কাগজের ব্র্যান্ড ভ্যালু বাড়ানোর জন্য কৃতী ছাত্রছাত্রীদের প্রতিভা বৃত্তি দেওয়ার ব্যবস্থা করেছেন সরকার বাড়ির বাবুরা। অথচ বছর শেষে নিজেদের কাগজের প্রতিভাবান এবং পরীক্ষিত ১৬জন সাংবাদিককে বিনা অপরাধে বরখাস্ত করতে তাদের বুক কাঁপল না। বন্ধ হয়ে যাচ্ছে সাদা বাড়ি কালো গ্রিল থুড়ি কালো মন থেকে প্রকাশিত হওয়া এবেলা নামে ট্যাবলয়েডটি। আগামী শনিবার থেকে এই দৈনিকটি আর প্রকাশিত হবে না। এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে কোন প্রতিবাদের বুদবুদও ওঠেনি। রাজনৈতিক দল থেকে সাংবাদিক সংগঠন সবাই নীরব। মানুষ তো ছাড়, বাড়ির পোষা কুকুর, বেড়ালের জন্য সোশ্যাল মিডিয়ায় থেকে থেকে যারা ডাক ছেড়ে কেঁদে ওঠেন সরকার বাড়ির সেই সংবেদনশীল সাংবাদিককুল তাদের সহকর্মী সাংবাদিক ও চিত্রসাংবাদিকদের প্রতি এই অন্যায়ের প্রতিবাদে এখনও মুখ খোলেননি। এমনকি ব্যাক্তিগতভাবেও কর্মচ্যুত বন্ধু ও সহকর্মীদের কাছে ডেকে কোন সমবেদনা জানান নি।
শুনলাম একেবারে শেষবেলায়, হয়তো খানিকটা পাপবোধের তাড়নাতেই বরখাস্ত সাংবাদিকদের মধ্যে থেকে যাতে অন্তত পাঁচজন চিত্রসাংবাদিককে না পড়লে পিছিয়ে হয় কাগজে নেওয়ার জন্য দরবার করতে গিয়েছিলেন সরকার বাড়ির এখনকার সাংবাদিকদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বেতনভুক দুজন কর্মচারী। বাড়ির এখনকার দণ্ডমুণ্ডের কর্তা তখন ফলাহার করছিলেন। পেয়ারায় কামড় দিয়ে ঠাণ্ডা গলায় তিনি তাদের জানান আমরা যা করেছি তা ভেবেচিন্তেই করেছি, আপনাদের এ নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে না। নিন, পেয়ারা খান। এরপর সেই পেয়ারা তাদের গলা দিয়ে নেমেছিল কিনা আমি জানিনা। এও জানিনা, এই ধমকের পর তারা আর কথা বাড়িয়েছিলেন কিনা।
চিত্রসাংবাদিক হিসেবে আনন্দবাজার ও এবেলা পত্রিকায় দীর্ঘদিন কাজ করেছি আমি। সাদা বাড়ির লোকেদের কালো মনের পরিচয় আমি পেয়েছি বহুবার। বিশেষকরে চিত্রসাংবাদিকদের প্রতি এদের আচরণ বরাবরই বেশ অদ্ভুত ও অমানবিক। কোনো ভাবে এ বাড়িতে চিত্রসাংবাদিক হিসেবে যোগ দিলে প্রথমেই তাকে জিজ্ঞেস করা হয়, ক্যামেরা, লেন্স এসব আছে তো? আমরা কিন্তু ওসব দিতে পারবো না। ভালো করে মন দিয়ে কাজ কর, পরিশ্রম কর, আমরা ঠিক তোমায় নিয়ে নেব। খুড়োর কলের মত তাদের চোখের সামনে প্রতিশ্রুতি ও আশ্বাসটুকু ঝুলিয়ে রেখে কার্যোদ্ধার করেন মালিকের পদলেহী সাংবাদিক নামধারী একশ্রেণীর দালাল।
এই প্রতিশ্রুতি পাওয়ার পরই কর্মযজ্ঞে ঝাঁপিয়ে পড়লেন সদ্য যোগ দেওয়া চিত্রসাংবাদিকটি। তার কোন ছুটি নেই, তার পরিবার পরিজন থাকতে পারে না, তাকে শুধু জগৎসংসার ভুলে ছবি তুলে যেতে হবে। পুরনো দিনে কলকাতার স্টুডিওগুলোর সাইনবোর্ডে লেখা থাকতো দিবারাত্র ছবি তোলা হয় এ ব্যাপারটাও অনেকটা সেইরকম। নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই একথার সত্যতা জানি। সরকার বাড়ির চিত্রসাংবাদিকটির আর কিছুই করার নেই, প্রতিবাদ করার কথা ভাবলেই ভেসে উঠবে তার ওপর নির্ভরশীল পরিবার পরিজনদের মুখ। ওদের মুখে একটু হাসি দেখতে হলে এটুকু তো করতেই হবে। ১০-১২-১৪-১৬বছর পর কপাল ভাল হলে কেউ রিটেইনারশিপ পান। ব্যস, এতদিন পর একেবারে এলেবেলে ব্যাপার থেকে তিনি একটা চুক্তিতে এলেন। ২৭-২৮বছর ঘষার পর হাজিরা খাতায় কারও নাম ওঠে, মানে তার চাকরি হয়। কিন্তু যে সময়কাল ধরে তিনি চাকরি করেছেন সেটা দেখানো হয়না, দেখানো হয় বড়জোর ১০ থেকে ১২বছর তিনি চাকরি করেছেন। কোন পেনশন নেই। অনেকের ভাগ্যে এটুকুও জোটে না।
আমার বন্ধুদের মধ্যে অনেকেই দীর্ঘদিন কাজ করার পরেও স্রেফ রিটেইনার হয়েই বিদায় নিয়েছেন। অথচ খবরের কাগজের জন্য তেমন কোন ছবি না তুলে শুধু মালিকের বাড়ির কাজ করলেও এখানে অবসরের বয়স পেরিয়ে গেলেও কাজ করা যায়। এমনকি তারা বছর বছর এক্সটেনশনও পান। অনেকে লিফট ছাড়া একতলা থেকে দোতলায় উঠতে পারেন না। জেলার অবস্থা তো আরও খারাপ। যাতায়াতের খরচ বাবদ যা দেওয়া হয় তাতে মোটেই কুলোয় না। তার জন্য বেতনের ওই সামান্য টাকাই ভরসা। যাতায়াতের খরচ সবাই পান না, সামান্য মোবাইল বিলও আটকে দেওয়া হয়। অথচ ব্যয়সঙ্কোচের ধুয়ো তোলা এই কাগজে অনেক নড়াচড়া না করতে পারা চিত্রসাংবাদিকও বছরের পর বছর বেতন পেয়ে চলেছেন। এখানে কার যে কোথায় বাবু ধরা আছে তা বোঝা সত্যিই মুশকিল।
এ বাড়ির মহিমা অপার। এখানে ঢুকলে মানুষ বদলাতে থাকে। ৩হাজার টাকা মাইনেতে জীবন শুরু করার সময় যে সাংবাদিক বিপ্লবী ছিলেন মাইনে লাখ ছুঁতে না ছুঁতেই তিনি ম্যানেজমেন্টের প্রিয়পাত্র হওয়ার চেষ্টা করেন। মাইনে লাখ তিনেক ছুঁলে তিনি তো একেবারে পাক্কা ম্যানেজমেন্টের লোক। বলেন কম, শোনেন বেশি, মুখে থাকে স্মিত হাসি। কেউবা অকারণে গম্ভীর হয়ে যান। মাইনে বাড়ার পর দানধ্যান না বাড়লেও কারও আবার জ্ঞানদান বেড়ে যায়। এই মুহূর্তে সরকার বাড়ির সাংবাদিকদের যারা পরিচালনা করছেন তাদের প্রত্যেককে আমি ব্যাক্তিগতভাবে চিনি তারাও আমায় বিলক্ষণ জানেন। তারা সত্যিই সাংবাদিক হিসেবে সফল। কিন্তু সহকর্মীদের প্রতি তাদের কোনরকম সহমর্মিতা নেই, এটা যেন এ বাড়িরই এক ধর্ম। তাদের সব বড় বড় কথা শুধু সোশ্যাল মিডিয়ার জন্য তোলা থাকে। এবারের ঘটনাতেও সেটা আবার প্রমাণিত হল। নিজেদের কর্মস্থলে এতবড় অন্যায় নিয়ে তারা এখনও একটি শব্দও খরচ করলেন না।
লিখতে লিখতে মন খারাপ হয়ে যাচ্ছে কী করবে, কোথায় যাবে এরা? আমি জানি এদের অনেকেই চিত্রসাংবাদিক হিসেবে খুবই গুণী এবং প্রতিভাবান। মুখের কথায় স্রেফ এরা প্রত্যেকেই এইচআর এর কাছে রেজিগনেশন লেটার দিয়ে দিয়েছেন। আমি জানিনা এভাবে রেজিগনেশন লেটার দেওয়া আইনসম্মত কিনা? হয়তো দেখা যাবে কোম্পানির সঙ্গে এগ্রিমেন্টের চিঠিতে এটাই লেখা আছে। জানি লেবার কোর্ট আছে, কিন্তু কে মামলা করবে বলুন তো? কারও ঘরে বৃদ্ধ বাবা-মা, কারও গর্ভবতী স্ত্রী, কোন বাড়িতে বাবার মুখ চেয়ে বসে থাকে স্কুলে পড়া ছেলে মেয়ে। সাধারণভাবে খবরের কাগজের অফিসে সাংবাদিকদের ইউনিয়নগুলি মালিকদের তোষামোদ করে বেঁচে আছে। স্বাভাবিকভাবেই তারা এ প্রশ্নে নীরব। এতকিছু খারাপের মধ্যে শেষমেশ একটা ভাল খবর পেলাম, তা হল সরকার বাড়ির বাবুরা তাদের তাড়িয়ে দেওয়া কর্মীদের কাছ থেকে ক্যামেরা ও লেন্স ফেরৎ নেবেন না। নাকের বদলে নরুণ পেলেন তারা। কিন্তু যে ক্ষতি তাদের হল এতে কী তা মিটবে?
শতবর্ষের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছনো একটি কাগজে কী অকারণে কর্মচ্যুত এই সাংবাদিক, চিত্রসাংবাদিকদের কর্মসংস্থানের কোন পরিসর সত্যিই ছিল না? ক্ষুব্ধ কর্মীরা যদি এর প্রতিবাদে কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কবিতার একটা লাইনের মতই বলে ওঠে, … সে অন্নে যে বিষ দেয় কিংবা তাকে কাড়ে/ ধ্বংস কর ধ্বংস কর ধ্বংস কর তারে। তাহলে তা কী প্রতিষ্ঠানের ব্র্যান্ড ভ্যালুকে স্পর্শ করবে না? আসুন, যে যেভাবে পারি এবেলার কর্মচ্যুত সহকর্মীদের পাশে সহমর্মী হয়ে দাঁড়াই।
( মতামত লেখকের ব্যক্তিগত )