মাঝে মাঝে চেনা জিনিসকে অচেনা লাগে। রেড রোড আমার বহুকালের চেনা সড়ক। বহু ঘটনা, দুর্ঘটনার সূত্রে এ সড়ক আমার জীবনে জড়িয়ে আছে। কিন্তু মঙ্গলবার সন্ধ্যায় পুজো কার্নিভালের তৃতীয় বর্ষে তার যে রূপ দেখলাম, তা আগের সব অভিজ্ঞতাকে ছাপিয়ে গেছে। শহরের শারোদৎসব এই কার্নিভালের মধ্যে দিয়ে প্রকৃত অর্থেই একটা আন্তর্জাতিক চেহারা পেয়ে গেল। ভাবনার বিস্ফোরণ, উপস্থাপনার বৈচিত্র, ব্যবস্থাপনার অভিনবত্ব সব নিরিখেই এবারের কার্নিভাল এক অর্থে লা জবাব। এই কার্নিভালে বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসবের চোখ দিয়ে গোটা বাংলাকে যেন দেখে নিলেন দেশি-বিদেশি অতিথিরা। এমনকি বহু খোদ কলকাতাবাসীও বঙ্গ সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে নতুন করে আবিষ্কার করলেন। বাঙালি গোল্লায় গেছে বলে যারা গণমাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়ায় সকাল সন্ধ্যা বিলাপ করে চলেছেন এই উদ্যোগটি তাদের মুখ বন্ধ করে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ঠ। তারা না চাইলেও কানে কানে ছড়িয়ে যাচ্ছে কার্নিভালের কথা।
প্রযুক্তি থেকে পালকি, পরিবেশ থেকে আদিবাসী জীবন, যুদ্ধ থেকে শান্তি, লোক সংস্কৃতি থেকে সাহিত্য, নারী জাগরণ থেকে কন্যাশ্রী, রূপশ্রী প্রকল্পের সাফল্য, আধার কার্ড বিতর্ক সবমিলিয়ে এ যেন আমাদের রোজকার জীবনকেই নতুন চোখে নতুনভাবে দেখা। একইসঙ্গে এ যেন বঙ্গ সংস্কৃতির এক ঝাঁকি দর্শন, একটা ছোট ক্যাপসুল, যা অল্প সময়ে বাংলার নাচ, গান, জনজীবন কয়েক ঘন্টায় গম্ভীর ভাষণ ছাড়াই অনায়াসে দেখিয়ে দেয়। এ কার্নিভাল যেন দিনদিন হয়ে উঠেছে বাংলার সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের এক মিলন মেলা।
আমি ছবি তুলতে তুলতে মাঝে মাঝে উপস্থিত মানুষ ও বিশিষ্ট অতিথি ও বিদেশি অভ্যাগতদের প্রতিক্রিয়া দেখছিলাম। তাদের চোখে পলক পড়ছিল না। ভাবছিলাম তারা নিশ্চয় দেশে ফিরে তাদের প্রিয়জনদের কাছে এই অভিজ্ঞতার বর্ণনা করবেন এবং শ্রোতারা তা শোনার পর বাংলায় আসার কথা ভাববেন। এ কোন কষ্ট কল্পনা নয়, এভাবে কোন ঘোষণা ছাড়াই আমাদের পুজো কার্নিভাল হয়ে উঠতে পারে বাংলার সবচেয়ে যোগ্য কালচারাল অ্যামবাসাডর। আমি দেখছিলাম মঙ্গলঘট, হাতপাখা, কলস, ফুল, আলিঙ্গন, ছৌ আর রায়বেঁশে নাচ, নৃত্যনাট্য, রবীন্দ্র সংগীত, পুরাতনী গান, নমস্কার, স্মিত হাসির ছোট ছোট স্নিপেটস-এ উঠে আসছে উৎসবের দিনে মানুষকে আপন করে নেওয়া আমাদের এই বাংলা। পুজো কার্নিভাল বাংলার এই মেজাজটাকে একদম ঠিকঠাক ধরেছে। আর ধরেছে বলেই মানুষ ঠায় শেষ অবধি বসে থেকে এই কার্নিভাল দেখেছে। আমি আমার বাড়ির কথাই বলি। আমার স্ত্রী, ছেলেরা পুজোর ভিড়ে যেতে চায় না। কিন্তু ওরাও আজ কার্নিভাল দেখে উচ্ছসিত।
আমার বেশ মনে পড়ছে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন পুজোর পরপরই এই কার্নিভালের পরিকল্পনা করেছিলেন তখন তার সমালোচকরা মুখ বেঁকিয়ে হেসেছিলেন, বলেছিলেন সরকারি টাকায় মোচ্ছব হবে। এ এক নতুন হুজুগ, উৎসব ছাড়া উনি আর কিছুই ভাবতে পারেন না। আমাদের দিদি এই সমালোচনায় দমেন নি। নিজের সহজাত আত্মবিশ্বাস নিয়ে তিনি বলেছিলেন, এক জায়গায় শহরের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিমাগুলিকে শহরের বিদেশি অতিথিদের দেখানো, যারা মন্ডপে ঘুরে ঘুরে ঠাকুর দেখার সময় ও সুযোগ কোনটাই পান না তাদের সেরা প্রতিমাগুলি দেখার সুযোগ এই কার্নিভালকে জনপ্রিয় করবেই। আর পুজোকে কেন্দ্র করে কলকাতা ও সংলগ্ন এলাকায় আমাদের শিল্পী, কারিগর, লোকশিল্পী, আলোকশিল্পী, সুরকার, গীতিকারদের সৃজন ভাবনার যে বহিঃপ্রকাশ ঘটে তা বাইরের মানুষের কাছে তুলে ধরার জন্য এটা হল আদর্শ জায়গা, ঠিক এই ঘটনাটাই এখন ঘটছে। বাংলার অতি বুদ্ধিমান রাজনৈতিক নেতারা কার্নিভালের এই সম্ভাবনার জায়গাটাই ধরে উঠতে পারেন নি। তারা ভাবতেও পারেন নি পুজো কার্নিভাল এমন চেহারা নিতে পারে। এখানে দিদির সঙ্গে তাদের তফাৎ।
আমার মনে হয় পুজো কার্নিভালই খুলে দিতে পারে বাংলার পর্যটনে এক নতুন সম্ভাবনা। বৈচিত্র ও বিশালত্বের সূত্রে তা টানতে পারে বিদেশি পর্যটকদের। এই সম্ভাবনা আছে বলেই ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক ম্যাগাজিন এই কার্নিভালের ওপর বিশেষ প্রোগ্রাম করছে। ইন্টারন্যাশনাল ফুড, ওয়াইন অ্যান্ড ট্রাভেল রাইটার অ্যাসোসিয়েশনের কো-ফাউন্ডার ডমিনিক এ মার্লে বলেছেন, এত বড় ইন্সটলেশন আর কোথাও দেখা যায় না। আর পুজোর সময় গোটা শহরটার মুডটাই যেন বদলে যায়। এই ব্যাপারটাই বিদেশি পর্যটকদের সবথেকে বেশি আকর্ষণ করেছে। এই বছরই মার্লে এবং তার সঙ্গে ইউরোপ ও আমেরিকার বিভিন্ন জায়গা থেকে আসা ১০জন বিদেশি লেখক ও সাংবাদিক শহরে ২৭৩টি প্যান্ডেল ঘুরে দেখেছেন। তারা এককথায় অভিভূত। এই বিস্ময়ের সদ্ব্যবহার করতে হবে আমাদের।
সাংবাদিকতার সূত্রে দেশ বিদেশের কিছু কার্নিভাল দেখার সামান্য সুযোগ আমার হয়েছে। ব্রাজিলের কার্নিভালের তো খুব নামডাক। আমাদের দেশে শীতের সময় গোয়ার কার্নিভাল বিদেশি পর্যটকদের কাছে একটা বড় আকর্ষণ। এসময় গোয়াতে তিল ধারণের জায়গা থাকে না। রাস্তার ওপর দিয়ে চলে যাওয়া গান বাজনার দল, মুখোশ পরা মানুষ, ড্রাগন ডান্স, গোয়ার স্থানীয় খ্রিষ্টানদের নাচ গান, আদিবাসী নৃত্য সত্যি একটা অন্যরকম উৎসবের মেজাজ নিয়ে আসে। বহু বিদেশি পর্যটক এই কার্নিভালের জন্য অপেক্ষা করেন। এবারের পুজো কার্নিভাল দেখে আমার মনে হয়েছে আমাদের এই কার্নিভাল গোয়ার কার্নিভালকেও সবদিক থেকে ছাপিয়ে গেছে। সোজা কথায় বলি এটা এখন দেশের ১নং কার্নিভাল। উৎসব, মেলা কার্নিভালকে ঘিরে সাংস্কৃতিক পর্যটন এখন সারা বিশ্বে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। এই পর্যটন সম্ভাবনা রয়েছে আমাদের বাংলাতেও। দিদির উদ্ভাবনী ভাবনাটার মুকুটে আমাদের যোগ করতে হবে আরও নতুন নতুন পালক। বিদেশি পর্যটন সংস্থাগুলোর কাছে পুজো কার্নিভালের যথাযথ বিপণন একটা বড় ব্যাপার। এর পাশাপাশি রাজ্য পর্যটন দপ্তর ও দেশের অন্যান্য পর্যটন সংস্থাগুলি পুজো কার্নিভালে যোগ দিতে পর্যটকদের উৎসাহিত করতে পারে। সোশ্যাল মিডিয়ায় পুজো কার্নিভাল নিয়ে প্রচার আরও বাড়াতে হবে।
আমাদের মনে রাখতে হবে পর্যটন বাড়া মানে স্থানীয় মানুষের কাজের সুযোগ বাড়া। হোটেল, গাইড, পরিবহণ সংস্থা, সাংস্কৃতিক কর্মী সবারই পর্যটনের সূত্রে আয় বাড়ে। বাড়ে মানুষের সঙ্গে মানুষের যোগাযোগ। এক দেশের মানুষ চেনেন, জানেন, বোঝেন অন্য দেশের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে। কাজেই ভ্রমণ মানেই শুধু বেড়ানো নয়। আমি বাজি রেখে বলতে পারি পুজো কার্নিভাল দেখার পর এখানে আসা পর্যটকরা বাংলার অন্যান্য ভ্রমণবিন্দুগুলি দেখতে উৎসাহিত হবে। তাতেও আমাদের লাভ।
পুজো কার্নিভাল মানেই নিছক উৎসবের মেয়াদ বাড়িয়ে দেওয়া নয়, বরং বাংলার পর্যটন সম্ভাবনার দরজা খুলে দেওয়া। কানে কানে ছড়িয়ে যাক বাংলার পুজো কার্নিভালের কথা। কার্নিভালের খোলামেলা আবহাওয়া ভ্রমণ নিয়ে আমাদের একঘেয়ে পুরোনো চিন্তাগুলোকে দমকা বাতাসের মত উড়িয়ে দিক।
( মতামত লেখকের ব্যক্তিগত )