এবার কেঁচো খুঁড়তে বেরিয়ে পড়ল কেউটে। বর্ষবরণে বাকি আর মাত্র কয়েকদিন। গোপন সূত্রে খবর পেয়ে নতুন বছরের প্রাক্কালেই দিল্লীতে বড়সড় জঙ্গি হামলা ও আত্মঘাতী ফিদায়েঁ হামলাছক বাতিল করল জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা এনআইএ। দিল্লী ও উত্তরপ্রদেশ পুলিশকে সঙ্গে নিয়ে বুধবার সকাল থেকেই এই দুই রাজ্যে তল্লাশি শুরু করে এনআইএ। আর সেটা করতে গিয়েই যা তথ্য হাতে পেয়েছেন তদন্তকারীরা তাতে ঘুম উড়েছে গোয়েন্দাদের। হদিশ মিলেছে আইসিস দ্বারা অনুপ্রাণিত এক নতুন জঙ্গি সংগঠন ‘হরকত উল হার্ব এ ইসলাম’-এর।
গোপন সূত্রে খবর পেয়ে গতকাল দুই রাজ্যের ১৭টি জায়গায় যৌথভাবে হানা দেয় এনআইএ, উত্তরপ্রদেশ পুলিশের সন্ত্রাস দমন শাখা এবং দিল্লি পুলিশের স্পেশ্যাল সেল। ১৬ জন সন্দেহভাজনকে জেরা করে, তাদের মধ্যে থেকে ১০ জনকে গ্রেফতার করে তারা। এদের মধ্যে ৫ জনকে গ্রেফতার করা হয় আমরোহা থেকে। বাকি ৫ জনকে উত্তর-পূর্ব দিল্লি থেকে।উল্লেখযোগ্য ভাবে গ্রেফতার হওয়া ১০ জনের মধ্যে ২৪ বছরের এক যুবতীও রয়েছে। সে ফিদায়েঁ অর্থাৎ আত্মঘাতী বাহিনীর সদস্যা।
বিকেলে সাংবাদিক বৈঠক করে এনআইএর পক্ষ থেকে জানানো হয় তল্লাশি অভিযানে ধৃতদের ডেরা থেকে উদ্ধার হয়েছে ২৫ কেজি বিস্ফোরক-সহ পটাশিয়াম নাইট্রেট, অ্যামোনিয়াম নাইট্রেটের মতো প্রচুর রাসায়নিক, শতাধিক ফোন, ১২০টি অ্যালার্ম ক্লক, নগদ সাত লাখ টাকা, ২৫টি পিস্তল, ১৫০ রাউন্ড বুলেট, দেশীয় প্রযুক্তিতে ১ রকেট লঞ্চার। এছাড়াও পাওয়া গিয়েছে ১৩৫টি সিমকার্ড, একাধিক ল্যাপটপ, মেমোরি কার্ড।
রিমোর্ট কন্ট্রোল আইইডি তৈরির জন্য এ গুলি মজুত করা হয়েছিল বলে মনে করা হচ্ছে। প্রাথমিকভাবে গোয়েন্দাদের ধারণা, খেলনা গাড়ির রিমোট কন্ট্রোল, কলিং বেলের সুইচ এই ধরনের জিনিস দিয়েই দূরনিয়ন্ত্রিত আইইডি তৈরির পরিকল্পনা করেছিল জঙ্গিরা। ধৃতদের একজনের মোবাইল থেকে আইইডি তৈরির ভিডিয়োও পাওয়া গিয়েছে। এনআইএ জানিয়েছে, এই টিমের মধ্যে বোমা স্কোয়াড ছাড়া রয়েছে আত্মঘাতী বাহিনী। কারণ পাওয়া গিয়েছে বেশ কিছু সুইসাইড ভেস্ট বা আত্মঘাতী হামলার পোশাক।
তাদের দাবি, গত তিন চার মাস ধরে সক্রিয় হয়েছিল জঙ্গি সংগঠনটি। এবং এদের মূলত দু’টি প্ল্যান ছিল। ১) জনবহুল স্থানে অথবা ভাইটাল ইনস্টলেশনে রিমোট কন্ট্রোলড বিস্ফোরণ ২) সিকিউরিটি প্রটোকলের শৈথিল্যের সুযোগ নিয়ে খুব কাছে গিয়ে কোনও ভিআইপিকে হত্যা। দ্বিতীয় প্ল্যানের জন্য বাছাই করা হয়েছিল আত্মঘাতী বাহিনী। যারা দিল্লীর সরকারি ভবন-সহ উত্তর ভারতের বিভিন্ন জায়গায় আত্মঘাতী বিস্ফোরণ ঘটানোর পরিকল্পনা করছিল। এমনকি একাধিক গুরুত্বপূর্ণ ভিআইপিকে টার্গেট করে আক্রমণের প্ল্যান করা হয়েছিল বলে জানা গেছে। বিভিন্ন পেশার লোকেরা যুক্ত রয়েছে এই সংগঠনে।
তদন্তে উঠে এসেছে, চক্রান্তের অন্যতম এক মাস্টারমাইন্ড হল নয়ডার খ্যাতনামা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অ্যামিটি ইন্টারন্যাশনাল কলেজের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং পাঠরত এক ছাত্র। আর অন্য কারিগর উত্তরপ্রদেশের আমরোহার এক মসজিদে কর্মরত মৌলবি মুফতি সুহেল। দিল্লীর সিলমপুরের জাফরাবাদের একটি ঘর ভাড়া নিয়ে থাকছিলেন তিনি। তিন মাস আগে এই সংগঠনের সদস্যদের মধ্যে প্রথম যোগাযোগ স্থাপন হয়।
গতকাল ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সির আইজি অলক মিত্তাল বলেন, ভারতের প্রতিবেশী এক রাষ্ট্র থেকেই এই গোটা টিমকে পরিচালনা করা হচ্ছে। সেখানে রয়েছে এক গোপন হ্যান্ডলার। কে সে? কোন রাষ্ট্র? সেই রাষ্ট্রের নাম অবশ্য এনআইএ জানায়নি। যদিও ইঙ্গিত পাকিস্তানের দিকেই।
অন্যদিকে, দিল্লী, লখনউ, উত্তরপ্রদেশের আমরোহা, হাপুরে পাওয়া গিয়েছে এই সংগঠনের একাধিক নেটওয়ার্ক। প্রধানত হোয়াটসঅ্যাপ এবং টেলিগ্রাম নামক দু’টি সোশ্যাল মিডিয়ার মেসেজিং প্ল্যাটফর্মে তথ্য আদানপ্রদান ও যোগাযোগ রাখা হয়েছে বলে জানা গেছে। দু’মাস আগেই এ বিষয়ে ইনপুট পান কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারা। এবং শুরু হয় ট্র্যাক করা। ওই টিমের মধ্যে প্রত্যেকেই মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। এনআইএ জানতে পেরেছে, এদের মধ্যে দু’জন নিজেদের বাড়ি থেকেই সোনার গয়না চুরি করে এবং তারপর তা বিক্রি করে লখনউতে। সেই টাকায় কেনা হয় সন্ত্রাসের প্রয়োজনীয় সামগ্রী।
কিন্তু পুলিশ-প্রশাসনের নজর এড়িয়ে এত বড় আয়োজন হল কীভাবে? তাও আবার খোদ রাজধানীর বুকে! জবাবে এনআইএর সাফাই, আইএস-এর হ্যান্ডলারদের সঙ্গে হোয়্যাটসঅ্যাপ এবং টেলিগ্রামের মাধ্যমে গোপনে যোগাযোগ ছিল সংগঠনটির। আইএস থেকে যে নির্দেশ আসে, সেই অনুয়ায়ী এগনো হয়। নতুন বছর আসার প্রাক্কালে সর্বত্রই উৎসবের পরিবেশ। ফলে দিল্লির মতো শহরে সর্বত্রই জনবহুল আবহ। প্রতিটি মার্কেট উপচে পড়ছে। এমতাবস্থায় এভাবে ২৬ জানুয়ারির আগে হামলার ছক করার পিছনে বৃহত্তর কোনও জঙ্গি গোষ্ঠীর পরোক্ষ মদত নেই, এমন ভাবনা উড়িয়ে দিচ্ছে না এনআইএ।