কালের যাত্রার স্পন্দন মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার সংকল্প নিয়ে যে পত্রিকার যাত্রা শুরু হয়েছিল তার প্রাণস্পন্দন স্তব্ধ হয়ে যাচ্ছে। দেশজোড়া রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কেচ্ছা কেলেঙ্কারি, নানা ঘটনা-দুর্ঘটনা ও #MeToo-র আলোড়নে এই গুরুত্বপূর্ণ খবরটি বেশিরভাগ লোকেরই নজর এড়িয়ে গেছে। এটাও ঘটনা যে ধারে ও ভারে কালান্তরের আগের মহিমা এখন অনেকটাই অস্তমিত। তবুও বাংলা সাংবাদিকতায় কালান্তর ছিল একটা উজ্জ্বল নাম। খবরটা পাওয়া মাত্র খুব মন খারাপ হয়ে গেল আমার। কর্মজীবনে বহু সহকর্মীর সংস্পর্শে এসেছি যাদের সাংবাদিক জীবন শুরু হয়েছিল এই কাগজ থেকে। পরে অনেক বেশি বেতনে বড় কাগজে কাজ করলেও কালান্তরে কাজ করার অভিজ্ঞতা ও তার সূত্রে দেশের শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, ও নানাস্তরের বুদ্ধিজীবীদের সংস্পর্শে আসার স্মৃতি তারা কেউ ভুলতে পারেননি।
ভোলার কথাও নয়, কারা ছিলেন কালান্তরে? শুধু নামগুলি বলি বাংলা সাংবাদিকতায় রিপোর্টাজ-এর স্রষ্টা সোমনাথ লাহিড়ী, বিশিষ্ট বামপন্থী তাত্বিক, বাগ্মী ও লেখক হীরেন মুখোপাধ্যায়, রাজনৈতিক বিশ্লেষক ভবানী সেন, বিশ্বনাথ মুখোপাধ্যায়, চিন্মোহন সেহানবীশ, প্রভাত দাশগুপ্ত, জয়তী দাশগুপ্ত, রণজিৎ দাশগুপ্ত, গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের মত মানুষ যারা রাজনীতির সঙ্গে লেখনী, বুদ্ধিবৃত্তি ও বিশ্লেষণকে মিলিয়ে ছিলেন। সেই টানেই মত ও পথের চূড়ান্ত অমিল থাকা মানুষজনও খোঁজ করতেন কালান্তরের। অর্থ, সংগঠন, ব্যবস্থাপনা, বিজ্ঞাপন, পাঠক সংখ্যা কোনকিছুর সঙ্গেই ঝাউতলা রোডের কালান্তরের সঙ্গে আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের গণশক্তির কোন তুলনা হয়না। তবুও মগজাস্ত্রে বিশ্বাসী মানুষ মাত্রেই কালান্তর বেশি পছন্দ করতেন। কাগজটির লেখনী ও বিশ্লেষণই তার প্রধান কারণ।
কালান্তর পেয়েছিল সুভাষ মুখোপাধ্যায়, দেবেশ রায়, অমিতাভ দাশগুপ্ত থেকে শুরু করে পরবর্তীকালে আফসার আহমেদ, অমর মিত্রর মত লেখকদের। সাপ্তাহিক থেকে শুরু করে দৈনিক পর্যায়ে যতদূর মনে পড়ে গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের সম্পাদনার সময়েও বাংলার লেখক, বুদ্ধিজীবীদের অনেকেই ছিলেন কালান্তরে নিয়মিত লেখক ও ভাবনার দিক থেকে কাছাকাছি থাকা মানুষ। এই লেখক সম্পদ গণশক্তি কোনদিনই পায়নি। শুনতে খারাপ লাগলেও একথা মেনে নেওয়া ভাল। আমার মনে হয় এর একটা বড় কারণও আছে। ক্ষমতায় থাকার শেষদিকে রাজ অনুগ্রহ পাওয়ার আশায় কয়েকজন সিপিএমের সঙ্গে গা মাখামাখি শুরু করলেও বাংলার বুদ্ধিজীবীরা এই দলটিকে কখনোই খুব একটা পাত্তা দেন নি। কমিউনিস্ট পার্টি ভাগ হওয়ার পর দলের বেশিরভাগ লেখক, বুদ্ধিজীবী চলে এসেছিলেন সিপিআইয়ের দিকে। পরবর্তীকালে সিপিএম ভেঙে সিপিআইএমএল হওয়ার সময়েও গোটা দেশে দলের উজ্জ্বল ছেলেমেয়েরা সিপিএম থেকে বেরিয়ে যান। এই ঘাটতি সিপিএম পূরণ করতে পারেনি।
এক সবসময় দুয়ে বিভক্ত হয়। এটাই ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনের নিয়ম। সিপিআই থেকে সিপিএম তার থেকে সিপিআইএমএল আর এখন তো ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি ভেঙে এক হাজারেরও বেশি উপদল তৈরি হয়েছে। নেতাদের ইগোর লড়াইয়ের ফলে তৈরি এই ভাঙনে কমিউনিস্ট আন্দোলনই দুর্বল হয়েছে। সিপিআইয়ের মুখপত্র স্বাধীনতা পত্রিকা ছিল কালান্তরের পূর্বসূরী। স্বাধীনতার গুণমান কালান্তরে এসে একটু কমলো। আবার সিপিএমের গণশক্তিতে তা আরেকটু হ্রাস হল। আমরা দেখছি দলের ভাঙন বুদ্ধিজীবী ফ্রন্টকেও দুর্বল থেকে দুর্বলতর করেছে। অথচ এই মেধাসম্পদ একটা পত্রিকায় একত্রে মিললে যে কোন বাজারি কাগজের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারতো। দলীয় মুখপত্রগুলি এতটা দুরাবস্থা হত না। এই বিভাজনে মানুষ, দল, মুখপত্র, সংস্কৃতি, সাংবাদিকতা কোন কিছুই লাভবান হয় না। শোনা যাচ্ছে উপদলীয় কোন্দল কালান্তর কাগজটিতেও ছিল। এটা তার সংকটকে আরও ত্বরান্বিত করেছে।
উজ্জ্বল অতীতের কথা শুনতে ভাল লাগে। কিন্তু তাতে বর্তমানের আঁধার দূর হয়না। আমি শুধু ভাবছি, ৫২পার করে ৫৩তে পা দেওয়া এই কাগজের ১০০জন সাংবাদিক-অসাংবাদিক কর্মীর কথা। দল এবং পার্টি মুখপত্রর জন্য সারা জীবন দিয়ে দেওয়া এই মানুষগুলি জীবন জীবিকার কি ব্যবস্থা হবে? সিপিআইয়ের বিশিষ্ট নেতারা কালান্তরের কর্মীদের আশ্বস্ত করে বলেছেন, এখন আমরা অল্প ব্যয়ে পাক্ষিক হিসেবেই পত্রিকাটি চালাবো। ভবিষ্যতে কালান্তর আবার দৈনিক হবে। কিন্তু এতে কর্মীরা মোটেই আশ্বস্ত হচ্ছেন না। হওয়ার কথাও নয়। কারণ যারা এই বাণী বিতরণ করছেন, কাগজে কাজ করে তাদের সংসার চলে না।
কালান্তরের পরিচালকমণ্ডলী কর্মীদের বলেছেন, আমরা আর ভর্তুকি দিয়ে কাগজ চালাতে পারছি না। পার্টির মুখপত্র তাই কেউ বিজ্ঞাপন দেবে না। সরকারি সাহায্য ছাড়া আমরা কাগজ কি করে চালাবো? আমরা গণশক্তি নই, আমাদের অত ফান্ডও নেই, সদস্যও নেই। যেহেতু কাগজটি কোন বাণিজ্যিক কাগজ নয়, দলীয় মুখপত্র তাই বন্ধ হওয়ার পর তেমন কোন আর্থিক সুবিধা তারা পাবেন না। কর্মীদের অধিকাংশই তরুণ নন, অন্য কোথাও কাজ পাওয়া তাদের কাছে কঠিন। কেউ কেউ বলছেন কালান্তর চালানো নিয়ে দলের মধ্যেই মতপার্থক্য রয়েছে। ২০১৯এর ভোটে লড়ার মত রসদ এখন দলের নেই, তাই ব্যয়সংকোচের জন্য দলের মুখপত্র বন্ধ করে দেওয়া হছে। আবার অনেকের মতে কালান্তরের আর্থিক দুর্দশার পিছনে পরিচালক মণ্ডলীরও ভূমিকা রয়েছে। তারা কাগজটিকে মুদ্রণ ও বিষয় কোন দিক থেকেই আধুনিক করে তুলতে না চাওয়ার দরুণ পাঠক সংখ্যা কমেছে। শুধু অতীত গৌরব দিয়ে আজকের কাগজ চলে না।
গরু, কুকুর, বেড়াল, হনুমান, ফেরার শিল্পপতি, জোচ্চোর মন্ত্রী, নেতা, সিবিআই ইত্যাদি নিয়ে মেতে থাকার মত নানা বিষয়ের ভিড়ে কর্মহীন সাংবাদিকদের কথা আমাদের ভাবার সময় কোথায়? পার্টির নেতাদের মত ভুজুং ভাজুং দিয়ে লোককে আশ্বস্ত করার শিল্প জানিনা তাই একের পর এক সংবাদপত্র, চ্যানেল বন্ধ হওয়ার পর কর্মহীন সতীর্থদের দেখে আমার মন খারাপ হয়ে যায়। এদের জন্য আমরা কিছুই করতে পারি না? আমরা কি শুধুই নীরব দর্শক হয়ে থাকবো? কালান্তরের মত কাগজ চালানোর খরচ কিন্তু খুব বেশি নয়। অনুদান ও সহায়তা ইত্যাদির সাহায্যে কোন তহবিল তৈরি করে কাগজটিকে চালানো যায় না? সত্যযুগ পত্রিকার কর্মীরা তো একটা কোঅপারেটিভ তৈরি করে তাদের প্রকাশনাকে চালু রেখেছেন। আমি জানি না ঠিক কী করতে হবে? কিন্তু ভাবার মত একটা সজীব মন আমাদের থাকবে না কেন? এই জিনিসটারই তো আজ বড় অভাব।
আগামী ৩০শে অক্টোবর দৈনিক কালান্তর পত্রিকার শেষ সংস্করণ প্রকাশিত হবে বলে পরিচালক মণ্ডলী জানিয়েছেন। বন্ধ হয়ে যাবে একদা মানুষের পক্ষে আওয়াজ তোলা একটা প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর। দেশজুড়ে হনুমানতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত করার যে উদ্যোগ শুরু হয়েছে তখন এই কণ্ঠস্বরগুলিকে বাঁচিয়ে রাখাটা গণতন্ত্রের স্বার্থেই খুব জরুরি। মতপার্থক্য থাকতেই পারে কিন্তু বিজেপির মত সাম্প্রদায়িক ধর্মান্ধ শক্তির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ছোট বড় সমস্ত শক্তিকে আজ জমায়েত করতে হবে। এ কাজে কালান্তরের মত কাগজেরও একটা ভূমিকা আছে। মনে রাখতে হবে সূচনার সময়েই কালান্তরের ঘোষণা ছিল এটা পার্টি বুলেটিন নয়, সমাজ প্রগতির পক্ষে পরিচালিত সংবাদপত্র। পত্রিকার নামকরণ হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের একটি লেখা থেকে। নামাঙ্কন করেছিলেন সত্যজিৎ রায়। কাল থেকে কালান্তরে যাওয়ার ঘোষণা নিয়ে যে পত্রিকার যাত্রা শুরু তার কি এই পরিণতি প্রত্যাশিত ছিল?
( মতামত লেখকের ব্যক্তিগত )