সাদামাটা এক ছাপাখানায় অবসরের পর ও হাজার দুয়েক আয় হবে বলে কাজ করতো এক দাদু। বাড়ি ফেরার সময় ময়লা প্যান্টের পকেট থেকে দশটা টাকা বের করে ছটা গুজিয়া কিনে আনতো নাতির জন্য। বড়দিনে বালিশের নিচে রেখে দিত সুগন্ধি রবার, রঙ পেন্সিল, অনেক গুলো মন ভালো করে দেওয়া হজমিগুলি। নাতি ঘুমোতে যাওয়ার আগে দিদার কাছে শুনতো সান্তা ক্লসের গল্প, রাজকন্যার গল্প, ঠাকুমার ঝুলির গল্প। মাথায় হাত বুলিয়ে দিত দিদা।
বছর দশেক পর, দিদার মারা যাওয়ার পর পরই দাদু মারা গেছিল। নাতির সেদিন সেমিস্টার। যেতেই হত। ঘাট কাজ সেরে ফেরার পর, দাদুর আলমারি খুলে এ জিনিস ও জিনিস ঘাঁটতে গিয়ে এক দিস্তে হলদে কাগজ বেরিয়ে এসেছিল। নাতির করা হিজিবিজি, রঙ পেন্সিল দিয়ে আঁকিবুঁকি, অনেক বছরকার।
পুজোয় কক্ষনো বাবার কিচ্ছু দরকার হত না। বাবার সব ছিল। দেখা যেত না যদিওবা। কাঁচভাঙা চিনে মোবাইলে সেলোটেপ লাগানো, একাধিক সেলাই করা একটাই চামড়ার জুতো, কনফারেন্স এ পাওয়া কাঁধের ব্যাগ। সেই ব্যাগ থেকেই ছেলের জন্য একদিন বের করেছিল একটা ল্যাপটপ। উত্তেজিত ছেলে একবার ও জানতে চায়নি এলআইসির কাজ করে বাবা কিভাবে কিনলো ও জিনিস। বিশ্বাস করেছিল সান্টা আছে কোন এক দেশে। ঠিক চলে আসে এ সময়। দামী কিছু নিয়ে।
মা কখনো চাকরি করেনি। তবু ও নানা রকম খেলনা কিনে দিত। স্কুল থেকে ফেরার পথে আইসক্রিম, বুড়ির চুল, আলো জ্বলা জুতো, ক্যাম্বিস বল, রহমানের ক্যাসেট।
দাদাভাই তো দিনভর ঝগড়া করতো। চুল ধরে টানতো, আমি ও দিতাম ঘুষি। একদিন খুব কেঁদেছিলাম সন্ধেবেলা। আসলে ভোম্বল কিছুতেই ব্যাটিং দেবে না বলেছিল। ও রোজ ব্যাট আনতো। আমায় তো বল কেনার টাকাও দিত না বাবা। আমি লজ্জায়, অপমানে একটানা ফিল্ডিং করেছিলাম। দাদা সবটা দেখেছিল। বড়দিনে কে যেন একটা ক্রিকেট ব্যাট উপহার দিয়েছিল আমায়। এরপর আর কোনদিন দাদার সাইকেলটা চোখে পরেনি। বাবাকে বলেছিল চুরি হয়ে গেছে। থাপ্পড় ও খেয়েছিল। মুচকি হেসেছিল স্রেফ।
বোন বরাবর খুব চুপচাপ। বন্ধু ও ছিল না সেরকম। খালি পড়াশোনা করতো আর দাদাকে দেখতো আড্ডা মারছে, গান লিখছে, প্রেম করছে। মাধ্যমিক এ বোন প্রথম হয়েছিল। দাদা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে, একটা সেমিস্টারে ফেল করেছে, স্যার গাঁজাখোর বলে, বাকিরা Loser। মাধ্যমিকের রেজাল্ট এর দিন, টিভিতে বোনের ইন্টারভিউ দেখেছিল দাদা। বোনকে সাংবাদিক প্রশ্ন করেছিল, তোমার আইডল কে? মেয়েটা চকচকে চোখে বলেছিল, দাদা। আমার আইডল আমার দাদা। টিভির ওপারে loser এর গলার কাছে কি যেন আটকে তখন।
O Henry’s “Gift of the Magi” এর গল্প মনে আছে? বরের সামান্য আয়, বউ এর সাদামাটা শখ দামী এক চিরুনি কেনার। ঘন লম্বা চুলের জন্য। বরের ও একটা দরকার ছিল। শখের ঘড়িটার স্ট্র্যাপ বদলানোর। দুজনেরই শখ পূরণ হয়েছিল। তবে বউ নিজের চুল বেঁচে দিয়ে বরের ঘড়ির স্ট্র্যাপ কিনেছিল আর বর ঘড়িটাই বিক্রি করে বউ এর চিরুনি কিনেছিল। সান্টাকে ওরা কেউ দেখেছিল বলে মনে হয় না।
আপনি সান্তা ক্লসকে কখনো চাক্ষুষ দেখেছেন পাড়ায়? ছুঁয়ে দেখেছেন কাছ থেকে ওই নরম লাল কোট, সাদা তুলো? দুটো কথা বলেছেন ওর ভাষায়?
সান্তা ক্লস আমাদের চার দেওয়ালেই আছে। পাজামা পরে, নোংরা শাল জড়িয়ে, হলুদ মাখা আঁচলে, সিঁদুর, সোহাগ এ। ওদের বড়দিন লাগেনা মন ভালো করতে। কেক লাগেনা, ঘন্টা লাগেনা, লাল টুপি, স্লেজ গাড়ি, Elf লাগেনা। এরা রোজ নিজের সন্তানদের একটা দিনবদলের গল্প বলে, একটা সুন্দর সকাল উপহার দেয়, ফেলে আসা দারিদ্র্য ঢেকে দেয় রকমারি বেলুন, লজেন্স, রামধনুতে।
আমাদের মা, বাবা, দাদু, দিদা, দাদাভাই, বোন কেউ প্যালেস্টাইন, সিরিয়া, হামাস, আইসিস, মানববোমা, যুদ্ধ জাহাজ, আংকেল স্যাম এর গল্প বলে না। বাবা মায়ের ধর্ম আধপেটা খেয়ে মোজা ঝুলিয়ে রাখা, উপহার দিয়ে যাওয়া সান্টার নাম করে, একটা ঝলমলে সকাল উপহার দেওয়া সন্তানকে।
পৃথিবীর সব মৃত বাবা মা ই চেয়েছিল সন্তানের কপালে চুমু খেয়ে যেতে। সান্টা ক্লস সাজতে, বন্দুক, আফিম, ড্রাগস এর বদলে কেক, পেস্ট্রি রেখে যেতে।
আসুন রোজকার জীবনের এই সান্টা ক্লস, ওই সুপার হিরোদের ভালোবাসি, ভালো করে দুটো কথা বলি। কাজ না হয় পরে হবে, চাকরি ও হবে। দু চার কথা বলি, মাথায় হাত বুলিয়ে দিক সান্টা।
( মতামত লেখকের ব্যক্তিগত )