একটু ফ্ল্যাশব্যাকে হাঁটলেই সহজেই ফিরে যাবেন আটই নভেম্বর দুহাজার ষোলর সন্ধ্যেতে। দেশবাসীর স্বার্থে আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী আকস্মিক এবং সম্পূর্ন অপ্রত্যাশিতভাবেই পাঁচশো, হাজার টাকার নোট ব্যান করেছিলেন। তার পরবর্তীতেই রেডিওতে তাঁর মন কি বাত শুনে তামাম দেশবাসীর মতোই নিশ্চয় আপনার ও নিজেকে ছাপান্ন ইঞ্চির সিনার মালিক মনে হয়েছিলো। নোটবন্দীতে পদপিষ্ট সহ অন্যান্য কারনে মৃত একশো ষাট জনের পরিবারের হাহাকার কে নিশ্চয় আপনার কুম্ভীরাশ্রু মনে হয়েছিলো। প্রধানমন্ত্রীর ভাষনে “আশায় মরে চাষার” মতো নিশ্চয় আপনারও হয়তো মনে হয়েছিলো, যে মরছে মরুক, আমার তো নিশ্চয় ‘আচ্ছে দিন এসে গেছে’।
তার ঠিক ছয়দিনের মাথায় বিজেপি সভাপতি অমিতশাহ পরিচালিত আমেদাবাদ ডিস্ট্রিক্ট কো-অপারেটিভ ব্যাঙ্ক এ জমা হলো সাতশো পঁয়তাল্লিশ কোটি উনষাট লক্ষ টাকা। গুজরাতের ক্যাবিনেট মন্ত্রী তথা রাজকোট ডিস্ট্রিক্ট কো-অপারেটিভ ব্যাঙ্ক এর চেয়ারম্যান জয়েশভাই ভিঠলভাই রাজারিয়ার ব্যাঙ্কে জমা হলো ছয়শো তিরানব্বই কোটি উনিশ লক্ষ টাকা( উভয় তথ্য সমাজকর্মী মনোরজ্ঞন এস রায়ের আর টি আই এর ভিত্তিতে নাবার্ডের জেনারেল ম্যানেজারের দেওয়া)।এই দিনই একটু পরে আশ্চর্য জনক ভাবে কো-অপারেটিভ ব্যাঙ্ক গুলোর পুরোনো নোট জমা নেওয়ার ওপরে নিষোধাজ্ঞা জারি হলো।
কয়েকদিনের মধ্যেই বাতিলকৃত পাঁচশো-হাজার নোটের নিরানব্বই শতাংশ ব্যাঙ্কের কাছে ফিরে এলো। আপনিও প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতিলব্ধ পনেরো লক্ষ টাকা পাবার আশায় ব্যাঙ্ক -পোষ্টাপিস এ ঘুরে ঘুরে জুতোর শুকতলা খুইয়ে উপলব্ধি করলেন যেকোন সদর শহরে এস বিআই এর মতো রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাঙ্কের সব কটি এটিএম একসাথে একদিন ও সচল থাকেনা, পোষ্টাপিসে বেশীর ভাগ সময় ই লিঙ্ক স্লো, কোনও কোনদিন লিঙ্ক পুরোটাই ডাউন।
বুকের কোনে একটা চিনচিনে গোপন ব্যথা নিয়ে আপনি বাড়ী ফিরে এলেন। নিজেকে অন্যমনস্ক রাখতে টিভির বাটন টিপতেই দেখলেন প্রধানমন্ত্রী এখন নিজেই পেটিএম এর ব্রান্ড অ্যাম্বেসডর।
আস্তে আস্তে বুকের ব্যথা বেড়ে চললেও আপনি যে একশতাংশ পাঁচশো-হাজার টাকার ফেরৎ আসেনি তা জেহাদী, কালোবাজারীদের ভেবেই নিজেকে শান্ত করে চললেন। আমার মতো, পুরুলিয়ার গ্রামীন মানুষের অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তিকরন( Rural Financial Inclusion) এর গবেষকদের সমীক্ষার ভিত্তিতে উপলব্ধ মতামত সমূহকে ফেসবুকে গালিগালাজ দিয়ে ভেবে চললেন সত্যিই দেশ হয়তো এগিয়ে চলেছে, এখনো বোঝা যাচ্ছেনা।
কিন্তু কি জানেন স্যার,এই একশতাংশ টাকা ফেরৎ না আসা সম্পর্কে আমার অভিমত আরো একবার স্পষ্ট হয়ে গেছে, বিগত ২৬/১১/২০১৮ তে আমার জেলা পুরুলিয়াতে মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীর প্রশাসনিক সভাতে। এই সভাতে আরো একবার পরিস্কার হয়ে গেছে ব্যাঙ্কের ভ্রান্ত-নীতি, রাজনীতিকরন আর গাফিলতির কারনে পুরুলিয়ার ১৭০ টি গ্রামপঞ্চায়েতের মধ্যে ৮৪ টি তে এখনো পর্যন্ত কোন রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাঙ্কের শাখা নেই, সিএসপি গুলির টাকা ডিস্ট্রিবিউশনের পদ্ধতিও সঠিক নয়। আমার জেলা পুরুলিয়াতে নোটবন্দীর পরবর্তী ধাক্কা সামলে যখন প্রান্তিক কৃষক,খেতমজুরদের স্বার্থে মাননীয় জেলাশাসকের নেতৃত্বে বিয়াল্লিশ শতাংশ থেকে একবছরে আশি শতাংশ অবধি কৃষক কৃশান ক্রেডিট কার্ড পাওয়ার অপেক্ষাতে রয়েছে, ঠিক তখনই দেখা গেলো কোন এক অলক্ষ্যনীয় কারণে এই কৃষকদের মধ্যে প্রায় একলক্ষ্যের কৃষাণ ক্রেডিট কার্ড আজ ও আটকে রয়েছে।গত ছাব্বিশ এ নভেম্মবরের প্রশাসনিক বৈঠকে ততক্ষনাৎ মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পুরুলিয়ার জেলাশাসক শ্রী অলোকেশ প্রসাদ রায় কে দায়িত্ব দিয়েছেন, জেলাশাসকের নেতৃত্বে পুরুলিয়া জেলা সেন্ট্রাল কো-অপারেটিভ ব্যাঙ্কের উদ্যোগে এবার আটকে থাকা প্রায় এক লক্ষ্য কৃষান ক্রেডিট কার্ড তৈরী হবে, চুরাশি টি পঞ্চায়েতে সেন্ট্রাল কো-অপারেটিভ ব্যাঙ্ক এর মাধ্যমে গ্রামীন মানুষের অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তিকরন
( Rural Financial Inclusion) এর ভিত্তি সুদৃঢ় হবে।
এবার নিশ্চয় বুঝতে পারছেন, যে এক শতাংশ পাঁচশো- হাজার টাকার নোট ফেরৎ আসেনি, তা জেহাদীদেরও নয়, কালো বাজারীদেরও নয়। আমি-আপনি প্রায়দিনই পাঁচশো টাকার নোট জোর করে গুঁজে দিয়ে যে সব্জীওয়ালী মাসীর কাছে খুচরো নিয়েছি, সারা দেশ জুড়ে এই একশতাংশের সিংহভাগ তাদেরই। এদের অধিকাংশের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট নেই,বাড়ীর থেকে কয়েক কিলোমিটারের চৌহদ্দীতে ব্যাঙ্ক নেই, শহরের ব্যাঙ্কে যাবার সামর্থ-শারীরিক সক্ষমতা নেই। তাই দুহাজার ষোলর নভেম্বরের শীতের পরবর্তীতে কনকনে ঠান্ডাতে এরকমই সারা দেশেই সব্জীওয়ালী মাসী বা তার নবতিপর স্বামীর একটা বড় অংশ একশো ষাট জন মৃতর তালিকাতাতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে। ব্যতিক্রম শুধু পশ্চিমবঙ্গ; মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী নোটবন্দীর পরবর্তী সমুয় থেকে বাংলার প্রান্তিক মানুষের স্বার্থে সবসময় পাশে থেকেছেন।গত ছাব্বিশে নভেম্বর ও পুরুলিয়ার প্রান্তিক কৃষকের স্বার্থে দেশ জোড়া বিফল ব্যাঙ্কিং ব্যবস্হার সামনে অগ্রগতির হাতিয়ার হিসেবে-কো-অপারেটিভ ব্যাঙ্ক কে সারা দেশের সামনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একটা নজির তৈরী করে দেখালেন। আপনি ও পারবেন তো,আঙ্গুলের এক টোকাতে আগামী দুই হাজার উনিশের দেশজোড়া লোকসভা নির্বাচনে প্রতিশ্রুতির মুখোশভরা নরেন্দ্রমোদীর মিথ্যায় ফুলে থাকা ছাপান্ন ইঞ্চির ফানুশ আপনার রোজ খাবারের স্বার্থে,খাবারের যোগানদাত্রী সব্জীওয়ালা মাসীর পরিবারের সুরক্ষার স্বার্থে চুপসে দিতে?
(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)
লেখক পরিচিতি- সিধো-কানহো বিরসা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিবন্ধীকৃত পুরুলিয়ার গ্রামীন মানুষের অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তিকরন( Rural Financial Inclusion)এর গবেষক।