ভোট এলে রাম মন্দির আসে, ভোট এলে অযোধ্যা খবরে আসে। ভোট এলে ধর্মীয় মেরুকরণ বাড়ে। ২০১৯ র লোকসভা ভোট শিয়রে, আবার ভারতের রাজনীতি সরগরম হচ্ছে রাম মন্দির ইস্যুতে। ভোগী যোগীরা ঘাঁটি গাড়ছে অযোধ্যায়। যেন রাম মন্দির ছাড়া আর কোনো ইস্যুই নেই ভারতে। বড় রামের মূর্তি বসছে সরকারি টাকায়।
একবার ফিরে যান ২০১৪ লোকসভা ভোটের প্রচারে। প্রচারের মূল সুর কি ছিল? ভারতবাসী কংগ্রেসকে ছুঁড়ে ফেলল কেন? মোদি এত বড় নেতা হল কিভাবে?
ভারত ভুগছিল নীতি পঙ্গুত্বে। কংগ্রেসের একের পর এক দুর্নীতিতে সাধারণ বিরক্ত হয়ে উঠেছিল। ছিল শক্তিশালী নেতার অভাব। চোখের সামনে আঁধার দেখা যুব সমাজ মোদি নামের আলোর সন্ধান পেয়েছিল। বেকারত্ব কমবে, ফিরবে কালোটাকা। পথে ঘাটে মা-বোনেরা সুরক্ষিত থাকবে। শিল্পে জোয়ার আসবে, ‘আচ্ছে দিন’ আসবে ঘরে ঘরে। কমবে পেট্রোলের দাম, কমবে গ্যাসের দাম, বাড়বে টাকার দাম- স্বপ্ন ছিল সাধারণের চোখে মুখে। ভোট প্রচারে মূল স্লোগান ছিল ‘সবকা সাথ, সবকা বিকাশ’। অর্থাৎ উন্নয়নকে সামনে রেখেই সাম্প্রদায়িক মোদিকে মানুষ ‘বিকাশ পুরুষ’ মোদি হিসাবে গ্রহণ করেছিল।
কিন্তু কি হল? কোন স্বপ্ন পূরণ হয়েছে নাগরিকদের? বেকারের চাকরি পাওয়া দূরে থাক, বেড়েছে বেকার সমস্যা। শিল্পের গতি শ্লথ, মোদির একাধিক ঐতিহাসিক ভুলে ধুঁকছে অর্থনীতি। কালো টাকা ফেরত আনা তো হলই না, ব্যাংকের টাকা মেরে বিদেশে উধাও হয়ে গেল শিল্পপতিরা। একের পর এক শিল্পপতির ঋণ মুকুব করে দেওয়া হচ্ছে, এদিকে আত্মহত্যা করছে চাষিরা। দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ সঁপে দেওয়া হচ্ছে ক্রোনি ক্যাপিটালিস্টদের পায়ে, এদিকে মাত্র কয়েক হাজার টাকা ঋণ মুকুবের দাবিতে কৃষকরা রাস্তায় নামছে, পুলিসের গুলিতে মরছে। ডিমানিটাইজেশন, জিএসটির কারণে ধুঁকছে নানা ছোটো শিল্প, অসংগঠিত শ্রমিকদের দুরবস্থার শেষ নেই। কাজ হারিয়েছেন অনেকেই। আক্রান্ত হচ্ছেন দলিত-আদিবাসীরা, আক্রান্ত মহিলারা। সংখ্যালঘুরা আতঙ্কে, চারিদিকে ভয়ের পরিবেশ। গ্যাসের দাম বেড়েছে অনেকটা, পেট্রোল-ডিজেলের দামের কথা না বলাই ভালো। দাম কমেছে টাকার। ২০১৪ য় যা বলা হয়েছিল, হয়েছে ঠিক তার উল্টো। ধর্ম নিয়ে রাজনীতি হবে না, কথা ছিল তেমনই। কিন্তু ক্ষমতায় আসার পরই বদলে গেল সরকারের অভিমুখ। ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতাই সব, ধর্ম ধর্ম করে মাতিয়ে রাখা হয়েছে যুব সমাজকে। পেটের ক্ষিদে ভুলিয়ে ধর্ম গেলানো হচ্ছে। তাই রাম মন্দির ইস্যু আবার সামনে। বিজেপি জানে, উন্নয়ন ইস্যুতে ভোটে লড়া সম্ভব না, মুখ থুবড়ে পড়বে দল। তাই আরও নোংরামো, আরও বাড়ানো হচ্ছে সাম্প্রদায়িকতার ডোজ। চড়ছে সুর, হিন্দুত্ব বাহিনীর আস্তানা এখন অযোধ্যা।
হিন্দুদের কাছে কটা প্রশ্ন। ২০১৪ র পর ভোটের পর কি লাভ হয়েছে হিন্দুদের? চাকরি বেড়েছে? জিনিসপত্রের দাম কমেছে? ইনকাম বেড়েছে? বেকারত্ব কমেছে? ফসলের দাম বেড়েছে? শ্রমিকের মাইনে বেড়েছে? চাষি মৃত্যু কমেছে? নারী নির্যাতন কমছে? দুর্নীতি কমেছে? কালো টাকা ফেরত এল? ব্যাংক একাউন্টে ১৫ লাখ ঢুকেছে? বছরে ২ কোটির চাকরি হয়েছে? শিল্পে জোয়ার এসেছে? ছেলেমেয়ের পড়াশোনার খরচ কমেছে? চিকিৎসার খরচ কমেছে?
হিন্দুরা এক্সট্রা কি পেল? হিন্দুদের জন্য আলাদা করে গ্যাস-পেট্রোলের দাম কমেছে? বিজেপির আইটি সেল প্রোপাগ্রান্ডা করার জন্য কাজ দিয়েছে কিছু যুবককে। এর বাইরে?
রাম মন্দির হাওয়ায় উড়ে গিয়ে নিজেদের সর্বনাশ কেন করছেন? পাঁচ বছরে শিক্ষা হয়নি? দৈনন্দিন সমস্যা ও সমাধান ইস্যুতে কথা বলুন। রাম মন্দির ও সাম্প্রদায়িকতায় ভুলে থাকলে আপনার-আমার ক্ষতি, শুধু বিজেপির লাভ। এটা কবে বুঝবেন? রাম মন্দির হলে আপনার লাভ কি? চোখ বুজে একবার ভেবে দেখুন।
আপনি হিন্দু-মুসলিম যাই হোন, উন্নয়ন ইস্যুতে কথা বলুন। রাজনীতিকে রাজনীতির জায়গায় ফিরিয়ে আনুন, এটা আমাদের সবার দায়িত্ব। ক্ষিদে বেশি দিন ধর্ম দিয়ে ভুলিয়ে রাখা যায় না।
( মতামত লেখকের ব্যক্তিগত )