তাঁকে বোঝা সহজ নয়, তবে তাঁর মতো প্রতিভাবান, মানবিক একজন মানুষকে ভুলে যাওয়া সত্যিই কঠিন। তিনি জানতেন পুরনো গল্পকে কিভাবে নতুন আঙ্গিকে বলতে হয়।
সত্যজিৎ রায়ের ভাবশিষ্য ছিলেন তিনি। প্রথমে তথ্যচিত্র দিয়ে শুরু করে চলচ্চিত্র নির্মাণ শুরু করেন নব্বইয়ের দশকে।
বাংলা সিনেমার দর্শক যখন ছবিঘর থেকে মুখ ফিরিয়েছে, তখন নতুন করে তাঁদের চলচ্চিত্র প্রেক্ষাগৃহে টেনে এনেছিলেন তিনি।
!['ঋতুবিহীন' ----রানা চক্রবর্তী 2 5cc2c2ea d11e 4b15 b0c3 7e61cb6a4cb6](https://ekhonkhobor.com/wp-content/uploads/2019/08/5cc2c2ea-d11e-4b15-b0c3-7e61cb6a4cb6.jpg)
তিনি যেমন ধরিয়ে দিয়েছিলেন বাঙালির জীবনের ‘উৎসব’, তেমনই চিনিয়ে দিয়েছিলেন বাঙালির ‘অসুখ’। গতানুগতিক ফর্মুলা বদলে ভিন্ন ধারায় তাঁর তৈরি চলচ্চিত্র দেখে দর্শকরা হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছিলেন।
তাঁর চলচ্চিত্রের বৈশিষ্ট্য ছিল, তিনি মারদাঙ্গা অ্যাকশন, নাচ-গানের মতো বিনোদনের পরিবর্তে মানুষের গল্প, মনোজগতের গল্প বলতে ভালোবাসতেন। চলচ্চিত্রের ভাষা তাঁর সিনেমায় ছিল প্রধান। ছোট্ট একটি দৃশ্যের মাধ্যমে তিনি সৃষ্টি করতেন দ্বন্দ্ব। দর্শককে নিয়ে যেতে পারতেন ভাবনার সিঁড়িতে।
তিনি শুধুমাত্র একজন প্রতিভাবান পরিচালকই ছিলেন না, তিনি চিত্রনাট্যকার, গীতিকার এবং অভিনেতা হিসেবেও ছিলেন সফল। সংলাপ রচনার ক্ষেত্রেও প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছিলেন তিনি।
আজও যখনই তাঁর প্রসঙ্গ আসে তখনই একটি প্রশ্ন প্রায়ই ওঠে, “তিনি কি পুরুষ ছিলেন নাকি নারী? নাকি দুটোই ছিলেন?” আবার অনেকের মন্তব্য, তিনি পুরুষ থেকে রূপান্তরিত নারী। কিন্তু তিনি শুধু ‘মানবিক’ একজন ‘মানুষ’ ছিলেন। প্রচলিত জীবনের বোধ ও যৌনতার সীমারেখা অতিক্রম করে যে মানুষ দাঁড়াতে চেয়ে বলেছিলেন “শিল্পীর কোনো জেন্ডার হয় না”।
তিনি আধুনিক বাংলা চলচ্চিত্রের অন্যতম শ্রেষ্ঠ পরিচালক, চিত্রনাট্যকার, গীতিকার ও অভিনেতা।
তিনি ঋতুপর্ণ ঘোষ।
ঋতুপর্ণ ঘোষ ভারতীয় বাঙালি চলচ্চিত্র পরিচালক। অর্থনীতির ছাত্র ঋতুপর্ণ ঘোষের কর্মজীবন শুরু হয়েছিল একটি বিজ্ঞাপন সংস্থার ক্রিয়েটিভ আর্টিস্ট হিসেবে। শুধু পরিচালনাই নয়, ঋতুপর্ণ একাধারে চিত্রনাট্যকার, গীতিকার ও অভিনেতা হিসেবেও ছিলেন সফল। সংলাপ রচনায়ও নিজের মেধার স্বাক্ষর রেখেছেন।
১৯৬৩ সালের আজকের এই দিনে ( ৩১ আগস্ট) কলকাতায় বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ঋতুপর্ণের জন্ম হয়।
ঋতুপর্ণ লেখাপড়া করেন কলকাতার সাউথ পয়েন্ট হাইস্কুলে। তার বাবা-মা দুজনই চলচ্চিত্রজগতের মানুষ ছিলেন। বাবা সুনীল ঘোষ ছিলেন তথ্যচিত্র নির্মাতা। স্কুল কলেজ পেরিয়ে ঋতুপর্ণ যাদবপুর ইউনিভার্সিটিতে অর্থনীতিতে ভর্তি হন। গত শতাব্দির আশির দশকে বিজ্ঞাপনী প্রতিষ্ঠানের কপিরাইটার হিসেবে পেশাজীবন শুরু করেন তিনি। বিজ্ঞাপনের চিত্রনাট্য লিখে বেশ নামও কুড়িয়েছেন তিনি। তবে মূল আগ্রহ ছিল চলচ্চিত্রে। ছিলেন সত্যজিৎ রায়ের ভাবশিষ্য।
১৯৯২ সালে তার প্রথম সিনেমা ‘হিরের আংটি’ মুক্তি পায়। এটি ছিল ছোটদের সিনেমা। এটি তৈরি হয়েছিল শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের একটি উপন্যাস অবলম্বনে। ১৯৯৪ সালে তার দ্বিতীয় সিনেমা ‘উনিশে এপ্রিল’ মুক্তি পায়। এই সিনেমাতে এক মা ও তার মেয়ের পারস্পরিক সম্পর্কের কাহিনি দেখানো হয়েছে। সিনেমাটি সমালোচকদের প্রশংসা কুড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে বাণিজ্যিকভাবেও সফল হয়।
১৯৯৫ সালে এই সিনেমা শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারও পায়। এরপর ১৯৯৭ সালে দহন সিনেমাটি মুক্তি পায়। এই সিনেমাটি শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্য বিভাগে জাতীয় পুরস্কার পায় এবং এই সিনেমার দুই অভিনেত্রী ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত ও ইন্দ্রাণী হালদার একসঙ্গে শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান। সিনেমার বিষয়বস্তু কলকাতার রাস্তায় এক মহিলা ধর্ষিত হওয়ার কাহিনি। অপর একটি মেয়ে সেই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী। সে এগিয়ে আসে অপরাধীদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে। কিন্তু সমাজ ও ধর্ষিতার পরিবার পরিজনের ঔদাসিন্যে সে হতাশ হয়।
১৯৯৯ সালে মুক্তি পাওয়া ‘অসুখ’ সিনেমাতে এক অভিনেত্রী ও তার আয়ের উপর অনিচ্ছুকভাবে নির্ভরশীল বাবার সম্পর্ক দেখানো হয়। এ সিনেমাটিও শ্রেষ্ঠ বাংলা সিনেমা বিভাগে জাতীয় পুরস্কার পায়। ‘বাড়িওয়ালি’ মুক্তি পায় ২০০০ সালে। এই সিনেমাতে এক নিঃসঙ্গ বিধবা (কিরণ খের) নিজের বাড়িটি এক ফিল্ম প্রোডাকশনকে ভাড়া দেন। তার অবদমিত কামনাবাসনাগুলো সিনেমার সুদর্শন পরিচালককে নিয়ে কল্পনার ডানা মেলে। এই সিনেমার জন্য কিরণ খের শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী বিভাগে জাতীয় পুরস্কার লাভ করেন।
২০০০ সালে মুক্তি পায় ‘উৎসব’ সিনেমাটি। এটি শ্রেষ্ঠ পরিচালনা বিভাগে জাতীয় পুরস্কার পায়। এই সিনেমার বিষয়বস্তু এক একান্নবর্তী পরিবারের ভাঙন। এই পরিবারের সদস্যরা তাদের পারিবারিক বাড়ি থেকে বেশি দূরে না থাকলেও বছরে শুধু একবার দুর্গাপূজার সময় একত্রিত হয়।
২০০২ সালে মুক্তি পায় ‘তিতলি’ সিনেমাটি। এই সিনেমার গল্প এক অভিনেত্রীর মেয়েকে কেন্দ্র করে। মেয়েটির প্রিয় ফিল্মস্টারের সঙ্গে এক সময় তার মায়ের প্রণয় সম্পর্ক ছিল।
২০০৩ সালে আগাথা ক্রিস্টির দ্য মিরর ক্র্যাকড ফ্রম সাইড টু সাইড অবলম্বনে ঋতুপর্ণ তৈরি করেন ‘শুভ মহরত’। এই সিনেমাতে অভিনেত্রী রাখী গুলজার ও শর্মিলা ঠাকুরের সঙ্গে অভিনয় করেন নন্দিতা দাস। একই বছর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উপন্যাস অবলম্বনে ঋতুপর্ণ তৈরি করেন ‘চোখের বালি’। এই সিনেমাতে বলিউড অভিনেত্রী ঐশ্বরিয়া রাইকে নিয়ে কাজ করেন তিনি।
২০০৪ সালে ঋতুপর্ণের প্রথম হিন্দি সিনেমা ‘রেনকোট’ মুক্তি পায়। এই সিনেমাটি ও হেনরির ছোটগল্প ‘দ্য গিফট অব দ্য ম্যাজাই’ (১৯০৬) অবলম্বনে নির্মিত। এই সিনেমাতেও ঐশ্বরিয়া রাই অভিনয় করেছিলেন; সঙ্গে ছিলেন অজয় দেবগন। সিনেমাটি শ্রেষ্ঠ হিন্দি সিনেমা বিভাগে জাতীয় পুরস্কার পায়।
২০০৫ সালে ‘অন্তরমহল’ সিনেমাটি মুক্তি পায়। এটি ব্রিটিশ আমলের এক জমিদার পরিবারের গল্প। জ্যাকি শ্রফ জমিদার চরিত্রে অভিনয় করেন। আর তার দুই স্ত্রীর চরিত্রে অভিনয় করেন সোহা আলি খান ও রূপা গাঙ্গুলী।
২০০৭ সালে ‘দ্য লাস্ট লিয়ার’ মুক্তি পায়। এটি একটি প্রাক্তন শেক্সপিয়ারিয়ান থিয়েটার অভিনেতার জীবনের গল্প। অমিতাভ বচ্চন কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করেন। এ ছাড়া প্রীতি জিনতা ও অর্জুন রামপালও এই সিনেমাতে অভিনয় করেন।
২০০৮ সালে মুক্তি পায় ‘খেলা’। এটি মানব সম্পর্কের গল্প। এটি মণীষা কৈরালার প্রথম বাংলা সিনেমা। একই বছর মুক্তি পায় তার ‘সব চরিত্র কাল্পনিক’ চলচ্চিত্রটি। প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় ও বিপাশা বসু অভিনীত এই সিনেমাটি শ্রেষ্ঠ বাংলা সিনেমা বিভাগে জাতীয় পুরস্কার পায়।
২০০৯ সালে যীশু সেনগুপ্ত, অনন্যা চট্টোপাধ্যায়, দীপংকর দে ও মমতা শঙ্কর অভিনীত সিনেমা ‘আবহমান’ মুক্তি পায়। এটিও শ্রেষ্ঠ পরিচালনা বিভাগে জাতীয় পুরস্কার পায়। মৃত্যুর আগে তিনি তার পরবর্তী সিনেমা ‘সত্যান্বেষী’ এর শুটিং শেষ করেছিলেন। এই সিনেমাটি গোয়েন্দা ব্যোমকেশ বক্সীর কাহিনি অবলম্বনে তৈরি হচ্ছিল।
মাত্র দুই দশকের পেশাগত জীবনে পেয়েছেন ১২টি জাতীয় পুরস্কার। এ ছাড়া কয়েকটি আন্তর্জাতিক পুরস্কারও পেয়েছেন ঋতুপর্ণ। তিনি মানুষের গল্প, মনোজগতের গল্প বলতে ভালোবাসতেন। চলচ্চিত্রের ভাষা তার সিনেমাতে ছিল প্রধান। তার সিনেমাতে ছোট্ট একটি ইঙ্গিতে খুলে যেত মনোজগতের দ্বার। আবার একইভাবে মনে উদয় হতো প্রশ্ন। তিনি সাবলীলভাবে দর্শককে তার সিনেমায় ডু্বিয়ে দিতে পারতেন। মানবিক অনুভূতির চরম শিখরে পৌঁছে দিতেন ইমেজের মধ্য দিয়ে।
২০১৩ সালের ৩০ মে মাত্র ৪৯ বছর বয়সে ঋতুপর্ণ ঘোষ মারা যান। বাংলা চলচ্চিত্রের নতুন এক যুগ তৈরি করেছিলেন ঋতুপর্ণ। তাঁর অকাল মৃত্যুতে সেই যুগের অবসান হয়।
খুব স্বাভাবিকভাবেই একটা মানুষ চায় পৃথিবীতে তার উত্তরসূরি রেখে যেতে। যে তাঁর বংশ পরম্পরা ধারণ করবে। বিভিন্ন সময়ে হঠাৎ হঠাৎ তার কথা স্মরণ করবে। কিন্তু এই মানুষটির রক্তের কোনো উত্তরসূরি নেই। তবে রক্তের সম্পর্কের চেয়েও সুদৃঢ় সম্পর্ক গড়েছিলেন চলচ্চিত্রের সঙ্গে। জীবন নিয়ে তিনি খেলেছেন ঠিক অন্যভাবে। পুরুষ হয়ে নারী-মন বোঝার জন্যে জীবনের শেষ সময়গুলোতে তিনি লিঙ্গ রূপান্তর নিয়ে ব্যস্ত থেকেছেন। বিভিন্ন সময়ে তাকে নিয়ে বিভিন্ন মহলে নানা কথা উঠে এসেছে। তার জীবনে প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি, ভালোবাসা-ঘৃণা সবই ছিল। কিন্তু এসবকে কাছে ভিড়তে না দিয়ে তিনি তার চিন্তা ফুটিয়ে তুলেছেন চলচ্চিত্রের পর্দায়।
‘দ্য লাস্ট লিয়ার’ (২০০৮) মুক্তির সময় ঋতুপর্ণ ঘোষের নিম্নের সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেন সাংবাদিক শ্রীমতী তৃষা গুপ্তা। ‘তেহেলকা’ ম্যাগাজিনে সাক্ষাৎকারটি প্রকাশিত হয়েছিল।
“প্রশ্ন: ভারতের বেশ কিছু চলচ্চিত্রকার আছেন যারা স্বতন্ত্রভাবে চিত্রনাট্য লিখছেন, আপনি তাদের মধ্যে একজন। চলচ্চিত্রকার হিসেবে ভাবার আগে আপনি কি নিজেকে একজন লেখক হিসেবে মনে করেন?
ঋতুপর্ণ ঘোষ: একটা বিজ্ঞাপন সংস্থার কপি রাইটার ছিলাম আমি। হ্যাঁ, শব্দ নিয়ে খেলতে আমি অভ্যস্ত। তবে নিজের চলচ্চিত্রের জন্য লিখতে আমি পছন্দ করি। এবং ঠিক যেমন অন্যের জন্য চিত্রনাট্য লিখতে আমি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি না, তেমনি অন্য কারো চিত্রনাট্যে কাজ করতেও আমার অস্বস্তি লাগে।
প্রশ্ন: চলচ্চিত্রে আসার আগে আপনার মাথায় কয়টি চলচ্চিত্রের গল্প প্রস্তুত ছিল?
ঋতুপর্ণ ঘোষ: চলচ্চিত্রে সংশ্লিষ্ট হওয়ার অন্যতম দিক হচ্ছে আমার লেখালেখি। একটা লাইন যখন লিখি তখন আমি ঠিক জানি, এটার নির্দেশনা আসলে কেমন হবে, কীভাবে করা উচিত। তাই আমি খুব কারিগরি উপায়ে নির্দেশনা করি। নির্দেশনার কাজটা হচ্ছে কারিগরি, যেখানে লেখালেখিটা মুক্ত-বহমান। ঠিকঠাক ডায়ালগ পেতে চিত্রনাট্য নির্দেশনার জন্যে আগে আমার একজন লেখক ছিল। কিন্তু এখন এটা করার কোন প্রয়োজন আমার নেই। প্রধানত আমি কখনোই আমার চিত্রনাট্যকে সেভাবে ভালোবাসিনি, মাঝে মাঝে আমার সহকারী পরিচালকরা খুব বিস্মিত হতো যখন আমি বলতাম তারা কিছু পরিবর্তন ঘটিয়েছে। এটা একবারে কংক্রিট কিছু না, আমি শুধুমাত্র এটা লিখেছি।
প্রশ্ন: নিজের ধারণা থেকে নির্মিত চলচ্চিত্র যেমন ‘তিতলি’ কিংবা ‘উৎসব’ এই দুইটি চলচ্চিত্রের সঙ্গে অন্যের কাহিনী নিয়ে নির্মিত চলচ্চিত্র- ধরুন ‘চোখের বালি’ কিংবা ‘দহন’ চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে সেরকম তুলনামূলক কোনো সম্পর্ক আছে কিনা?
ঋতুপর্ণ ঘোষ: আদৌ না। উপন্যাসের মূল ধারণাটা আমাকে উদ্বুদ্ধ করে। আমি শুধুমাত্র গল্পের চেতনাটাকে বিশ্বাস করি; গল্পের ক্ষেত্রে বিশ্বস্ত থাকার কোন প্রয়োজন মনে করি না। উদাহরণস্বরূপ, ‘চোখের বালি’ লেখা হয় ১৯০২ সালে এবং আমি এটাকে চলচ্চিত্রে রূপ দিই ২০০৩-এ। ঠাকুর নিজেও এই গল্পের শেষটা নিয়ে সন্তুষ্ট ছিলেন না। তার উপন্যাসটি শেষ হয় সব আশা-আকাঙ্খা পরিত্যাগ করে বিধবা বিনোদিনী বসবাস করতে যাচ্ছেন বেনারসে-এই ঘটনা দিয়ে। তবে আমার চলচ্চিত্র তার স্বাধীনতার উপর আলোকপাত করেছে। যখন বিনোদিনী তার চিঠিতে নিজের দেশ নিয়ে লিখছেন, যেটা শুধুমাত্র দেশ হিসেবে নয়, কোন জায়গা বা রাজ্য হিসেবে বিবেচনা করে পড়া উচিৎ। আমার চলচ্চিত্রের আরেকটা উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হচ্ছে, বিনোদিনীর চাদরে লাল রঙের ব্যবহার। ১৯০২ খ্রিস্টাব্দে লাল এর অর্থ ছিল ‘আবেগ’। কিন্তু পুরো বিশ শতক আমাদের শিখিয়েছে, বিপ্লবের প্রতীকও লাল। তাই ২০০৩ সালে আমি যখন লাল রং ব্যবহার করছি তখন সেটা আর ‘আবেগ’ থাকেনি, বিপ্লবে পরিণত হয়েছে। এখানে আমি ঠাকুরের চেয়ে এগিয়ে, কারণ গত একশ বছরে তার কোন অর্জন নেই।
প্রশ্ন: কলকাতায় বেড়ে ওঠা, সেখানকার শিল্প, সাহিত্য ও চলচ্চিত্রের ঐতিহ্য একজন চলচ্চিত্রনির্মাতা হিসেবে আপনাকে কতটুকু প্রভাবিত করেছে?
ঋতুপর্ণ ঘোষ: প্রচুর। চিত্রকর পরিবারে জন্মেছি আমি, তাই ঠিক ছোটবেলা থেকেই চিত্রপ্রদর্শনীতে যুক্ত ছিলাম। এখন আমি বুঝতে পারি, আমার ভিজু্য়্যাল ট্রেনিং তখন থেকেই শুরু। আমি ইংলিশ মিডিয়ামে পড়লেও বাড়িতে মাতৃভাষা চর্চার কমতি ছিল না। আমার বয়স যখন ছয়, আমার বাবা আমাকে বাংলাভাষায় অনূদিত ‘মহাভারত’ উপহার দিয়েছিলেন। এবং আমি একটার পর একটা অধ্যায় সশব্দে পড়ে ফেলি। যদি কোন শব্দের অর্থ আমি বুঝতে না পারতাম যেমন, ভ্যু (চক্রভ্যু); তখন বাবা বলতেন, পড়তে থাকো, বুঝতে পারবে। আমাকে অভিধান দেখার চর্চার মধ্যে রাখতেন তিনি। এবং পেন্সিল ছাড়া অন্যকিছু দিয়ে বই দাগাতে নিষেধ করতেন। সেই থেকে আজ পর্যন্ত পত্রিকা পড়তে গেলে আমার হাতে একটা পেন্সিল থাকে।
সাউথ পয়েন্ট স্কুল থেকে যখন যাদবপুর ইউনিভার্সিটিতে গেলাম, তখন সেটা ছিল পটভূমি ও আদর্শের গলনপাত্র। কলকাতা তখন বামদের শহর হয়ে উঠেছে। বামপন্থী হয়ে ওঠা তখন প্রায় ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে। অর্থনীতিতে পড়ার সময় আমিও মার্ক্স পড়েছিলাম। আমি চলচ্চিত্র উৎসবে যেতাম। সেখানে সত্যজিৎ রায়ের চলচ্চিত্র দেখে সিদ্ধান্ত নিই, চলচ্চিত্র নির্মাতাই হব আমি। এর আগেও তার কিছু চলচ্চিত্র আমি দেখি। কিন্তু ১৯৭৫ সালে ‘কলকাতা দূরদর্শন’ আসার পর সত্যজিতের সবগুলো চলচ্চিত্র দেখার পর আমার চোখ খুলে যায়। এ জন্যে টেলিভিশনের প্রতি আমি বিশেষভাবে কৃতজ্ঞ।
প্রশ্ন: আপনি সত্যজিৎ রায়ের কথা বললেন। ৬০-এর দশক পর্যন্ত বাংলা চলচ্চিত্র খুব জনপ্রিয়। গত কয়েক দশকে সেরকম কিছু পরিবর্তন কি ঘটেছে?
ঋতুপর্ণ ঘোষ: আপনি জানেন, তপন সিনহা এবং তরুণ মজুমদারের মতো বাঙালি পরিচালকেরা জনপ্রিয় চলচ্চিত্রের দলে জায়গা করে নিয়েছেন। কারণ, তাদের জন্যে অন্য কোন জায়গা আমরা খুঁজে পাচ্ছি না। তারাও কিন্তু বাস্তববাদী। তবে তাদের বাস্তবতা নির্মাণের পদ্ধতিগুলো সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক কিংবা মৃনাল সেন-এর থেকে ভিন্ন। বর্তমানে অভিনেতারা গ্রহণযোগ্য অভিনয়ের জন্যে কিছু নির্দিষ্ট ধরনের চলচ্চিত্রে কাজ করেন। বাংলা চলচ্চিত্রের শুরুর দিকে এটা কোনো ব্যাপারই ছিল না। এই বছর (২০০৮) সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় যখন সেরা অভিনেতা হিসেবে জাতীয় পুরস্কার পেলেন। আমি বলছি, আপনি যদি তার একই ধাঁচের চলচ্চিত্রের অভিনয়টাকে পাশে সরিয়ে রাখেন তাহলে দেখবেন, শুধুমাত্র জনপ্রিয় চলচ্চিত্রে তার নিজস্ব ভূমিকার জন্যে তিনি এই পুরস্কার পেতে পারেন। একই লেখক, একই ধরনের ভাবপ্রবণতায় চলচ্চিত্রায়ণ করা হলো: অজয় কর-এর ‘সপ্তপদী’ এবং সত্যজিৎ রায়-এর ‘জলসাঘর’ দুটোই তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্পে নির্মিত। শুধুমাত্র চলচ্চিত্রের নির্মাণশৈলীটা আলাদা। আমি মনে করি এখন বাংলা চলচ্চিত্র তার সাহিত্যের শেকড় থেকে বিচ্যুত হয়েছে। সংস্কৃতির সঙ্গে এর যে গভীর সম্পর্ক তাও নুইয়ে পড়েছে। তবে চলচ্চিত্র যে শুধু সাহিত্যিক সংশ্লিষ্টতায় থাকবে তা নয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজেই বলেছেন, এটা (গল্প-উপন্যাস) যদি শুধুমাত্র মূল গল্প থেকে একটু সরে যায় তাহলেই সেটা প্রকৃত চলচ্চিত্র হয়ে উঠবে। কিন্তু চলচ্চিত্রের দৃষ্টিভঙ্গি বাংলায় এখনো সেভাবে গড়ে ওঠেনি। এরা বর্ণনা করার প্রবণতা ছাড়তে পারে না, যে কারণে চলচ্চিত্রের গল্প নিকৃষ্ট মানের হয়ে ওঠে।
প্রশ্ন: কোন ভারতীয় চলচ্চিত্র নির্মাতার কাজ আপনার ভালো লাগছে?
ঋতুপর্ণ ঘোষ: আবারো বলছি, ‘কলকাতা দূরদর্শন’ থেকে আমি হিন্দী, বাংলা সব ধরনের চলচ্চিত্র দেখেই বড় হয়েছি। আমি চলচ্চিত্রের বিচারক নই। যে কারণে আমি সব ধরনের চলচ্চিত্র বানাতে পারি নি কিন্তু সব ধরনের চলচ্চিত্র দেখতে পারি। আমার ইচ্ছানুযায়ী ‘রক অন’ও দেখতে পারি কিংবা ‘তারে জামিন পার’ও দেখতে পারি। আমি ফারহান আখতারের কাজও যেমন উপভোগ করতে পারি তেমনি ফারাহ খানের কাজও। নাসিরউদ্দীন শাহ’র প্রথম চলচ্চিত্র ‘ইউ হোতা তো কিয়া হোতা’ (২০০৬) আমার খুবই পছন্দ। বিশাল ভরদ্বাজের কাজও আমার খুব পছন্দ। এবং ‘হানিমুন ট্রাভেলস’ ও ‘মিথ্যা’সহ সব ধরনের নতুন চলচ্চিত্রই আমার খুব ভালো লাগে। আমি মনে করি, সঞ্জয় লীলা বানসালি একজন গুরুত্বপূর্ণ চলচ্চিত্র নির্মাতা। যদিও তার কিছু চলচ্চিত্র নিয়ে আমার ভিন্নমত রয়েছে। মনিরত্নম, আদর গোপালকৃষ্ণ, অপর্ণা সেন, শ্যাম বেনেগালসহ আরো অনেকের চলচ্চিত্রই আমার পছন্দের। শ্যাম বেনেগালকে আমি সর্বশেষ ভারতীয় রেঁনেসা বলে মনে করি।
প্রশ্ন: আপনি শুধু বাঙালি অভিনেতাদের সঙ্গেই কাজ করেননি, প্রায় সময় বোম্বের অভিনেতাদের সঙ্গেও কাজ করেছেন। এমনকি দুটি চলচ্চিত্র বাংলা ভাষা ছাড়াও অন্য ভাষায় বানিয়েছেন। ‘রেইনকোট’ এবং ‘দ্য লাস্ট লিয়ার’ চলচ্চিত্র দুটি যে হিন্দী ও ইংরেজি ভাষায় নির্মাণ করলেন, সেটার কি অন্তর্নিহিত কিছু ব্যাপার ছিল?
ঋতুপর্ণ ঘোষ: ‘দ্য লাস্ট লিয়ার’ শুধুমাত্র ইংরেজিতেই নির্মাণ করা যেতে পারে। কিন্তু ‘রেইনকোট’ খুব সহজেই বাংলাতে হতে পারে। এটা সম্ভবত হিন্দীতে নির্মাণ করাই উচিৎ ছিল। কিন্তু আমি যদি শুধুমাত্র বাঙালি অভিনেতা নিয়েই কাজ করতে থাকি, তাহলে প্রতিভার এক বিশাল জায়গাকে আমার অস্বীকার করতে হবে। হিন্দীভাষী অভিনেতা দিয়ে বাংলা চলচ্চিত্র নির্মাণের চেয়ে, হিন্দীতে চলচ্চিত্র নির্মাণই আমার কাছে সহজ মনে হয়। ‘সানগ্লাস’ চলচ্চিত্রে যেমন বাংলা ও হিন্দী ভাষায় নাসিরউদ্দীন শাহ’র একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। হিন্দী-বাংলা দুই ধরনের ডায়ালগেই তিনি হিন্দী ভাষা ব্যবহার করেছেন, কারণ তিনি বাংলা বলতে পারেন না। আমি মনে করি, বহুভাষী চলচ্চিত্রের ধারণা নিয়ে আমাদের একটু ভেবে দেখা দরকার। যখন আমরা চলচ্চিত্রের সমন্বয় নিয়ে কথা বলি, তখন শুধু ভারতীয় চলচ্চিত্রের আন্তর্জাতিক চেতনা নিয়েই কথা বলি। কিন্তু দেশের ভিতরের চলচ্চিত্র নিয়ে আমরা ব্যাপক আলাপ করতে পারি। ‘রোজা’র মতো চলচ্চিত্রের কথায় ধরুন, যেখানে একজন তামিল মেয়ে বুঝতে পারে সে আর কারো সাথে যোগাযোগ করতে পারছে না এবং ভাষার পরিবর্তে সে প্রতীকী ভাষা ব্যবহার করে-এই ধরনের তিক্ততা হিন্দী ডাবিং থেকে হারিয়ে গেছে। এরকম সম্ভাবনাময় চলচ্চিত্রের বাজারজাত করার বুদ্ধি কেউ দেয় নি। আমরা রীতিবিরুদ্ধ চলচ্চিত্র নির্মাণ করি এবং গতানুগতিক চলচ্চিত্রের বাজারের সঙ্গে সেগুলোকে খাপ খাইয়ে নেওয়ার চেষ্টা করি। কিন্তু যদি নির্মিত চলচ্চিত্রের এক-পঞ্চমাংশও ঠিকঠাক বাজারজাত করা হয় তাহলে আমি আশা করি ভিন্ন ধরনের একটা চলচ্চিত্র শিল্প আমাদের গড়ে উঠবে।
প্রশ্ন: আপনার চলচ্চিত্রে যেমন ‘দহন’ ‘বাড়িওয়ালি’ ‘অন্তরমহল’ ‘শুভ মহরত’-এর কেন্দ্রীয় চরিত্রে জটিল নারীচরিত্র দেখা যায়। যেখানে পুরষ চরিত্র অনুপস্থিত থাকে, অনেক সময় পুরুষ চরিত্রকে দুর্বলভাবে কিংবা দানবীয়ভাবে হাজির হতে দেখা যায়। এই চরিত্রায়ণের সঙ্গে আপনি কি একমত?
ঋতুপর্ণ ঘোষ: আমি মনে করি ‘দহন’-এ নারীকে মহিমান্বিত করেছি এবং পুরুষের প্রতি ভয়ঙ্কর বিচার করেছি, যেটা খুবই সোজা ছিল। কিন্তু দুর্বলতার বিষয়টি নিয়ে আমি খুবই আগ্রহী ছিলাম। আমি পিতৃতান্ত্রিকতার বিরোধী। একজন নারী ও অপরজন পুরুষ হলেও ‘দ্য লাস্ট লিয়ার’-এর হ্যারি চরিত্রটি থেকে ‘বাড়িওয়ালি’র বনলতার মধ্যে খুব বেশি পার্থক্য নেই। দু’জনই একটা ক্ষমতা কাঠামোর লোভ ও রাজনীতিতে পীড়িত। এটাকে আপনি ‘ধূর্ত পিতৃতন্ত্রশাসিত সমাজ’ বলতে পারেন।
প্রশ্ন: কার্যত, শিল্পবিশ্বে, বিশেষভাবে চলচ্চিত্রে তারকার ধারণা যা আপনার অনেক চলচ্চিত্রের মধ্যেই দেখতে পাওয়া যায় সেই ‘উনিশে এপ্রিল’ এরপর ‘তিতলি’, ‘বাড়িওয়ালি’ এবং ‘শুভ মহরত’ থেকে ‘দ্য লাস্ট লিয়ার’-এর মধ্যে।
ঋতুপর্ণ ঘোষ: খ্যাতির সঙ্গে আসা ক্ষমতাগুলো অনুধাবনে আমার বেশ আগ্রহ আছে। এবং যেটার পেছনে মানুষের দুর্বলতা রয়েছে তা মানুষ অস্বীকার করতে চায়। এবং যে কারণে আমার কাজ দেখানো, ক্ষমতার চর্চা, নিয়ন্ত্রণ ও কারসাজির বিষয়গুলো সেখানে উপস্থিত রয়েছে।
প্রশ্ন: মাঝে মাঝে একটা কথা শোনা যায় যে, আপনার চলচ্চিত্র পূর্ণাঙ্গ চলচ্চিত্র নয় কিংবা অনেকেই মনে করেন এগুলা ‘নাট্য-চিত্র’। এ ব্যাপারে আপনার জবাব কী?
ঋতুপর্ণ ঘোষ: যদি আউটডোরে শুট করা হয় তাহলে সেটা চলচ্চিত্র আর ইনডোরে করা হলে সেটা নাটক-এ ব্যাপারে মানুষের একটা সাধারণ ধারণা আছে। এই মানদণ্ডে বিচার করলে শুধুমাত্র কুরোশাওয়ারটা চলচ্চিত্র, বার্গম্যানেরটা নয়। তাহলে ‘চেম্বার নাটক’ (ছোট কক্ষে অল্প অভিনেতা নিয়ে নির্মিত)-কে আপনি কী বলবেন? যেটা বার্গম্যানের প্রমাণিত চমৎকার চলচ্চিত্র। আমি বলছি না, বার্গম্যানের কিংবা আমার নির্মিত ‘রেইনকোট’ একটি মহান চলচ্চিত্র। কিন্তু ন্যায়সঙ্গত ধারায় আমার চলচ্চিত্রকে স্বীকৃতি না দেয়াটাকে আমি অগণতান্ত্রিকভাবেই দেখি কিছুটা।
প্রশ্ন: এমন কোনো চলচ্চিত্র কি নির্মাণ করেছেন যেখানে অন্যান্য চলচ্চিত্রের তুলনায় আপনি একটু বেশি সংযুক্ত করেছেন?
ঋতুপর্ণ ঘোষ: যে চলচ্চিত্রগুলো নিন্দিত হয়েছে কিংবা দর্শক জনপ্রিয়তা পায়নি সেগুলোকে সংরক্ষণ করে রাখার প্রবণতা একজন চলচ্চিত্রকারের মধ্যে সব সময়ই থাকে। তাই আমি বলবো ‘অন্তরমহল’র কথা, যেটাকে আমি খুব শক্তিশালী চলচ্চিত্র বলে মনে করি এবং ‘অসুখ’ এবং ‘দোসর’ যেগুলো অল্প দেখা। তবে বলতেই হয়, ‘দ্য লাস্ট লিয়ার’র সঙ্গে আমি খুব বেশি যুক্ত।
প্রশ্ন: ‘হীরের আঙটি’ নামে আপনি শিশুতোষ চলচ্চিত্র এবং রহস্যমূলক চলচ্চিত্র ‘শুভ মহরত’ নির্মাণ করেছেন। এই ধরনের চলচ্চিত্র আবার জনপ্রিয়তা পাবে বলে আপনি কি মনে করেন?
ঋতুপর্ণ ঘোষ: রঙ্গ পিসিমা (‘শুভ মহরত’র চরিত্র রাখী) নিয়ে আমি একটি পুরো গোয়েন্দা সিরিজ নির্মাণ করতে চেয়েছিলাম। বাছ-বিচারহীন অপরাধের কাহিনী নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ একটু কঠিনই যেটা আমি ‘শুভ মহরত’-এ দেখানোর চেষ্টা করেছিলাম। একটা ধূসর চরিত্র, পুলিশের কোনো হস্তক্ষেপ নেই, কিচ্ছু নেই। গোয়েন্দা জানে অপরাধ কে করেছে কিন্তু তিনি কিছইু করছেন না। ইচ্ছাকৃতভাবেই নারীকে আমি অপরাধী এবং গোয়েন্দা হিসেবে দেখিয়েছি। কারণ জন্মগতভাবেই তারা অতিমাত্রায় সহনশীল। একটা খুব সাধারণ গল্প যেখানে শিকারী এবং শিকারের মধ্যে বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পর্ক ছাড়া আর কোন সম্পর্ক নেই। কিন্তু কার্যকরীভাবে আপনি একজনের প্রতি আচ্ছন্ন না হলে কীভাবে এতোটা আবেগশূন্য হতে পারেন?
প্রশ্ন: উৎপল দত্তের ‘আজকের শাহজাহান’কে কীভাবে আপনি ‘দ্য লাস্ট লিয়ার’ এ রূপান্তরিত করলেন? মূল নাটক থেকে চলচ্চিত্রের কি কিছু পরিবর্তন হয়েছে?
ঋতুপর্ণ ঘোষ: কলেজের ছাত্রাবস্থায় আমি ‘আজকের শাহজাহান’ দেখেছিলাম এবং এটা খুব চলছিল। থিয়েটারের সঙ্গে চলচ্চিত্রের সম্পর্ক কী-সেই সময়ে এই প্রশ্নটি আমার মাথায় আসে। এবং উৎপলদাকে আমি বাংলার প্রেক্ষাপটে আনতে চেয়েছিলাম। হিন্দী চলচ্চিত্রে তিনি শুধুমাত্র কৌতুক অভিনেতা হিসেবে পরিচিত ছিলেন। কিন্তু তার মধ্যে চিত্রনাট্যকার হিসেবে কাজ করার সম্ভাবনা ছিল প্রবল। বয়স্কদের দূর্বলতা নিয়ে মূল নাটকটি লেখা। সেখানে শাহজাহান এবং তার কন্যা জাহানারার মধ্যে একটা সম্পর্ক রয়েছে অনুরূপভাবে লিয়ার এবং কর্ডেলিয়ার মধ্যেও এরকম সম্পর্ক রয়েছে। তাই যখন আমি বিশ্বজনীন আবেদন দিয়ে কিছু একটা করার চিন্তা করলাম তখন স্বাভাবিকভাবেই শেক্সপিয়রের কাছে চলে এলাম। আর এভাবেই ‘দ্য লাস্ট লিয়ার’ জন্ম নিল।”
আজ ছয় বৎসরের বেশি হয়ে গেলো “সত্যান্বেশী” তে, চিরন্তন সত্যের অন্বেষণে তিনি পাড়ি দিয়েছেন অমৃতলোকে, জীবনের অন্তিম শূন্যতায়।
বাংলা চলচ্চিত্রের এই বিরাট শূন্যস্থান কি পূরণ হবে আদৌ কখনও? পারবেন কি ইন্ডাস্ট্রিতে পাড়ি দেওয়া নবীন প্রজন্ম এই ক্ষতিপূরণ দিতে?
আপামর মানুষের নিরবচ্ছিন্ন আবেগ – “রিয়্যাল” থেকে “রিল” — “টেকনিশিয়ান্স” থেকে “ইন্দ্রপুরী” —
ঋতুপর্ণের পর কে হবেন সেই সেলুকাস???
(তথ্যসূত্র:
১- তাহেলকা পত্রিকা, অক্টোবর সংখ্যা, ২০০৮ সাল।
২- আনন্দবাজার পত্রিকা, ২রা জুন ২৯১৩, ৩০শে মে ২০১৪।
৩- বর্তমান পত্রিকা, ৩০ শে মে ২০১৪।
৪- উইকিপিডিয়া।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত