গতকাল কাশ্মীরের পুলওয়ামার ভয়াবহ জঙ্গি হামলায় উত্তোরত্তর বাড়ছে মৃতের সংখ্যা। শেষ পাওয়া খবর অনুযায়ী ৪২ জন জওয়ান প্রাণ হারিয়েছেন এই হামলায়। তাঁদেরই মধ্যে একজন হাওড়ার বাউরিয়ার চককাশী রাজবংশী পাড়ার বাসিন্দা সিআরপিএফ জওয়ান বাবলু সাঁতরা৷ তাঁর কর্মজীবনে অনেক প্রতিকূল পরিস্থিতির মুখে পড়েছেন ভারতীয় সেনার এই বীর যোদ্ধা৷ বরাবরই রণক্ষেত্রে শত্রুর বুলেটের সামনেও নির্ভয় ছিলেন তিনি৷ জঙ্গিদের এই নৃশংস বর্বরতায় প্রাণ হারালেন বাবলু। শোকের অকূল সমুদ্রে ভাসিয়ে রেখে গেলেন বৃদ্ধা মা, স্ত্রী এবং ৫ বছরের কন্যাকে।
বাবলু সাঁতরার মাকে আজ সকালেই ফোন করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়৷ বাবলুর পরিবারের সবরকম দায়িত্বের আশ্বাস দিয়েছেন তিনি৷ বাবলুর বাড়িতে গিয়ে তাঁর পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়েছেন সমবায়মন্ত্রী অরুপ রায়ও৷ খেলোয়াড় লক্ষ্ণীরতন শুল্কাও শোকজ্ঞাপন করেছেন বাবলুর পরিবারের প্রতি৷
ছোটোবেলায় বাবাকে হারিয়েছিলেন। ৫ ভাইবোন আর মায়ের সংসারের জোয়াল ধরতেই স্কুলের গণ্ডি পেরনোর আগে মাছ বিক্রি করতে শুরু করেছিলেন বাবলু। এরপর স্কুল পেরিয়ে কলেজে যাওয়া। কিন্তু ছোটো থেকেই দেশের কাজে নিজেকে সোপেঁ দেওয়া ছিল তাঁর লক্ষ্য। ২০০০ সালে কলেজে পড়ার সময়ই সেনাবাহিনীতে যোগ দেন তিনি। তাঁর কাজে যোগদানের পর সংসারের শ্রী ফিরেছিল৷ বুধবার রাতেও মা এবং স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেন বাবলু৷ কেউ ভাবতেও পারেননি পরের দিনটা কতটা অন্ধকার হতে চলেছে৷
সেনা সূত্রে খবর এসেছে, দলাপাকানো রক্ত-উর্দির ভিতর থেকে চেনা যায়নি বাবলুকে। এতটাই ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছিল সব দেহগুলি, শেষপর্যন্ত হাতের আংটি দেখে চিহ্নিত করা গিয়েছে তাঁকে। খানিক ক্ষণ আগেই বাউরিয়া থানার পুলিশ অফিসিয়ালি নিশ্চিত করেছে বাবলুর মৃত্যু।
বাবলুর পরিবারের এক আত্মীয় জানিয়েছেন, তাঁকে যে কাশ্মীরে পোস্টিং করা হচ্ছে, বিষয়টি তাঁরা আগে থেকেই জানতেন৷ তাই বৃহস্পতিবারের ঘটনার পর থেকেই মনটা আনচান করছিল তাঁদের৷ এদিন সন্ধ্যায় হঠাৎ নয়াদিল্লি থেকে ফোন আসে৷ আর তারপরই পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যায় সাঁতরা পরিবারের৷ জানতে পারেন, তাঁদের প্রিয় বাবলা আর নেই৷ শোকে ভেঙে পড়ে গোটা পরিবার৷
কাল থেকে মুহূর্তের জন্য কান্না থামেনি বাবলুর মা, ৭০ বছরের বনলতা সাঁতরার। বারবার বলছেন, “ছেলে চলে গেল, আর কারও কাছে কিচ্ছু চাওয়ার নেই।” পরিবারের সদস্যরা একটাই কথা বলছেন, “আর কেউ যেন এই চাকরিতে না যায়।” বাবলুর দিদি জানালেন, পরশু রাতে শেষ কথা হয়েছিল বাবলুর সঙ্গে। ঘরোয়া কথাবার্তা। কাল রাত থেকে আর ফোন আসেনি। দিন পনেরো আগেই আরও একটি বিপর্যয় ঘটে গিয়েছে বাবলুর পরিবারে। মারা গিয়েছেন তাঁর মেজো জামাইবাবু। দিদির দায়িত্বও নিয়েছিলেন বাবলুই। সেই সঙ্গে রয়েছেন বাবলুরর স্ত্রী মিতা, ছ’বছরের ছোট্টো মেয়ে পিয়াল। “সবটা ভাসিয়ে দিয়ে চলে গেল বাবলু।” বলছেন ঠাকুমা উবজা সাঁতরা।
কথা বলার শক্তি হারিয়েছেন বাবলুর স্ত্রী। ঘরের দরজা বন্ধ করে বসে রয়েছেন তিনি। সাড়া দিচ্ছেন না কারোর ডাকেই। কি হচ্ছে তা বোঝার মত বয়স হয়নি তাঁদের একরত্তি মেয়ের। সবাইকে কাঁদতে দেখে সেও কাঁদছে।
গত ডিসেম্বরেও যখন বাবলু বাউরিয়ার গ্রামে ফিরে পাড়ার মাঠ মাতিয়ে ভলিবল খেললেন, তখনও কেউ ভাবতে পারেননি এই তাঁর শেষ খেলা, শেষ আসা! কেউ আন্দাজও করতে পারেননি, ৩৯ বছরের তরতাজা যুবকের প্রাণ চলে যাবে জঙ্গি হামলার শিকার হয়ে। প্রতিবেশীরা ভাবতে পারছেন না, এই মাঠে আর কখনও খেলবেন না বাবলু! কয়েক মাস পরেই চাকরির মেয়াদ শেষ হয়ে যেত এই জওয়ানের৷ দেড় মাস আগে যখন বাড়িতে এসেছিলেন, তখনই মা’কে বলে গিয়েছিলেন, তাড়াতাড়ি ফিরে আসবেন৷ কিন্তু সেই ফেরা আর স্বাভাবিক হল না৷ এবার বাবলু ফিরবেন কিন্তু কফিনবন্দি অবস্থায়৷