কখনও কখনও নিজের ওপরেই ভীষণ রাগ হয় আমার। ঠিক দরকারের সময় প্রয়োজনীয় লেখা, ছবিগুলো খুঁজে পাইনা। ঠিক যেমন হল আজ সকালে। খুঁজে পাচ্ছিনা মানে হারিয়ে গেছে তা নয়। আমি নিজেই সেসব যত্ন করে তুলে রেখেছি কোথাও। কিন্তু এমনই সে আয়োজন যে প্রয়োজনের সময় খুঁজে পাইনা। আজ সুভাষদা, মানে কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের জন্মদিন। কবিতা ও গদ্যে সব্যসাচী এই অসাধারণ মানুষটি আমার মত একজন সামান্য আলোকচিত্রীকে কিঞ্চিৎ প্রশ্রয় দিতেন। তার মত একজন এ লেভেলের মানুষের কাছে আমি নিতান্তই এলেবেলে, তবু এ ঘটনা ঘটতো। ছবি তোলার জন্য সময়ে-অসময়ে নানাসময় আব্দার করতাম তাঁর কাছে। প্রথমে প্রাণপণে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেও শেষমেশ তিনি তা মঞ্জুর করতেন। একটা চমৎকার ছবি হত। রঘু রাই বলেন, ছবি তোলার মত তা সংরক্ষণ এবং প্রয়োজনের সময় খুঁজে বার করে তা ব্যবহার করাটাও আরেকটা শিক্ষা, নইলে সে ছবি কোন কাজেই আসবে না। তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে বাংলা তো বটেই দেশের বিভিন্ন প্রান্তে নানা বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব, ঘটনা ও জনজীবনের ছবি তুলেছি। কিন্তু দরকারের সময় তা খুঁজে পাইনা। সেই সংরক্ষণ বিদ্যা এ বয়সেও আমার আয়ত্তে এলো না।
ঘটনাটা একটু খুলেই বলি। সুভাষদা একবার আমাকে তাঁর লেখা একটা কবিতা উপহার দিয়েছিলেন। এটা সত্যিই আমার এক পরম প্রাপ্তি। আজ সকালে ভাবলাম কবির জন্মশতবর্ষে সেই কবিতাটা ও তা রচনার প্রেক্ষাপট এবং আমার সেটা পাওয়া সেসব মিলিয়ে একটা পোষ্ট দেবো। আমার এই সামান্য রচনার পাঠকমাত্রই জানেন, বহু মানুষের সান্নিধ্যের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আমি তাদের ছবি তোলার কোন স্মৃতির কথা বলি এবং অবধারিতভাবে কৈফিয়ত দিই, ছবিটা পাচ্ছিনা বলে দেওয়া গেলো না। আপনারা আমাকে ঢপবাজ ভাবতে পারেন কিন্তু সত্যি এই ঘটনাটা ঘটে। সেই কারণেই সুনীলদা, রমাপদদা, নীরেনদাকে নিয়ে লেখাগুলোতে তাদের অসাধারণ সব ছবি আমার কাছে থাকা সত্বেও সেই ছবি আমি দিতে পারিনি।
সুভাষদার বেলায়ও ঠিক সেই ঘটনাটাই ঘটল। যে ছবিটা পেলাম না সেই ছবিটার নেপথ্য কাহিনীটাই এখন আমি আপনাদের বলবো। একবার অন্নদাশঙ্কর রায়ের জন্মদিনে তাঁকে নিয়ে আনন্দবাজারের কলকাতা পেজে একটা বিশেষ ছবি করার পরিকল্পনা করলাম আমি। ঠিক করলাম, এই ছবিটিতে অন্নদাশঙ্কর রায়ের সঙ্গে থাকবেন সুভাষ মুখোপাধ্যায়। সুভাষদাকে একথা বলতেই তিনি প্রাণপণে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেন, অবশেষে তাঁকে আমি রাজি করিয়ে ফেললাম। তাঁর� জন্মদিনে সুভাষদাকে নিয়ে আমি পৌঁছে গেলাম অন্নদাশঙ্কর রায়ের বাড়িতে। তিনি তখন খুব অসুস্থ, খাটে শুয়ে আছেন, সুভাষদা পাশে বসে তাঁর হাত ধরলেন। একটু ঝুঁকে বসে কথা বলতে শুরু করলেন তাঁর সঙ্গে। ভারতীয় সাহিত্যের দুই বিখ্যাত ব্যক্তিত্বের আলাপচারিতার সে এক অসাধারণ দৃশ্য। এক অন্তরঙ্গ মুহূর্তকে ক্যামেরাবন্দী করলাম আমি। বার্ধক্যজনিত কারণেই অন্নদাশঙ্কর কথা বলছিলেন আস্তে আস্তে খোনা গলায়, সে কথা বোঝা খুব কঠিন। অন্যদিকে সুভাষদা তখন কানে খুব কম শোনেন, হয়তো তিনি কিছুই শুনতে পাচ্ছেন না। শারীরিক এই প্রতিবন্ধকতা দূর করে দুজনে কীভাবে আলাপ চালিয়ে যাচ্ছিলেন তা আমার মোটামাথায় কিছুতেই ঢুকছিল না। ছবি তোলার পর আমি সুভাষদাকে একটা জুৎসই হেডিং এর কথা বলতেই সুভাষদা একটা কাগজে খসখস করে চার লাইনের একটা কবিতা লিখে দিয়েছিলেন। সেই অমূল্য সম্পদটিই হারিয়ে ফেলেছি আমি। আপনারা ভাবুন, সুভাষদার জন্ম শতবর্ষে আমার এই সামান্য লেখাটার সঙ্গে ভারতীয় সাহিত্যের এক প্রধান কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের সেই অসামান্য কবিতাটা আপনারা পড়ছেন। আনন্দবাজারে যেদিন ছবিটা প্রকাশিত হয়েছিল সেদিন দুপুরে অফিসের তিনতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে আনন্দবাজারের চিফ ফোটোগ্রাফার তপন দাসের সঙ্গে চা খাচ্ছিলাম। সুমনদা এসে পেটে আলতো একটা ঘুষি মেরে বললো, কী ছবি তুলেছিস! বারো মিনিটের এডিটোরিয়াল মিটিং এ আট মিনিট তোর ছবি নিয়ে খোদ সম্পাদক বলে গেলেন। বললেন, এমন ছবিই আজকের খবরের কাগজ চায়।�
আমি যে বিরাট কিছু কবিতা অনুরাগী তা কিন্তু নয়। সুভাষদার অনেক কবিতা আমি পড়েছি তাও নয় বরং আমার ভালো লাগে তাঁর নিরাভরণ অথচ বুদ্ধিদীপ্ত গদ্য। ওঁর আমার বাংলা, ডাকবাংলোর ডাকে, আবার ডাকবাংলোর ডাকে আমার খুব প্রিয় বই। ওঁর লেখার সবচাইতে যেটা বড় গুণ তা হল আমার মত অশিক্ষিত লোকেদেরও বুঝতে কোন অসুবিধা হয় না। গভীর কথা কোন ব্যাপক গাম্ভীর্য ছাড়াই সুভাষদা কীভাবে অনায়াসে লিখে ফেলতেন তা ভাবলেও অবাক হতে হয়। অথচ কোন দেখনদারি নেই, বিরাট কোন হাবভাবও নেই, আমি বড় কবি বলে কোন ঘোষণাও নেই। কোন চেষ্টা ছাড়াই তিনি একটা বিরাট উচ্চতায় বিরাজ করতেন। কথার ভাষা আর লেখার ভাষার মধ্যে তফাৎ ঘুচিয়ে দেওয়াটা সুভাষদার লেখার একটা বড় গুণ। ওঁর ছেলে গেছে বনে কবিতাটার দুটো লাইন মনে পড়লো � ছেলে গেছে বনে, বুড়ো দশরথ বাপ/ দুঃখ যা পেলেন মনে, ছ রাত্রেই সাফ। অশিক্ষিতের উদ্ধৃতি, পণ্ডিতরা নিজগুণে ক্ষমা করে দেবেন। এই হলেন সুভাষদা! শতবর্ষ পেরিয়েও তিনি টিঁকে আছেন এই সহজ গভীরতার জন্য।
সুভাষদা রাজনীতি করতেন, বামপন্থী রাজনীতি। অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলেন তিনি। কিন্তু যে কোন সৃষ্টিশীল মানুষের মতই তিনি পার্টিজান ছিলেন না। পার্টি ব্যুরোক্র্যাটদের সঙ্গে সৃষ্টিশীল লেখকদের সংঘাত সারা পৃথিবীর বামপন্থী আন্দোলনেরই এক চেনা ঘটনা। শিল্প সংস্কৃতি নিয়ে দলের রাজনৈতিক মাতব্বরদের ফতোয়া মানতে না পেরে কত বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী, কবি, লেখক যে পালিয়ে বেঁচেছেন তা গুনে শেষ করা যাবে না। সেসব মাতব্বরদের নাম ইতিহাস মনে রাখেনি, কিন্তু তারা যাদের লেখালেখি শেখাতে চেয়েছিলেন তাদের কথা মানুষ মনে রেখেছে। সুভাষদাকে রাশিয়ার দালাল, সংশোধনবাদী কবি বলে যারা ছাপ্পা দিয়েছিলেন তাদের নাম আমাদের মনে নেই। কিন্তু বাংলা ভাষার পাঠক মাত্রেই কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে পড়েছেন।
সুভাষদা বরাবরই স্বাধীন ও স্বতন্ত্র। নিজস্ব ন্যায় অন্যায় বোধই তাঁকে সিঙ্গুর নন্দীগ্রাম পর্বে দিদির পাশে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল। শাসক বামেদের অন্যায়ের প্রতিবাদে সরব হয়েছিলেন তিনি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে সমর্থন করার অপরাধে এই অজাতশত্রু মানুষটিকে তাঁর শতবর্ষে ব্রাত্য করে রাখলো বাম দলগুলি। তাঁর জন্ম শতবর্ষে সিপিআই, সিপিএম সহ অন্যান্য বাম দলগুলি পদাতিকের কবিকে নিয়ে নীরব। দলগতভাবে কবি সুভাষ স্মরণে কোন পরিকল্পনাই নেই তাদের। হিন্দুত্ববাদীদের ছুঁৎমার্গ নিয়ে যারা সমালোচনা করেন তাদের নিজেদের এই ছুঁৎমার্গ দেখলে আমার অবাক লাগে।
কিন্তু এদের এই মনে করা বা না করায় সুভাষদার মতন মানুষদের কিছু যায় আসে না। বাংলা কবিতা যতদিন থাকবে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ও ততদিন থাকবেন। সেই কবিতা বুকে নিয়ে তারা লড়াইয়ে ঝাঁপাবে, মিছিলে হাঁটার সময় তাঁর কবিতা থাকবে তাদের মুখে। বেঁচে থাকতেই কিংবদন্তী হয়ে গিয়েছিল তাঁর বহু কবিতার লাইন � ফুলগুলো সরিয়ে দাও আমার লাগছে; রাস্তাই একমাত্র রাস্তা; একটু পা চালিয়ে ভাই। এই বয়সে এসে ফুলগুলো সরিয়ে দাও কবিতাটা বারবার মনে পড়ে। আবার আজকে একটা মিছিল দেখে মনে পড়ছিল, ঝাঁকড়া চুল আর অবিন্যস্ত ধুতি পাঞ্জাবি পরা সুভাষদাকে, সেই মিছিলে হাঁটতে হাঁটতে তিনি যেন বলছেন � একটু পা চালিয়ে ভাই। সত্যিই আমাদের অনেকটা দেরি হয়ে গেছে। মেকি বাম আর ধর্মের ধ্বজা তোলা বিভেদের ফেরিওয়ালাদের হাত থেকে দেশকে বাঁচানোর লড়াইয়ে আমাদের একটু পা চালিয়েই হাঁটতে হবে। এভাবেই জন্ম শতবর্ষে শ্রদ্ধা জানানো যাবে সুভাষদাকে।
( মতামত লেখকের ব্যক্তিগত )