আমি যেটুকু লেখালেখি করি, যে ক’জন মানুষ তা ভালোবাসেন, তারা যিশুর থেকে ও দয়ালু। এতো ব্যাকরণ ও বানানগত ভুল থাকার পরে ও লেখাগুলো ছড়িয়ে যায়।
নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী ‘আনন্দবাজার পত্রিকা ব্যবহার বিধি/ বাংলা কী লিখবেন কেন লিখবেন’ বলে একটি বই সম্পাদনা করেছিলেন৷ আমি ও কিনেছিলাম। মেনে লিখতে পারিনি সব৷
আমি ছোটবেলায় ভেবেছিলাম আচারওয়ালা হবো। সাথে আলুকাবলি, ঝালমুড়ির আলাদা দোকান থাকবে৷ তারপর ভাবলাম ছবি বানাবো। বা দারুন স্লোগান তুলবো মাঠে ময়দানে। কিংবা নাটক করবো৷ এসব করতে আমার ভালো লাগতো৷ লাগে৷ শেষমেশ সিনেমা না বানিয়ে নিউজ প্যাকেজ বানাই এখন। লাভ জিহাদের, জ্যান্ত জ্বালিয়ে দেওয়া সংখ্যালঘু লাশের, দীপিকা পাদুকোনের কানের দুলের। স্লোগান ও খারাপ তা বাজার বলে দিয়েছে। ঝালমুড়িটা ও বেচা হবেনা বোধহয়। ওসব ও প্যাকেটবন্দি হচ্ছে এখন অনেকটা উদারবাদী হাওয়া ঠেসে৷
নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী ‘অমলকান্তি রোদ্দুর হতে চেয়েছিল’ লিখেছিলেন৷ আমি ও কিনেছিলাম। পড়েছিলাম। মেনে চলতে পারিনি। রোদ্দুর দূরে থাক, এক ছোপ কালো মেঘ হয়ে থেকে গেছি। জটিল, মেপে মেপে চলা একটা মেঘ।
আমি রোজ একবার করে ভাবি সদর দপ্তরে কামান দাগবো। রোজ ভাবি ভীষণ রাগে যুদ্ধ হবে এবার। রোজ ভাবি রাজাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেবো যে ওই কাজটা ও মোটেও ভালো করেনি। রোজ ভাবি আর একে ওপরের পিঠ চুলকে দেবো না, নিজেরদের কুয়োতেই নিজেরা কাঁকড়া হবো না। রোজ ভাবি।
নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী ‘উলঙ্গ রাজা’ বলে একটি কবিতা লিখেছিলেন৷ আমি ও পড়েছিলাম। কিন্তু তা ও রাজার গুকেই গুলাব জামুনসম ভেবেছিলাম, নগ্নতার খবর ধামাচাপা দিয়ে রোজ মন্দির মসজিদ খেলে যাচ্ছি। আসলে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখকর সুর মাসের শেষে ওই এটিএম থেকে টাকা বের হওয়ার শব্দ। পাঁচ অক্ষরের সবচেয়ে মনভালো করা গল্প, Your Salary has been credited।
সুতরাং নীরেন বাবুকে নিয়ে আমার খুব বেশী কিছু লেখা পায়না। যেমন মুকুলের সবসময় হাসি পায়না, ভারতের ৬০% লোক দুবেলা খেতে পায়না, নিম্ন মধ্যবিত্ত বিনাপয়সায় প্রাথমিক শিক্ষা ও স্বাস্থ্য পায়না, সরকার কালোটাকার হদিশ পায়না, বাঙালি ৪৫’ এ নেতাজীর কি হয়েছিল তা জানতে পায়না।
আমরা খুব মধ্যমেধার মানুষ। রোদ্দুরকে স্পর্শ করার স্পর্ধা নেই আমাদের। একটাও ইংরেজি শব্দ ব্যবহার না করে টানা বাংলা বলতে হোঁচট খাই। বানান ভুল করি, চুকলি করি, দালালি করি, অখাদ্য কুখাদ্য কিছু ছড়া লিখে, ছবি বানিয়ে জিজ্ঞেস করি, কেমন হে? আর স্তাবক পার্টি মস্ত বড় বড় কথা ছাপে দেওয়াল জুড়ে। এরই মধ্যে কোন পুঁচকে যিশু বেড়ে খেলতে গেলে তার পাতা কেটে দেওয়া আবশ্যক৷ তারপর ফের দল বেঁধে সাধু সাধু। ক্রমে স্পষ্ট হয় সব। কে সিংহ, কুকুর, হাতি, সার্কাসের ঘোড়া; কে টিয়া, চন্দনা, কিংবা হাঙর কুমির।
ভাগ্যিস ওই কাগজে কালিতেই ওসব কাপড় কোথায় ফোথায় জিজ্ঞেস করার পাট চুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এখন হলে মাওবাদী, রাষ্ট্রবিরোধী, উন্নয়ন দেখতে না পাওয়া, প্রধানমন্ত্রীকে খুনের চক্রান্ত করা, পাকিস্তান প্রেমী গরুখেকো বলে জেলে পচানো হতো৷
তখন অবশ্য আমাদের ইরাবতীর চুপকথা দেখার সময়। তারপর হিরো আলমের একটা ভিডিও দেখতে দেখতে ভাগাড়ের মাংস খাওয়া। ক্যান্সার কিসে কিসে হয় তার উপর টকশো এর রিপিট চালু রেখেই কিছু ফেক নিউজ তেরোটা গ্রুপে ফরোয়ার্ড করা, তারপর ঘুম। এরই মাঝে ডানা ঝপটিয়ে নিখিল শূণ্যের দিকে উড়ে চ’লে গেল এক সুন্দর মানুষ।
“সে যেমন আসে, ঠিক তেমনি চলে যায়। গল্পে, গানে, ঠোঁট-ফোলানো অভিমানে, প্রকাণ্ড ঠাট্টায় সব-কিছু ভাসিয়ে তার যাওয়া”। একটা বড়দিনে৷
( মতামত লেখকের ব্যক্তিগত )