হাই ডেফিনেশন ক্যামেরাটা সাইডলাইনের ধারে ডাগ আউটে বসে থাকা লোকটার ওপর ফোকাস করল। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে ওয়ার্ম আপ করা মুখটায় বিন্দু বিন্দু ঘাম ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে আর হাঁটুর ওপর থেকে নীচ পর্যন্ত একটা সোজাসুজি গভীর কাটা দাগ, যা এখনও মেলায়নি। চোখের দিপ্তী যেন হাজার ওয়াটের আলো। আর অপেক্ষা, শুধু কোচের অনুমতির।
মনে তখনও বোধহয় ফ্ল্যাসব্যাকে ঘুরপাক খাচ্ছে এই যুবভারতী, যেখানে বাংলাদেশের ধানমুন্ডীর হয়ে খেলতে আসা ছেলেটা হেরে গিয়েও চোখে পড়ে গেছিল মোহনকর্তাদের, পরের মরসুমেই সাইন মোহনবাগানে। এ যেন এক নতুন অধ্যায়ের শুরু।
বিশ্ব ফুটবল বদলেছে, তাই নব্য ফুটবল বোধহয় এখন ডান পায়ের উইঙ্গারকে বামপ্রান্তে খেলানোর কথা বলে, সোনি নর্ডিরও পছন্দের জায়গা সেটাই, মোহনবাগানে শুরুও সেখান থেকেই। কিন্তু রাজাধিরাজের সাম্রাজ্য যে সীমাহীন। কখনও ডানপ্রান্ত, কখনও ডাউন দা মিডিল রান, কখনও নীচে নেমে এসে ডিফেন্সকে সাহায্য করা, কখনও বিপক্ষের ডিফেন্স চেরা থ্রু, কখনও মাপা সেন্টারের আ্যসিস্ট আবার কখনও পিন পয়েন্টেড ফ্রি কিক্। আর লেফ্ট উইয়ে দু তিন জন ডিফেন্ডারকে আউটস্টেপ ইনস্টেপে কাটিয়ে, গেলকিপারকে সামনে এনে সেকেন্ড পোস্টে প্লেস ? এটাই তো সনি নর্ডির সিগনেচার।
এই সুন্দর ফুটবল বৈচিত্রের জন্যই ডার্বি গোলের পর বন্দুকের একটা গানশট নয়, বরং স্টেইনগানের হাজার গুলির সেলিব্রেশন।
এরপর ভারত সেরার তকমা। আইলীগ চ্যাম্পিয়ন, রানার্স, ফেডারেশন কাপ চ্যাম্পিয়ান, প্রথম ভারতীয় দল হিসেবে এ এফ সির মূলপর্বে, সবই যেন সোনা দিয়ে বাঁধানো মুহূর্ত।
সাফল্য আর সমর্থকের ভালোবাসায় জুটল রাজার মুকুট, ক্যাপ্টেন্সির আর্মব্যান্ড আর কোচ আর সমর্থকদের অগাধ ভরসা।
কিন্ত বহু ট্যাকল সহ্য করা হাঁটুটা এরপরই হঠাৎ যেন জবাব দিতে শুরু করল। অপারেশন করাতেই হবে। এ যেন রাজ্যপাট ছেড়ে রাজার বনবাস।
অবশেষে এই যুবভারতীতেই এলো সেই ডার্বির দিন। টীমলিস্টে নাম নেই রাজার। রাজা তখন দর্শকাসনে। বললেন টীমের সাথেই আছি। সেদিন যুবভারতী দেখেছিল এক অন্য মোহনবাগানকে। টীম যেন রাজার জন্য খেলছে। বিপক্ষের সাথে ছেলেখেলা করে নাস্তানাবুদ করা এমন খেলা মোহনকর্তারাও মনে করতে পারেননি শেষ কবে দেখেছেন। কিন্তু তবু সবার মন খারাপ। সবাইকে কাঁদিয়ে আর্জেন্টিনায় অপারেশন করাতে চলে গেলেন সোনি। কাঁদতে কাঁদতে শুধু বলে গেলেন সমর্থকদের এই ভালোবাসার দাম দিতে আমি ফিরে আসবই, আর কোলকাতায় শুধু মোহনবাগানেই খেলব, বাকিদের অফার ডাস্টবিনে আগেই পাঠিয়েছি।
সকলেই জানতাম এরকম চোট থেকে ফেরা প্রায় অসম্ভব কোনো খেলোয়াড়ের। অপারেশন হলো, কঠিন পরিশ্রম শুরু করলেন আর্জেন্টিনায়, সেখান থেকে আমেরিকার স্যান্ড ট্রেনিং। সবাই যখন ভাবছি আর বোধহয় হলো না। সোনি এলেন। রাজার দেওয়া কথা রাজা পালন করলেন।
কাল অবধি ভাবছিলাম, সেই পুরোনো সনিকে বোধহয় আর পাবো না।
৬০ মিনিটের খানিক বাদে কোচ তুলে নিলেন এক বিদেশী মিডিওকে, গর্জে উঠল যুবভারতী। আরও একবার। গোলপোস্টের পেছন থেকেই বেড়িয়ে গেলেন পরিবর্তিত খেলোয়াড়, যেন বললেন সোনিকে,দ স্টেজ ইস অল ইওরস। মাঠে নেমেই কর্নার নিতে দৌড়লেন। কিন্তু থামিয়ে দিলেন কিংস্লে, এই ম্যাচের এতক্ষনের ক্যাপ্টেন নিজের হাত থেকে খুলে পড়িয়ে দিলেন আর্মব্যান্ড। রাজার মুকুট রাজাকেই তো মানায়। খানিক পর সেই বামপ্রান্তে বল পেয়েই কোনাকুনি দৌড়। চকিৎ টার্নিং। পরিছন্ন খেলা।
এবং তারপর সেই সিগনেচার মোমেন্ট। একের পর এক ডিফেন্ডারকে কাটিয়ে গোলকিপারকে ফার্স্ট পোস্টে ফ্রিজ শট করে, শট অন দ টপ অফ দ সেকেন্ড পোস্ট। চোখ ধাঁধানো গোল আর তারপরই কর্নার ফ্ল্যাগের দিকে দৌড়। আবেগে আনন্দে দিশেহারা যুবভারতী। এ এক অন্য অনুভূতি। সবাইকে আস্বস্ত করলেন- ‘সনি নর্ডে ইস ব্যাক ’।
দল লীগে হোঁচট খেয়েছে। এবার দেখার রাজা কিভাবে তার রাজ্য সামলায়। কিন্তু ঐ যে বলে – “হোয়েন দ গোয়িং গেটস টাফ , দ টাফ গেটস গোয়িং ” আর লীগের সবে তো শুরু।
( মতামত লেখকের ব্যক্তিগত )