কলকাতার পুলিস কমিশনারকে সিবিআই বাড়ির থেকে গ্রেপ্তারের যে চেষ্টা করেছিল তাতে জল ঢেলে দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। তাই সে প্রসঙ্গে আজ আর যাচ্ছি না। আমার প্রশ্ন অন্য জায়গায়। সিবিআইয়ের যে অপকম্মোটি দেশের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো, গণতন্ত্র, এবং সংবিধানের ওপর আঘাত হানলো সে ব্যাপারে রাজ্য কংগ্রেস এবং সিপিএমের কোন প্রতিক্রিয়া নেই। বরং এব্যাপারে তারা শত্রুর শত্রু তাই আমার বন্ধু এই আপ্তবাক্যটি মনে রেখে তৃণমূল নেত্রীর সমালোচনা করে দেশের প্রধানমন্ত্রীর দোষকে তুলনামূলকভাবে হাল্কা করে দেখানোর চেষ্টা করেছেন। এ এক বিচিত্র রাজনীতি! দেশ-দশ সবকিছুকে বাদ দিয়ে বাংলার কংগ্রেস কুলপতিরা এখনও নিজেদের তুচ্ছ অহম ত্যাগ করে বাস্তবতাকে মেনে নিতে শিখলেন না। সোমেনদা-মান্নানদা-অধীরদারা নিজেদের সব ক্ষমতাকে জীবনভোর শুধু ক্ষুদ্র গোষ্ঠীতান্ত্রিক রাজনীতিতেই আটকে রাখলেন। এমন আশ্চর্য রাজনীতি ও অত্যাশ্চর্য নেতাদের আপনি শুধু বাংলাতেই পাবেন।
অথচ জাতীয় কংগ্রেসের কর্ণধার রাহুল গান্ধী কলকাতার পুলিশ কমিশনার রাজীব কুমারের বাড়িতে তাকে গ্রেপ্তারের জন্য সিবিআইয়ের হানা দেওয়ার ঘটনার কথা শোনামাত্র প্রতিবাদ জানিয়ে তৃণমূল নেত্রীর পাশে থাকার অঙ্গীকার করেছেন। দলের কর্ণধার রাহুল বলছেন একরকম কথা আর সেই দলের রাজ্যনেতারা বলছেন অন্যরকম কথা। এমনিতেই নানা প্রশ্নে কংগ্রেসের রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে আমার মত অনেক সামান্য মানুষের বিভ্রান্তি আছে। দলের রাজ্যনেতা ও কেন্দ্রীয় নেতাদের দুরকম কথাবার্তায় তা আরও বাড়বে।
এখানেই থামেননি কংগ্রেস নেতারা। বিজেপির গণতন্ত্র ও সংবিধান বিরোধী কার্যকলাপের বিরুদ্ধে যৌথ আন্দোলন গড়ে তোলার বদলে তারা সারদা ও অন্যান্য চিটফান্ডগুলির কেলেঙ্কারির তদন্ত দ্রুত শেষ করার দাবি জানিয়ে নতুন করে আন্দোলন শুরু করার ডাক দিয়েছেন। কংগ্রেসের কর্ণধার রাহুল গান্ধী যখন দেশের সংবিধান বাঁচাতে দিদির সত্যাগ্রহকে সমর্থন জানিয়ে এই প্রতিবাদে সবাইকে সামিল হতে আহ্বান জানাচ্ছেন ঠিক তখনই তার দলের রাজ্য নেতৃত্ব বলছে সম্পূর্ণ অন্য একটা ইস্যুতে আন্দোলনের কথা। আরও আশ্চর্যের কথা হল তাদের এই আন্দোলনের দাবিগুলির সঙ্গে সিপিএমের দাবিগুলির খুব মিল।
মিল থাকাটাই স্বাভাবিক। রাজ্যের চিটফান্ড নিয়ে প্রথম শোরগোল তুলেছিল কংগ্রেস। তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পরপরই চিটফান্ডগুলির বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু হয়। সুদীপ্ত সেন থেকে গৌতম কুন্ডু সবাইকে জেলে যেতে হয় সে কারণেই। সে বিচার এখনও শেষ হয়নি। রাজ্য কংগ্রেস ও সিপিএম নেতারা এসব কথা যে জানেন না তা নয়, তবু এ প্রসঙ্গে তারা একটা বিরোধী অবস্থান বজায় রেখে নিজেদের একটা স্বতন্ত্র সত্ত্বা প্রমাণ করার চেষ্টা করছেন। কিন্তু এতে যে তাদের দল সম্পর্কেই জনমানসে একটা ভুল বার্তা যাচ্ছে এবং কট্টর কংগ্রেস এবং সিপিএম সমর্থকদের মনে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে, তা তারা একবারও ভেবে দেখছেন না।
এ রাজ্যে বিজেপি বিরোধী ইউনাইটেড ইন্ডিয়া সমাবেশে সিপিএম আসেনি। অন্যদিকে দলের সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি কংগ্রেস সহ দেশের অন্যান্য বিরোধী দলগুলির নেতাদের বাণী দিচ্ছেন, বিজেপি বিরোধী লড়াইয়ে তারা সবরকম ভাবে বিরোধী দলগুলির সঙ্গে আছেন। বাংলার মানুষ জানেন, এ থাকাটা শুধু বাণীতে থাকা, বাস্তবে থাকা নয়। রাহুল গান্ধীর সঙ্গে ইয়েচুরির এ নিয়ে বৈঠকও হয়েছে, কিন্তু বিজেপির বিরুদ্ধে এই লড়াইয়ের যিনি মূল উদ্যোগটা নিয়েছেন তার সঙ্গে কথা বলতে ইয়েচুরির বাঁধছে। কারণ, নিজেদের অপদার্থতার কারণে তৃণমূলের কাছে হেরে বাংলা থেকে বিদায় নেওয়ার ব্যাথাটা তারা এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেননি।
কাজে নেই, আন্দোলনে নেই, সমর্থনে নেই, তাদের সব সক্রিয়তা দেখা যায় শুধু সোশ্যাল মিডিয়ায়। সেখানে স্বনামে বেনামে দিনরাত বাংলার তৃণমূল নেত্রী এবং রাজ্য প্রশাসনের প্রধান মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে কারণে অকারণে ছড়ায়-ছবিতে, কথায়-কার্টুনে লাগাতার গালমন্দ করে চলেন এই দুদলের একশ্রেণীর কর্মী ও সমর্থকরা। দেখেশুনে আমার মনে হয় দিদির বিরুদ্ধে বিষোদ্গারটা একটু কম করে দলের কাজে সময় দিলে তাদের নিজেদের এবং দলের কিঞ্চিৎ উপকার হতো। তাদের সংগঠনটা একটু বাড়তো। কর্মী ও সমর্থকদের এসব কাণ্ডকারখানার কথা উচ্চতর নেতৃত্ব বিলক্ষণ জানেন কিন্তু রাজনীতি বড় বালাই, কর্মীদের দলে ধরে রাখতেই এসব বিকৃত মানসিকতাকে প্রশ্রয় দেওয়া হয়।
যে কোন দলে সংগঠন ধরে রাখে রাজনীতি ও আন্দোলন। রাজ্যের কংগ্রেস ও সিপিএমে এ দুটোর কোনটাই নেই। তাই প্রবীণ নেতাদের নবীন চ্যালাচামুন্ডারা এসব নিয়েই ব্যস্ত থাকেন। এসব কর্মী সমর্থকদের সঙ্গে নিয়ে রাজ্য রাজনীতিতে প্রাসঙ্গিক থাকার জন্যই বাংলায় কংগ্রেস, সিপিএম নেতারা তৃণমূল বিরোধী রাজনীতিকে প্রশ্রয় দিচ্ছেন। এদের চাপেই রাহুল ও ইয়েচুরি বলতে বাধ্য হচ্ছেন, জাতীয় রাজনীতিতে যাইহোক না কেন, বাংলায় তাদের দল স্থানীয় পরিস্থিতি অনুযায়ী চলবে। এই তোষণনীতিই প্রমাণ করে দিচ্ছে তথাকথিত সর্বভারতীয় দলগুলির সাংগঠনিক দুর্বলতা।
সুপ্রিম কোর্টের রায়ে শেষ হাসি হাসলেন আমাদের দিদি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রথম রাউন্ডে তিনি জিতেছেন, শেষ রাউন্ডেও তিনিই জিতবেন। সত্যাগ্রহ তুলে নিয়ে লড়াইকে পরের রাউন্ডে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছেন তিনি। লড়াইয়ের ফল জানার জন্য আমাদের খুব বেশিদিন অপেক্ষা করতে হবে না। সাধারণ নির্বাচনের ফল প্রমাণ করে দেবে বাংলার মানুষ কাদের চায়। বাংলার এসব অদূরদর্শী কংগ্রেস ও সিপিএম নেতাদের তখন দূরবীন দিয়েও খুঁজে পাওয়া যাবে না। বাংলার সিপিএম ও কংগ্রেস নেতারা তখন তাদের আশ্চর্য রাজনীতি ও অত্যাশ্চর্য রাজনৈতিক দলিল দস্তাবেজ নিয়ে জাদুঘরে বিরাজ করবেন।
অশোক মজুমদার