শহরে থাকলে রোজ সকালে মর্নিং ওয়াক করার সময় দেখি রাস্তার কল থেকে জল পড়ে যাচ্ছে, ব্যবহার করার পর কলটা কেউ বন্ধ করে যাননি। বহু জায়গায় বন্ধ করার কোন ব্যাপারই নেই। স্টপককটা চুরি হয়ে গেছে, দাঁড়িয়ে আছে শুধু একটা পাইপ, জল আসার সময় সেটা দিয়ে জল পড়ে, চলে গেলে বন্ধ হয়। কাগজে দেখলাম শহরে এমন স্টপককহীন কলের সংখ্যা প্রায় ১৭ হাজার। কাজকর্মে গ্রামে থাকার সময় গভীর রাতে শুনি টানা গুড়গুড় আওয়াজ, সাবমার্সিবল পাম্প দিয়ে ভূগর্ভ থেকে চাষের জন্য তুলে নেওয়া হচ্ছে জল। গ্রামের লোক বলে �সাবমার্শাল� পাম্প। মার্শালই বটে, বছরের পর বছর তার আক্রমণে রাজ্যের নানা জায়গায় ভূজলের স্তর নেমেই চলেছে।
দেখেশুনে �জলই জীবন� কথাটা কেমন হাস্যকর শোনায়। যার এত অপচয়, তার জন্যই মারামারি করে মরছে মানুষ। দুদিন আগে শুনলাম, গ্রামের একটা জলের লাইনের ঝগড়ায় একজন মানুষ মারা গেছেন। বেশ কিছুদিন ধরেই শুনছি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ হবে নাকি জলের জন্য। জলের জন্য হাহাকার, পরিবেশ বিজ্ঞানীদের সতর্কবাণী দেখেশুনে মনে হচ্ছে সে ঘটনা ঘটতে আর বেশি দেরি নেই। কেন্দ্রের নীতিআয়োগ তো বলেই দিয়েছেন ২০৩০ এর মধ্যে দেশে জলকষ্ট এত বাড়বে যে অবস্থা সামাল দেওয়া যাবে না।
তবুও আমাদের হুঁশ নেই! শহরে যত বহুতল বাড়ছে তত কমছে ভূগর্ভের জলস্তর। ফ্ল্যাটের খিদে সিঁদ কাটছে শহরের ভূজলের ভাঁড়ারে। যত উঁচু ফ্ল্যাট, ভূগর্ভ থেকে তার জল তোলার হাত, থুড়ি পাইপ, তত লম্বা। অথচ প্রতি পাড়াতেই এখন পুরসভা পরিশ্রুত জল সরবরাহের ব্যবস্থা করেছে। ফ্ল্যাট বাড়িগুলিতেও সেই জলের লাইন নেওয়ার ব্যবস্থা আছে। ভূজলের তুলনায় ক্লোরিন দেওয়া সেই জল অনেক নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত তবুও একশ্রেণীর বিত্তবান মানুষের পুরসভার সেই টাইম কলের জল ব্যবহারে আপত্তি। তারা কিছুতেই সে জল মুখে তুলবেন না। তাতে তাদের �ক্লাস� যায়। অথচ এসব আলোকপ্রাপ্ত লোকেরাই পরিবেশ দিবসে মিছিল করবেন, বলবেন জলসঙ্কটের কথা, ভূজলের অত্যাধিক ব্যবহারে শহর যে ক্রমশই জলশূন্য হয়ে পড়ছে তারস্বরে জানাবেন সে কথাও। জ্ঞানপাপীদের স্বভাব কবে বদলাবে তাই বসে বসে ভাবি। �
আসলে আমরা সবাই একেকটা কালিদাস। বিপদ যে পায়ে পায়ে আমাদের ঘাড়ের কাছে এসে দাঁড়াচ্ছে তা আমরা বুঝেও বুঝি না। পাম্প দিয়ে অতিরিক্ত জল তোলার ফলে শহরে এই সমস্যার সূত্রপাত প্রায় আশির দশক থেকে। একটু লক্ষ্য করলেই দেখবেন রাস্তার জলের কলের পাইপগুলো ক্রমশই নিচু হচ্ছে। বহু জায়গায় দেখি� ফুটপাথের থেকে নিচে গর্ত করে সেই গর্ত বেশ কায়দা করে বাঁধিয়ে কল বসানো হয়েছে। কারণ জলের চাপ এত কম যে কলের স্বাভাবিক উচ্চতায় জল উঠছে না। শহরের উত্তর ও দক্ষিণপ্রান্তে তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে জলসঙ্কট।
জল কমছে তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কমছে শহর, গ্রাম, মফস্বলের পুকুর, খাল,বিল আর জলাজমি। একশ্রেণীর লোভী বিধায়ক, পুরপিতা, রাজনৈতিক নেতা ও প্রমোটারদের কল্যাণে দুরন্ত গতিতে চলছে জলাজমি আর পুকুর বোজানোর কাজ, সে জায়গায় উঠছে বাড়ি। তারাই আবার পাড়ায় পাড়ায় ঘটা করে আয়োজন করেন পরিবেশ দিবস। নেতা, মন্ত্রীরা আসেন, ফিতে কাটেন, গলায় কুকুরের চেনের মত সোনার চেন পরে তা উদ্বোধন করেন কিছু জমিহাঙর। এদের দাপটে ইতিমধ্যেই উধাও হয়ে গেছে সোনাই আর সরস্বতী নদী, পূর্ব কলকাতার জলাভূমির একটা বড় অংশ, ডানকুনি, কল্যাণী, মুর্শিদাবাদ, মালদার জলাভূমি। অথচ এসব বাঁচানোর জন্য অনেক ঢাকঢোল পিটিয়ে আইন করেছিলাম আমরা। কিন্তু সেই আইনের ফাঁক বার করে রাজ্যকে জলাভূমি শূন্য করার অভিযান সগৌরবে চলিতেছে।
জলদূষণ, মাত্রাতিরিক্ত ভূজল তোলা, পুকুর, খাল, বিল, নদী ভরাট করে নির্মাণ করার অপরাধে আজ পর্যন্ত একজন লোকেরও শাস্তি হয়েছে কিনা আমার জানা নেই। বরং এই অন্যায়ের অপরাধে সরব পরিবেশপ্রেমী মানুষদের ওপর বারবার আক্রমণ নেমে আসছে। অথচ ভূজল কমলে বা দূষিত হলে বিপদে পড়বো আমরা সবাই। তাই এই মুহূর্তে যে কোনভাবেই এটা আটকাতে হবে, নইলে আমরা নিজেরাই নিজেদের ক্ষমা করতে পারবো না।
দেশের গ্রামগুলির অর্ধেক পরিবার এই ২০১৯ সালেও স্বাস্থ্যসম্মত পানীয় জল পায় না। তাদের নুন্যতম জলের চাহিদা এখনও মেটাতে পারেনি দেশ। অথচ জাতীয় গ্রামীণ পানীয় জল কর্মসূচীতে গত পাঁচ বছরে খরচ হয়ে গেছে কোটি কোটি টাকা। এই অবস্থায় জলের অপচয়, অপব্যবহার এবং পরিকল্পিতভাবে জলের উৎসগুলিকে ধ্বংস করে চলার ঘটনা খুব গায়ে লাগে। জলাভূমি ভরাট করে হাতে গোনা কয়েকজন লোকের পকেট ভারি করা দেখলে আগুন জ্বলে ওঠে মাথায়। এটা আটকানোর জন্য আমরা কি কিছুই করতে পারিনা?
নিজের নিজের মত করে জল বাঁচানো ও অপচয় রোধ করার কাজটা তো করাই যায়। নিদেনপক্ষে জল সংরক্ষণ ও পুকুর, খাল, বিল, জলাজমি ভরাট করার বিরুদ্ধে দলমত নির্বিশেষে আমরা এক হয়ে তো লড়াই করতেই পারি। প্রতি বাড়িতে জল তোলার পাম্প না বসিয়ে সরকারি জল সরবরাহ ব্যবহারের জন্য সরব হতে পারি আমরা। সবাই মিলে আওয়াজ তুললে আমাদের দাবি আরও জোরালো হবে। আমি জল পাচ্ছি, আমার কোন সমস্যা নেই এই ভেবে চুপ করে থাকার দিন কিন্তু এখন শেষ। কারণ এটা এমন একটা সমস্যা যা সবাইকে স্পর্শ করতে বাধ্য। আপনার আজকে সমস্যা না থাকলেও কালকে হবেই।
কথায় কথায় আমরা রবীন্দ্রনাথকে টানি। জল নিয়ে এই সামান্য লেখাটাতেও তাঁকে টেনে আনার লোভ সামলানো গেল না। মানুষের স্বাস্থ্যসম্মত পানীয় জল পাওয়ার ব্যাপারটাকে তিনি কতটা গুরুত্ব দিতেন তা বোঝা যায় এসো এসো হে তৃষ্ণার জল গানটিতে। শান্তিনিকেতনে টিউবয়েল বসানোর সময় তিনি গানটি লিখেছিলেন, তখন তাঁর বয়স ৬১ বছর। এত বছর পেরিয়ে এসেও জলকে এতটা গুরুত্ব দিতে আমরা অনেকেই শিখিনি।
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত