থিমের হাওয়ায় এখনও হারায়নি সাবেকিয়ানা। বরং থিম ও সাবেকি সাজের মিশেলেই যেন সেজে উঠেছে পুজোর বাংলা।
এবছর শহর ও শহরতলির পুজোয় থিমের পাশাপাশি সাবেকিয়ানারও ছড়াছড়ি। ছোট বড় সব পুজোতেই এখন চূড়ান্ত ব্যস্ততা। শেষ মুহূর্তে ‘ফাইনাল টাচ’-এ ব্যস্ত অনেক থিম শিল্পীরা। আবার সাবেকি নিয়মে হওয়া বনেদি বাড়ির পুজোগুলিতেও চলছে ব্যাপক তোড়জোড়।
রাজ্যের দূরদূরান্ত থেকে আত্মীয় স্বজনরা আসতে শুরু করে দিয়েছেন। এমনকি প্রবাস থেকেও বাড়ি ফিরছেন অনেকে। ইতিমধ্যেই বাড়ির ঠাকুরদালান ঝাড়বাতির আলোয় আলোকিত। বেজে উঠেছে সানাইয়ের সুর। সব মিলিয়ে মাতৃ আরাধনায় মুখর গোটা বাংলা।
আহিড়িটোলা সর্বজনীন দুর্গোৎসব সমিতির পুজো এবার পড়ল ৭৯ তম বর্ষে। পুরনো রাজবাড়ির আদলে গড়ে উঠেছে এখানকার মণ্ডপ। এখানের মণ্ডপে প্রবেশ করলেই দেখা যাবে, পুরনো রাজবাড়ির জীর্ণ দেওয়াল। খসে পড়েছে রং, পলেস্তারা। বাড়ির চারদিকে জ্বলছে আলোর শিকল। আর নাটমন্দিরে বসে সাবেকি প্রতিমা। সেই প্রতিমার গায়ে অসংখ্য গয়না। গোটাবাড়িতে যেন ছড়িয়ে পড়েছে পুজোর গন্ধ।
নারকেলডাঙা মেন রোডে চণ্ডীতলায় পূর্ব কলকাতা সর্বজনীন দুর্গোৎসব কমিটির পুজোয় এবারের আকর্ষণ—‘মায়াজাল’। পুজো কমিটির সভাপতি মানসরঞ্জন দত্ত জানান, মণ্ডপসজ্জার ভাবনা স্বপন সরকারের। আবহ সঙ্গীতে আছেন কল্যাণ সেন বরাট। আলোকসজ্জার দায়িত্বে সৌরভ সান্ন্যাল। প্রতিমা শিল্পী সনাতন রুদ্র পাল।
শাস্ত্র শেখায়, জগৎ সংসার হল মায়া। একে উপেক্ষা করতে পারলেই ‘মুক্তি’। জীবনযাপনেও একইভাবে মোহবন্ধন আটকে রাখে আমাদের। যে মোহজালে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রয়েছি আমরা। তারই প্রতীকী উদ্ভাস তুলে ধরা হয়েছে শারদ উৎসবের এই মণ্ডপে। পুজো কমিটির তরফে সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় জানান, এবার আমাদের স্লোগান, ‘জাল ছিঁড়তে পারলেই মুক্তি’।
পটারি রোডে কামারডাঙা সাধারণ দুর্গোৎসব সমিতির পুজো এবার প্রাক-শতবর্ষে পড়ল। এখানে পুজোর ক্যাচলাইন ‘দার্জিলিং দেখতে চলে আসুন কামারডাঙায়’। পুজো কমিটির সম্পাদক সমীর সাহা জানান, দার্জিলিঙ শহরকেই এখানকার মণ্ডপে তুলে ধরা হয়েছে। থাকছে টয়ট্রেন, চা বাগান, ঝর্না, রোপওয়ে-সহ একাধিক দ্রষ্টব্য। প্রতিমা থাকছে পাহাড়ের গুহায়। যা দেখতে মণ্ডপজুড়ে দর্শকদের ঢল নামবে বলেই পুজো কমিটির আশা।
উত্তর শহরতলির দেশবন্ধু রোডে (পূর্ব) বনহুগলি ‘সমাজসদন’ যুবকবৃন্দের পুজোয় এবার রয়েছে নানা চমক। হবে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও। সিঁথির গীতাঞ্জলি সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটির পুজো এবারও ধূমধাম করে পালিত হচ্ছে। এখানে মহালয়ার দিন আঁকা হয়েছে মায়ের চোখ। পুজো উপলক্ষে ৫০০ জন দুঃস্থ ছেলে মেয়েকে নতুন পোশাক দেওয়া হবে। মহাপঞ্চমীর সন্ধ্যায় এই পুজোর সূচনা হয়।
দেবেন্দ্রচন্দ্র দে রোডে শক্তি সঙ্ঘের দুর্গাপুজো এবার ৩৩ তম বর্ষে পড়ল। পুজো কমিটির তরফে খোকন চক্রবর্তী ও কমল ভৌমিক জানান, এখানকার পুজোয় প্রতিমা, মণ্ডপ এবং আলোয় রয়েছে নানা চমক। পুজো উপলক্ষে বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানও হবে।
নৈনানপাড়া লেন ও কাশীনাথ দত্ত রোডের সংযোগস্থলে ফ্রেন্ডস অ্যাসোসিয়েশনের পুজো এবার পড়ল ৭০তম বর্ষে। স্থায়ী মণ্ডপে বিশাল সাবেকি প্রতিমায় পুজো হয় এখানে। পুজোর বাড়তি আকর্ষণ হল কাশী বিশ্বনাথ মন্দিরের আদলে গড়ে ওঠা শিবমন্দির। পুজো কমিটির সভাপতি অজয় ঘোষ জানান, কাশী বিশ্বনাথ মন্দিরের প্রধান পুরোহিত এই মন্দিরের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। পুজো কমিটির আশা, মাতৃপ্রতিমার সঙ্গে এই শিবমন্দির দেখতেও ভিড় হবে। তৃতীয়ার সন্ধ্যা থেকেই ভিড় জমেছে এই পুজো দেখতে।
নর্থ ত্রিধারা সর্বজনীন দুর্গোৎসবের পুজো এবার অষ্টাদশ বর্ষে। তাদের থিম- ‘জন্মধারায় কর্মফল’। এখানে প্রবেশদ্বারের পরেই রয়েছে চারটি দীর্ঘ পথ, যা চতুরাশ্রমের প্রতীক। সবশেষে মাতৃমন্দির। মা এখানে শান্তিরূপেণ সংস্থিতা…।
উত্তর শহরতলির কালীদাস লাহিড়ি লেনের পুজোয় মা’কে পড়ানো হয় সোনার নানা অলঙ্কার। দুর্গাপুজো উপলক্ষে পাঠবাড়ি লেনে এক বিশাল ছবির প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছে। প্রদর্শনীর কর্ণধার শিল্পী শৈলেন্দ্রনাথ প্রামাণিক জানান, একাদশী পর্যন্ত চলবে এই প্রদর্শনী। রবিবার সন্ধ্যায় এই প্রদর্শনীর সূচনা হয়। নদীয়ার রানাঘাট কুমার ষাটপুর গ্রামের পুজো এবার ধুমধাম করেই পালিত হচ্ছে।
ক্যানেল ইস্ট রোডে অরবিন্দ সেতু সর্বজনীন দুর্গাপুজো সমিতির পুজো এবার পড়ল ৪২তম বর্ষে। পুজো কমিটির সভাপতি নারায়ণ দাসের দাবি, এবার অন্য বছরের তুলনায় ভিড় বেশি হবে। মণ্ডপ এবং আলোকসজ্জায় রয়েছে বিশেষ আকর্ষণ। আবার শহরতলির কিশোর অ্যাথলেটিক ক্লাবের পুজোতেও রয়েছে নানা চমক। পুজোয় বাড়তি আকর্ষণ মহিলাদের অংশগ্রহণ। এখানকার প্রতিমা সাবেকি।
এভাবেই থিম আর সাবেকিয়ানার মেলবন্ধন ঘটেছে রাজ্যের সর্বত্রই। এখন উৎসবের এই বাতাবরণেই মাতৃ আরাধনায় মুখর গোটা বাংলা।