পুলওয়ামা হামলার জের তো ছিলই। তার ওপর গত ৫ আগস্ট সংসদে ৩৭০ ধারা বাতিল করে জম্মু ও কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা খারিজের ঘোষণা করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। সংখ্যাগরিষ্ঠতার বলে বিল পাশ করিয়ে কাশ্মীর থেকে লাদাখকে বিচ্ছিন্ন করে দু’টি পৃথক কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল গঠন করার ঘোষণা করেন তিনি। আর তারপর থেকেই ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের টানাপোড়েন চরমে। তবে এই পরিস্থিতিতে আমেরিকা যখন মাঝেমধ্যেই মধ্যস্থতার প্রসঙ্গ তুলে সাউথ ব্লকের রক্তচাপ বাড়াচ্ছে, তখন দু’দিক বজায় রাখার, অর্থাৎ ভারসাম্যের নীতি নিয়েছে ব্রিটেন। কাশ্মীর নিয়ে জনসন সরকারকে কার্যত দড়ির উপর দিয়ে হাঁটছে হচ্ছে।
কূটনীতিক বিশ্লেষকদের একাংশের মতে, প্রথমত, ব্রিটেনে ভারত এবং পাকিস্তানের বহু মানুষ বসবাস করেন। ভারতের সঙ্গে যেমন তাদের বাণিজ্যিক সম্পর্ক ভাল, তেমনি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের ব্রিটেন যোগ- এই উভয় দিক বজায় রেখেই চলতে হচ্ছে বরিস জনসন সরকারকে। ইতিমধ্যেই দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ফোনে কথা বলেছেন ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের সঙ্গে। ভারতকে আশ্বস্ত করে জনসন জানিয়েছেন, ব্রিটেনে অবস্থিত ভারতীয় হাইকমিশনের নিরাপত্তার জন্য সব রকম ব্যবস্থা করা হয়েছে।
জানা গেছে, মোদী ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়েছেন, ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ রদের সিদ্ধান্তের পর পাকিস্তানের তরফে মৌলবাদ, সন্ত্রাসবাদ এবং জঙ্গী-উস্কানির ঘটনা বেড়ে গিয়েছে। এই সব বন্ধ করতে জরুরি কার্যকরী পদক্ষেপ। ওই ফোনালাপের পরই ডাউনিং স্ট্রিট এক বিবৃতিতে বলেছে, ‘কাশ্মীরের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী (বরিস জনসন) এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর কথা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী ব্রিটেনের অবস্থান স্পষ্ট করে মোদীকে জানিয়েছেন, কাশ্মীর সমস্যা ভারত-পাকিস্তানের দ্বিপাক্ষিক বিষয়। দু’দেশকে আলোচনার মাধ্যমে এই সমস্যার সমাধান করতে হবে।’
প্রসঙ্গত, গত কয়েক বছর ধরে দিল্লির সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক বাড়াতে উন্মুখ লন্ডন। সেখানের কনজারভেটিভ পার্টির সমর্থন বরাবরই পেয়েছে ভারত। ডেভিড ক্যামেরন, টেরেসা মে-র পরে জনসনও ভারতের সঙ্গে সখ্যের পথেই এগিয়েছেন। তাঁর প্রাক্তন স্ত্রী ছিলেন ভারতীয় বংশোদ্ভূত। ব্রেক্সিট-পরবর্তী অধ্যায়ে ভারতের সঙ্গে ব্যবসা বাড়ানো ব্রিটেনের অগ্রাধিকার। তবে ইমরান প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরে ইসলামাবাদের সঙ্গেও লন্ডনের সম্পর্ক পোক্ত হয়েছে। ইমরানের সঙ্গে ব্রিটেনের সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। তিনি নিজে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তনী। তাছাড়া ব্রিটিশ ধনকুবের তথা রাজনীতিক জেমস গোল্ডস্মিথের কন্যা জেমাইমাকে একদা বিয়ে করেছিলেন ইমরান।
উল্লেখ্য, এই গোল্ডস্মিথই ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে ব্রিটেনের বেরিয়ে যাওয়ার অন্যতম প্রচারক ছিলেন। জেমাইমার ভাই জ্যাক গোল্ডস্মিথ, কনজারভেটিভ পার্টির এমপি-ও বটে। জ্যাক আবার ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর ভাইয়ের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। ফলে ইমরানের সঙ্গে ব্রিটেনের পারিবারিক, ব্যক্তিগত এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের সংযোগ রয়েছে। আর সেই কারণেই জনসন এমন কিছু করতে পারবেন না, যাতে ব্রিটেনে বসবাসকারী পাকিস্তানিদের ভাবাবেগে আঘাত লাগে।
সূত্র জানাচ্ছে, কাশ্মীর নিয়ে ফ্রান্স যখন এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, এটা ভারত এবং পাকিস্তানের দ্বিপাক্ষিক সমস্যা। আলোচনায় সমাধান সম্ভব। বাংলাদেশ বলেছে, ৩৭০ অনুচ্ছেদ বিলোপের সিদ্ধান্ত ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়। তখন কাশ্মীর থেকে বিশেষ মর্যাদা প্রত্যাহারের পর রাষ্ট্রপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদের রুদ্ধদ্বার বৈঠকে ব্রিটেন আর যা-ই করে থাকুক, ফ্রান্স বা আমেরিকার মতো পুরোপুরি ভারতের পাশে দাঁড়ায়নি। বরং পরিষদের কাছে অনুরোধ করেছিল বিবৃতি দিতে। জম্মু-কাশ্মীরে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়টিও ব্রিটেনের স্থায়ী প্রতিনিধি উল্লেখ করেছেন বলে খবর।