বাঙালির বুকশেলফ যতই পরিপাটি করে গোছানো থাক, খুঁটিয়ে দেখলে দেখা যাবে গোঁড়াতেই ‘আবোল তাবোল’। তাই ছোটবেলায় তাঁর লেখা পড়েননি এমন বাঙালি খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। জীবনকাল মাত্র ৩৫ বছর ১০ মাস ১০দিন, দেখে যেতে পারেননি নিজের প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থটিও। তিনি বাংলা শিশু-সাহিত্যের প্রবাদ পুরুষ সুকুমার রায়। যাকে মনে করা হয় বিশ্বসাহিত্যে সর্বযুগের অন্যতম সেরা শিশু সাহিত্যিক।
আজ ৩০ অক্টোবর অনন্য এই শিশু সাহিত্যিকের জন্মদিন। ১৮৮৭ সালের আজকের দিনেই কলকাতার এক ব্রাহ্ম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন তিনি।
সুকুমার রায় বাংলা শিশুসাহিত্যের উজ্জ্বল রত্ন উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরীর ছেলে। তাঁর মা বিধুমুখী দেবী ছিলেন ব্রাহ্মসমাজের দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের মেয়ে। ছোট থেকেই সুকুমারের পারিবারিক পরিবেশ ছিল সাহিত্যনুরাগী। যা তাঁর মধ্যকার সাহিত্যিক প্রতিভা বিকাশে সহায়ক হয়।
সুকুমার কলকাতার সিটি স্কুল থেকে এন্ট্রাস পাশ করেন সুকুমার। আর প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ১৯০৬ সালে রসায়ন ও পদার্থবিদ্যায় বি.এস.সি.(অনার্স) করার পর মুদ্রণবিদ্যায় উচ্চতর শিক্ষার জন্য ১৯১১ সালে তিনি বিলেতে যান। সেখানে তিনি আলোকচিত্র ও মুদ্রণ প্রযুক্তির ওপর পড়াশোনা করেন এবং কালক্রমে ভারতের অগ্রগামী আলোকচিত্রী ও লিথোগ্রাফার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন।
১৯১৩ সালে সুকুমার কলকাতাতে ফিরে আসেন। তিনি ইংল্যান্ডে থাকাকালীন উপেন্দ্রকিশোর উন্নত-মানের রঙিন হাফটোন ব্লক ও একটি ছাপাখানা তৈরি করেছিলেন। এবং ছোটদের একটি মাসিক পত্রিকা ‘সন্দেশ’ প্রকাশনা শুরু করেন। সুকুমারের বিলেত থেকে ফেরার অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তার বাবা উপেন্দ্রকিশোরের মৃত্যু হয়।
উপেন্দ্রকিশোর জীবিত থাকতে সুকুমার লেখার সংখ্যা কম থাকলেও তার মৃত্যুর পর ‘সন্দেশ’ পত্রিকা সম্পাদনার দায়িত্ব সুকুমার নিজের কাঁধে তুলে নেন। আর তারপরই শুরু হয় বাংলা শিশুসাহিত্যের এক নতুন অধ্যায়। পিতার মৃত্যুর পর আট বছর ধরে তিনি ‘সন্দেশ’ ও পারিবারিক ছাপাখানা পরিচালনার দায়িত্ব পালন করেন।
সুকুমার লিখেছেন ১০৩টি কবিতা, ৮৮টি নানা ধরনের ছোট গল্প, ১২২টি প্রবন্ধ, ৩৭টি জীব-জন্তু বিষয়ক লেখা, ১৬টি জীবনীমূলক কাহিনী, ৮টি নাটক ও ২টি বড় গল্প আর এঁকেছিলেন ‘সন্দেশ’ পত্রিকার সমস্ত ছবি। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থাবলী- ‘আবোল তাবোল’, ‘পাগলা দাশু’, ‘হেশোরাম হুশিয়ারের ডায়েরি’, ‘অবাক জলপান’, ‘লক্ষণের শক্তিশেল’, ‘হ য ব র ল’, ‘শব্দ কল্প দ্রুম’ ইত্যাদি।
রবীন্দ্রনাথ সুকুমার রায় সম্বন্ধে লিখতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘সুকুমারের লেখনী থেকে যে অবিমিশ্র হাস্যরসের উৎসধারা বাংলা সাহিত্যকে অভিষিক্ত করেছে তা অতুলনীয়। তাঁর সুনিপুণ ছন্দের বিচিত্র ও স্বচ্ছল গতি, তাঁর ভাব সমাবেশের অভাবনীয় অসংলগ্নতা পদে পদে চমৎকৃতি আনে…বঙ্গ সাহিত্যে রঙ্গ রসিকতার উৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত আরও কয়েকটি দেখা গেছে, কিন্তু সুকুমারের হাস্যোচ্ছাসের বিশেষত্ব তাঁর প্রতিভার স্বকীয়তার যে পরিচয় দিয়েছে, তার ঠিক সমশ্রেণীর রচনা দেখা যায় না…’