আধুনিক প্রজন্মের সব থেকে প্রিয় জিনিস হল মোবাইল ফোন। সকালে ঘুম থেকে উঠে রাতে ঘুমোতে যাওয়া পর্যন্ত যে জিনিসটা আমাদের সর্বক্ষণের সঙ্গী তা হল ওই মুঠোফোনটা। মুঠোফোনের দৌলতে গোটা দুনিয়া আমাদের হাতের মুঠোর মধ্যে এসে গেলেও তা আমাদের বানিয়ে দিয়েছে ভীষণ আত্মকেন্দ্রিক। আমরা এখন কথা মুখোমুখি কথা বলতেই ভুলে গেছি। ফোন আমাদের জীবনে অনেক সমস্যারও সৃষ্টি করে। সেই তালিকায় নয়া সংজোজন ‘ফ্যান্টম ভাইব্রেশন সিন্ড্রোম’।
মনে করুন অফিস যাওয়ার জন্য বেরিয়েছেন আপনি। আচমকাই ভাইব্রেট করে উঠল পকেটের মোবাইলটি। চট করে চেক করলেন, দেখলেন কিছুই আসেনি। বা ধরুন, সিনেমা হলে বসে আছেন। আচমকা পকেটে কেঁপে উঠল মোবাইল। চেক করতে গিয়ে দেখলেন, মোবাইলটি তো পকেটে রাখেনইনি। একটু খেয়াল করলে দেখবেন, এমনটা আপনার সঙ্গেও হয়তো ঘটেছে কয়েক বার। গবেষণা বলছে, এতে ভয় বা ভুল কোনওটাই নেই। এমনকী এটা শুধু আপনার একার সঙ্গেই ঘটে, তা-ও নয়। বরং গবেষকদের মতে, মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীদের মধ্যে শতকরা ৯০ জনই কোনও না কোনও কারণে এবং কোনও না কোনও সময়ে এমন বিভ্রান্তির শিকার হন। ফোনে কল কিংবা মেসেজ না আসার সত্ত্বেও আপনার মনে হয়েছে কখনও যে ফোনটি ভাইব্রেট হচ্ছে, বিজ্ঞানের ভাষায় একেই বলা হয় ‘ফ্যান্টম ভাইব্রেশন সিন্ড্রোম’। গবেষকেরা বলছেন, এক রকমের প্রযুক্তিগত মানসিক বিভ্রান্তি।
তাঁদের ব্যাখ্যা, আজকাল আমাদের মধ্যে মোবাইল ফোনের ব্যবহার এতটাই বেড়ে গিয়েছে, যে দিনের অনেকটা সময়ই এই যন্ত্রটার উপরে নির্ভরশীল হয়ে পড়েছি, এর সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছি। ঘরে কিংবা বাইরে, প্রতিটা মুহূর্তে আমাদের ফোনটি সঙ্গে থাকা চাই। কাজের ফাঁকে কিংবা যাত্রা পথে সারা ক্ষণই ফোনটা হাতে নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করি আমরা! আমাদের অনেকেরই কিছু সময় অন্তর ফোনের নোটিফিকেশন চেক করা স্বভাব। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সব সময়ে যন্ত্রটি সঙ্গে রাখতে গিয়ে আমাদের এমনই অবস্থা হয়েছে, যে ফোনটি যেন আমাদের শরীরেরই একটি অংশ হয়ে উঠেছে।
আটলান্টার ‘জর্জিয়া ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি’-তে প্রযুক্তির প্রভাব নিয়ে গবেষণারত ডক্টর রবার্ট রোসেনবার্গ এই বিষয়ে জানান, ফোনের ভাইব্রেশন চিহ্নিত করা এবং তার ফলে সজাগ হওয়া আমাদের একটি অভ্যাসে পরিণত হয়ে গিয়েছে। তাঁর মতে, সর্ব ক্ষণ ফোন ব্যবহারকারীরা নিজেদের অজান্তেই একটি কল কিংবা মেসেজ কিংবা নোটিফিকেশন মিস করার ভয়ে এতটাই ভীত থাকেন, যে তাঁদের শারীরিক ও মানসিক প্রতিবর্ত ক্রিয়া শুধু ফোনের সেই ভাইব্রেশনটি টের পাওয়ার জন্যই উন্মুখ হয়ে থাকে। ফলে ফোনের ভাইব্রেশনের মতো একই রকম কোনো শারীরিক অনুভূতি, যেমন পোশাকের ঘর্ষণ কিংবা হয়তো কোনও পেশির সংকোচন-প্রসারণ– এ সবকে অনেকেই ফোনের ভাইব্রেশন ভেবে ভুল করে বসেন।
গবেষকেরা এই সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য কিছু উপায় জানিয়েছেন। তাঁদের মতে, প্রতি ৯০ মিনিট অন্তর প্রত্যেক স্মার্টফোন কিংবা প্রযুক্তিপণ্য ব্যবহারকারীর ১০ মিনিটের একটি বিরতি নেওয়া উচিত। এই ১০ মিনিটের বিরতি তাঁকে প্রযুক্তিগত উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তা থেকে মুক্ত করবে। শুধু তা-ই নয়, এই ১০ মিনিটে কী করণীয়, তাক একটি তালিকাও দিয়েছেন গবেষকেরা। যেমন–
১) এই ১০ মিনিটের জন্য প্রকৃতির কাছাকাছি কোনও জায়গা থেকে ঘুরে আসুন। সে বাড়ির পাশের বাগান হোক বা অফিসের পাশের লেক। যদি এ সব কিছু না থাকে, তবুও ১০ মিনিটের জন্য বাইরে থেকে ঘুরে আসুন। এই ১০ মিনিট ফোনের দিকে না তাকিয়ে প্রকৃতির দিকে তাকান।
২) এই ১০ মিনিটে আপনি ছোটখাটো একটি মেডিটেশন করে নিন। আপনার মন শান্ত হবে, দুশ্চিন্তাও কমবে।
৩) হাল্কা কিছু ব্যায়াম করে নিতে পারেন ১০ মিনিটে। এতে শরীরের জড়তা দূর হবে।
৪) যদি উপরের কোনওটিই সম্ভব না হয়, তবে এই ১০ মিনিটে আপনার পছন্দের কোনও গান শুনুন। এ ক্ষেত্রে রিল্যাক্সিং কোনও গান কিংবা মিউজিকও শুনতে পারেন।
৫) গান শুনতে ভাল না লাগলে, নিজেই এই ১০ মিনিটে নিজেই একটু গান গেয়ে নিন। আপনার গানের গলা ভাল হোক কিংবা খারাপ, তা নিয়ে ভাববেন না। কারণ কোনও অনুষ্ঠানে অন্যকে শোনানোর জন্য নয়, বরং নিজের ক্লান্তি দূর করার জন্য গান গাইছেন।
৬) হাতের কাছে মজার কোনও বই রাখুন। এই ১০ মিনিটে দু’-একটি একটুখানি পড়ে ফেলুন। মন ভাল হয়ে যাবে