অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলির অসুস্থতায় শিকে ছিঁড়েছে রেলমন্ত্রী পীযূষ গোয়েলের। অর্থ মন্ত্রকের দায়িত্ব নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বাজেট-বক্তৃতা দেওয়ার সুযোগ পেয়ে তিনি দাবি করলেন, অর্থনীতির এমন সুদিন নাকি আগে কখনও দেখেইনি দেশ। বাজেট-বক্তৃতায় এমন ভাঁওতা অন্য কোনও জমানায় তো নয়ই, খোদ নরেন্দ্র মোদীর জমানাতেই এর আগে শোনা যায়নি।
ভোটের বছরে অন্তর্বর্তী বাজেট পেশ করাটাই রীতি। সাধারণত অন্তর্বর্তী বাজেটে থাকে ভোট পর্যন্ত সরকারের খরচ চালানোর সংস্থান। তবে লোকসভা ভোটের আগে সরকার নতুন অর্থ বছরের প্রথম চার মাস, অর্থাৎ এপ্রিল থেকে জুলাই পর্যন্ত খরচ রাজকোষ থেকে ব্যয় করতে সংসদের মঞ্জুরি নিয়ে নেয়। কারণ নতুন সরকার গঠন হয়ে তার পূর্ণাঙ্গ বাজেট পাশ হতে জুলাই গড়িয়ে যায়। একেই বলে ভোট-অন-অ্যাকাউন্ট। তা ধ্বনিভোটেই পাশ হয়ে যায়।
কিন্তু গত ৫ বছরে নরেন্দ্র মোদী কোনও গণতান্ত্রিক রীতির প্রতিই বা শ্রদ্ধাশীল থেকেছেন? অর্থনীতির বৃদ্ধিহার থেকে কর্মহীন মানুষের সংখ্যা— কোনও পরিসংখ্যানই প্রকাশ না করে, ছোট চাষিদের সরাসরি অনুদানের টাকা কোথা থেকে আসবে তার সামান্যতম ইঙ্গিতও না দিয়ে মোদীর অন্তর্বর্তী অর্থমন্ত্রী সারা বছরের বাজেট পেশ করে জানালেন, জানুয়ারি মাসে জিএসটি সংগ্রহ ১ লক্ষ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। কিন্তু চেপে গেলেন যে, গত বছরের বাজেটে জিএসটি সংগ্রহের লক্ষ্য ধার্য করা হয়েছিল মাসে ২.৫ লক্ষ কোটি টাকা। প্রকৃত সংগ্রহ তার অর্ধেকেরও কম।
‘মোদী, মোদী, মোদী’ চিৎকারের মধ্যেই গোয়েল ঘোষণা করলেন, ২ একরের কম জমির মালিকদের সরাসরি অনুদান দেওয়া হবে বছরে ৬০০০ টাকা। কিন্তু দেশ জুড়ে অভাবী চাষিদের আত্মহত্যা যে অভূতপূর্ব সঙ্কট ডেকে এনেছে, সে বিষয়ে তিনি একটি শব্দও উচ্চারণ করলেন না। যেমন করলেন না স্বামীনাথন রিপোর্ট মেনে ফসলের ন্যূনতম মূল্য ধার্য করার ব্যাপারে। আজ আলু চাষের খরচই দাঁড়িয়েছে কিলো প্রতি ৮ টাকা। হুগলী, বর্ধমান, বীরভূম জুড়ে ভরা আলুখেতে চাষিরা মাথায় হাত দিয়ে ভাবছেন, নাম কে ওয়াস্তে নতুন প্রকল্প চালু করে মোদী সরকার তাঁদের জন্যে মাসে যে ৫০০ টাকার অনুদান বরাদ্দ করলেন, তাতে মান-সম্মান নিয়ে বেঁচে থাকা সম্ভব?
উল্লেখ্য, উড়িষ্যার ‘কালিয়া’ কৃষক সহায়তা প্রকল্পে সরাসরি অনুদান দেওয়া হয় বছরে ১০,০০০ টাকা, আর তেলেঙ্গানার ‘রায়তু বন্ধু’ প্রকল্পে বছরে ৮০০০ টাকা। কেন্দ্রীয় প্রকল্পে বরাদ্দ করা হয়েছে ৭০,০০০ কোটি টাকা। কোত্থেকে সেই বাড়তি টাকার সংস্থান করা হবে? না, সে বিষয়ে একটি শব্দও খরচ করা হয়নি বাজেট-বক্তৃতায়। পাশাপাশি ভোটের বছরে কৃষিজীবীদের পাশাপাশি মধ্যবিত্তকে খুশি করতে আয়করে যে ঢালাও ছাড় দেওয়া হয়েছে, সেই রাজস্ব ক্ষতিই বা কীভাবে সামলানো হবে? তারও কোনও উল্লেখ নেই বাজেট-বক্তৃতায়। শুধু বলা হয়েছে, আর্থিক ঘাটতি বেড়ে ৩.৪% হবে।
বস্তুত, শুধু ভোটে জেতার কথা ভেবেই কৃষক অনুদান, আয়করে ছাড়, শ্রমজীবীদের পেনশনের মতো প্রকল্প চালু করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে অন্তর্বর্তী বাজেটে। কৃষিজীবী, শ্রমজীবী এবং মধ্যবিত্ত মানুষদের নিয়ে মোদীর মাথাব্যথা যদি আন্তরিক হত, তবে আগের চার-চারটি বছরের বাজেট সে বিষয়ে উদাসীন ছিল কেন? কেন অপেক্ষা করতে হল নির্বাচনের মাস তিনেক আগে অন্তর্বর্তী বাজেটের জন্যে? কারণটা স্পষ্ট। ভোটে জেতার জন্যে জরুরি সমস্ত উপাদান ঢেলে রান্না করা হয়েছে এই বাজেট।
আর্থিক ঘাটতির কী হবে, মুদ্রাস্ফীতি কতটা বাড়বে, সেসব ভোটে জিতলে ভাবা যাবে। আর ভোটে যদি বিজেপি নাই যেতে, তাহলে এর ফল ভুগতে হবে নতুন সরকারকে। অর্থাৎ দেশের নয়, নিজেদের স্বার্থে সব দিক বিবেচনা করেই এই বাজেট পেশ করেছে মোদী সরকার।