কবি শঙ্খ ঘোষ একদা লিখেছিলেন, “সে ছিল একদিন আমাদের যৌবনে কলকাতা!/ বেঁচে ছিলাম ব’লেই সবার কিনেছিলাম মাথা।” এই ‘যৌবনে কলকাতা’টা হয়তো আজ আর নেই। তবে এখনও তরুণ কবিদের কলমে উঠে আসে কলকাতার সেই চিরযৌবনা রূপই। গানের কথায় লেখা হয়- “ঘুম ভাঙে এসপ্ল্যানেড, খোলা ভাঙে চীনেবাদাম/ চেনা কোনো ঘাসের দাগ, শুয়ে থাকা কি আরাম।” আজ ২৪ আগস্ট। কল্লোলিনী কলকাতার ৩২৯ তম জন্মদিন। জব চার্নকের আগমনের সময় থেকে এতগুলি বছর পেরিয়ে জীবন্ত ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে রয়েছে যে কলকাতা। বিশ্বের দরবারে যে সমাদৃত ‘সিটি অফ জয়’ নামে।
১৬৯০ সালের ২৪ আগস্ট এরকমই এক মেঘলা দিনে কলকাতার মাটিতে পা রেখেছিলেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পদস্থ আমলা জব চার্নক। সেই থেকে দিনটি পালিত হয়ে আসছে কলকাতার জন্মদিন হিসাবে। যদিও কেউ কেউ এর বিরোধিতা করে বলেন, চার্নক সাহেব আসার আগেও কলকাতায় মনুষ্যবসতি ছিল। ফলে তিনি কলকাতা শহরের জনক, এটা ঠিক নয়। কিন্তু তাহলেও এ কথা একেবারেই অস্বীকার করা যায় না যে, আধুনিক কলকাতা বলতে যা বোঝায়, তার পত্তন করেছিলেন জব চার্নকই। তাই তার আগমনের লগ্নটিকে ‘নব’ কলকাতার জন্মদিন করে নিয়ে যদি একটা দিন শহরবাসী তাদের ভালবাসার শহরকে নিয়ে মেতে ওঠে, তাহলে ক্ষতি কী।
প্রসঙ্গত, ডিহি কলকাতা, সুতানুটি ও গোবিন্দপুর, মূলত এই তিনটি গ্রাম নিয়েই কলকাতার পত্তন হয় ১৬৯০ সালে। আর পত্তনের পর থেকেই ক্রমশ বাড়তে থাকে এর গৌরব। ১৭৫৭ সালে পলাশীর প্রান্তরে এদেশের স্বাধীনতার সূর্য ডুব দিয়েছিল ঠিকই, কিন্তু তার ছড়ানো আভায় লেগেছিল আগামী দিনের নতুন ইতিহাসের ছটা। সিরাজদৌল্লাকে পরাজিত করে, রবার্ট ক্লাইভ সদর্পে এসে জাঁকিয়ে বসলেন কলকাতায়। সিরাজের যে বিপুল সম্পদ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হস্তগত হয়েছিল, তা দিয়েই কলকাতার উন্নয়নের কাজ শুরু হয়। তারপর ১৭৭২ সালে তৎকালীন বড়লাট লর্ড ওয়ারেন হেস্টিংস সুবে বাংলার রাজধানী মুর্শিদাবাদ থেকে সরিয়ে আনেন কলকাতায়।
হেস্টিংসের এই সিদ্ধান্তে রাতারাতি কলকাতার রাজনীতিক, প্রশাসনিক এবং সাংস্কৃতিক গুরুত্বও বেড়ে যায়। পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাবে বাংলা তথা ভারতে যে নবজাগরণ শুরু হয়েছিল, তার কেন্দ্রবিন্দু ছিল কলকাতাই। ব্রিটিশ শাসনে কলকাতা কিছু গৌরবজনক ঘটনার সাক্ষী হয়। যেমন ১৮৩৫ সালে এশিয়ার প্রথম মেডিকেল কলেজ স্থাপিত হয় কলকাতাতেই। কলকাতা মেডিকেল কলেজে তখন এশিয়ার অন্যান্য দেশ থেকেও ছাত্ররা পড়তে আসতেন। আবার ১৮৫৭ সালে তৈরি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল গোটা পূর্ব ভারতে প্রথম এ হেন কুলীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। ১৯১১ সাল পর্যন্ত অবিভক্ত ভারতবর্ষের রাজধানী ছিল এই কলকাতাই।
জন্মলগ্ন থেকে এতগুলো বছর পেরিয়েও কলকাতা আজও চির সবুজ। এই শহরের বড় বড় ইমারতের ইট, কাঠ, বালি, সিমেন্টের পরতে পরতে লুকিয়ে একেকটি বটবৃক্ষ সমান ইতিহাস। সিন্দুকে লুকানো স্মৃতি। নস্টালজিয়া চিরসঙ্গী তিনশো বছরের ‘যুবক’ এই শহরের। কলকাতা ভালবাসতে জানে। তার জন্যেই এই শহরে রোজ ভিড় করেন অসংখ্য মানুষ। বনেদিয়ানার সঙ্গে আধুনিকতার ছন্দময় মেলবন্ধন ঘটেছে এই শহরে। জাত পাত ধর্ম সব ভুলে সবাইকে বুকে আগলে রেখেছে এই শহর। প্রজন্মের পর প্রজন্ম নতুন নতুন বয়স আসে, দেখার চোখ ভিড় করে, কিন্তু শহরটা কলকাতা আজও আছে কলকাতাতেই। জন্মদিনে ভালোবাসার শহরকে শুভেচ্ছা। ভবিষ্যতেও জয় হউক ‘সিটি অফ জয়’-এর।