বিজেপির রথযাত্রা নামক সার্কাসটি দেখে ছোটবেলায় পড়া একটা কবিতা মনে পড়ে গেল। রথযাত্রা লোকারণ্য মহা ধুমধাম/ ভক্তেরা লুটায়ে পড়ে করিছে প্রণাম/ রথ ভাবে আমি দেব পথ ভাবে আমি/ মূর্তি ভাবে আমি দেব হাসে অন্তর্যামী। ক্ষমতায় আসীন হওয়ার পর মোদী নিজেকে সত্যি সত্যি দেবতা ভাবছেন। প্রতিটি সিদ্ধান্ত ও কর্মসূচী রূপায়নে ব্যর্থ এমন প্রধানমন্ত্রী দেশে এর আগে আর আসেননি। ১৯এর ভোটের মুখে নিজের ব্যর্থতা, দুর্নীতি ও ক্রমেই বেড়ে চলা সমস্যা থেকে মানুষের চোখ ফেরাতে তিনি ও তার পার্টি ম্যানেজাররা হাইড্রোলিক এয়ারকন্ডিশনড বাসকে রথ নাম দিয়ে এই সার্কাস শুরু করেছেন। তা দেখে হাসছে দেশের প্রকৃত ভাগ্যবিধাতা সাধারণ মানুষ। গণতন্ত্রে তারাই তো প্রকৃত অন্তর্যামী। তাদের ইচ্ছেতেই তো ঠিক হয় দেশের শাসন ক্ষমতায় কারা আসবেন।
রথ বলতে প্রথমে আমার চোখে মহাভারতে পড়া অর্জুনের রথটাই ভেসে ওঠে। সে রথে কৃষ্ণ ছিলেন তাঁর সারথি। সেই রথের সঙ্গে এ রথের কোন মিল খুঁজবেন না। সে রথে দাঁড়িয়ে কৃষ্ণ যুদ্ধক্ষেত্রে ধ্বংস ও মৃত্যুতে বিহ্বল অর্জুনকে ন্যায়যুদ্ধে শক্ত হওয়ার উপদেশ দিয়েছিলেন। দুনিয়াদারির হালচাল বোঝাতে বিশ্বরূপ দর্শন করিয়েছিলেন তাঁকে। মোদীদের রথে কোন মঙ্গল নেই, ন্যায়যুদ্ধের ঘোষণাও নেই। মোদীর রথ হল লৌহমানব প্যাটেলকে শ্রদ্ধা জানানোর নামে গরিব আদিবাসী মানুষের জমি কেড়ে নিজেদের ক্ষমতা ও বিত্ত দেখানোর রথ; মানুষকে ডিমনিটাইজেশনের মাধ্যমে সর্বস্বান্ত করার রথ; দেশের সম্পদ রক্ষার নামে নীরব মোদী, মেহুল চোকসির মত মানুষদের দেশকে লুঠ করতে প্রশ্রয় দেওয়ার রথ; ধর্মের নামে দেশকে বিভক্ত করার রথ; এ কোন সাধারণ রথ নয়, এ হল দাঙ্গা বাধানোর রথ। মোদী-অমিতদের রথযাত্রা মানুষকে শান্তি, বিকাশ, সম্প্রীতির কোন অভয় বাণী দেয় না। মহাভারতের রথের মত এখানে কোন দুষ্টের দমনের ঘোষণাও নেই। এই রথের সঙ্গে মহাভারতের রথকে মেলানো যায় না।
৯০এর দশকে যখন লালকৃষ্ণ আদবানির রথযাত্রা বেরিয়েছিল তখন আমি আনন্দবাজার পত্রিকার চিত্রসাংবাদিক। সেই রথযাত্রার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আমি কভার করেছিলাম। সঙ্গী সাংবাদিক ছিলেন সঞ্জয় শিকদার। রথযাত্রার মাধ্যমে ধর্মের নামে বিভাজন ছড়ানোর খেলা তখনও ছিল। সেই রথযাত্রার পরিণতিতে দেশের বিভিন্ন জায়গায় অশান্তি ও দাঙ্গা হাঙ্গামার ঘটনাও ঘটেছিল। কিন্তু তখনও বিজেপির বিভিন্ন স্তরে মূল্যবোধের রাজনীতি পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যায়নি। তখনও অমিত শাহর মত নেতারা বিজেপির দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হয়ে বসেনি। মোদী-অমিতের আমলে দলটির যে দানবিক মুখ আমরা দেখতে পাচ্ছি সেই মুখ তখনও এতটা প্রকট হয়নি। সে রথযাত্রাও খুব একটা সুখের সময় ছিল না। মোদী-অমিতরা রথযাত্রাকে ঘিরে যত মধুর ভাষণই দিন না কেন, অতীতের সেই অভিজ্ঞতা আজকের মানুষকেও আতঙ্কিত করে তুলছে।
মানুষকে লুঠের কোটি কোটি টাকার এই কর্মসূচীতে বিজেপির কোন সুবিধা হবে বলে আমার মনে হয়না। তার একটা বড় কারণ হল, গান্ধীর ডাণ্ডি অভিযান, চম্বলের ডাকাত অধ্যুষিত এলাকায় বিনোভা ভাবের পদযাত্রার মত কর্মসূচীতে যে ত্যাগ, কষ্ট, নিষ্ঠা, সাহস ছিল বিলাসবহুল ফাইভস্টার রথে তা নিতান্তই অনুপস্থিত। আর যাই হোক, মোদী-অমিতদের মত নেতাদের ত্যাগী ও আদর্শবাদী মনে করা কট্টর বিজেপি সমর্থকদের পক্ষেও কঠিন। কিছু প্রাপ্তিযোগের আশায় তাদের আশেপাশে স্বার্থান্বেষীরা ভিড় করলেও সাধারণ মানুষের এই রথযাত্রা নিয়ে কোন আগ্রহ নেই। বাংলায় এ কাজ আরও কঠিন। এর দুটো কারণ, বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উন্নয়নমূলক কর্মসূচীর সাফল্য ও তার ত্যাগী এবং লড়াকু ভাবমূর্তি।
কোনভাবেই আমাদের দিদির সঙ্গে পাল্লা দিতে না পেরে তিনটি দিনে ত্রিমুখী শলার মত রাজ্যের তিনটি প্রান্ত থেকে রথ বার করে হাঙ্গামা বাধাতে চাইছে বিজেপি। বস্তুত এই রথযাত্রার মধ্যে দিয়েই নির্বাচনী প্রচার শুরু করে দিচ্ছে তারা। ধর্মীয় উস্কানি দিয়ে নিজেদের স্বপক্ষে হিন্দু ভোট টেনে আনাটাই তাদের লক্ষ্য। কিন্তু এ রাজ্যে সে চেষ্টা সফল হবে না। কারণ, ক্ষমতায় আসার পর থেকে পাহাড় থেকে সাগরে লাগাতার উন্নয়নমূলক কর্মসূচির মাধ্যমে মানুষের মন জয় করেছেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। এ কাজে কে হিন্দু, কে মুসলমান, কে সিপিএম, কে কংগ্রেস, কে বিজেপি তা তিনি দেখেন না। যার প্রয়োজন সে পাবে, অগ্রাধিকার পাবে অবহেলিত এলাকা। এ ব্যাপারে কোন গাফিলতি দিদি পছন্দ করেন না। রথ বার করে দিদির বিরুদ্ধে মোদীরা কী বলবেন? বাংলায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধানোর চক্রান্ত প্রতিহত করবেন সাধারণ মানুষ। জীবনের অভিজ্ঞতা থেকেই তারা জানেন বাংলায় ধর্মীয় বা জাতপাতের কারণে মানুষ কোন সুযোগ থেকে বঞ্চিত হন না।
অন্য কোথায় কী হবে জানিনা। কিন্তু রথের রাজনীতি বাংলায় ব্যর্থ হবে। কারণ তা আমাদের মানসিকতার সঙ্গে যায় না। আমাদের রামকৃষ্ণ, রামপ্রসাদ, ভবা পাগলা, বামাক্ষ্যাপারা দেবতাদের ঘরের লোক বানিয়ে দিয়েছেন। ঠাকুর-দেবতারা বাংলায় বিভেদ নয়, সম্প্রীতির মন্ত্র। এখানে দুর্গা বাপের বাড়িতে আসেন। জগন্নাথ, বলরাম, সুভদ্রা রথে চড়ে যান মাসির বাড়ি। রথের সন্ধ্যায় ছোট ছোট শিশুদের ফুল, পাতায় সাজানো কাঠের রথ, আরেকটু বড় সাইজের পারিবারিক রথের শোভাযাত্রায় আড়ম্বরের বদলে থাকে আন্তরিকতা, সবাইকে কাছে ডেকে নেওয়া। আতঙ্ক নয়, সে এক আনন্দের দৃশ্যপট। এক ধর্মের ওপর অন্য ধর্মের আধিপত্য ঘোষণার কোন সুযোগই সেখানে নেই। বিভেদ, ধ্বংস, অশান্তি ছড়ানোর কোটি টাকার ফাইভস্টার রথ বড় রাস্তার ওপর দিয়ে গেলেও এখানে মানুষের মনের ভেতর দিয়ে যেতে পারবে না।
( মতামত লেখকের ব্যক্তিগত )