল্যাণকৃৎ কশ্চিদ্দুুর্গতিং তাত গচ্ছতি’। তাই আমার জন্য চিন্তা কর্ব্বেন না।’’
১২ই জানুয়ারি ১৯৩৩ সালে, মেদিনীপুরের দ্বিতীয় শ্বেতাঙ্গ ম্যাজিস্ট্রেট ডগলাস কে হত্যার অপরাধে, মাত্র ঊনিশ বছর এক মাস ঊনত্রিশ দিনের মাথায় তাঁর ফাঁসি হয়।
![‘ন হি কল্যাণকৃৎ কশ্চিদ্দুুর্গতিং তাত গচ্ছতি’----রানা চক্রবর্তী 2 70200758 2330559986997931 5918118549070544896 n](https://ekhonkhobor.com/wp-content/uploads/2019/09/70200758_2330559986997931_5918118549070544896_n.jpg)
তিনি আজ বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যাওয়া বীর বিপ্লবী শ্রী প্রদ্যোতকুমার ভট্টাচার্য।
১৩ই নভেম্বর ১৯১৩ সালে তিনি মেদিনীপুর জেলার দাসপুর থানার রাজনগরের গোকুলনগরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর পিতার নাম ছিল শ্রী ভবতারণ ভট্টাচার্য।
ধীরস্থির, শান্ত, প্রদ্যোৎ ১৯৩০ সালে মেদিনীপুরের হিন্দু স্কুল থেকে প্রথম বিভাগে প্রবেশিকা পরীক্ষা পাশ করে, স্থানীয় কলেজে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হয়েছিলেন। তার পরেই জীবন পালটে গেল। অথচ তাঁর পরিবারে কেউ কখনও স্বদেশি করেননি। বাবা ছিলেন রেভিনিউ এজেন্ট। বড় ভাই ডাক্তার। মেজ ভাই সাউথ ইস্টার্ন রেলের কর্মী।
বলা হয়, মেদিনীপুর জেলার হিজলি বন্দি শিবিরে নিরস্ত্র বন্দিদের উপর গুলি চালানোর প্রতিবাদে তাঁর মন ব্রিটিশ নিধনে ইন্ধন জুগিয়েছিল।
এক সময়, বেঙ্গল ভলান্টিয়ার বা বিভি মেদিনীপুর শাখার নিষ্ঠাবান যোদ্ধা দীনেশ গুপ্তের সান্নিধ্যে আসেন প্রদ্যোৎ। প্রদ্যোতের তেজ, প্রাণোচ্ছলতা এবং রবীন্দ্রপ্রীতি মুগ্ধ করল দীনেশকে। তখন প্রদ্যোতের সবে সতেরো।
দীনেশ তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘তুমি জানো, ধরা পড়লে ফাঁসি, দ্বীপান্তর, অকথ্য অত্যাচার, ভাগ্যে যা খুশি জুটতে পারে। হাসিমুখে সইতে পারবে? ‘মন্ত্রগুপ্তি’ রক্ষা করতে পারবে?’
উত্তরে প্রদ্যোৎ তাঁকে বলেছিলেন, ‘নিশ্চয়ই। পারব।’
১৯৩০ সালে দীনেশ গুপ্ত প্রদ্যোৎকে দলে নিয়ে নেন।
মেদিনীপুর সংস্থার পরিচালনার ভার পড়েছিল প্রফুল্ল দত্তের ওপর। তিনি বলেছিলেন,
‘বাঃ, এই তো সাচ্চা দীনেশ গুপ্তের ভাবশিষ্য। নামেও ‘কচি’ (প্রদ্যোতের ডাকনাম), বয়সেও। তবু কাজে লাগানো যেতে পারে।’
এই ‘কচি’ প্রদ্যোৎই জেল ম্যাজিস্ট্রেট প্যাডি হত্যার প্ল্যান করার জন্য ২৫শে মার্চ ১৯৩২ সালে সন্ধে সাতটায়, ফণী কুণ্ডু, জ্যোতিজীবন, বিমল দাশগুপ্ত এবং প্রফুল্ল দত্তের সঙ্গে দেখা করেছিলেন, স্টেশনের নির্জন মাঠে। কিছু দিন পরে এক সন্ধেয়, একটি জেলা স্কুলশিক্ষা প্রদর্শনীতে হঠাৎ রিভলভারের গুলি খেয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েছিলেন অত্যাচারী প্যাডি। হত্যাকারী জ্যোতিজীবন ঘোষ এবং বিমল দাশগুপ্ত তখন বিদ্যুৎগতিতে সীমানার বাইরে।
তার পরে শুরু হল পরবর্তী ম্যাজিস্ট্রেট ডগলাসকে হত্যার পরিকল্পনা।
প্রভাংশুশেখর পাল এবং প্রমথ মুখোপাধ্যায়ের ওপর পড়ল দায়িত্ব। কংসাবতী নদীর তীরে তাঁরা অপেক্ষায় ছিলেন। কথা ছিল, ডগলাস বোটে করে পার হবেন। তারপরে গাড়ি থেকে নামলেই গুলি চালানো হবে। কিন্তু সে দিন তিনি নামলেন না। অভিযান ব্যর্থ হল। কিন্তু এই ব্যর্থ অভিযান থেকে একটা জিনিস পরিষ্কার হল। দেখা গেল প্রমথ ভীষণ নার্ভাস। অতএব তাঁকে বাতিল করে দিলেন প্রদ্যোৎ।
৩০ এপ্রিল ১৯৩২। দুপুর পৌনে দুটো।
ডগলাস ব্যস্ত জেলা মিটিং-এ।
প্রদ্যোতের চোখে সেদিন চশমা। সিঁথিটা অন্য দিকে কাটা।
প্রভাংশুর সেদিন মোটা গোঁফ, পরনে মালকোঁচা মারা ধুতি।
দুজনেই ছদ্মবেশে।
প্রহরীরা কিছু বোঝার আগেই তাঁরা দু’জন তীব্র গতিতে একেবারে ডগলাসের পিছনে ছুঁটলেন। গুলি ছুঁড়লেন।
বুলেটবিদ্ধ ডগলাস চিরকালের জন্য লুটিয়ে পড়েছিলেন মাটিতে।
তার পর তাঁরা ছুঁটতে শুরু করলেন।
গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে প্রভাংশু অমর লজের পাশ দিয়ে পালালেন। পথে একটি সাঁকোর তলায় রিভলভারটি পুঁতে সাধারণ পোশাকে অদৃশ্য হলেন।
কিন্তু প্রদ্যোতের ভাগ্য সে দিন ছিল বিরূপ।
পিছনে তখন প্রহরীদের চিৎকার, ‘পাকড়ো পাকড়ো’। গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে তাঁরাও পিছু নিয়েছে।
প্রদ্যোৎ ঘুরে বার বার রিভলভারের ট্রিগারে চাপ দিলেন। কিন্তু গুলি বেরল না!
দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে তিনি একটি পোড়ো বাড়ির ভেতর ঢুকে পড়লেন। বন্দুকে নতুন গুলি ভরতে চেষ্টা করলেন। ইতিমধ্যে কপাটহীন ঘরে ঢুকে এক জন গুলি চালালো। প্রদ্যোৎ ঘর থেকে বেরিয়ে উত্তর দিকে দৌঁড়ালেন। বন্দুক তাক করে আবার ট্রিগারে চাপ দিলেন।
কিন্তু নাঃ! এ বারেও গুলি বেরোল না!
শেষে ঝোপ-জঙ্গলের ভিতর দিয়ে সরু গলি ধরে যখন পালাচ্ছেন, হঠাৎই কাঁটাতারের বেড়ায় কাপড় জড়িয়ে তিনি ছিটকে পড়লেন। একটা ইঁটের টুকরো এসে লাগল তাঁর মুখে।
হাত থেকে রিভলভার ছিটকে পড়ল দূরে।
ব্যস! তাঁর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল রাজভক্তের দল।
শুরু হল এলোপাথাড়ি মার।
রাজভক্তদের প্রহারে রক্তাক্ত প্রদ্যোতের চোখে তখনও আগুন। তাঁর পকেট থেকে পাওয়া গিয়েছিল দু’টুকরো কাগজ। যার একটিতে লেখাছিল,
‘A fitting reply to premeditated and prearranged barbarous & cowardly attempt on the patriotic sons of Bengal— Bengal revolutionaries.’
আর অন্যটিতে লেখাছিল,
‘হিজলী হত্যার ক্ষীণ প্রতিবাদে— ইহাদের মরণেতে ব্রিটেন জানুক। আমাদের আহুতিতে ভারত জাগুক— বন্দেমাতরম।’
সেদিন প্রচণ্ড অত্যাচার চলেছিল প্রদ্যোতের অলিগঞ্জের বাড়িতেও। ঘরের আসবাব ভেঙেচুরে তছনছ করে দেওয়া হয়েছিল। প্রদ্যোতের মা’কে কটূক্তি করা হয়। বড় ভাই আর মেজ ভাই তখন গ্রামে ছিলেন না। তখন, প্রদ্যোতের ঠিক ওপরের ভাই শর্বরীভূষণকে থানায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।
ও দিকে হাজার জেরা, শত অত্যাচারেও প্রদ্যোতের মুখ থেকে একটা কথাও বেরোয়নি। বেরোয়নি সঙ্গী প্রভাংশু বা অন্য কারও নাম।
স্বীকারোক্তি আদায়ের চেষ্টায় যখন থানার ভূপেন দারোগা ব্যঙ্গ করে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘ছিঃ প্রদ্যোৎ, তোমার মতো বুদ্ধিমান ছেলে এমন ভুল করল? শেষে কিনা তুমি এমন একটা রিভলভার নিয়ে গেলে, যা কাজের বেলায় একেবারেই সাড়া দিল না!’
শিকল-বাঁধা দুই হাত কপালে ঠেকিয়ে প্রদ্যোৎ বলেছিলেন,
‘Irony of fate, Bhupen-babu, had my revolver spoken out, I would not have been here and in this condition, the story would have been otherwise.’
রবীন্দ্রনাথ-বিবেকানন্দ-নজরুল তাঁর জপতপ ছিলেন। মেদিনীপুর কারাগারে আশপাশের সেল থেকে, এমনকী প্রহরীরাও শুনতে পেত তাঁর গান।
বিপ্লবী ভূপাল পান্ডা তখন একই জেলে ছিলেন। তিনি লিখেছিলেন,
‘…সন্ধ্যায় লকআপের পর হঠাৎ শোনা গেল প্রদ্যোতের মধুর কণ্ঠের গান, রবীন্দ্রনাথের ‘তোর আপন জনে ছাড়বে তোরে/ তা ব’লে ভাবনা করা চলবে না।’ কখনও বা কাজী নজরুলের ‘দুর্গম গিরি কান্তার মরু…’
শুধু কি গান?
শৈলেশ দে, ‘আমি সুভাষ বলছি’-তে এক জায়গায় লিখছেন,
‘বিপ্লবের সংজ্ঞা সম্বন্ধে এমন সুনিশ্চিত বিশ্লেষণ ইতিপূর্বে তুমি কোথাও পড়েছ কি? মনে রেখ সে দিন তাঁর বয়স ছিল মাত্র আঠারো বছর…’
চিঠিটি জেল কর্তৃপক্ষের নজর এড়িয়ে তিনি পাঠিয়েছিলেন তাঁর মা’কে। সেই চিঠির কিছু কিছু অংশ নিম্নরূপ –
‘কিন্তু আজ একটা আদর্শের জন্য প্রাণ বিসর্জন করছি। তাতে আনন্দ আমার মনের কানায় কানায় ভরে উঠেছে। …ফাঁসির কাঠটা আমার কাছে ইংরেজের রসিকতা মনে হচ্ছে। আমার এই অন্তরের কথাটা তোমারই অন্তরের প্রতিধ্বনি। আমি চিরদিনই জানি যে, আমি বাঙালী (বা ভারতবাসী) আর তুমি বাংলা (বা ভারতবর্ষ) একই পদার্থ। যুগ যুগ ধরে তুমি যে অপমান, লাঞ্ছনা ও নির্যাতন সহ্য করে এসেছ, মাটিতে মুখ থুবড়ে বোবা গরুর মতো মার খেয়েছ, তারই বিরুদ্ধে তোমার মনে যে বিদ্রোহের ধারা অন্তঃসলিলা ফল্গুর মতো বয়ে যাচ্ছিল, সেই পুঞ্জীভূত বিদ্রোহ-ই আমি।’
‘বিপ্লব জিনিসটা কিছু আমোদের নয়, কিন্তু মানব জাতিকে ধ্বংসের হাত হতে বাঁচানোর জন্য যুগে যুগে এটার প্রয়োজন হয়েছে।’
‘যাঁদের প্রতিটি রক্তবিন্দু দাসত্বের কলঙ্কে কলঙ্কিত হয়ে গেছে তাঁদের কথা ভাবি না। …কিন্তু যাঁরা মধ্যপন্থী, আপস মীমাংসায় এখনো বিশ্বাসবান, তাঁদের জন্য দুঃখ হয়।’
রাজবন্দি কৃষ্ণলাল চট্টোপাধ্যায় ফাঁসির আগের দিন তাঁর সাথে দেখা করে তাঁর কানে কানে বলেছিলেন, ‘ভাই, কাউকে কিছু বলবার আছে কি?’
প্রদ্যোৎ বলেছিলেন, ‘আমার প্রতিটি রক্তবিন্দুতে যেন একটি করে শহিদ তৈরি হয়।’
অবশেষে এল শেষের অভিশপ্ত সে দিন।
১২ জানুয়ারি ১৯৩৩।
জেলের ঘড়িতে সময় তখন ভোর সাড়ে পাঁচটা।
ঘড়ির ঢং ঢং শব্দে জেগে উঠল ভোর।
সেদিন ছিল কনকনে ঠান্ডা। চারিদিকে কুয়াশা।
কিন্তু অত শীতেও তত ক্ষণে প্রদ্যোতের স্নান সারা। গীতাপাঠও করে নিয়েছেন।
ঠিক ছ’টা বাজতে তিন মিনিট আগে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হল ফাঁসির মঞ্চে।
জেলের বিভিন্ন সেল থেকে গর্জন উঠল, ‘প্রদ্যোৎ কুমার কি জয়।’
তিনি ফাঁসির মঞ্চের ওপরে দাঁড়ালেন।
নিহত ডগলাসের পরবর্তী জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মিঃ বার্জ জিজ্ঞেস করলেন, ‘Are you ready?’
শান্ত ভাবে প্রদ্যোৎ বললেন, ‘One minute please Mr. Burge, I have something to say.’
বার্জ অনুমতি দিলেন।
এ বারে প্রদ্যোৎ হাসতে হাসতে বললেন,
‘We are determined, Mr. Burge, not to allow any European to remain at Midnapore. Yours is the next turn. Get yourself ready.’ (এই ভবিষ্যদ্বাণী সত্যি হয়েছিল। মাস সাতেক বাদেই বার্জকে হত্যা করেন বিপ্লবীরা।)
একটু থেমে আবার বললেন,
‘I am not afraid of death. Each drop of my blood will give birth to hundreds of Prodyots in all houses of Bengal. Do your work please.’
তারপরে কালো কাপড়ে মুখ ঢাকা পড়ল।
ফাঁসির দড়ি পরানো হল।
তিনি শেষ বারের মতো উচ্চারণ করলেন, ‘বন্দে মাতরম’।
তাঁর নশ্বর দেহটা মঞ্চের নীচে অদৃশ্য হল।
ফাঁসির দড়িটা কয়েক মুহূর্ত কেঁপে উঠে স্থির হয়ে গেল।
দুই দাদা, প্রভাতভূষণ ও শক্তিপদ দেখেছিলেন সেই মৃত্যুদৃশ্য।
এর পরের ইতিহাস আরও করুণ। শর্বরীভূষণের সঙ্গে বিপ্লবী দলের কোনও যোগাযোগ ছিল না। হ্যাঁ, প্রদ্যোতের পিঠোপিঠি ভাই হিসেবে কিছু হয়তো জানতেন। সন্দেহের বশে তাঁকেও জেলে পোরা হল। চলল অকথ্য অত্যাচার। চার বছর জেল-হাজত, তার পর শর্বরী অত্যাচারের চোটে পাগল হয়ে গেলেন। রাঁচির উন্মাদ আশ্রমে বাকি জীবন কাটাতে হল। ১৯৮০ সালের ২৮ মার্চ তিনি মারা যান। তখনও জানতেন না, দেশ স্বাধীন হয়েছে। তিনিও কি শহিদ নন?
(তথ্যসূত্র:
১- আমি সুভাষ বলছি( অখণ্ড সংস্করণ), শৈলেশ দে, রাবেয়া বুকস্ (২০১৫)।
২- নিঃসঙ্গ: অগ্নিযুগের বিপ্লবীর স্মৃতি কাহিনী, সতীশ চন্দ্র দে, অ্যাকাডেমিক পাবলিশার্স (২০১২)।
৩- অগ্নিযুগের স্বাধীনতা সংগ্রাম, রূপময় পাল, তরুলতা (২০১২)।
৪- অগ্নিযুগের বিপ্লবী মামলা, চিন্ময় চৌধুরী, দীপ প্রকাশন।
৫- উইকিপিডিয়া।
৬- আনন্দবাজার পত্রিকা, ১০ই জানুয়ারি ২০১৬ সাল।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত