তিনি ছিলেন অতি অভিজ্ঞ, অতি সুদক্ষ এক সারথি। নিজের রথ কী ভাবে কোন কায়দায় চালাতে হবে তা তিনি জানতেন। এটা সম্ভব হয়েছিল তাঁর কোনও উচ্চ আকাঙ্খা ছিল না বলে। জীবনদর্শন ছিল এই রকম কয়েক দিনের জন্য এসেছি, আনন্দ করতে করতে চলে যাব। এই আনন্দটাও ছিল রিবাউন্স করা। তোমাদের আনন্দ আমার আনন্দ। তোমাদের সঙ্গে খানিক মজা করব। জীবন নিংড়ে এমন কোনও লেখা বের করতে চাই না যার মধ্যে কোনও ইজম আছে।
অথচ একসময়, জীবনের প্রথম দিকে তিনি রাজনীতি ঘেঁষা অবশ্যই ছিলেন। ‘ঈশ্বর-পৃথিবীর ভালবাসা’-র শুরুটাই করেছেন এইভাবে,
“প্রায় লেখককেই নিজের কবর খুঁড়তে হয় নিজের কলম দিয়ে। গায়কের মতো লেখকেরও ঠিক সময়ে থামতে জানা চাই। সমে এসে যথাসময়ে না থামলেই বিষম, সবটাই বিষময় হয়ে দাঁড়ায়। এমনকী কালজয়ী লেখকও যদি যথাকালে না থামেন তো জীবদ্দশাতে জীবন্মৃতের অন্তর্দশা তাঁর বিধিলিপি।
অবশ্য মহাকাল কারও কারও প্রতি একটু সদয়। সময় থাকতে থাকতেই তাঁদের নিরস্ত করেন, নিজের পুনরাবৃত্তির পথে আত্মহননের ভোগান্তি তাঁদের আর পোহাতে হয় না। যেমন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, বিভূতিভূষণ, শরৎচন্দ্র। বিস্ময় থাকতে থাকতেই, রাখতে রাখতেই তাঁরা অস্ত গেছেন।”
এই দুটি প্যারা পড়লে বোঝা যায় গদ্যের ওপর তাঁর বাঁধুনিটা কত মজবুত ছিল। এই আত্মজীবনীতেই দেখতে পাওয়া যাবে সব লেখকই যে যে দুস্তর বাঁধা অতিক্রম করেন তাঁকেও তা করতে হয়েছে। যেমন, জীবনের প্রথম দিকে প্রবাসীতে একটি কবিতা পাঠিয়েছিলেন। এবার নিজেই লিখছেন, দিন কতক বাদে লেখাটা ফেরত এল। সঙ্গে চারুদার এক চিরকুট। এই হলেন শিবরাম। চারুদার চিরকুট। শব্দ যেন তাঁর সঙ্গে খেলা করত।
চিঠির বক্তব্য, কবিতাটি মন্দ হয়নি কিন্তু এটি প্রবাসীতে ছাপিয়ে তোমাকে উৎসাহ দিতে চাই না। সম্পাদক উপদেশ দিয়েছিলেন, এই বয়সে লেখাপড়া করে মানুষ হও আগে। তারপর না হয় লিখো। সঙ্গীত, কবিত্ব আর ল্যাজ কারও ভিতরে থাকলে তা আটকানো যায় না। তোমার মধ্যে যদি তা থাকেই তা প্রকাশ পাবেই। যথাকালে দেখা দেবে অযথা জোর করে অসময়ে তাকে টানাটানি করে বার করার কোনও দরকার নেই। শিবরাম লিখছেন, কথাগুলো আমার মর্মে মর্মে গাঁথা হয়েছিল অনেক দিন।
বাংলা সাহিত্যে হাস্যরস নিয়ে কাজ করেছেন এমন লেখকদের সংখ্যা খুব বেশি না হলেও একেবারে হাতে গোনার মতনও নয়। তবে এখানে হাস্যরসের ধরনটা নিয়ে একটুখানি গোল আছে। কোনো কোনো লেখক হাস্যরস সৃষ্টি করেছেন নিছকই হাস্যরস সৃষ্টির লক্ষ্যে, হাস্যরস সৃষ্টির জন্য তারা সস্তা চটুলতা কিংবা অশ্লীলতার পথ অবলম্বনেও পিছপা হননি।
অন্যদিকে কেউ কেউ এই হাস্যরসকে নিয়ে গেছেন একেবারে শিল্পের পর্যায়ে। এসব হাস্যরসে লেখকেরা শব্দের জাদুকরী খেলায় একদিকে যেমন পাঠককে হাসিয়েছেন, আরেকদিকে তাদের মনোজগতে খুলে দিয়েছেন নতুন দ্বার। শিবরাম চক্রবর্তী এই দলেরই একজন। এপার বাংলা আর ওপার বাংলা মিলিয়ে আজ অব্দি যত হাস্যরস সমৃদ্ধ সাহিত্য রচিত হয়েছে, তার মধ্যে শিবরামের লেখাগুলো এক বিশেষ স্থান দখল করে আছে।
শিবরাম চক্রবর্তী, তিনি বলতেন বা লিখতেন শিব্রাম চক্কোত্তি। নিজের নাম নিয়েই খেলা করতেন।
পরশুরাম বালকদের তেমন বোধগম্য হতেন না। কারণ তাঁর ব্যঙ্গাত্মক লেখা, স্যাটায়ার ছিল বড়দের জন্য। আর ত্রৈলোক্যবাবুর কোনও কোনও লেখা ছোটদের হাত ধরতে চাইলেও তেমন জোরে ধরতে পারতেন না।
শিবরাম চক্রবর্তীর লেখা যেমন ছোটদের জন্য, সেই রকম বড়দের জন্যও। এমনটা অনেকের ভাগ্যে ঘটে না।
তিনি তো কবিতা দিয়ে শুরু করেছিলেন। গম্ভীর বিষয়ে প্রবন্ধও লিখেছেন। কিন্তু ব্যক্তি শিবরামের অবস্থান ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন মেরুতে। একেবারে অন্য রকমের মানুষ, অন্য রকমের লেখা। কারও সঙ্গে মিলবে না। যদি কেউ প্রশ্ন করেন, তাঁর লেখার আকর্ষণটা কোথায়? তাহলে একটিই উত্তর বলতে পারব না। ভাল রাঁধুনি যেমন বলতে পারবেন না, ঠিক কীসের সঙ্গে কীসের সংযোগে এমন সুস্বাদু একটি পদ তৈরি হল।
তাঁর লেখার মধ্যে একজন মানুষকে দেখতে পাওয়া যেত। না সাধু, না গৃহী সম্পূর্ণ মুক্তমনের একজন। যারা তাঁকে দেখেছেন, যাঁরা তাঁকে চিনেছেন, তাঁদের মনে হয়েছে যে, মানুষটি যেন রাজাধিরাজ। একেবারে বন্ধনমুক্ত। নিজের জীবন নিয়েই কত রসিকতা।
গদ্যে তাঁর অভাবনীয় দখল ছিল। যার ফলে বাক্যকে এমন মোচড় দিতেন যা বিস্ময়কর। তাঁর প্রতিভার এটা একটা মস্ত দিক। সাফল্যের নব্বই ভাগ এরই উপর দাঁড়িয়ে আছে। ইংরেজিতে যাকে বলে ‘পানিং’। তিনি বলতেন, মুক্তারামবাবুর মুক্ত আরামে আছি। জমিদারের ছেলে। পরিবার-পরিজনের কী হল তা কখনও বলতেন না। একটি প্রাচীন মেসবাড়ির একটি ঘরেই তাঁর সাম্রাজ্যের বিস্তার।
জমিদারের ছেলে। সংস্কারে সেই বীজটি তাঁর মধ্যে ছিল আমৃত্যু। সিল্কের পাঞ্জাবি, সাদা ধবধবে ধুতি। উজ্জ্বল মূর্তি, মাথার চুল বিচিত্র কায়দায় আঁচড়ানো। ফর্সা টকটকে কপালের উপর ঝুলে থাকত এক গুচ্ছ চুল। বড়দের খুব একটা পাত্তা তিনি দিতেন না। তিনি বন্ধুত্ব করেছিলেন শিশু কিশোর, কিশোরীদের সঙ্গে।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তখন আনন্দবাজার-এ চাকরি করেন। একদিন বেলার দিকে এক সাহিত্যিক এসে খবর দিলেন শিবরামবাবুকে দেখলাম, অফিসের কাছেই সেন্ট্রাল এভিনিউ-এর ফুটপাথে চিৎ হয়ে শুয়ে আছেন। মনে হয় শরীরটরির…!’’
সর্বনাশ! সে কী কথা!
সুনীল সদলবলে ছুটলেন। তিনি গিয়ে দেখেন ‘চাংওয়া’র সামনে শিবরাম আরামে ফুটপাতে শুয়ে আছেন। একটা হাত কপালে, আর একটা হাত সিল্কের পাঞ্জাবির পকেটে। একটু আড়ালে দাঁড়িয়ে ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করেন তিনি। শিবরামের ডান হাতটা পাঞ্জাবির পকেটে। পকেট থেকে তেলেভাজা বের করে মাঝে মাঝে মুখে দিচ্ছেন।
এই বারে তিনি গিয়ে ঝুঁকে পড়ে শিবরাম কে জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘কী হল? শরীর খারাপ লাগছে?’ এইখানে এইভাবে শুয়ে আছেন কেন!” শিবরাম উত্তরে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় কে নিচু হতে ইশারা করলেন।
তারপরে ফিসফিস করে বললেন, ‘‘না না, ফার্স্টক্লাস আছি। আসলে যেতে যেতে হঠাৎ মনে হল ফুটপাতে শুয়ে আকাশটাকে কেমন দেখতে লাগে একবার দেখাই যাক।’’ তারপরে বললেন, “চলন্ত বাস থেকে নামতে গিয়ে কোঁচা জড়িয়ে পড়ে গেছি। একটা ধেড়ে মানুষের পড়ে যাওয়াটা লজ্জার, না শুয়ে থাকাটা লজ্জার!”
উত্তরে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বললেন, “এর উত্তর দেবেন সাগরদা। আপনি এখন উঠুন।”
সিল্কের পাঞ্জাবির পিছনে ধুলো। মাথার পেছনে ধুলো। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সেটা ঝাড়ার চেষ্টা করতেই শিবরাম বললেন, “তুমি কিছুই জান না। এক সময় কলকাতার বাবুরা ভোরবেলায় খানা থেকে উঠে প্রাসাদে প্রবেশ করত। পাঞ্জাবির পেছনে ধুলো এটা একটা অ্যারিস্টোক্রেসি।”
অন্য একদিন মুক্তারামবাবুতে শিবরামের মেসে গিয়েছেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। একটা সভায় যাওয়ার কথা। তাঁকে শিবরাম বললেন, “আমার এই তক্তাপোশে পা তুলে বসো। কারণ এর তলায় কী কী জন্তু জানোয়ার আছে তা আমি জানি না। ঘাঁটাইনি কোনও দিন। সাপও থাকতে পারে। আমি আমার ড্রেসিং রুম থেকে আসছি।”
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় জিজ্ঞেস করলেন, “সেটা কোথায়?”
শিবরাম বললেন, “ওই যে রাস্তার ওপারে যে লন্ড্রিটা রয়েছে ওইটা। আমি ওখানে গিয়ে আমার এই ধুতি আর পাঞ্জাবিটা ছেড়ে দেব। আর যেটা কেচে এসেছে সেটা পরে চলে আসব। দুটো সেট। কোনও ঝামেলা নেই। বাক্সপ্যাঁটরা নেই। বুঝলে, একেই বলে আপনি আর কোপনি। জীবনটাকে হালকা করো। রেল কোম্পানির বিজ্ঞাপন দেখেছ? ট্রাভেল লাইট।”
শিবরাম ভালোবাসতেন তিনটি জিনিস। ভোজন, নিদ্রা আর সিনেমা। হাতে তার টাকা থাকতো না কখনোই। শোনা যায়, তিনি নাকি একই ঠিকানায় কাটিয়ে দিয়েছেন জীবনের ৬০টি বছর। শিবরামের নিজের ভাষায়, “মুক্তারামের মেসে, শুক্তারাম খেয়ে, তক্তারামে শুয়ে”। অনেকে বলেন, মুক্তারাম স্ট্রীটের এই বাড়িটিতে তিনি নাকি পাহাড়াদার হিসেবে এসেছিলেন, তারপর আমৃত্যু এখানকার স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে যান।
তার ঘরটিও ছিলো দেখবার মতন। আসবাবপত্রের কোনো বালাই না থাকলেও অভাব ছিলোনা পুরনো কাগজ, অগোছালো জঞ্জাল আর আজেবাজে জিনিসের। এ সম্পর্কে বিখ্যাত লেখক শতদল গোস্বামী তার ‘১৩৪, মুক্তারাম স্ট্রীটের সেই রসিক লেখক’ শীর্ষক লেখায় জানান,
“বয়সের ভারে জরাজীর্ণ মেস-বাড়ি। বাড়িটা কবে তৈরি তা নিয়ে নানা মুনির নানা মত। কেউ বলে, মহারানি ভিক্টোরিয়ার মুখে ভাতের দিন, কেউ আবার অত দূর অতীতে যেতে চায় না; বলে, অসম্ভব! মুখে ভাতের দিনে নয়, গায়ে-হলুদের দিন। জরাজীর্ণ রেলিং আর ভাঙা সিঁড়ি বেয়ে উপরতলায় উঠতে হবে। আহা হা হাঁচবেন না, হাঁচবেন না। শব্দদূষণের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া এক্ষুণি টের পাবেন। চুন-বালি-সুরকির পলকা পলেস্তারা আশীর্বাদের মতো ঝুরঝুর ঝরে পড়বে। এবার ধীরেসুস্থে উপরে উঠুন। ভেজানো দরজা ঠেলা দিন, ঘর। হোম। সুইট হোম। হোম নয়, রুম। শৈলেশ্বরের একক সোনার সংসার!”
শতদল গোস্বামীর সেই লেখা থেকে আরো জানা যায়, শিবরামের ঘরের সমস্ত দেয়াল জুড়ে ছিলো অজস্র আঁকিবুকি। অবশ্য শিবরামের যে চিত্রকলায়ও পারদর্শিতা ছিলো ব্যাপারটি কিন্তু তা নয়। দেয়ালে লেখা ছিলো অসংখ্য লোকের নাম আর তাদের যোগাযোগের ঠিকানা, ফোন নম্বর। নামগুলোর নিচে আবার লাল-নীল কালিতে দাগ দেওয়া। ওই দাগের রং দিয়েই নাকি বুঝতেন কে তার পাওনাদার আর তিনি কার কাছে টাকা পাবেন। খামখেয়ালিতে যদি খাতা হারিয়ে যায়, সেই ভয়েই নাকি এই ব্যবস্থা!
শিবরামবাবুর লেখায় আমরা সেই সব চরিত্রদের পাই। যেমন হর্ষবর্ধন, গোবর্ধন, পিসিলা, জহর ইত্যাদি। এই চরিত্রদের তিনি খেলিয়েছেন। গল্প অনেক ক্ষেত্রেই সামান্য। রস তৈরি হয়েছে কথার পিঠে কথা আর সিচ্যুয়েশনের মাধ্যমে। কত নাম করব। গন্ধচুরির মামলা, খোলাখুলি ইত্যাদি ইত্যাদি। কোনও দিন তাঁকে দেখিনি নিজের লেখা, বই আর প্রাপ্যের হিসাব রাখতে। সংস্কারটা যে ছিল জমিদারের আর ত্যাগীর। সেই জন্যই বইটির নাম প্রথমে ঈশ্বর, তারপর পৃথিবী এবং সব শেষে ভালবাসা। এই মানুুষটিকে আমরা চিরকাল ভালবাসতে বাধ্য।
শিবরামের লেখালেখি সম্পর্কে খুব একটা প্রচার প্রসার হয়নি। এর পেছনে লেখকের খামখেয়ালিপনাই অধিকাংশে দায়ী। লেখালেখি সংরক্ষণ বা ছাপার খুব একটা আগ্রহ তাঁর ছিলো না। শিবরামের লেখালেখি বা সাহিত্যকর্ম সম্পর্কে যতটা জানা যায় তার চেয়েও কম জানা যায় তাঁর ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে।
ব্যক্তিগত জীবনে অত্যন্ত অনাড়ম্বর এই মানুষটি লোকচক্ষুর আড়ালেই থাকতে বেশি ভালোবাসতেন। ভালোবাসতেন সাদাসিধে জীবনযাপন। খুব বেশি জামাকাপড় তার ছিলো না। শোনা যায়, এমনও নাকি বহুবার হয়েছে যে, শুধুমাত্র দু’খানা কাপড় ছিলো তাঁর। একটিকে ধোপাবাড়ি দেওয়া হয়েছে বিধায় তাঁকে কোনো কারণে কাপড় বদল করতে হলে ধোপা বাড়িতে গিয়েই কাপড় বদলে আসতে হয়েছে।
জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি ক্ষমা করতে পারেননি শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে! অথচ একসময় এই শরৎচন্দ্রকেই ঈশ্বরের মতো শ্রদ্ধা করতেন শিবরাম।নিজের একটি বইয়ের পাণ্ডুলিপিও নিয়ে গেছিলেন শরৎবাবুর কাছে। ‘যদি দুটো লাইন লিখে দেন ভূমিকায় তাহলে একটা প্রকাশক জোটে’ এই আশায়। লিখেও দিয়েছিলেন কথাশিল্পী। সেই সম্পর্কই এক ঘটনায় চুরমার হয়ে গেল।
‘দেনাপাওনা’ উপন্যাসের নাট্যরূপ দিয়েছিলেন শিবরাম। নাম হয়েছিল ‘ষোড়শী’। সকলেই জানে সে কথা। স্বয়ং লেখকও জানেন। অথচ সেই নাটক যখন ‘ভারতী’ পত্রিকায় প্রকাশ পেল সেখানে নাট্যকারের নাম বদলে শরৎচন্দ্রের নাম!
শিবরামের বদলে শরৎবাবুর নাম দিলে পত্রিকা বিক্রি হবে বেশি। সম্পাদকের যুক্তিতে চুপ থাকলেন শিবরাম। নাটক নিয়ে গেলেন শিশিরকুমার ভাদুড়ীর কাছে। নাটক পড়ে উচ্ছ্বসিত নাট্যাচার্য।
‘‘অসাধারণ নাট্যরূপ দিয়েছেন! আমি করব।’’
শুরু হল শো। প্রায় প্রতিদিনই হাউসফুল। এদিকে তখন দেনার দায় জর্জরিত খোদ নাট্যকার শিবরাম।
নাট্যাচার্যকে বললেন, ‘‘শিশিরবাবু, কিছু টাকা পেলে ভাল হয়। নাটকে আমার লভ্যাংশ থেকে যদি কিছু দিতেন।’’
নাটকের বেনিফিট শোয়ের দিন শিবরামকে আসতে বললেন শিশির কুমার। গেলেন।
শো শেষে সাজঘরে গিয়ে হাত পাততেই শিশিরকুমার বললেন, ‘‘দেরি করে ফেললেন। আজ টিকিট বিক্রির সব টাকা একটি থলেতে ভরা ছিল, শো শেষ হতেই শরৎবাবু সাজঘরে এসে সব টাকা নিয়ে চলে গেলেন।’’
‘‘সে কী! আপনি বললেন না আমার কথা!’’ হতবাক শিবরাম।
‘‘বলেছিলাম। শরৎবাবু উত্তরে আমায় বললেন, ‘শিবরাম টাকা দিয়ে কী করবে? বিয়ে-থা করেনি, কিচ্ছু না। ছেলেপুলে নেই, ঘর-সংসার নেই, টাকার তার কীসের দরকার?’ আমি বললাম তবু কিছু দিন অনুগ্রহ করে…। খুব খারাপ অবস্থায় রয়েছে ও। আজ আসবে ও কিছু টাকার আশায়। শুনে বললেন, ‘না না। এই বেনিফিট নাইটের বখরা ওকে দিতে যাব কেন? এ রাত্তিরে টিকিট বিক্রি হয়েছে আমার নামে। এর মধ্যে শিবরাম আসছে কোথা থেকে!’ বলে টাকার থলে নিয়ে একটু বেশিই তাড়াতাড়ি চলে গেলেন শরৎবাবু। হয়তো আপনার মুখোমুখি যাতে না হতে হয় সেই জন্যই।’’
শিশিরকুমারের কাছে এই কথা শুনে চুপ শিবরাম। কী বলবেন ভেবে পাচ্ছেন না!
মাথা নিচু করে ফিরে আসছেন, পিছন থেকে ডাক দিলেন শিশিরকুমার, ‘‘দাঁড়ান একটু।’’ বলে একজনকে বললেন, ‘‘আমার চেকবইটা নিয়ে আয় তো।’’
চেকবই এল।
‘‘আমার অ্যাকাউন্টে কত আছে জানিস?’’
‘‘একশো কুড়ি টাকা।’’
‘‘শিবরামবাবু, আপনার নামের বানান বলুন।’’
‘‘আমার তো কোনও ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টই নেই।’’
‘‘বেশ তাহলে এই একশো কুড়ি টাকারই একটা সেলফ চেক কেটে দিলাম। আমার আর কিছু নেই, বিশ্বাস করুন, থাকলে সেটুকুও দিতাম। কিছু মনে করবেন না।’’
সেই চেক হাতে নিয়ে ক্ষতবিক্ষত মনে ফিরে এসেছিলেন শিবরাম। কথাশিল্পীর প্রতি জমে ওঠা এত দিনের শ্রদ্ধা যেন চোখের সামনে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে গিয়েছিল।
যে শিবরাম কখনও কারও নিন্দা করেননি, সেই তিনিও ‘দরদি’ কথাশিল্পীর অমন আঘাত ভুলতে পারেননি শেষ দিন পর্যন্ত।
এমনিতে টাকাপয়সা, সম্পত্তির প্রতি কোনও দিনই তার আসক্তি ছিল না। নেহাত পেটে টান না পড়লে টাকার চিন্তাও করতেন না। পুরো জীবনটাই যেন তার কাছে ছিল একটা ঠাট্টা।
প্রেমেন্দ্র মিত্রর সঙ্গে আচমকাই পরিচয় হল এক সিনেমা হলে। শিবরামের আবার রোজ একটি করে সিনেমা না দেখলে খাবার হজম হয় না। তো, পরিচয়ের একটু পরেই দু’জনের গল্প এমন তুঙ্গে উঠল যে সিনেমা দেখা মাথায়।
শিবরাম তখন ওই সিনেমা হলেরই সিটে বসে প্রেমেন্দ্রকে নিয়ে মানসভ্রমণে বেরিয়ে পড়েছেন। এই দেশ ওই দেশ ঘুরে বেড়াচ্ছেন। প্রেমেন্দ্র মিত্রও হাঁ করে শুনছেন। মোটামুটি কোন কোন দেশ ঘুরতে যাওয়া হবে তার খসড়া রেডি। তখন প্রেমেন্দ্র জিজ্ঞাসা করলেন, ‘‘কিন্তু এত দেশ যে ঘুরব দু’জনে টাকা কই?’’
‘‘আরে লাখ টাকার মামলা ঠুকেছি ভায়া। জিতলাম বলে। ওই টাকা হাতে পেলেই বেরিয়ে পড়ব দুই বন্ধুতে।’’
হ্যাঁ, সত্যিই শিবরাম সেবার এক লাখ টাকার মামলা ঠুকেছেন তার পৈতৃক সম্পত্তির দাবিতে। যাকে বলে একেবারে শিব্রামীয় মামলা।
উকিল ব্যারিস্টার কেউ নেই। শিবরাম নিজেই সব। প্রমাণ বলতে একজন সাক্ষী। আর সেই সাক্ষী কে? যার বিরুদ্ধে মামলা ঠুকেছেন স্বয়ং তাকেই নিজের পক্ষের সাক্ষী বানিয়েছেন শিবরাম। এতই বিশ্বাস যে সাক্ষী মিথ্যে বলবেনই না।
এ দিকে যা অবশ্যম্ভাবী, তাই-ই ঘটল।
আদালতে দাঁড়িয়ে সেই প্রতিপক্ষ তথা সাক্ষী বলল, ‘‘ধর্মাবতার শিবরামবাবুর এই অভিযোগ সবটাই মিথ্যে এবং ভিত্তিহীন।’’ ব্যস, সাক্ষীর একটি কথাতেই পুরো মামলা ডিসমিস।
প্রেমেন্দ্র মিত্র আর শিবরাম চক্রবর্তীর বন্ধুত্ব নিয়েই আরও কিছু বলি। শিবরাম তাঁর আত্মজীবনীর প্রথম খণ্ড ‘ঈশ্বর পৃথিবী ভালোবাসা’তে লিখেছেন, “পৃথিবীতে বড় বয়সের বন্ধু বলে কিছু হয় না। বন্ধু হয়, সেই ছোটবেলায় স্কুল কলেজে পড়বার সময়। তার পর হয় এনিমি বা নন-এনিমি। এই নন-এনিমি দেরই আমরা বন্ধু বলে ধরি।” তবে, প্রেমেন্দ্রের ব্যাপার আলাদা। শিবরাম প্রায়ই বলতেন, “প্রেমেনের মতো মিত্র হয় না।”
এক বার, এক রেস্তরাঁয় বসে খাওয়াদাওয়া করছেন প্রেমেন্দ্র মিত্র, হেমেন্দ্রকুমার রায়, কাজী নজরুল এবং শিবরাম। স্নেহের আবেগে জাপ্টে ধরে হঠাৎ হেমেন্দ্রকুমার প্রেমেনের গালে একটা চুমু খেয়ে বসলেন। শিবরাম লিখলেন,
“গল্প না বৎস, না কল্পনা চিত্র
হেমেন্দ্র চুম্বিত প্রেমেন্দ্র মিত্র।”
প্রেমেন্দ্র তাঁর প্রথম প্রকাশিত ছোটগল্পের বই ‘পুতুল ও প্রতিমা’ উৎসর্গ করেন শিবরামকে। সেই প্রসঙ্গে শিবরাম লিখছেন, “অনেকদিন পরে ‘পুতুল ও প্রতিমা’র দ্বিতীয় সংস্করণ বেরুল সিগনেট থেকে। তার একখানা কপি হাতে পেতে পাতা উল্টে দেখি, বইটা আমার নামেই উৎসর্গ করা। এ কী! আমি অবাক হয়ে গেলাম দেখে। ‘তোমার প্রথম বইটা আমাকেই দিয়েছ দেখছি’, গদগদ কণ্ঠে তাকে বললাম। ‘সে কি! তুমি জানতে না?’ সে শুধালো। ‘না, এই দ্বিতীয় সংস্করণ বের হবার পর টের পেলাম’, আমি বলি— ‘দ্বিতীয় সংস্করণটাই দিয়েছ বুঝি আমায়? প্রথম সংস্করণটা কাকে দিয়েছিলে?’ ‘কেন? তোমাকেই তো! তুমি জানতে না?’ সে হতবাক। ‘বইয়ের প্রথম সংস্করণ একজনকে, দ্বিতীয় সংস্করণ আরেকজনকে— এরকম দেওয়া যায় নাকি! …আশ্চর্য! বইটা বেরুবার দিনই তো দিয়েছিলাম তোমায়, তোমার বাসায় গিয়ে, মনে নেই? বইয়ের মলাটও উলটে দেখনি নাকি!’ ‘উলটে দেখার কী ছিল? তোমার সব লেখাই তো মাসিকে বেরুনোর সঙ্গে সঙ্গেই পড়া। একবার নয়, বারবার। সেই সব জানা গল্প আবার নতুন করে জানতে যাবার কী আছে— তাই কোন কৌতূহল হয়নি আমার।’ …মনে পড়ল তখন। হাতে পেয়ে বইটার মলাট দেখেই খুশি হয়েছিলাম। মলাটের পাতা উলটে আরও বেশি খুশি হবার সৌভাগ্য আমার ঘটেনি যে, সেটা আমার ললাট। প্রেমেনের বই তখন লোকের হাতে হাতে চলত, তাই মনে হয়েছিল এই দুর্যোগের দিনে এটাকেও হাতে হাতে চালিয়ে দিই এই সুযোগে। সঙ্গে সঙ্গে এম সি সরকারে গিয়ে বেচে দিয়ে এসেছিলাম বইটা।”
প্রেমেন্দ্রের ‘পাতালে পাঁচ বছর’ বইটি প্রকাশিত হওয়ার কিছু পরেই শিবরাম লিখলেন, পাতালে বছর পাঁচেক’ গল্পটি। এতে লিখছেন— “…তখনই বারণ করেছিলাম গোরাকে সঙ্গে নিতে। ছোট ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে কোনো বড় কাজে যাওয়া আমি পছন্দ করিনে। আর ঐ অপয়া বইখানা। প্রেমেন মিত্তিরের ‘পাতালে পাঁচ বছর’! যখনই ওটা ওর বগলে দেখেছি, তখনই জানি যে, বেশ গোলে পড়তে হবে…” নিবিড় অন্তরঙ্গতা থাকলে, তবেই না প্রেমেন মিত্তিরের মতো সাহিত্যিকের সাহিত্য নিয়ে এমন মশকরা করা যায়!
এক ধূপকাঠিওলার ছদ্মবেশে দিনদুপুরে এক চোর ঢুকল শিবরামের ঘরে। ঘর মানে, যেখানে মুক্তারামের তক্তারামে শুক্তারাম খেয়ে শিবরাম থাকেন সেই মেসের ঘরে। বাইরে গেলে কোনও কালেই ঘরে তালা দেন না, তালা দিয়ে লাভ কী? কিছুই তো নেই ঘরে। শুধু চার দেওয়ালে অজস্র নাম-ঠিকানা আর ফোন নম্বর লেখা। শিবরামের অকাট্য যুক্তি, ‘খাতা হারিয়ে গেলেও দেওয়াল হারানোর কোনও সুযোগ নেই। চোর ঢুকে গোটা ঘরে তন্ন তন্ন করে খুঁজেও কিছুই পেল না। ফিরে গেল। সন্ধেবেলা শিবরাম ঘরে ঢুকে দেখে জামাকাপড়, লেখার কাগজপত্র, কম্বল-বালিশ সব তছনছ। আর তক্তপোশের ওপর রাখা একটি দশটাকার নোট এবং এক প্যাকেট ধূপকাঠি আর একটি চিঠি।
চিঠিতে লেখা, “ভাই তোমার ঘরে চুরি করতে এসে দেখলাম তোমার অবস্থা আমার থেকেও খারাপ। কাজকম্ম বোধহয় কিছুই করো না। এই দশটা টাকা রেখে গেলাম। এই টাকায় এই কোম্পানির ধূপকাঠি কিনে ফেরি কোরো। এইভাবে কত দিন চলবে? আমার পরামর্শ মানলে জীবনে উন্নতি করবে।”
ধূপকাঠি ফেরি না করলেও জীবনের প্রথম রোজগার শুরু করেছিলেন কিন্তু ফেরিওলা হয়েই। খবরের কাগজ ফেরি। গ্রামের বাড়ি থেকে পালিয়ে কলকাতা এসেছে কিশোর শিবরাম। কোথায় থাকবে, কী করে পেট চলবে জানা নেই। সুতরাং দুই বেলা কখনও ভিখিরিদের সঙ্গে পঙ্ক্তিভোজ আর রাত্রে ওই ভিখিরিদের সঙ্গেই ফুটপাতে বা মন্দিরের গায়ে লাইন দিয়ে শোয়ার ব্যবস্থা। একদিন হঠাৎই পরিচয় হল তারই বয়েসি একটি ছেলের সঙ্গে।
‘‘আরে তুমি তো ভদ্রলোকের ছেলে, এই ভাবে ভিখিরিদের সঙ্গে বেশি দিন থাকতে পারবে না। এক কাজ করো।’’
‘‘কী করব তাহলে?’’ শিবরামের প্রশ্ন।
‘‘তুমি আমার মতো খবরের কাগজ ফেরি করো। আমি যোগাযোগ করিয়ে দেব।’’
ব্যস, শুরু হয়ে গেল পরদিন থেকেই। কখনও হেদুয়া তো কখনও শ্যামবাজার, কখনও বউবাজার তো কখনও গোলদিঘি। কিন্তু কাগজ বেচাও অত সহজ নয়। পুরনো ফেরিওয়ালারা নতুনকে ঢুকতে দেবে কেন? তাই বার বার জায়গা বদল। সারাদিন কাগজ বেচে যা কমিশন হাতে আসে তাই দিয়ে আগেই রাবড়ি, রসগোল্লা, চপ-কাটলেট এবং অবশ্যই সিনেমা।
রোজের রোজগার রোজই শেষ।
রবিবার ইস্কুল-আপিস বন্ধ তাই সব ফেরিওয়ালারই সারাদিনে কাগজ বিক্রি হত কম। ফেরিওয়ালারা কাগজ তুলতও কম। শিবরাম কিন্তু কাগজ তুলে সেদিন সকালে বিশেষ বিক্রির চেষ্টা না করে সন্ধেবেলায় উত্তর কলকাতার একটি সিনেমা হলের সামনে গিয়ে দাঁড়াতেন। রবিবার হাউসফুল। সিনেমা শুরুর আগে পর্যন্ত কেউ কিনত না। কিন্তু যেই শুরু হত তার একটু পর থেকেই তিরবেগে নিজের সিট ছেড়ে বাইরে উঠে আসতেন দর্শকরা, তারপর শিবরামের থেকে বাংলা ইংরেজি উর্দু নির্বিশেষে যা হোক একটা দুটো কাগজ কিনে আবার ঢুকে যেতেন ভেতরে। আসলে, ওই হলের সিটে এত ভয়ংকর ছারপোকা ছিল যে কাগজ না পেতে বসার উপায় নেই। শুধু একটা কাগজ কিছুতেই বেচতেন না, রেখে দিতেন নিজের জন্য। টিকিট আগেই কাটা থাকত। সব বিক্রি শেষ হলে ওই কাগজ হাতে নিয়ে ঢুকে পড়তেন হলে। একেই বলে শিব্রামীয় বুদ্ধি!
বাউণ্ডুলেপনা ছিল তাঁর রক্তে। নইলে রাজপরিবারের উত্তরাধিকারী হয়ে কেউ সব ছেড়েছুড়ে এমন ভবঘুরে জীবন কাটায়?
শিবরামের জন্ম পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায়, ১৯০৩ সালের ১৩ ডিসেম্বর। যদিও তাঁর শৈশব ও কৈশোরের অধিকাংশ সময়ই কেটেছে পাহাড়পুর আর চাঁচলে। শিবরামের মা শিবরাণী দেবী মালদহের চাঁচলের জমিদার পরিবারের মেয়ে ছিলেন। বাবা শিবপ্রসাদ চক্রবর্তী ছিলেন কিছুটা সন্ন্যাসী প্রকৃতির। প্রায়ই ভবঘুরের মতো নিরুদ্দেশ হয়ে যেতেন। শিবরামও বাবার এই স্বভাবের খানিকটা উত্তরাধিকার সূত্রে অর্জন করেছিলেন। মায়ের মাঝেও ছিলো আধ্যাত্মিকতার প্রচ্ছন্ন ছায়া। পার্থিব জীবনের প্রতি আকর্ষণ শিবরামের মা-বাবা কারোরই তেমন ছিলো না। তাই ছোটবেলা থেকেই বন্ধনহীন মুক্ত পরিবেশে বড় হয়েছিলেন শিবরাম। সুযোগ পেলেই উদ্দেশ্যহীন, গন্তব্যহীন হয়ে ঘরছাড়ার স্বভাবটা তখন থেকেই গড়ে উঠেছিলো। শিবরামের এই স্বভাবের প্রতিফলন আমরা দেখি তার কিশোর উপন্যাস ‘বাড়ি থেকে পালিয়ে’ (১৯৩৭)-তে।
উত্তরবঙ্গের চাঁচোল। সেখানকার রাজা ঈশ্বরগুপ্তের দুই স্ত্রী সিদ্ধেশ্বরী আর ভূতেশ্বরী। রাজা দুই স্ত্রীকেই অপুত্রক রেখে দেহ রাখলেন। তখন সিদ্ধেশ্বরী দেশের থেকে নিজের বোন বিন্ধ্যেশ্বরীর ছেলে শিবপ্রসাদকে নিয়ে এসে তাকে দত্তক নিলেন। এই শিবপ্রসাদ চক্রবর্তীই হলেন শিবরামের বাবা। শিবপ্রসাদ রাজসম্পত্তির উত্তরাধিকারী তো হলেন কিন্তু তার এসবে কোনও কালে মন নেই। সংসারে থেকেও সন্ন্যাসী। জাগতিক সব কিছুতেই নির্লিপ্তি। আর মা? যাঁর প্রতি শিবরামের ছিল আজীবনের গভীর ভালবাসা, তিনিও সারাক্ষণ আধ্যাত্মিক জগতেই থাকতেন। শিবরাম ছোটবেলা থেকেই দেখতেন বাড়িতে তার বাবা এবং মা, এই দু’জনের কেউই যেন লৌকিক জগতে থেকেও নেই। ফলে শিবরামেরও তাই হল। সংসারের প্রতি মায়া জন্মাল না। একেবারে অল্প বয়স থেকেই বাড়ি ছেড়ে বারবার পালাত কিশোর শিবরাম। কখনও পাহাড়, কখনও সমুদ্র, যখন যেখানে খুশি। পকেটে এক পয়সাও নেই। ট্রেনে চেপে বসে, যা হোক তা হোক করে, যেখানে খুশি যত দিন খুশি কাটিয়ে আবার সে ফিরে আসত বাড়ি। এসে দেখত এই অল্পবয়েসে কাউকে কিছু না জানিয়ে এত দিন বাইরে থাকার পরেও বাবা-মা দুজনেই নির্বিকার। একবার তাঁরা জিজ্ঞাসাও করতেন না, ‘এত দিন কোথায় ছিলিস?’ আর মায়ের তো বিশ্বাস ছিল মা দুর্গা সবসময় শিবরামকে রক্ষা করেন!
এমন পরিবেশে বড় হওয়ার জন্যই হয়তো রাজসম্পত্তি, সংসার কোনও কিছুতেই মায়া জন্মাল না কোনও দিন। তারপর ওই কিশোর বয়েসেই একদিন পাকাপাকি ভাবে বাড়ি ছেড়ে পালাল স্বয়ং দেশবন্ধু চিত্তররঞ্জন দাশের সঙ্গে। শিবরাম ছিলেন খাপছাড়া আর আজন্ম বৈরাগ্যের সাধনাকারী এক মানুষ। অনেকটাই নিজের খেয়াল-খুশিতে চলতেন। ১৯১৯ সালে মালদহের সিদ্ধেশ্বরী ইনস্টিটিউট থেকে মেট্রিকুলেশন পরীক্ষা দেওয়ার কথা থাকলেও তা আর হয়ে ওঠেনি। কারণ ওই সময়ে তার দেখা হয় বিপ্লবী দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের সাথে। চিত্তরঞ্জন দাশ তখন স্ত্রী বাসন্তী দেবীর সাথে চাঁচলে এসেছিলেন স্বদেশী আন্দোলনের সভা করতে। শিবরাম এতটাই আগ্রহী হলেন যে চিত্তরঞ্জন দাশের সাথে ফিরতি ট্রেনে চেপে বসলেন। স্বপ্ন কলকাতা যাবেন, স্বদেশী আন্দোলনে যোগ দেবেন।
সে গল্পে আসছি একটু পরে। তার আগে বলি আরেক ঘটনা।
শিবরাম তখন প্রাথমিক স্কুলে। দেশ জুড়ে চলছে স্বাধীনতা আন্দোলনের জোয়ার। ইস্কুলে মাস্টারমশাই প্রবন্ধ লিখতে দিলেন— বড় হয়ে কী হতে চাও? ছাত্রদের কেউ লিখল ডাক্তার, কেউ উকিল। শিবরাম লিখল, দেশপ্রেমিক হতে চাই। শিক্ষক অবাক!
ইস্কুল শেষে এক বন্ধু আড়ালে টেনে নিয়ে বলল, ‘‘তুই দেশপ্রেমিক হতে চাইলে আমাদের দলে নাম লেখা। আমিও বিপ্লবী, আমার মতো দেশের কাজ করবি।’’
শিবরাম যোগ দিল ওই বিপ্লবীদের দলে। দলে ছোটদের কাজ হল গোপনে চিঠি আর অস্ত্র দেওয়া নেওয়া করা, যাতে পুলিশ সন্দেহ না করে। একদিন শিবরামের ওপর দায়িত্ব পড়ল এক সাহেবকে গুলি করে হত্যা করার। তা’ও আবার এক বিশাল সভার মাঝে। পিস্তল এসে গেল। পকেটে পিস্তল নিয়ে দুরুদুরু বুকে শিবরাম পৌঁছলেন সেই সভায়। সাহেবকে গুলি করার পরেই যে নিজেকেও মরতে হবে তাও অজানা নয়। দেশের জন্য মরতেও প্রস্তুত। মঞ্চে সেই সাহেব যেই উঠেছেন অমনি দর্শকের আসন থেকে উঠে দাঁড়ালেন শিবরাম। গুলি ছোড়ার জন্য সবে পকেট থেকে পিস্তল বার করতে যাবেন অমনই মাইকে ঘোষণা, ‘‘শিবরাম চক্রবর্তী মঞ্চে এসো।’’ কেন? উদ্বোধনী সঙ্গীত গাইতে হবে। সবার চোখ তখন শিবরামের দিকে। আর উপায় নেই Gun এর বদলে গানই ব্যবহার করতে হল মঞ্চে। পকেটের পিস্তল পকেটেই রয়ে গেল!
দেশের কাজ করতেই হবে। নইলে জীবন বৃথা।
চাঁচোলে সভা করতে এলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ। গোটা এলাকা ভেঙে পড়ল দেশবন্ধুর ভাষণ শুনতে। কিশোর শিবরামও পোঁছল সেই সভায়। দেশবন্ধুর ভাষণ শুনে এমন উদ্বুদ্ধ হল যে সিআর দাশ যেই ফেরার ট্রেনে উঠলেন অমনই ওই বগিতেই লাফ দিয়ে উঠে পড়ল শিবরাম।
‘‘আপনার সঙ্গে কলকাতায় যাব।’’
‘‘কী করবে গিয়ে?’’
‘‘দেশসেবা। স্বদেশী করব।’’ শিবরামের সাফ জবাব।
‘‘চলো তাহলে।’’
কলকাতায় এসে উঠল এক মেসে, যেখানে সব অল্পবয়েসি স্বদেশীরা থাকে, ইস্কুলে যায়, চরকা কাটে।
সব ব্যবস্থা করে দিলেন দেশবন্ধু। তবে এও বললেন, ‘‘শুধু দেশসেবা করলে হবে না, সঙ্গে পড়াশোনাও করতে হবে কিন্তু।’’
কলকাতায় আসার পর বিপ্লবী বিপিনবিহারী বাবুর পরামর্শে শিবরাম কলকাতার ন্যাশনাল কাউন্সিল অব এডুকেশন এর অধীনস্থ গৌড়ীয় সর্ববিদ্যায়তনে ভর্তি হন। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু সে সময় সেই বিদ্যায়তনের প্রিন্সিপাল ছিলেন। দেশবন্ধুর সহযোগিতায় শিবরামের ফরবেস ম্যানসনে বিনে পয়সায় থাকা-খাওয়ার এবং নিয়মিত কিছু মাসোহারার ব্যবস্থা করা হয়েছিলো। প্রথম বেশ কিছুদিন ভালো কাটলেও শিবরামের বাউণ্ডুলে স্বভাবের কারণে এই অবস্থা আর বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। কিছুদিনের মধ্যেই পড়াশোনা আর মেসের পাট চুকিয়ে তাঁকে আবারও রাস্তায় নামতে হয়। যদিও পরে দেশবন্ধুর প্রচেষ্টায় এই বিদ্যায়তন থেকেই এন্ট্রান্স পাশ করেন তিনি।
শিবরামকেও স্কুলে ভর্তি করা হল। সেই মেসের কড়া নিয়ম। মেস-ম্যানেজারের হাতে দেশবন্ধু দশটা টাকা দিয়ে বললেন, শিবরামের বই খাতা পেন জামা সব কিনে দিতে। কী করে যেন সেই টাকা শিবরামের হাতে এল!
আর তার পর?
দু’দিনের মধ্যেই পুরো টাকা সিনেমা দেখে আর চপ কাটলেট খেয়ে শেষ।
ম্যানেজার চড়াও হলেন। কৈফিয়ত চাইলেন, ‘‘কোথায় তোমার বইখাতা? টাকাই বা কোথায় গেল?’’
জেরার মুখে সত্যবাদী শিবরামের তখন সরল স্বীকারোক্তি।
ম্যানেজার ধমক দিয়ে বললেন, ‘‘তোমাকে আর মেসে থাকতে হবে না। তুমি এখানে থাকলে বাকি ছেলেরাও গোল্লায় যাবে।’’
ব্যস, আবার শুরু হল ভবঘুরের জীবন।
ইস্কুল পাশ করার পরীক্ষাটা অবশ্য দিতেই হয়েছিল সি আর দাশের নির্দেশে। কিন্তু ম্যাট্রিক পাশ দিয়েই আবার পুরোদমে স্বদেশী আন্দোলনে।
শিবরামের ভোজনরসিকতা নিয়ে খুব মজার কিছু ঘটনা জানা যায়। স্বদেশী আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণের ফলে সবসময়ই ছিলেন পুলিশের নজরদারিতে। একবার এক পুলিশের দায়িত্ব পড়লো তাকে অনুসরণ করার। পুলিশের অভিযোগ, শিবরামকে ধাওয়া করতে গিয়ে তিনি মুটিয়ে গেছেন। তা কেমন করে হলো এসব? শিবরাম নাকি এখান থেকে ওখানে যান, আর হোটেল বা খাবার দোকান দেখলেই থেমে শিঙাড়া, রসগোল্লা, চপ-কাটলেট মুখরোচক যা পান খেতে বসে যান। এখন শিবরামকে ধাওয়া করতে গিয়ে তাঁর পিছু পিছু হোটেলে গিয়ে তো খালি মুখে বসে থাকা যায় না। কিছু না কিছু অর্ডার করতে হয়। সেই করে খেতে খেতে পুলিশ অফিসার গেলেন মুটিয়ে। পুলিশ অফিসারের আফসোস, শিবরামের মতো লোকের পেছনে লাগার শিক্ষা তাঁকে পেতে হয়েছে গা ভর্তি মেদের পাহাড় জমিয়ে।
তখন হাজারে হাজারে ছেলে জেলে যাচ্ছে ‘বন্দেমাতরম’ বলে। শিবরামেরও খুব শখ জেলে যাওয়ার। কিন্তু অমন ল্যাকপেকে চেহারা দেখে পুলিশ কিছুতেই আর ধরে না।
একদিন ধরল। বলা যায় নিজেই একপ্রকার ধরা দিলেন। সেই জেলে গিয়েও অবাক শিবরাম। গ্রামে তার কিশোরী প্রেমিকা রিনি, যে কলকাতায় চলে এসেছিল সেও রয়েছে ওই জেলেই। জেলের মধ্যেই আবার প্রেমিকার সঙ্গে পুনর্মিলন। কিন্তু বেশি দিনের সুখ তো শিবরামের কপালে নেই। কয়েক দিন পরেই অন্য জেলে বদলি হয়ে গেল শিবরাম। আবার বিচ্ছেদ।
প্রথমে তাকে প্রেসিডেন্সি জেলে কারাবন্দী করা হলেও পরবর্তীতে বদলির আদেশ এলো। এবারের গন্তব্য বহরমপুর জেলখানা। বহরমপুরের জেলখানা একরকমের পাগলা গারদ বলেই শুনেছিলেন শিবরাম। বদলির আদেশ শুনে খানিকটা ভয় পেলেও যখন শুনলেন সেখানে কাজী নজরুল ইসলামের দেখা মিলবে, তখন তার সমস্ত ভয় উবে গেলো।
বহরমপুর গিয়ে শিবরামের মন আনন্দে ভরে গেলো। কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর স্বভাবসুলভ চাপল্যে সবাইকে মাতিয়ে রাখেন। আর গান-বাজনা, আবৃত্তি তো আছেই। কিন্তু শিবরামের জন্য আরো একটি বিশেষ আকর্ষণীয় দিক ছিলো। আর তা হলো নজরুলের হাতের রান্না। ছেলেবেলায় নজরুলকে অর্থাভাবে হোটেলে কাজ করতে হয়েছিলো, সেখান থেকেই রান্না শেখা।
তাঁর হাতের অপূর্ব স্বাদের রান্না খেয়ে বহরমপুরের দিনগুলো ভালোই কেটেছিলো শিবরামের। শিবরামের ভাষায়,
“মনে পড়লে এখনও জিভে জল সরে। নিজেকে সজিভ বোধ করি! আর জেলখানার সেই খানা। আহা! আমি তো বহরমপুর জেলে যাওয়ার আগে পর্যন্ত টিঙটিঙে রোগা ছিলাম। তারপর দুইবেলা কাজীর খানা খেয়ে এমন মোগলাই চেহারা নিয়ে বের হলাম যে আর রোগা হলাম না। জেলখানায় আর জেলের খানায় গড়া এই চেহারা এতটুকু টসকায়নি।”
তখন মুক্তারামের মেসে পাকাপাকি চলে এসেছেন।
একদিন রাতে কুখ্যাত টেগার্ট সাহেব স্বয়ং এসে হাজির শিবরামের মেসে। চারদিক পুলিশে পুলিশে ছয়লাপ।পাকা খবর, শিবরামের মেসে প্রায়ই নাকি বিপ্লবীরা এসে রাতে থাকে। টেগার্ট এসে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘‘তোমার মেসে আর কেউ আসে?’’
‘‘আজ্ঞে হ্যাঁ, যার যখন খুশি চলে আসে। চলে যায়, আবার আসে।’’
‘‘এর মধ্যে কে এসেছিল?’’
‘‘আজ্ঞে, তারক এসেছিল।’’
‘‘কেমন দেখতে?’’
শিবরামের বর্ণনা শুনে টেগার্ট বলে উঠলেন, ‘‘ইয়া দ্যাটস দ্য ম্যান। হি ইজ্ সিয়োরলি আ টেররিস্ট।’’
‘‘টেররিস্ট কি না জানি না স্যার তবে হি ইজ এ নভেলিস্ট।’’
‘‘নাউ হি ইজ আ রাইটার? নট এ টেররিস্ট ইউ মিন?’’
শিবরামের জবাব, ‘‘বাট টু লিসন টু হিজ রাইটিংস নট লেস এ টেরর স্যার। আই ডোন্ট লাইক, কিন্তু কী করব? জোর করে সে শোনাবেই।’’
এবার টেগার্ট কী বলবেন বুঝে পেলেন না। শিবরামের ঘর সার্চ হল। কিছুই পাওয়া গেল না। কিন্তু তার পর দিন থেকে শিবরাম পেলেন অনেক কিছু। এলাকায় বিশাল নাম হয়ে গেল তাঁর। কেউ ভাবল পুলিশের চর, তো কেউ ভাবল বড় বিপ্লবী।
যারা পাত্তাই দিত না তারাই দুইবেলা খাতির করত। সব থেকে বড় পাওনা সাধনবাবুর সন্দেশের দোকানে ধারে রাবড়ি পাওয়ার ব্যবস্থা। টাকা নিয়ে টানাটানি আর যায় না। হবে নাই বা কেন? লিখে কিছু টাকা এলেই তো সঙ্গে সঙ্গে চপ কাটলেট, রসগোল্লা, বাবড়ি আর সিনেমা। তাও আবার একা নয়। সঙ্গে কেউ থাকলে তাকেও পাকড়াও করে নিয়ে যেতেন দোকানে।
পেটপুরে খাওয়া, যতক্ষণ না শেষ পয়সাটাও নিঃশেষ হচ্ছে। আর কোনও নেশা নেই। ‘নেশা করলে রাবড়ির নেশা করাই ভাল’— এই হল শিবরামের সিদ্ধান্ত।
একবার তো বন্ধু কার্টুনিস্ট চণ্ডী লাহিড়ীর সঙ্গে গিয়ে ঘুগনিওলাকে বললেন ‘‘তিন প্লেট ঘুগনি দাও।’’ ঘুগনিওয়ালা জিজ্ঞাসা করল, ‘‘আপনারা তো দুইজন, আরেকটা কাকে দেব?’’
‘‘আরেকটা তুমি খাবে। কোনও দিন নিজের ঘুগনি খেয়ে দেখেছ? আজ খাও। আমি খাওয়াব।’’
ঘুগনিওয়ালা এমন খদ্দের পেয়ে হাঁ। শিবরামের সামনেই নিজের বানানো ঘুঘনি খেয়ে তারপর তার নিস্তার।
ভোজন আর নিদ্রা ছাড়া শিবরাম আর যে কাজটি ভালোবাসতেন তা হলো সিনেমা দেখা। পকেটে শেষ টাকাটি থাকা অব্দি নাইট শোতে একটি সিনেমা তাঁর দেখতেই হতো।
সে বার বেজায় টানাটানি চলছে। খবর কানে গেল দেশবন্ধুর। শিবরাম চিরকালই তাঁর বড় প্রিয়, বারবার বলতেন, শিবরাম আলাদা জাতের। অনেক প্রতিভা।দেশবন্ধু চিঠি লিখলেন সুভাষ বোসকে।— ‘শিবরামকে আত্মশক্তি কাগজে নিয়ে নাও। ভালো লেখে ও।’
গুরুদেবের আদেশে শিবরামকে চাকরিতে নিলেন নেতাজি। কিন্তু মানুষটি যে শিবরাম! নিয়মকানুনের ধারে কাছে নেই। কোনও দিন অফিস যান তো কোনও দিন টিকিটি নেই। কখন আসেন আর কখন বেরিয়ে যান তা’ও কেউ জানে না।
সুভাষ বোসের কানে গেল সেকথা। এমন আচরণ নিয়মনিষ্ঠ নেতাজির কোনও মতেই পছন্দ নয়। শিবরামকে ওয়ার্নিং তিনি দিলেন ঠিক সময়ে রোজ দপ্তরে আসার জন্য। কিন্তু শিবরাম কোনও দিনই বা কার কথা শুনে চলেছেন? ফলে যা হওয়ার তাই হল। একদিন হাতে একটি খাম পেলেন। তার মধ্যে একশো টাকার একটি নোট আর সুভাষচন্দ্রের একটি একলাইনের চিরকুট। তাতে লেখা।— ‘আপনাকে আর দরকার নেই।’ চাকরি নেই। এ বার দিন চলবে কী করে? ভয়ে তো কুঁকড়ে যাওয়ার কথা! কিন্তু তিনি যে শিবরাম।
হাতে বরখাস্ত হওয়ার চিঠি পেয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন!
কাগজের চাকরি যেমন গেছে তেমনই একবার আস্ত একটা খবরের কাগজেরই মালিক হয়ে গিয়েছিলেন শিবরাম। কিন্তু তার জন্যই আবার জেলে যেতে হল তাঁকে।
যুগান্তর সেবার দেউলিয়া। বন্ধই হয়ে যাবে এমন অবস্থা।
মাত্র ৫০০ টাকা দিয়ে শিবরাম কিনে ফেললেন যুগান্তর-এর স্বত্ত্ব। সম্পাদক হলেন। তখন অনেক কাগজেরই ইংরেজ সরকারের কোপে পড়ে ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। যুগান্তর-এ ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে লেখা ছেপে শিবরামও পড়লেন রাজরোষে।
একদিন দফতরের কাজ সেরে মেসের দিকে ফিরছেন, রাস্তাতেই খবর পেলেন পুলিশ এসেছে। তাঁকে খুঁজছে। শিবরাম বুঝে গেলেন। আগেই ঢুকে পড়লেন সামনে একটা মিষ্টির দোকানে, যদি জেল হয় তাহলে কত দিন মিষ্টি খাওয়া হবে না, কে জানে! আর আজ নিশ্চয়ই অনেকক্ষণ না খেয়ে থাকতে হবে পুলিশি জেরায়। সুতরাং কুড়িটা বড় সাইজের রসগোল্লার অর্ডার। ধরা যখন পড়তেই হবে, তখন রসগোল্লা খেয়ে ধরা পড়াই ভাল। টপাটপ কুড়িটা রসগোল্লা আত্মসাৎ করার পর পকেটে হাত দিয়ে বুঝলেন একটা টাকাও নেই। এবার?
দোকানের মালিক সঙ্গে লোক দিয়ে দিলেন, যে শিবরামের সঙ্গে ওর মেস পর্যন্ত গিয়ে টাকা নিয়ে আসবে।
বাড়িতে ঢোকার মুখেই গ্রেপ্তার হলেন শিবরাম। পুলিশকে বোঝালেন একজনকে টাকা মেটাতে হবে, একবার ঘরে ঢোকা দরকার। বলে পিছনে তাকাতেই অবাক! সেই কর্মচারী বিপদ বুঝে কখন পালিয়েছে! পাছে স্বদেশীকে মিষ্টি খাওয়ানোর অভিযোগে তাকেও জেলের ঘানি ঘোরাতে হয়!
জেল হল। ছাড়াও পেলেন। ছাড়া পাওয়ার সময় জেলর বলেছিলেন, ‘‘আপনার নিজের যা জিনিস আছে তা নিয়ে যেতে পারেন।’’
নিজের বলতে তো কিছুই ছিল না। জেল থেকে দেওয়া দুটো কম্বল ছিল, যা নিয়ে যাওয়ার কারও নিয়ম নেই, তবু শিবরাম কী করে যেন ওই দুটোকে বগলদাবা করে বেরিয়ে পড়লেন রাস্তায়।
তারপর মুক্তারামের তক্তারামে রসগোল্লার ওই দুটো কম্বল পেতেই কাটিয়েছেন বাকি জীবন।
জেলমুক্ত শিবরাম কিছু পয়সা জুটিয়ে আগে গেলেন সেই মিষ্টির দোকানে। ধারের টাকা মেটাতে হবে যে! কিন্তু ঢুকতেই দোকানের মালিক হাতজোড় করে উঠে দাঁড়ালেন।— ‘‘দয়া করে বোমা মারবেন না। যা টাকা লাগবে বলুন দিয়ে দিচ্ছি।’’
আসলে তত দিনে স্বদেশী নামে বিখ্যাত হয়ে উঠেছে শিবরাম। জেলে যাওয়া মানেই সন্ত্রাসবাদী।
‘‘না না আমি টাকা নিতে আসিনি।’’
‘‘আজ্ঞে যা আছে দিয়ে দিচ্ছি। স্বদেশের কাজ করেন, আমাদেরও তো সেবা করা উচিত।’’ বলে কাঁপা হাতে ক্যাশবক্সে হাত দেন দোকানদার।
‘‘আরে কী মুশকিল, আমি এসেছি আপনার ধার মেটাতে।’’
শিবরামের কাছে সব শুনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন দোকানদার। টাকা তো নিলেনই না, উপরন্তু একজন মানুষ এক সিটিং-এ বসে কুড়িটা রাজভোগ খেতে পারেন শুনে, আবার কুড়িটা রাজভোগ শিবরামকে খাইয়ে নিজের চোখ আর কানকে বিশ্বাস করালেন। এবং আরও কুড়িটা হাঁড়িতে ভরে দিলেন। বললেন, ‘‘বাড়িতে খাবেন আর দোকানে যখন খুশি এসে খেয়ে যাবেন। পয়সা লাগবে না।’’
না, দ্বিতীয় দিন থেকে আর ওই দোকানের ধারেকাছে যাননি শিবরাম। ধারের ধার বেশি না ধরাই ভাল, এই ছিল শিবরামীয় যুক্তি।
ছোটদের জন্য লিখতেন, নিজের মনটাও ছিল একেবারে শিশুর মতো। নিজের খেয়াল খুশির রাজা। খুদে পাঠকরাই ছিল তাঁর বন্ধু। বেজায় ভালবাসতেন ছোটদের। জীবনে কোনও দিন কারও নিন্দা করেননি, শুনতেও চাইতেন না।
কেউ যদি কখনও এসে বলতেন, শিবরামদা আপনার নামে অমুকে খারাপ কথা বলে বেড়াচ্ছেন, সঙ্গে সঙ্গে শিবরামের উত্তর, ‘‘হতেই পারে না। আপনিই ভুল শুনেছেন।’’ বলেই তার হাত ধরে নিয়ে যেতেন খাওয়াতে। নিজেকে সাহিত্যিক পরিচয় দিতেও সংকোচ। বলতেন, ‘‘ধুর ধুর আমি আবার সাহিত্যিক হলাম কবে? প্রেমেন, অচিন্ত্য, শরৎচন্দ্র, বিভূতিভুষণ এরা হলেন সাহিত্যিক। কত ভাল ভাল লেখেন! তাদের পাশে আমি!’’
নিজের সম্পর্কে বলতেন, ‘‘সার্কাসের ক্লাউন যেমন। সব খেলাই সে পারে, কিন্তু পারতে গিয়ে কোথায় যে কী হয়ে যায় খেলাটা হাসিল হয় না। হাসির হয়ে ওঠে। আর হাসির হলেই তার খেলা হাসিল হয়।’’
‘ক্লাউন’-এর দর্শনটাই আলাদা!
শিবরামীয় দেখাটাই ছিল অন্য রকম। আকাশের দিকে তো আমরা সবাই তাকাই কিন্তু শিবরামের মতো তাকাতে পারি কি?
খামখেয়ালিপনা, হাস্যরস ছিলো শিবরামের দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে। প্রখর বুদ্ধিমত্তা আর ভাষাজ্ঞানের জোরে সেই হাস্যরস ফুটে উঠতো তার লেখাতেও। তবে শিবরামের লেখায় হাস্যরসের আড়ালে থাকতো ঘুণে ধরা সমাজ ব্যবস্থার আসল রূপ, বিপ্লব আর সাধারণ মানুষদের কথা। শিবরামের লেখা শুধুমাত্র ছোটদের জন্যই নয়, বরং সকল বয়সী পাঠকের কাছে এর সমান আদর।
শিবরামের লেখালেখি শুরু হয়েছিলো অনেকটা বিপদে পড়ে। এক কাবুলিওয়ালার কাছ থেকে চড়া সুদে টাকা ধার নিয়েছিলেন। শর্ত ছিলো সময় মতো সুদের টাকা পরিশোধ করতে না পারলে কাবুলিওয়ালা মেসে এসে হামলা করবে। জাঁদরেল সেই কাবুলিওয়ালার হাত থেকে বাঁচতেই মূলত লেখালেখির শুরু। কেননা এতে করে নিজের পেট চালানো তো যেতোই, উপরন্তু কাবুলিওয়ালার সুদের টাকাও দেওয়া যেতো।
শিবরামের প্রথমদিকের রচনাগুলোতে প্যারডির প্রভাব বেশ লক্ষণীয়। তারপরে ধীরে ধীরে স্বকীয়তা নিয়ে আত্মপ্রকাশ করেন। ভাবতে অবাক লাগে, ‘ঘোড়ার সঙ্গে ঘোরাঘুরি’, ‘হাতির সঙ্গে হাতাহাতি’, ‘চটির সঙ্গে চটাচটি’র মতো কথা কিংবা হর্ষবর্ধন আর গোবর্ধনের মতো চরিত্র যিনি জন্ম দিয়েছেন, তিনিই ‘আজ এবং আগামীকাল’ (১৯২৯), ‘চাকার নীচে’ (১৯৩০), ‘মস্কো বনাম পণ্ডিচেরী’ (১৯৪৩), ‘যখন তারা কথা বলবে’ (১৯৪৯) এর মতো সমাজ ও সময়কে ধারণ করে এমন লেখার জন্ম দিয়েছেন।
এখানে লেখকের ‘মস্কো বনাম পণ্ডিচেরী’ প্রবন্ধের একটি লাইন তুলে ধরলাম, “ব্রাহ্মণের আদর্শের ক্ষেত্র এতই সংকীর্ণ যে সেখানে কেবল তাদেরই ধরে, ধরিত্রীর সমস্ত মানুষদের সেখানে ঢোকার পথ আর নেই।” এই লাইনটি থেকে শিবরামের চিন্তা সম্পর্কে আঁচ পাওয়া যায়। শিবরামের সৃষ্টিকর্মগুলোর মাঝে ‘ইশ্বর, পৃথিবী, ভালোবাসা’ (১৯৭৪) এক অনন্য স্থান দখল করে আছে। এটি প্রথমে ‘দেশ’ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে ছাপা হলে তুমুল জনপ্রিয়তা লাভ করে এবং পরবর্তী তা বই আকারে প্রকাশিত হয়।
নিজের সৃষ্টি দিয়ে মানুষের মন জয় করলেও শিবরামের অহংকার ছিলো না এতটুকুও। প্রচুর লেখা থাকা স্বত্ত্বেও অভাব কখনোই তার পিছু ছাড়েনি। তার সরলতার সুযোগ নিয়ে লোকে তাকে বহুবার ঠকিয়েছে। নিজের প্রচার কখনোই পছন্দ করতেন না। সাহিত্যে অবদানের জন্য বেশ কিছু সম্মানজনক পুরস্কারে ভূষিত হলেও সেগুলোর প্রতি তার বিশেষ কোনো আগ্রহ ছিলো না। বরং ভালোবাসতেন লোকচক্ষুর আড়ালে থাকতে।
শেষের দিনগুলোতে শরীরটা কিন্তু সত্যিই ঠিক যাচ্ছিল না। স্মৃতি কমে আসছিল। কথাবার্তা অসংলগ্ন। শেষ জীবনে প্রায় কপর্দকহীন। প্রায়ই বলতেন, ‘‘জিনিসপত্র সব বাঁধা হয়ে গেছে এবার একটা ট্যাক্সি পেলেই চলে যাব।’’
চিরকাল লোককে বিশ্বাস করেছেন আর বারবার ঠকেছেন। অনেক প্রকাশক ঠকিয়েছে। এমনকী শেষদিকে সেই সময়ের রাজ্য সরকার এবং কয়েকটি সংস্থা মিলে তাঁর চিকিৎসা ও ভরণপোষণের জন্য যে মাসিক ছ’শো টাকা তারই এক পাড়াতুতো পরিচিতের কাছে পাঠাত, সেই টাকারও সঠিক ব্যবহার হত না। শুকনো-রিক্ত চেহারা। অথচ কেমন আছেন জিজ্ঞাসা করলেই উত্তর ‘‘খাসা আছি। ফাইন আছি।’’
কোনও দিন কোনও অভিযোগ নেই কারও কাছে। তারমধ্যে আবার একদিন ঘরে চোর ঢুকে শেষ পাঞ্জাবিটাও নিয়ে গেছিল, গেঞ্জি পরেই থাকতেন। মুখে বলতেন, ‘‘দরকার কী? এই তো দিব্বি চলে যাচ্ছে গেঞ্জিতে।’’
হঠাৎ কয়েক দিনের প্রবল জ্বর। দুর্বল শরীরে টলতে টলতে বাথরুমে ঢুকেই সংজ্ঞা হারালেন। সারারাত পড়ে রইলেন ওখানেই। পরদিন বেলায় খবর জানাজানি হতে ভর্তি করা হল হাসপাতালে। ১৯৮০ সালের ২৮ অগস্ট সকাল। হাসপাতালের বেডে আচ্ছন্ন বাড়ি থেকে পালিয়ে’র নায়ক।
ডাক্তারবাবু জিজ্ঞাসা করলেন, ‘‘শিবরামবাবু, এখন কেমন লাগছে শরীর?’’
‘‘ফার্স্টক্লাস।’’
জড়ানো গলায় তখনও একই উত্তর।
তার ঠিক পাঁচ মিনিট পরেই সেই অপেক্ষার অচেনা ট্যাক্সিতে চেপে বসলেন শিবরাম।
রেডিয়োতে সন্ধেবেলায় যখন সেই খবর ঘোষণা হচ্ছে, তখন হয়তো হর্ষবর্ধন আর গোবর্ধনের সঙ্গে চাঁদে জমি কেনা নিয়ে তুমুল ব্যস্ত তাঁদের স্রষ্টা!
(তথ্যসূত্র:
১- ঈশ্বর পৃথিবী ভালবাসা, ভালবাসা পৃথিবী ঈশ্বর, শিরোনাম শিবরাম: কোরক।
২- যষ্টি-মধু: শিবরাম চক্রবর্তী সংখ্যা।
৩- গল্পমেলা: শিবরাম চক্রবর্তী সংখ্যা।
৪- শিবরাম চক্রবর্তী শ্রেষ্ঠ গল্প, সম্পাদনা-আবদুশ শাকুর, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র।
৫- ইশ্বর পৃথিবী ভালোবাসা, শিবরাম চক্রবর্তী, নবপত্র।
৬- ৯ই আগস্ট ২০১৪ সালে আনন্দবাজার পত্রিকায় শ্রী শিবরাম চক্রবর্তী’র স্মৃতিচারণে সাহিত্যিক ও কবি শ্রী সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লিখিত প্রবন্ধ।
৭- আনন্দবাজার পত্রিকা, ৯ই জুলাই ২০১৬ সাল।
৮- আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৬শে মে ২০১৮ সাল।
৯- https://roar.media/bangla/main/literature/hasirrajashibram/)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত