চর্যাপদ থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক কালের বাংলা গান রচয়িতাদের মধ্যে কাজী নজরুল ইসলামের গানে বিষয়ের যে বৈচিত্র্য, অন্য কারও গানে তা নেই। যুগের প্রয়োজনে এক এক কালে এক এক বিষয় প্রাধান্য বিস্তার করে। চর্যাগানের মূল বিষয় ছিল আধ্যাত্মিকতা। বৈষ্ণব পদাবলীতে পৌরাণিক বিষয় স্থান পেয়েছে। তার সঙ্গে কোথাও কোথাও প্রেমরস মিশ্রিত হয়েছে। পরবর্তী পর্যায়ের গানে লৌকিক ধ্যান ধারণা প্রবেশ করেছে। পরাধীনতার যুগে এসে গানের বিষয় হয়েছে দেশাত্মবোধ ও বিদ্রোহ চেতনা। এসব ছাপিয়ে সাম্প্রতিককালে প্রাধান্য বিস্তার করেছে মানবীয় প্রেম।

বাংলা গানের বিকাশ ও সমৃদ্ধির ধারায় অন্যতম প্রধান হলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, অতুলপ্রসাদ সেন, রজনীকান্ত সেন এবং কাজী নজরুল ইসলাম। এছাড়াও বাংলা গানকে যাঁরা সমৃদ্ধ করেছেন, নতুন সুর ও রীতির প্রবর্তন করেছেন, তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য রামপ্রসাদ সেন, রামনিধি গুপ্ত, দাশরথি রায়, হাসন রাজা, লালন ফকির, বিজয় সরকার প্রমুখ। এঁদের প্রত্যেকের গানেই রয়েছে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য। গানের বিষয়, সুর, আবদনে রয়েছে স্বকীয়তা। কিন্তু অনেকের গানেই বিষয়-বৈচিত্র্য নেই। কেউ শ্যামাসঙ্গীত লিখেছেন তো অন্য কোন বিষয়ে লেখেননি। কেউ শুধু অধ্যাত্মিক ভাবের গান রচনা করেছেন। কেউ বাউল বা কেউ আধুনিক প্রেমমূলক গান। আবার কেউ কেউ নানা বিষয় নিয়ে গান লিখেছেন। কিন্তু এত ব্যাপক বিষয়ের অবতারণা নজরুল ছাড়া শ্যামাসঙ্গীতও রচনা করেছেন। রামনিধি গুপ্ত টপ্পা অঙ্গের গান। দাশরথি রায় পাঁচালি গান রচনা করেছেন। হাসন রাজা-লালন ফকির লোকসঙ্গীত, বাউল গান রচনা করেছেন। বিজয় সরকারের গানের বিষয় আধ্যাত্মিকতা। এঁদের প্রত্যেকের গানেই যে কোন একটি বিষয় নির্ভর করেছে। একই বিষয় ও ভাবের গান রচনা করেছেন সারা জীবন ধরে। ব্যতিক্রম রবীন্দ্র, নজরুল, দ্বিজেন্দ্রলাল, অতুলপ্রসাদ ও রজনীকান্ত,। দ্বিজেন্দ্রলাল, অতুলপ্রসাদ এবং রজনীকান্ত মূলত ভক্তিমূলক, দেশাত্মকবোধক এবং প্রেম বিষয়ক গান রচনা করেছেন। দ্বিজেন্দ্রলাল অবশ্য হাস্যরস বিষয়ে কিছু গান রচনা করেছেন। কিন্তু এ তিন জনের গানেই খুব বেশি বিষয় বৈচিত্র্য নেই। বিষয় বৈচিত্র্য রয়েছে রবীন্দ্র-নজরুলের গানে বেশি। এত বিচিত্র বিষয় নিয়ে বাংলার আর কোন গীতিকার সঙ্গীত রচনা করেননি। নানা বিষয় সঙ্গীত লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ। নজরুল লিখেছেন তারও বেশি বিষয় নিয়ে।
প্রসঙ্গত বলে রাখি, গানের বিষয় বলতে আমি গানের মর্মবাণীকে যেমন বুঝাচ্ছি, তেমনি বুঝাচ্ছি সঙ্গীতের ধারা বা শ্রেণীকে। অর্থাৎ কথার অন্তর্নিহিত ভাব কোন আবেদন প্রকাশ করছে, সে অনুসারেই সঙ্গীতের শ্রেণীকরণ করছি। যেমন ভক্তিমূলক, আধ্যাত্মিক, বৈষ্ণব, পদাবলী, কীর্তন, জারি, সারি, ভাটিয়ালি, পল্লীগীতি, গজল, প্রেমসঙ্গীত ইত্যাদি। সঙ্গীতের এই নানা শাখায় বিচরণ করেছেন নজরুল। রবীন্দ্রনাথও বিভিন্ন, বহু বিষয়ে গান লিখেছেন। যেমনস ব্রহ্মসঙ্গীত, দেশাত্মবোধক, ভক্তিমূলক, কীর্তন, পদাবলী, প্রেম, প্রকৃতি, সম্প্রীতি, সমাজসচেতনা, আধ্যাত্মিকতা, বাউল ইত্যাদি বিষয় নিয়ে গান রচনা করেছেন। তিনি প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সুরের মিশ্রণ ঘটিয়েছেন সুরে। রামপ্রসাদী, কীর্তন, বাউল সুরের অনুপ্রবেশ ঘটিয়েছেন তাঁর গানে। কিন্তু নজরুল আর একটু এগিয়ে বাংলায় গজল রচনা করেছেন। মধ্যপ্রাচ্য অর্থাৎ আরবীয় সুরে সঙ্গীত রচনা করেছেন। জারি, সারি, মুর্শিদি, মারফতি, ভাটিয়ালি, গান যেমন লিখেছেন, তেমনি লিখেছেন, শ্যামাসঙ্গীত, কীর্তন, ভজন ইত্যাদি গান; আবার আধুনিক মানবীয় প্রেমসঙ্গীত, রাগসঙ্গীত, বিদ্রোহ ও দেশাত্মকবোধক গানও লিখেছেন নজরুল।
গ্রামোফোন কোম্পানির সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পর থেকে নজরুল অজস্র গান লিখে যাচ্ছিলেন। সেই গানের সম্ভার পরিমাণে যেমন বিপুল, শ্রেণী বিভাগেও তেমনি বিচিত্র। লঘু বাংলা গান থেকেও গুরুগম্ভীর ধ্রুপদ পর্যন্ত বাংলা গানের হেন শাখা নেই যাতে তিনি গান রচনা করেননি। বিদেশি গানের অনুকরণে বিদেশি সুর বসিয়েও অনেক গান রচনা করেছেন তিনি। বৈচিত্র্য ও বিপুলতা এ দুইই নজরুলের সঙ্গীত প্রতিভার প্রাচুর্যের স্বাক্ষর বহন করে।’
প্রায় তিন হাজার গান রচনা করেছেন নজরুল। এ এক বিশাল কর্মযজ্ঞ। আর নজরুলের গানের কথা, সুর ও বিষয়-বৈচিত্র্য সকলকে বিস্ময়াভিভূত করে। বৈষ্ণব যারা তাঁরা রাধাকৃষ্ণের বাল্যলীলা, প্রেমলীলা ও গোষ্ঠিলীলায় সুর-চিত্র দর্শনের দুর্লভ সুযোগ লাভ করবেন নজরুলের রচনায়। শাক্ত যিনি, তিনি শ্যামামায়ের পায়ের তলায় নিজের মনটিকেও একটি রাঙা জবা করে ধরে দিতে পারেন নজরুলের শ্যামসঙ্গীতের খেয়ায় ভেসে। মুসলমান যিনি, তিনি ঈদের বাঁকা চাঁদ প্রথম দেখার আনন্দে আত্মহারা হবার ভাষা খুঁজে পাবেন এই নজরুল গীতির থেকেই। প্রেমিক যিনি, তিনি প্রেমের বিভিন্ন স্তরের সুখের ও শোকের সাড়া পাবেন নজরুলের গানে। তাঁর হাসির গানের সংখ্যাও কম নয়। তাঁর দেশাত্মবোধক গান সারা বাংলা তথা ভারতের নিপীড়িত জনগণের অন্তর মথিত বাণী।
সারা জীবন নজরুল নানা জায়গা ঘুরছেন, বিচিত্র পেশা গ্রহণ করেছেন, বহু অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। নিজে ছিলেন শিল্পী এবং সুরস্রষ্টা। আর তাই অভিজ্ঞতালব্ধ বিষয়ই তার সঙ্গীতের বিষয় হয়ে উঠেছে। তাঁর কর্ম এবং অভিজ্ঞতা যেমন বিচিত্র ছিল; তেমনি তাঁর গানের বিষয়ও বিচিত্র ছিল। সঙ্গীত ছিল তাঁর একান্ত ব্যক্তিক অনুভূতির পরিম-ল। সঙ্গীত রচনাতেই সম্ভবত তিনি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন বেশি। আর এ কারণেই তার সঙ্গীত এত বিপুল ও বৈচিত্র্যময়। জাত-পাতে তাঁর বিশ্বাস ছিল না। তিনি মানুষ। তিনি সর্ব জাতির, সর্ব ধর্মের। আর এ বোধেরই প্রকাশ দেখা যায় তাঁর বিচিত্র বিষয়ের গানে। এদিকে যেমন লিখেছেন ভজন, কীর্তন, শ্যামসঙ্গীত, অন্যদিকে তেমনি লিখেছেন ইসলামি ভক্তিমূলক গান, জারি, সারি, মুর্শিদি মারফতি।
লেটোর দলকে কেন্দ্র করেই কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গীত ও কাব্য প্রতিভার বিকাশ ঘটে। এখানেই একই সঙ্গে বহু বিচিত্র বিষয়ে গান রচনায় তাঁর হাতে খড়ি হয়। লেটোর দলের জন্য পালা রচনা করতে গিয়ে মুসলিম ও হিন্দু সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সঙ্গে নজরুলের পরিচয় ঘটে। তিনি একদিকে যেমন মুসলিম জীবনধারা থেকে কাহিনী ও গীত রচনার উপাদান সংগ্রহ করেন, অপরদিকে হিন্দু পৌরাণিক উপাখ্যানের পটভূমিতেও পালাগান রচনা করেন। তাঁর সে সময়কার রচনাতেই এই দুই ঐতিহ্য স্রোতের সহাবস্থান লক্ষ্য করা যায়। নজরুলের পরবর্তীকালের বহু রচনায় মুসলিম ও হিন্দু ঐতিহ্যের যে অসামান্য সহাবস্থিত রূপটি প্রকাশ পেয়েছিল, তার সূচনা ঘটে এই পর্বে। তাছাড়া লেটোর দলের সঙ্গে যুক্ত হবার ফলে তিনি বর্ধমান অঞ্চলের লোকসংস্কৃতির সঙ্গে পরিচয়েও সুযোগ পেয়েছিলেন। সে অঞ্চলে বিশেষভাবে প্রচলিত ঝুমুর গানের সঙ্গে সে সময়ই নজরুলের পরিচয় ঘটে। পরবর্তীকালে ঝুমুর অঙ্গে বহু গান রচনা করেছিলেন তিনি। এই বিচিত্র অভিজ্ঞতার প্রকাশই তাঁর নানা গানে। এমন কোন বিষয় নেই, যে বিষয় নিয়ে তিনি গান রচনা করেননি।
নজরুলের এই ব্যাপক কর্মযজ্ঞ, বিশাল বিষয়-বৈচিত্র্যময় সঙ্গীত ভা-ার পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, বাংলা গানে যে সব ধারা প্রচলিত রয়েছে, নজরুলের গানেও সে সব ধারা রয়েছে। নজরুলের গানের উল্লেখযোগ্য ধারাগুলো হচ্ছে- ভজন, কীর্তন, শ্যামাসঙ্গীত, জারি, সারি, ভাটিয়ালি, পল্লীগীতি, মুর্শিদি, মারফতি, হামদ, নাত, আধুনিক প্রেমসঙ্গীত, গজল, রাগসঙ্গীত, দেশাত্মবোধক, বাউল সঙ্গীত, ঝুমুর, বিদ্রোহমূলক, হাসির গান ইত্যাদি। বাংলার আর কোন সঙ্গীত রচয়িতা এত বিচিত্র বিষয় নিয়ে গান রচনা করেননি। নজরুল গানের এই প্রত্যেকটি শাখায় সফলতা লাভ করেছেন। এখানেই নজরুলের শ্রেষ্ঠত্ব।
নজরুলের গানে এক বিশাল অংশ জুড়ে রয়েছে ভজন গান। ভজন এক জাতীয় আরাধনা সঙ্গীত বা ভক্তিগীতি। ঈশ্বর বন্দনাই এ গানের উদ্দেশ্য। অন্য কোন বাংলা গান রচয়িতা নজরুলের মত এত উৎকৃষ্ট, সমৃদ্ধ এবং বিপুল ভজন রচনা করতে সক্ষম হননি। তাঁর ভজন তথা হিন্দুধর্মীয় সঙ্গীত যেমন বিপুল, তেমনি বিস্ময়কর সঙ্গীত যেমন বিপুল, তেমনি বিস্ময়কর রকম বৈচিত্র্যপূর্ণ। ‘হে গোবিন্দ রাখো চরণে’, ‘সখি সে হরি কেমন বল,’ ‘খেলছি এ বিশ্ব লয়ে,’ ‘অনাদি কাল হতে অনন্ত লোক গাহে তোমারি জয়’, ‘আহার দিবেন তিনি রে মন, ‘জিভ দিয়াছেন যিনি,’ ‘অঞ্জলি লহৈা মোর সঙ্গীতে’, ‘কোথা তুই খুঁজিস ভগবান’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য গানসহ বহু ভজন লিখেছেন নজরুল।
বুলবুলের মৃত্যু নজরুলের জীবনে এক গভীর পরিবর্তনের বীজ বপন করে। অগ্নিগর্ভ কবিতা ও গীত রচয়িতা বিদ্রোহী নজরুল এই শোকের আঘাতে অনেকটা স্তিমিত হয়ে পড়েন। এক প্রকার আধ্যাত্মিকতা তাঁকে গভীরভাবে পেয়ে বসে। অন্তর্গত বিষাদ ও আধ্যাত্মিকতাই যেন ছিল তার চৈতন্যের বাদীস্বর। সেই সময় থেকেই নজরুলের ভেতরে ভক্তিমূলক গান লেখার প্রবণতা দানা বাঁধতে থাকে। এবং পরবর্তী সময়ে তিনি ইসলাম ও হিন্দু ধর্মীয় আবেগের পটভূমিতে প্রচুর গান রচনা করেন। ভজনগুলো সেই অনুভূতিরই বহিঃপ্রকাশ। নজরুলের গানের একটা বড় অংশ জুড়ে রয়েছে এই ভজন জাতীয় গানগুলো। কোন কোন ভজন গানে শিবের আরাধনা ব্যক্ত হয়েছে। কোনটায় কৃষ্ণের কথা। পদাবলী কীর্তনের ঢঙে নজরুল প্রচুর কীর্তন রচনা করেছেন। কথা ও সুরে পুরোপুরি কীর্তন। কিছু গান ভজনও বলা চলে, আবার কীর্তনও বলা চলে; দুইয়েরই প্রভাব রয়েছে। যেমন: ‘হৃদি পদ্মে চরণ রাখো’, ‘বাঁকা ঘনশ্যাম’; ‘গোষ্ঠের রাখাল বলে দেরে কোথায় বৃন্দাবন’ ইত্যাদি।
পদাবলী কীর্তন বা কীর্তন গান বাঙালির বহু কালের ঐতিহ্যের ধারক। এগুলো বাঙালির অন্তর-সম্পদে পূর্ণ। বাংলার নিজস্ব ঢঙ, চিরায়ত সুর এ গানে বিধৃত। রবীন্দ্রনাথও বহু কীর্তনাঙ্গের গান রচনা করেছেন। নজরুলের কীর্তন খুবই ঋদ্ধ। কথা ও সুরের সার্থক সমন্বয় ঘটেছে নজরুলের কীর্তনে। আধুনিককালে যাঁরা কীর্তন গান রচনা করেছেন, তাঁদের মধ্যে নজরুলের কীর্তনই শ্রেষ্ঠ এবং সংখ্যায়ও প্রচুর। উল্লেখযোগ্য কীর্তনগুলো হচ্ছে- ‘বাজে মঞ্জুল মঞ্জীর’, ‘সখি আমিই না হয় মান করেছিনু; ‘ওরে নীল যমুনার জল, আমি সুখে লো গৃহে রব, ‘না মিটিতে মনোসাধ, ‘মন মানস মাধবী ফুটিল কুঞ্জে, মণি মঞ্জীর বাজে অরুণিত চরণে, ‘এলো নন্দের নন্দন নবঘনশ্যাম’। মধ্যযুগের বৈষ্ণব পদাবলীর চেয়ে নজরুলের এ কীর্তনগুলো শিল্প সফরতায় কোন অংশেই কম নয়।
নজরুলের গানের একটা বিশাল অংশ জুড়ে যেমন রয়েছে ভজন এবং কীর্তন গান; তেমিন ব্যাপক অংশ জুড়ে রয়েছে শ্যামাসঙ্গীত। এত বিপুল পরিমাণ শ্যামাসঙ্গীত সমগ্র বঙ্গদেশে সম্ভবতঃ কাজী নজরুল ছাড়া আর কেউই লেখেননি। নজরুল ইসলামি ভাবধারার গানের থেকে অনেক অনেক বেশি তাঁর শ্যামাসঙ্গীত। রামপ্রসাদ শ্যামাসঙ্গীত রচনার সূত্রপাত করেন। নজরুল শ্যামাসঙ্গীতে কোথাও শ্যামা মাতৃরূপিণী, কোথাও কালীর রৌদ্রী রূপের ভয়ঙ্কর বর্ণনা, আবার কোথাও দেশাত্মবোধের প্রেরণা প্রকাশিত। অন্যান্য গানের চেয়ে নজরুলের শ্যামাসঙ্গীত সবচেয়ে সমৃদ্ধ এবং পরিমাণের প্রচুর বেশি। তাঁর উল্লেখযোগ্য শ্যামাসঙ্গীত হচ্ছে- ‘বলরে জবা বল;’ ‘শ্যামা নামের লাগলো আগুন’, ‘আমার কালো মেয়ের পায়ের তলায়’, ‘শ্মশানকালীর রূপ দেখে যা’; ‘শ্মশানে জাগিছে শ্যামা’, ‘থির হয়ে তুই বস দেখি মা; ‘ভারত শ্মশান হলো মা তুই; ‘আয় মা চঞ্চলা মুক্তকেশি শ্যামা কালী’; ‘শ্যামা তোর নাম যার জপমালা’; ‘ওমা খড়গ নিয়ে মাতিস রণে’।
নজরুল প্রচুর পরিমাণে জারি, সারি, ভাটিয়ালি এবং পল্লীগীতি রচনা করেছেন। এসব গানেও বাঙালির, আবহমান বাংলার ঐতিহ্য ধরা পড়েছে। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের আবেগ যেন এসব গানে স্থির হয়ে রয়েছে। ‘পদ্মার ঢেউরে’, ‘মোর শূন্য হৃদয় পদ্ম নিয়ে’, ‘যা যারে’, এই বিখ্যাত গানগুলি তাঁর লিখিত ভাটিয়ালি গানের উৎকৃষ্ট উদাহরণ। এছাড়াও রয়েছে- ‘নদীর এ কূল ভাঙে ও কূল গড়ে’, ‘এইতো নদীর খেলা’; ‘আমার গহীন জলের নদী’; ‘নদীর নাম সই অঞ্জনা’; ‘বাঁশি বাজায় কে কদম তলায়’, ‘ওগো ললিতে’, ‘পথভোলা কোন রাখাল ছেলে’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য গান।
ভক্তিমূলক গান রচনায় নজরুল অদ্বিতীয়। নজরুলের ইসলামি ভাবধারায় গানগুলোতে মুসলিম ঐতিহ্য ধরা পড়েছে। মুর্শিদি মারফতি হামদ নাত প্রভৃতি বিষয়ে নজরুল ইসলামি ভাবধারায় প্রচুর গান লিখেছেন। ভক্তি, শরণাগতি ও মাহাত্মবোধের প্রেরণা থেকে নজরুল ইসলাম ধর্ম সম্পৃক্ত বিভিন্ন বিষয় অবলম্বনে দুই শতাধিক গান রচনা করেছেন। এই সব গান নজরুলের ইসলামি গান রূপে খ্যাত। বাংলায় ইসলামি ভক্তিগীতির প্রবর্তন নজরুলই প্রথম করেন। তাঁর রচিত ইসলামি গান বাংলা গানের এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে। বাংলায় ইসলামি গানের সর্বশ্রেষ্ঠ রূপকারও নজরুল। আল্লাহর প্রশস্তি, রসূল প্রশস্তি, ধর্মীয় বিধান, ধর্মীয় অনুষ্ঠান, উপাসনা, উপাসনালয় প্রভৃতি নানা বিষয় অবলম্বনে নজরুলের ইসলামি গানগুলো রচিত। নজরুলের উল্লেখযোগ্য ইসলামি গানগুলো হচ্ছে- ‘মহম্মদের নাম জপেছিলি বুলবুলি তুই আগে’, ‘রমজানের ওই রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ’, ‘এই সুন্দর ফুল’, ‘সুন্দর ফল’, তোরা দেখে যা আমিনা মায়ের কোলে; খোদার প্রেমেরর ‘শরাব পিয়ে’; ‘শোনো শোনো ইয়া ইলাহী আমার মোনাজাত’; ‘মওলা আমার সালাম লহ’; ‘ত্রিভুবনের প্রিয় মোহাম্মদ এলো রে দুনিয়ায়’; ‘মসজিদেরই পাশে আমার কবর দিও ভাই’; ‘মরু সাহারা আজ মাতোয়ারা’; ‘মোহাম্মদ মোর নয়ন-মণি’; ‘তোমার নুরের রোশনী মাখা’; ‘রোজ হাশরে আল্লাহ আমার করো না বিচার।’
আধুনিক বাংলা প্রেমগানের বিশিষ্ট রূপকার নজরুল। তৎকালীন ছায়াছবির একটা প্রধান অংশ জুড়ে ছিল নজরুলের গান। আধুনিক গানকে নজরুলই জনপ্রিয়তা দান করেছেন। তাঁর আধুনিক গানের আবেদন আজকে এতটুকু হ্রাস পায়নি। আধুনিক গানের পরিমাণও নজরুলের কম নয়। নজরুলের আধুনিক গানের সুর বৈচিত্র্য আশ্চর্যভাবে বিস্ময়কর। কালজয়ী কিছু গান- ‘গভীর নিশীতে ঘুম ভেঙ্গে যায়’; ‘তুমি সুন্দর তাই চেয়ে থাকি’, ‘প্রিয়, জনম জনম গেল আশা পথ চাহি’; ‘মোরা আর জনমে হংস মিথুন ছিলাম’; ‘আজো মধুর বাঁশরী বাজে’; ‘আমি চিরতরে দূরে চলে যাবো’; ‘তবু আমারে দেবো না ভুলিতে’; ‘যারে হাত দিয়ে মালা দিতে পারো নাই’, ‘কেন মনে রাখো তারে’; ‘আমি চাঁদ নহি অভিশাপ’; ‘মনে পড়ে আজ সে কোন জনমে’, ‘বিদায় সন্ধ্যা আসিল’; ‘মোর প্রিয়া হবে এসো রাণী’; ‘ভীরু এ মনের কলি’; ‘মোর না মিটিতে আশা ভাঙিল খেলা’ ইত্যাদি।
বাংলায় গজল গানের প্রচলন মূলত নজরুলই করেন। গজল মূলত পারস্য প্রেম সঙ্গীত। ফার্সি কবিরা গজল রচনা করতেন। এ প্রেম ঐশী প্রেমপ্রার্থী। অন্য সকল প্রকার কাব্যগীতির মত জগলেরও সঙ্গীতাদর্শ হচ্ছে সুরের সাহায্যে গানের বাণীকে ধ্বনিত করে তোলা, যেন পদবাহিত ব্যঞ্চনা সুরের স্পর্শে প্রমূর্ত হয়ে উঠতে পারে।
মধ্যযুগের বাংলা কাব্যে-সংগীতে দু’টি ধারা বলবতী হয়েছিল, বৈষ্ণব আর শাক্ত পদাবলী। বৈষ্ণব সাহিত্যের মূল উপাদান রাধাকৃষ্ণের প্রেম। ভক্তকে রাধা বা ষোড়শসহস্র গোপিনীদের একজনরূপে কল্পনা করে পরমপুরুষ বা পুরুষোত্তম বিষ্ণুর কাছে নিঃশর্তে আত্মনিবেদনেই বৈষ্ণব কাব্যের সার্থকতা। বিষ্ণুপুরাণ বা হরিবংশের পরবর্তীকালে কৃষ্ণসহচরীরূপে রাধাকে সংগীত-কাব্যে নিয়ে আসেন বাংলার সংস্কৃত-কবি জয়দেব ও মৈথিল-কবি বিদ্যাপতি। তারপর পঞ্চদশ-ষোড়শ শতাব্দীর সন্ধিক্ষণে ঘটে চৈতন্যদেবের আবির্ভাব ও সেইসঙ্গে সুরদাস, কবীর, মীরাবাঈ, চণ্ডীদাস প্রমুখ একরাশ সমসাময়িক কবি-প্রতিভা ভারতে ভক্তিযুগের প্লাবন নিয়ে আসে। বেদের কিছু অংশ, শিবপুরাণ ও চণ্ডীর মাধ্যমে যে শক্তিপূজার সূচনা হয়েছিল এককালে তার রেশ স্তিমিত হয়ে থেকে যায় মুষ্টিমেয় তামসিক ও বুদ্ধোত্তরকালীন হীনযানী-বজ্রযানী তান্ত্রিক সাধকদের মধ্যে।
বস্তুতঃ শাক্তধর্ম মানে শক্তিবাদ। বৈষ্ণব-সাহিত্যের মত শাক্ত-কাব্যের মূলেও ছিল ভক্তি, তবে আধুনিক বৈষ্ণব সাহিত্যে যেমন ছিল আদিরসের প্রাধান্য, শাক্ত-সাহিত্য মূলতঃ সন্তানবৎসলা মাতা রূপে নারীশক্তির আরাধনা। হিন্দুধর্মের একটি শাখাসম্প্রদায় ছিল এই শক্তি-অনুসারীরা। দিব্য মাতৃকা-শক্তি বা দেবী পরম ও সর্বোচ্চ ঈশ্বর– এই মতবাদের ওপর ভিত্তি করেই শাক্তধর্মের উদ্ভব।
খ্রিস্টীয় দ্বাদশ-ত্রয়োদশ শতকে বাংলায় বৈষ্ণবধর্মের পাশাপাশি শাক্তধর্মের উদ্ভব ঘটে এবং তাকে কেন্দ্র করেই শাক্তগীতি চর্চার একটি ক্ষীণ ধারা প্রচলিত হয়। এই সময় বঙ্গদেশের তৎকালীন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বৈষ্ণবধর্মের চেয়ে শাক্তদর্শন ও শক্তিপূজা ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে উঠতে থাকে। বাঙালি প্রাচীনকাল থেকেই মাতৃকা উপাসক, তন্ত্রে আর সাংখ্যে যাকে প্রকৃতি বলে, বাঙালি সেই শক্তির উপাসক। চার হাজার বছরের পুরোনো পাণ্ডু রাজার ঢিবিতে অনেকগুলি মাতৃকামূর্তি পাওয়া গেছে। কিন্তু এই বাঙালি জাতি এতগুলো ওঠাপড়ার মধ্য দিয়ে গেছে, যে তার ক্রমিক বিবর্তনের ইতিহাস ঠিকভাবে গড়ে উঠতে পারেনি, খণ্ড খণ্ড বিচ্ছিন্নভাবে এখানে সেখানে রয়ে গেছে। গোপালদেবের আগে বাংলায় মাৎস্যন্যায় এসেছিল। মধ্যযুগে বখতিয়ার খিলজিরা এসেছেন, নালন্দা সহ সবকটি বিশ্ববিদ্যালয় তাঁরা পুড়িয়ে ফেলেছেন। ফলে একটানা ধারাবাহিকতা খুঁজে ইতিহাস পাওয়া দুষ্কর। কিন্তু জমি যেখানে উর্বরা, সেখানে যে সামান্য যত্নেই সোনার শস্য ফলে, তা বাংলার শাক্তসঙ্গীত দেখলেই বোঝা যায়।
মুসলমান আমল থেকে ইংরেজ শাসনকাল পর্যন্ত বহু শতাব্দীর পীড়ন আর অত্যাচার সয়ে অহিংস ভক্তির অসারতা বাঙ্গালী ধীরে ধীরে বুঝতে পারে, প্রেমের স্থলে শক্তি প্রাধান্য পেতে থাকে। বঙ্গজীবনের সংস্কৃতি, কাব্যে ও গানে শাক্তগীতি আপন স্থান তৈরি করে নেয়। কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ মধ্যযুগে কালীমূর্তি তৈরি করেন এবং তারপরের চারশো বছরে বাঙালি কর্তৃক মা কালীর উপাসনা যেভাবে দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়ে, তা থেকে স্পষ্ট যে এটি একটি ধর্মসংস্কার আন্দোলন ছিল, এবং মুষ্টিমেয় দার্শনিক বা ধর্মপ্রচারকের প্রেরিত সংস্কার নয়, এ ছিল গণসংস্কার। সংস্কার মানেই তো শুধু অতীতকে ভাঙা নয়, কেবল রীতিনীতিকে ধ্বংস করা নয়, অনেকসময় অতীতকে নতুনভাবে রক্ষা করাও।
ধর্মবিস্তার কখনই ধর্মসঙ্গীত ছাড়া সম্ভব হয়নি ভারতে, বেদের সময় থেকেই। সামগান ছাড়া বেদাচার সম্ভব ছিল না। বৌদ্ধনাটকের অভিনয়ে নৃত্যগীত হত। গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্ম প্রচারে বৈষ্ণব পদাবলীর কি অসামান্য ভূমিকা ছিল, আমরা জানি, স্বয়ং জয়দেব থেকে চৈতন্যদেব, সকলেই বৈষ্ণব-গীত রচনা করেছেন। তারও আগে আদি শঙ্করাচার্য, হিন্দুধর্মে শক্তিসাধনার আদি, সনাতন ধর্ম-আন্দোলনের প্রচারে সঙ্গীতের ব্যবহার করেছিলেন, ভবানী-অষ্টকম নামে দুর্গার উদ্দেশে লেখা একটি অসামান্য সঙ্গীত আছে আদি শঙ্করাচার্যের। এই সেদিনের ব্রাহ্ম ধর্মও ব্রহ্মসঙ্গীতের ওপরে একান্তভাবে নির্ভর করেছিল, রামমোহন থেকে রবীন্দ্রনাথ, সবাই ব্রহ্মসঙ্গীত রচনা করেছেন।
আগমনী বা শিব-দুর্গা বিষয়ক গান কবি বিদ্যাপতি দ্বাদশ শতাব্দীতে বেশ কিছু লিখলেও, বাংলা আগমনী ও শ্যামা সঙ্গীতের ধারাটি বিকাশ লাভ করে খ্রিষ্টীয় অষ্টাদশ শতাব্দীতে। আঠারো শতকের মধ্যভাগে সাধক কবি রামপ্রসাদ সেন (১৭১৮ – ১৭৭৫) এতে প্রাণ সঞ্চার করে বাংলা গানের জগতে শাক্ত পদাবলি বা শ্যামা সঙ্গীত নামে একটি বিশেষ সঙ্গীতধারা প্রতিষ্ঠিত করেন।
আদিকাল থেকে মাতৃকা-উপাসক, শক্তির উপাসক বাঙালির মধ্যে শাক্ত সঙ্গীতের অবিচ্ছিন্ন ধারা খুঁজে না পাওয়া গেলেও সাধক রামপ্রসাদ ও কমলাকান্ত এসে রাতারাতি বাংলার শাক্ত সঙ্গীতকে যে এক অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে দিলেন, তার থেকেই প্রমাণ হয় যে বহুযুগ ধরে পূর্বসূরিদের সঞ্চিত প্রজ্ঞার ফলে ভূমি প্রস্তুত ছিল, অন্তঃসলিলা হয়ে তা নিঃশব্দে বয়ে চলেছিল জাতির হৃদয়ের মধ্য দিয়ে। প্রথমেই বলা দরকার, এই শাক্ত সঙ্গীতের ওপরে শুধু তান্ত্রিক যা বৌদ্ধযুগে বজ্রযান নামে আত্মপ্রকাশ করেছিল প্রভাবই নয়, সহজিয়া বা সহজযানী প্রভাবও যথেষ্ট। আশ্চর্য বিষয়, কারণ রামপ্রসাদের সময় চর্যা বিস্মৃত, রামপ্রসাদের অনেক পরে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী নেপাল থেকে চর্যা উদ্ধার করেন। কিন্তু কিভাবে একটি জাতির শেকড় মাটির গভীরে থেকে সে জাতির শরীর, তার শাখাপ্রশাখাকে পুষ্ট করে, এ তারই এক আশ্চর্য উদাহরণ। চর্যার কথা, চর্যার সন্ধ্যাভাষার কথা নিশ্চিতভাবে জানতেন না রামপ্রসাদ। কিন্তু এই গানটা দেখুন,
“যে দেশেতে রজনী নাই, সে দেশের এক লোক পেয়েছি।
আমার কিবা দিবা কিবা সন্ধ্যা, সন্ধ্যারে বন্ধ্যা জেনেছি।। …
সোহাগা গন্ধক মিশায়ে, সোনাতে রঙ ধরায়েছি।
মণি মন্দির মেজে দিব, মনে এই আশা ধরায়েছি।।
প্রসাদ বলে ভক্তি মুক্তি, উভয়কে সাথে ধরেছি।
এবার শ্যামার নাম ব্রহ্ম জেনে, ধর্ম কর্ম সব ছেড়েছি।”
না, ঠিক আক্ষরিক অর্থে এরকম কোন চর্যাগীতি নেই, তবে সাধনার জটিলতার আবর্তে ঘুরপাক না খেয়ে ত্রিশরণের সহজিয়া-পদ্ধতির সাধনার কথা বলা হয়েছে কাহ্ন-বিরচিত এই পদটিতে, যার কথা রামপ্রসাদের জানার কথা নয়-
“তিশরণ ণাবী কিঅ অঠকমারী।
নিঅ দেহ করুণা শূণ মেহেলী।।
তরিত্তা ভবজলধি জিম করি মাঅ সুইনা।
মঝ বেণী তরঙ্গ ম মুনিআ।।
পঞ্চ তথাগত কিঅ কেড়ুআল।
বাহঅ কাঅ কাহ্ণিল মাআজাল।।
গন্ধ পরসর জইসো তইসৌ।
নিন্দ বিহূনেঁ সুইনা জইসৌ।।
চিঅ কণ্ডহার সুণত-মাঙ্গে।
চলিল কাহ্ন মহাসুহ-সাঙ্গে।।”
(‘ত্রিশরণ’ বৌদ্ধিক আশ্রমের তিন মহাশরণমন্ত্র- ‘বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি। ধম্মং শরণং গচ্ছামি। সঙ্ঘং শরণং গচ্ছামি।‘)
এই যে ধর্মকর্ম সব ছেড়ে নামব্রহ্ম অবলম্বন করা, এটি মধ্যযুগের ভক্তি আন্দোলনের বড় বৈশিষ্ট্য তো বটেই। পাণ্ডব-গীতায় মহামতি বিদুর বলছেন-
“হরের্নামৈব নামৈব নামৈব মম জীবনম
কলৌ নাস্ত্যেব নাস্ত্যেব নাস্ত্যেব গতিরন্যথা।।”
(হরিনাম হরিনাম জীবন আমার,
নাই নাই কলিযুগে অন্য গতি আর ।।
অনুবাদক – শশিভূষণ পুরকায়স্থ)
কিন্তু আদতে সহজিয়া আন্দোলন থেকেই মূলত এই প্রথা এসেছিল। একটি নামবীজই মোক্ষলাভে যথেষ্ট, জটিল সাধনা পদ্ধতির প্রয়োজন নেই- তন্ত্র-আন্দোলনের ঘরানায় সহজযানের এইটি একরকমের সর্বজনগৃহীত পদ্ধতি। শাক্ত এবং সহজিয়ার মেলবন্ধন রামকৃষ্ণ আন্দোলনও দেখিয়েছে বারবার, রামকৃষ্ণ নিজে শাক্তসঙ্গীতের প্রবল অনুরাগী ছিলেন, আমরা জানি।
মদনের এই গানটি শ্রী রামকৃষ্ণের বড় প্রিয় ছিল-
“গয়া-গঙ্গা-প্রভাসাদি কাশী-কাঞ্চী কেবা চায়?
কালী কালী কালী বলে অজপা যদি ফুরায়।
ত্রিসন্ধ্যা যে বলে কালী, পূজা সন্ধ্যা সে কি চায়?
সন্ধ্যা তার সন্ধানে ফেরে তবু সন্ধি নাহি পায়।।”
গানটির ইঙ্গিত স্পষ্ট সহজের দিকে। রামকৃষ্ণ অন্যত্র বলেছেন
“আর কাজ নাই জ্ঞান-বিচারে, দে মা পাগল করে। দেখ, ঐটে আমার ঠিক ভাব”।
তাত্ত্বিক ক্রিয়াকাণ্ডের বদলে আপামর বাঙালি এই সহজিয়া পদ্ধতিকেই শ্রেষ্ঠ মেনেছে। রামপ্রসাদের গানে দেখি, শক্তি উপাসনা সমস্ত জাতপাতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে আরেকটি সহজিয়া বৈশিষ্ট্যের পরিচয় রেখেছে।
“আমায় ছুঁয়ো না রে শমন আমার জাত গিয়েছে।
যে দিন কৃপাময়ী আমায় কৃপা করেছে।।
শোন্ রে শমন বলি আমার জাত কিসে গিয়েছে।
আমি ছিলেম গৃহবাসী, কেলে সর্বনাশী আমায় সন্ন্যাসী করেছে।।”
এখানে বাঙালি শাক্ত, শক্তি উপাসনা করে। বাঙালি তন্ত্রেরও স্রষ্টা। এই ভূমি কোনোদিনই বেদ ও ব্রাহ্মণ্যবাদ মানে নি। সাংখ্যকার বেদের দোহাই দিয়ে বেদেরই উচ্ছেদ করেছেন, বঙ্কিম লক্ষ্য করেছিলেন। বাংলার শাক্ত ভাবান্দোলনের একটি বড় বৈশিষ্ট্য হল, বৈষ্ণব ভক্তির সঙ্গে এর কোনও বিরোধ নেই। রামপ্রসাদ এবং কমলাকান্ত দুজনেই বৈষ্ণব সঙ্গীত রচনা করেছেন। রামকৃষ্ণ স্বয়ং নিজে বৈষ্ণব সঙ্গীতের এবং বৈষ্ণব ধর্মতত্ত্বের বিশেষ ভক্ত ছিলেন। বাঙালির সাংস্কৃতিক শেকড়ে থাকা প্রকৃতি-পুরুষ দ্বৈতবাদ বাঙালিকে সাংস্কৃতিকভাবে সংজ্ঞায়িত করে যার সম্পর্কে রামকৃষ্ণ বলছেন,
“যোগমায়া অর্থাৎ পুরুষ প্রকৃতির যোগ। যা কিছু দেখছ সবই পুরুষ-প্রকৃতির যোগ। শিবকালীর মূর্তি, শিবের উপর কালী দাঁড়িয়ে আছেন। শিব শব হয়ে পড়ে আছেন। কালী শিবের দিকে চেয়ে আছেন। এই সমস্তই পুরুষ-প্রকৃতির যোগ। পুরুষ নিষ্ক্রিয়, তাই শিব শব হয়ে আছেন। পুরুষের যোগে প্রকৃতি সমস্ত কাজ করছেন। সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয় করছেন!” (কৃতজ্ঞতা স্বীকার: ড: তমাল দাশগুপ্ত)
শাক্ত বা শ্যামাসঙ্গীত নিয়ে যখন লিখতে বসেছি, তখন সে গানের কথা বা ভাবই শুধু নয়, রাগ-সুর-তাল নিয়ে দু-চারটে কথা না বললে ভাল দেখায় না। আমি কোন সংগীতজ্ঞ পণ্ডিত নই, তাই ব্যাকরণভিত্তিক কচকচির মধ্যে না গিয়ে বলতে পারি, রামপ্রসাদ, কমলাকান্ত বা দাশরথি রায় একটা হিন্দুস্থানী রাগভিত্তিক কাঠামো রাখলেও, এর অবয়ব কিন্তু সম্পূর্ণভাবে বঙ্গীয় লোকগীতি-নির্ভর। শ্যামাসংগীত রচয়িতাদের মধ্যে যে যেমন শিক্ষায় দীক্ষিত হয়েছেন, তাঁর গানে চেতনা-অবচেতনে সেই ভাব ঢুকে পড়েছে। যেমন টপ্পা-বিশারদ নিধুবাবুর গান, দাশু রায়, মদন বা স্বামী বিবেকানন্দের রচনা রাগাশ্রয়ী, আবার রামপ্রসাদ-কমলাকান্ত-ভবা পাগলা-গিরীশ ঘোষের গানে আছে পরিপূর্ণ সরল ভক্তিভাব। রবীন্দ্রনাথ রচিত মুষ্টিমেয় শ্যামাসংগীত যেমন ‘কালী কালী বল রে আজ’ পাশ্চাত্য সুরে, ‘রাঙ্গা পদ-পদ্মযুগে’ টপ্পা-অঙ্গে (বাগেশ্রী/চতুর্মাত্রিক একতাল) অথচ ‘এবার ছেড়ে চলেছি মা’ প্রসাদী সুরে। নজরুলের শ্যামাসংগীতের একটা বড় অংশ বাগেশ্রীতে নিবদ্ধ, যেমন- ‘মাগো চিন্ময়ী রূপ ধরে আয়’, ‘শ্মশানকালীর নাম শুনে রে’, ‘শ্মশানে জাগিছে শ্যামা’, ‘তুই লুকাবি কোথায় মা কালী?’ ইত্যাদি। তবে ভৈরবী, শিবরঞ্জনী, দুর্গা, দেশ এইসব প্রচলিত রাগে, তাছাড়া নজরুল-সৃজিত অজস্র রাগে রচিত শ্যামাসংগীত আর শৈব-গীতির সংখ্যাও অসংখ্য।
এবার আসি নজরুলের শাক্ত-সংগীতের মৌলিকত্বে, দর্শনে, ভাবে ও কথায়। ইংরেজি সাহিত্যে ‘Metaphysical Wit’ একটি বিখ্যাত জিনিস। কোনও চিরাচরিত ধারণাকে নতুনভাবে, চমকে দেওয়ার মত প্রকাশভঙ্গীর মাধ্যমে ব্যাখ্যা করাই হল “Wit”। আলেকজান্ডার পোপ উইটের সংজ্ঞা এভাবে দিয়েছিলেনঃ
“True Wit is Nature to advantage dress’d
What oft was thought, but ne’er so well express’d;
Something whose truth convinced at sight we find,
That gives us back the image of our mind.
As shades more sweetly recommend the light,
So modest plainness sets off sprightly wit.”
(An Essay On Criticism)
বাঙালির শাক্ত সঙ্গীতেরও নিজস্ব “Wit” ঘরানা আছে। প্রকৃতি-পুরুষ দ্বৈতবাদের চিরায়ত কাঠামোকে নিয়ে কমলাকান্ত লিখেছেনঃ
“আর কিছু নাই শ্যামা মা তোমার কেবল দুটি চরণ রাঙা।
শুনেছি তাও নিয়েছেন ত্রিপুরারি, অতেব হৈলাম সাহস ভাঙা।।”
এটি অত্যন্ত উচ্চস্তরের উইট। ঈশ্বর হলেন একটা absence, পশ্চিমে বর্তমানের বিখ্যাত দার্শনিক জিজেকের (Zizek) নেগেটিভ বা Apophatic Theology জানাচ্ছেন। মার্ক্স atheist, তিনি বলেন ধর্ম হল হৃদয়হীন জগতের হৃদয়, আত্মাহীন পরিবেশের আত্মা। যেহেতু মানবসত্তার কোনও বাস্তব অস্তিত্ব নেই, ধর্ম হল মানবসত্তার কাল্পনিক বাস্তবায়ন। কিন্তু অস্তি আর নাস্তির মধ্যিখানে একটা বড় শূন্যস্থান থেকে যায়, সাব্জেক্টিভিটির একেবারে কেন্দ্রস্থলে থাকা সেই শূন্যতা আমাদের অস্তিত্বকে এক বিষাদে আচ্ছন্ন করে। সংশয়বাদী দার্শনিকরা মনে করেন যে মানব অস্তিত্বের কেন্দ্রেই রয়েছে শূন্যতা, যাকে লাকাঁ রিয়েল বলছেন,যা অবাঙ্মানসগোচরা, যাকে শব্দে প্রকাশ করা যায় না, মনে আনা যায় না। কিন্তু এখানে কমলাকান্ত যেভাবে নিঃস্ব, রিক্ত ঈশ্বরসাধকের ছবিটা ফুটিয়ে তুলেছেন সে অসাধারণ। মায়ের পা দুটি ছাড়া তো সত্যিই বাঙালির আর কিছু নেই, কিন্তু সে পা দুটি বাবা ভোলানাথ ইতিমধ্যেই দখল করে বসে আছেন, ফলে তাও আর অবশিষ্ট নেই। মধ্যযুগের বাঙালি নিঃস্ব, রাজক্ষমতা বিজাতীয় তুর্ক-পাঠান-মোগলদের হাতে। কোনওমতে গোপনে গভীর রাত্রে সে তার শক্তি উপাসনা করে থাকে। তেমন সময়ে বাঙালির কাছে মানব অস্তিত্বের কেন্দ্রে থাকা শূন্যতা শুধু দার্শনিক নয়, দস্তুরমত রাজনৈতিক এবং সামাজিক স্টেটমেন্টও বটে।
একদম একই রকমের বক্তব্য রেখেছেন রামপ্রসাদ-
“আশা ছিল মাতৃপদ, পিতা তাও দখল করেছে”।
এরপরেই বঙ্কিমের বন্দে মাতরম, বা রবীন্দ্রনাথের বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনের সময় “আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে কখন আপনি” হোক, বা চারণকবি মুকুন্দদাসের “মাতঙ্গী মেতেছে আজ সমররঙ্গে”– বাংলার সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামে মাতৃবন্দনা সাংস্কৃতিক ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছে। (কৃতজ্ঞতা স্বীকার: ড: তমাল দাশগুপ্ত)
বিংশ শতাব্দীর প্রাক্কালে এক নতুন ধারার শাক্ত সঙ্গীত বাংলায় নিয়ে এলেন কাজী নজরুল ইসলাম। শ্যামাকে কাজী নজরুল ইসলাম আত্মসচেতন, নিরহংকারিণী, শুভ-চিন্তার উদ্রেককারিণী, অশুভনাশিনী, আমিত্ববিনাশিনী ইত্যাদি গুণধারিণী হিসেবে দেখিয়েছেন। কখনো তিনি সর্বধর্মে সমন্বয় ঘটান, শ্যামারূপে প্রতিফলিত হয় শ্যামল দেশ, কখনো বা তিনি আসেন সমাজতন্ত্রের রূপকার হয়ে। নজরুল বাংলাগানের সমৃদ্ধ পটভূমিতে শ্যামাকে বিশেষভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন কালোরূপে বিশ্বরূপা রূপে, তাঁর পায়ের তলায় আলোর নাচন দেখিয়েছেন, যে আলোর ঝলকে রুদ্র শিবও পরাস্ত যাঁর হাতে আছে বিশ্বের মরণ-বাঁচন।
শ্বেতাঙ্গ- শাসকদের বিনাশিনীরূপে অবতীর্ণা মহাকালীর বীরত্বের কাছে হার মানার প্রতীক হিসেবে বাংলার শোষিত জনগণের বীরত্ব ও আন্দোলনকে নির্দেশ করেছেন নজরুল। মায়ের দিগবসনা হওয়ার ব্যাখ্যা তিনি দিয়েছেন এক নতুন ভাবে-
“সিন্ধুতে মা’র বিন্দুখানিক, ঠিকরে পড়ে রূপের মাণিক,
বিশ্বে মায়ের রূপ ধরেনা, মা আমার তাই দিগবসন।।”
বাংলা শাক্ত সঙ্গীত বা শ্যামার গানে নজরুল যে স্বাতন্ত্র্যের রূপ দেখিয়েছেন, সেখানে কালী শক্তির দেবী অপেক্ষা দেশমাতারূপে প্রধানতঃ রূপায়িত হয়েছে। ১৮৬৭ সালে হিন্দুমেলা প্রতিষ্ঠার আগে তেমন কোনো গানের চিহ্নই পাওয়া যায় না দেশমাতৃকার বন্দনারূপে। স্বদেশী গানে দেশকে ‘মা’, ‘মাতা’ সম্বোধন করে তত্কালে বহুগান রচিত হয়েছে, নজরুলের শ্যামাসংগীত মূলতঃ সেখান থেকেই শুরু। কিন্তু ব্যতিক্রম হলো অন্যান্য গীতিকারদের স্বদেশী গানের মধ্যে সরাসরি দেশকে বিষয় করে পদ রচিত হয়েছে, আর নজরুল শ্যামাসংগীত নাম প্রচলিত গানের মধ্যে এনেছেন প্রত্যক্ষ স্বদেশীয়ানা। এর সাথে বিদ্রোহের প্রত্যক্ষ রূপ জনমানসকে সরাসরি বিপ্লবী ও প্রতিবাদী করে তুলতে সাহায্য করেছিল। তাই তিনি প্রতীক আকারে বেছে নিয়েছিলেন শ্যামাকে, যিনি অশুভনাশিনী পরাক্রমশক্তি। সর্বোপরি তিনি শ্যামাকে তাঁর অসংখ্য গানে বিভিন্ন রূপ ও চরিত্রে, ভাবে ও প্রেমে দাঁড় করিয়েছেন।
উদাহরণস্বরূপ, নজরুলের একটি গানেই হয়ত কালীকে বিভিন্নরূপে তিনি দেখছেন :
‘আজই না হয় কালই তোরে কালী কালী বলবে লোকে।
(তুই) কালি দিয়ে লিখলি হিসাব কেতাব পুঁথি, শিখলি পড়া,
তোর মাঠে ফসল ফুল ফোটালো কালো মেঘের কালি-ঝরা।
তোর চোখে জ্বলে কালির কালো, তাই জগতে দেখিস আলো
(কালী)-প্রসাদ গুণে সেই আলো তুই হূদ-পদ্মে দেখবি কবে?’
এই গানে ‘কালী’ শব্দটিকে গুরুত্ব প্রদান করে দেশপ্রেমের প্রতি ইঙ্গিত করেছেন কবি। কালি অর্থে বিদ্যার আধার কলমের কালি, কালী অর্থে দেবী মহামায়া, ভূমি ও স্বদেশ আবার কালি অর্থে জল- জীবন ও জীবিকার উপাদান। এই গানটি যমক অলংকারের একটি সুন্দর উদাহরণ (কালি -কালী) রূপেও বাংলা কাব্য-গীতিতে বিশেষ স্থান দাবি করে। (কৃতজ্ঞতা স্বীকার: তত্ত্বকথা – সাইম রানা)
নজরুল দ্রুত জনপ্রিয় হয়েছিলেন হিন্দু-মুসলিমে বিভাজিত সে সময়কার ভারতীয় সমাজে। মুসলিম হওয়ার কারণে হিন্দুদের একটা শ্রেণী নজরুলকে বিজাতি মনে করত। ঠিক একইভাবে একশ্রেণীর মুসলমান নজরুলকে বিজাতি ঘোষণা করেছিল, কারণ ছিল হিন্দু ধর্মের প্রতি নজরুলের আগ্রহ। কিন্তু এত বিরোধিতার মধ্যেও দিগভ্রষ্ট না হয়ে তিনি ধর্মনিরপেক্ষতা বজায় রেখেছেন, মনেপ্রাণে থেকেছেন শুধু ‘মানুষ’ হয়ে। তৎকালীন ভারতবর্ষের অবস্থা উত্তাল, একদিকে বিশ্বযুদ্ধ আর অন্যদিকে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের প্রস্তুতি। বিশ্বময় পুঁজিবাদী দেশগুলোর আগ্রাসন শুরু হয়েছিল। এমন উত্তাল সময়ে প্রতিবাদই ছিল নজরুলের একমাত্র ভাষা। সে সময় ‘শাক্তদর্শন’ ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছিল নজরুলকে। কিন্তু নজরুলের কবিতা ও গানে মা এলেন শ্বেতাঙ্গ অসুর-রাজের বিরুদ্ধে ভারতের যুব-রক্ত টগবগিয়ে ফুটিয়ে তুলতে, শক্তিদায়িনী, ত্রাণকর্ত্রী-রূপে। ধুমকেতুর পত্রিকায় সন্তানবৎসলা শ্যামা মাকে তিনি আবাহন করলেন নতুন রূপে, নব-ভূমিকায়-
“আর কতকাল রইবি বেটি, মাটির ঢেলার মূর্তি-আড়াল?
স্বর্গকে আজ জয় করেছে অত্যাচারী শক্তি চাঁড়াল।
দেব-শিশুদের মারছে চাবুক, বীর যুবাদের দিচ্ছে ফাঁসি-
ভূ-ভারত আজ কসাইখানা, আসবি কখন সর্বনাশী?”
বলা বাহুল্য, এই আস্ফালন অত্যাচারী শাসকদের সহ্য হয়নি। ধূমকেতুর প্রকাশ রাজাদেশে বন্ধ হল, প্রেপ্তার হলেন নজরুল। তবে নজরুলের শক্তিসাধনা এখানেই থেমে থাকল না। তাঁর আকুল আহ্বান এবার ‘পূজা-বিলাসে’র বিরুদ্ধে। তাঁর সাধনা চিন্ময়ী মায়ের জন্যে যিনি বঙ্কিমের কাব্যে এসেছেন দেশমাতৃকা রূপে-
“ত্বং হি দুর্গা দশপ্রহরণধারিণী, ত্বং হি প্রাণা: শরীরে।
হৃদয়ে তুমি মা ভক্তি, বাহুতে তুমি মা শক্তি,
তোমারি প্রতিমা গড়ি মন্দিরে মন্দিরে।”
নজরুল আগমনী লিখলেন নতুন ভাবধারায়-
“মাগো চিন্ময়ী রূপ ধরে আয়।
তোর মৃন্ময়ী রূপ পূজেছি মা দুর্গা, তাই
দুর্গতি আর ঘুচল না হায়……
মন্দিরে দুর্গে রহে না যে বন্দী,
সেই দুর্গারে এই দেশ চায়।।
আমাদের দ্বিভূজে দশভুজা শক্তি
দে ব্রহ্মরূপময়ি!
এই শক্তিপূজার ফল ভক্তি কি পাবই শুধু-
হবনা কি বিশ্বজয়ী?”
এই চিন্ময়ী দেবীর উদ্দেশে তিনি আরো লিখলেন-
“এবার নবীন মন্ত্রে হবে জননী তোর উদ্বোধন।
নিত্যা হয়ে রইবি ঘরে হবে না তোর বিসর্জন!
…(মোরা) এক জননীর সন্তান সব জানি
ভাঙব দেয়াল ভুলব হানাহানি।
দীন-দরিদ্র রইবে না কেউ, সমান হবে সর্বজন।
বিশ্ব হবে মহাভারত নিত্য প্রেমের বৃন্দাবন।”
জননীর বিসর্জন? নজরুলের শ্যামা যে নিছক মৃন্ময়ী নন, তিনি মূর্তিমতী চিদ্শক্তির আধার। তাই বিজয়ার গানে কবি গাইলেন-
“যাসনে মা ফিরে যাসনে জননী, ধরি দুটি রাঙা পায়,
শরণাগত দীন সন্তানে ফেলে রাখি ধরার ধুলায়।
……আজও মরেনি অসুর, মরেনি দানব,
ধরণীর বুকে করে তাণ্ডব।
সংহার নাহি করি সে অসুরে কেন যাস বিজয়ায়?”
হিন্দু পৌরাণিক কাহিনী মতে, চণ্ডী বা দুর্গাদেবীরই একটি বিশেষ রূপ হল ‘কালী’ বা শ্যামা। বৌদ্ধ বজ্রযান তন্ত্রসাধনায় হয়ত এর ডাকিনী-যোগিনী রূপ ছিল, চণ্ডীতে মুণ্ডমালিনী দিগ্বসনা যুদ্ধরতা ‘শ্যামা মা’ রূপে যাঁর রূপের আলংকারিক ব্যাখ্যা নজরুল তাঁকে এক অনন্য ভাবে এঁকেছেন-
“……মা গো, তোমাকে না পেয়ে লোকে লোকে
যে অশ্রু ঝরেছে মোর চোখে,
সেই আঁখিজল জবাফুল হয়ে শোভা পেতে ওই চরণে চায়।।
মা গো, কত অপরাধ করেছিনু বুঝি, সংহার করি সে অপরাধ,
বল লীলাময়ি মিটেছে কি তোর মুণ্ডমালিকা পরার সাধ?
যে ভক্তি পায়নি চরণতল, আজ কি তা হল গঙ্গাজল!
মোর মুক্তির আশা মুক্তকেশী গো
এলোকেশ হয়ে পায়ে লুটায়।।”
নজরুলের শ্যামাসঙ্গীত জনপ্রিয় হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ ছিল, আবেগের গভীরতা। কেউ কেউ মনে করেন, নজরুল হৃদয়ের গভীর থেকে শ্যামার প্রতি ভক্তি নিবেদন করেছিলেন। আর সে ভক্তি সাকার হয়েছিল তার গানের ভাষাতে। তিনি লিখেছিলেন-
“ভক্তি, আমার ধুপের মত,
ঊর্ধ্বে উঠে অবিরত।
শিবলোকের দেব দেউলে,
মা’র শ্রীচরণ পরশিতে।”
শ্যামাসংগীতে নজরুলের অবদান সম্পর্কে ডক্টর করুণাময় গোস্বামী লেখেন, ‘বলতে কি শ্যামাসংগীত রচয়িতারূপে রামপ্রসাদ সেন বা কমলাকান্ত ভট্টাচার্য সাংগীতিক নান্দনিকতায় যে স্তরে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন, নজরুল তদপেক্ষা উচ্চস্তরে পৌঁছেছিলেন। কেননা, কবি ও সুরস্রষ্টারূপে তিনি পূর্ববতী সংগীতরচয়িতাদের চেয়ে মহৎ প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। সে পরিচয় তিনি অত্যন্ত গভীরভাবে রেখেছেন তাঁর গানে।’
নজরুলের হাতে শ্যামাসঙ্গীতের ভাণ্ডার পূর্ণ হয়েছে। শক্তির দেবী কালীকে একদিকে যেমন তিনি লোলরসনা রণরঙ্গিনী মূর্তিতে আহবান করেছেন, অন্যদিকে তাঁকেই কখনো স্নেহময়ী জননী আবার কখনও বা দুরন্ত উচ্ছলা কন্যারূপে কল্পনা করেছেন।
“এক হাতে মোর পূজার থালা ভক্তি শতদল,
আরেক হাতে ক্ষীর-নবনী কী নিবি তুই বল?”
অন্যত্র স্নেহভরে লিখেছেন-
“আমার কালো মেয়ে রাগ করেছে, তারে কে দিয়েছে গালি?
রাগ করে সে সারা মুখে মেখেছে আজ কালি।।”
এই যে এককালের প্রবলপ্রতাপান্বিতা দশ-মহাবিদ্যাস্বরূপিনী শ্যামাকে নিতান্ত ঘরোয়াভাবে পাওয়ার সহজিয়া সাধনা, তার সূচনা হয়েছিল রামপ্রসাদের হাতে, তাকে সত্যিকারের সাধনায় প্রতিফলিত করেন পরমপুরুষ শ্রীরামকৃষ্ণ আর কাব্যে-গীতিতে অপূর্ব সুষমায় বিকশিত করে অনন্য মর্যাদায় রূপদান করেন নজরুল। তাঁর হাতে শোভিত খড়্গ, গলার মুণ্ডমালা যেন অবাধ্য সন্তানকে ভয় দেখাবার জন্যে মায়ের ছলনা-
“কেন আমায় দেখাস মা ভয়, খড়্গ হাতে মুণ্ড নিয়ে,
আমি কি তোর সেই সন্তান, ভোলাবি মা ভয় দেখিয়ে?”
কবি নজরুল কালী আর রাসবিহারী কৃষ্ণে কোনো তফাৎ দেখেননি। রাম-রহিমকে একভাবে দেখা সমদর্শী এই সাধক যে শ্যাম আর শ্যামার মধ্যে ভেদ করবেন না তা বলাই বাহুল্য।
“শ্যামা মায়ের কোলে চড়ে জপি আমি শ্যামের নাম।
মা হলেন মোর মন্ত্রগুরু, ঠাকুর হলেন রাধা-শ্যাম।।
আমার মনের দোতারাতে শ্যাম ও শ্যামা দুটি তার,
সেই দোতারায় ঝঙ্কার দেয় ওঙ্কার রব অনিবার।।”
নামজপ এবং সহজিয়া সাধনাকে যে নজরুল অবহেলা করেননি তার উল্লেখ অন্তত: একটি গানে যার মধ্যে তাঁর সূক্ষ্ম রসবোধের পরিচয় পাওয়া যায়. এখানে ভক্ত যেন শিশুর সারল্যে মায়ের অঙ্কে (কোলে) বসে অঙ্ক, অর্থাৎ গণিত নিয়ে খেলা করছে.
“আমার আর কোনো গুণ নেই মা
তোমার নামের নামতা গোনা ছাড়া
কোনো অঙ্ক শেখাওনিকো
তোমার অঙ্ক বিনা তারা
জানি শুধু সাধনযোগ
শেখাও হতে রিপু বিয়োগ
আমি গুণ শিখেছি নাম গুণগান
শেখাও হতে সৃষ্টিছাড়া”
কালী মৃত্যুময়ী মাতা। আবার তিনিই অনন্ত জীবনের প্রতীক। “মৃত্যুরূপা মাতা” কবিতায় (বাংলা অনুবাদ- সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত) স্বামী বিবেকানন্দ শ্যামার এই রূপেরই বর্ণনা করেন-
“করালি! করাল তোর নাম, মৃত্যু তোর নিঃশ্বাসে প্রশ্বাসে
তোর ভীম চরণ-নিক্ষেপ প্রতিপদে ব্রহ্মাণ্ড বিনাশে!
কালি, তুই প্রলয়রূপিণী, আয় মা গো আয় মোর পাশে।
সাহসে যে দুঃখ দৈন্য চায়, মৃত্যুরে যে বাঁধে বাহুপাশে,
কাল-নৃত্য করে উপভোগ, মাতৃরূপা তারি কাছে আসে।।”
কিন্তু শ্মশানকালী প্রসঙ্গে নজরুল এই কথাই অন্যভাবে আরো সহজ-ভঙ্গীতে বললেন-
“মৃতের মাঝে মোর জননী বিলায় মৃতসঞ্জীবনী,
পায়না ধ্যানে যোগীন্দ্র সে যোগমায়ায়।
মা যে আমার শবের মাঝে শিব জাগায়।।”
পরিশেষে বলি, শ্মশানকালীর তাৎপর্য এত সুন্দর অথচ সরল করে কোন তান্ত্রিক, যোগী, সাধক বা কবি লিখে গেছেন বলে আমার জানা নেইঃ
“শ্মশানে জাগিছে শ্যামা
অন্তিমে সন্তানে নিতে কোলে।
জননী শান্তিময়ী বসিয়া আছে ঐ
চিতার আগুন ঢেকে স্নেহ-আঁচলে।।
সন্তানে দিতে কোল ছাড়ি সুখ-কৈলাস,
বরাভয়া রূপে মা শ্মশানে করেন বাস,
কী ভয় শ্মশানে শান্তিতে যেখানে
ঘুমাবি জননীর চরণ-তলে।।
জ্বলিয়া মরিলি কে সংসার জ্বালায়-
তাহারে ডাকিছে মা ‘কোলে আয় কোলে আয়’,
জীবনে শ্রান্ত ওরে ঘুম পাড়াইতে তোরে-
কোলে তুলে নেয় মা মরণেরই ছলে।।”
(কবির শ্যামাসংগীতের মধ্যে শ্মশানকালীর এই রূপ আর কোথাও নেই, শ্যামাসংগীতের জগতে এই গানটির আর জোড়া নেই এবং হবে কিনা তাও বলা কঠিন। জ্ঞান গোস্বামী এই গানটি খেয়ালের পদ্ধতিতে ‘ছাড়া’ তালে গেয়েছেন। যাঁরা এভাবে গাইতে পারেন তাঁরাই যেন এই গানটি গা’ন নইলে কবির প্রতি বড় বেশি অন্যায় করা হবে। – কাজী অনিরুদ্ধ, নির্বাচিত নজরুল ভক্তিগীতির স্বরলিপি)
নজরুল প্রায় ৩০০০ গান রচনা করেছেন এবং অধিকাংশের সুর নিজেই করেছেন, যেগুলো এখন নজরুল সঙ্গীত বা ‘নজরুল গীতি’ নামে পরিচিত, যার বড় একটি অংশই শ্যামা সঙ্গীত। শাক্তসঙ্গীত বিষয়ক নজরুলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ হচ্ছে ‘রাঙা-জবা’। ১৯৬৬ সালে ১০০টি শ্যামাসঙ্গীতে সমৃদ্ধ গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। শক্তি পূজায় তাঁর ভক্ত হৃদয়ের অকৃত্রিম আকুলতা ও আর্তি রাঙা-জবা’র গানের মধ্যে রূপায়িত। এছাড়া অন্যান্য বিভিন্ন কাব্যগ্রন্থে নজরুল ইসলামের আরো শতাধিক শাক্তগীতি ও শ্যামাসংগীত ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এক মালায় গাঁথার অপেক্ষায়।
‘রাঙা-জবা’ গ্রন্থটিতে যে সকল সঙ্গীত আছে সেগুলির তালিকা নীচে দেওয়া হল:
বল রে জবা বল
মহাকালের কোলে এসে
ভুল করেছি ওমা শ্যামা বনের পশু বলি দিয়ে
তোর কালো রূপ লুকাতে মা বৃথাই আয়োজন
(ওমা) দুঃখ অভাব ঋণ যত মোর
(আমায়) আর কতদিন মহামায়া
ফিরিয়ে দে মা ফিরিয়ে দে গো
মোরে আঘাত যত হানবি শ্যামা
এস আনন্দিতা ত্রিলোক-বন্দিতা
রে আলয়ে আজ মহালয়া, মা এসেছে ঘর
কে বলে মোর মাকে কালো
মা গো আমি তান্ত্রিক নই
মা গো তোমার অসীম মাধুরী
মা হবি না মেয়ে হবি
মা গো আজো বেঁচে তোরি প্রসাদ পেয়ে
দুর্গতিনাশিনী আমার
যে নামে মা ডেকেছিল সুরথ শ্রীমন্ত তোরে
পরম পুরুষ সিদ্ধ-যোগী মাতৃভক্ত যুগাবতার
আমার হৃদয় অধিক রাঙা মাগো
মায়ের চেয়েও শান্তিময়ী
কেঁদো না কেঁদো না মাকে কে বলেছে কালো
তুই পাষাণ গিরির মেয়ে হলি
মা গো আমি মন্দমতি
শক্তের তুই ভক্ত শ্যামা
মা গো আমি আর কি ভুলি
ওমা নির্গুণেরে প্রসাদ দিতে
আমায় যারা দেয় মা ব্যথা
করুণা তোর জানি মা গো
আয় নেচে আয় এ বুকে
আজও মা তোর পাইনি প্রসাদ
কোথায় গেলি মা গো আমার
মা কবে তোরে পারব দিতে
জগৎ জুড়ে জাল ফেলেছিস্ কালী কালী মন্ত্র জপি
আদরিণী মোর শ্যামা মেয়ে রে
শ্যামা তোর নাম যার জপমালা
আমি নামের নেশায় শিশুর মত
(ওমা) বক্ষে ধরেন শিব যে চরণ
রক্ষা-কালির রক্ষা-কবচ আছে আমায় ঘিরে
(আমার) মুক্তি নিয়ে কি হবে মা
(মায়ের) অসীম রূপ-সিন্ধুতে রে
(আমার) কালো মেয়ে পালিয়ে বেড়ায়
আঁধার ভীত এ চিত যাচে মা গো আলো
মা তোর চরণ-কমল ঘিরে
আয় মা চঞ্চলা মুক্তকেশী শ্যামা কালী
শ্মশানে জাগিছে শ্যামা
আয় অশুচি আয় রে পতিত
দীনের হতে দীন দুঃখী অধম যথা থাকে
(মা) একলা ঘরে ডাকব না আর
(তুই) বলহীনের বোঝা বহিস্ যেথায়
কেন আমায় আনলি মা গো মহারানীর
ভাগীরথীর ধারার মত সুধার সাগর
মা গো তোরি পায়ের নূপুর রাজে
জ্যোতির্ময়ী মা এসেছে আঁধার আঙিনায়
তোর কালো রূপ দেখতে মা গো
(বল্ মা শ্যামা) বল্ তোর বিগ্রহ কি মায়া
মাকে ভাসায়ে জলে কেমনে রহিব ঘরে
কে সাজালো মাকে আমার
(আমার) আনন্দিনী উমা আজো
আমার উমা কই গিরিরাজ
সংসারের এই দোলনাতে মা
আয় বিজয়া আয় রে জয়া
মেখে এলি এ কোন চুলোর ছাই
আমার কালো মেয়ে রাগ করেছে
শ্যামা মায়ের কোলে চড়ে
মা ত্রিনয়নী! সেই চোখ দে মা! আমি তোর অন্ধ ছেলে
আমার শ্যামা বড় লাজুক মেয়ে
আমার মা আছে রে সকল নামে
ওমা তোর ভুবনে জ্বলে এত আলো
ওমা তুই আমারে ছেড়ে আছিস
আমার মানস-বনে ফুটেছে রে
শ্যামা নামের লাগল আগুন
ওমা খড়্গ নিয়ে মাতিস রণে
আমার হৃদয় হবে রাঙা জবা দেহ বিল্বদল
যে কালীর চরণ পায় রে
তোরই নামের কবচ দোলে
মাতৃ নামের হোমের শিখা
আয় মা ডাকাত কালী আমার ঘরে কর ডাকাতি
আমি মুক্তা নিতে আসিনি মা
আমি সাধ করে মোর গৌরী মেয়ের
আমর ভবের অভাব লয় হয়েছে
থির হয়ে তুই বস দেখি মা।
কি নাম ঢরে ডাকবো তোরে
নিশি কাজল শ্যামা, আয় মা নিশীথ রাতে
ওমা, তোর চরনে কি ফুল দিলে
তোর নাম গানেরই দীপক রাগে
শ্যামা তোরে শ্যাম সাজায়ে দেখি আয়
রাঙা জবায় কাজ কি মা তোর
তোর মেয়ে যদি থাকতো উমা
বর্ষা গেল আশ্বিন এল
শঙ্খে শঙ্খে মঙ্গল গাও
এবার নবীন মন্ত্রে হবে জননী তোর
জাগো অরুণ ভৈরব, জাগো হে শিব ধ্যানী
এস শঙ্কর ক্রোধাগ্নি
শান্ত হও শিব বিরহ বিহ্বল
ভগবান শিব জাগো জাগো
নমো নমো নমো হিমগিরি সূতা
মা গো চিন্ময়ী রূপ ধরে আয়
(★ বিশেষ কৃতজ্ঞতা – শ্রী পল্লব চট্টোপাধ্যায় লিখিত প্রবন্ধ। মূল লেখার লিংক: http://www.abasar.net/gaanplbc1.htm
★ তথ্যসূত্র:
১- নজরুল গীতি প্রসঙ্গ, ড. করুণাময় গোস্বামী, বাংলা একাডেমি।
২- নজরুল-চরিতমানস, ডঃ সুশীলকুমার গুপ্ত, দে’জ পাবলিশিং (২০১৫)।
৩- নজরুল রচনাবলী, বাংলা একাডেমি (২০০৭)।
৪- সমকালে নজরুল ইসলাম, মুস্তাফা নূরউল ইসলাম, কথাপ্রকাশ (২০১৫)।
৫- নজরুল জীবনী, অরুণকুমার বসু, আনন্দ পাবলিশার্স (২০১৬)।
৬- দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকা, ২৫শে মে ২০১৮ সাল।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত