রাজনীতি মানুষকে দেশের দুঃখ কষ্ট বুঝতে শেখায় বলে জানতাম। কিন্তু অনেক রাজনীতিবিদদের দেখে সেকথা মনে হয়না। এমনই একজন মানুষ আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ফসলের দাম না পেয়ে কৃষকদের আত্মহত্যা, নোটবন্দিতে মানুষের হয়রানি ও আত্মহত্যা, রাতারাতি দেশের বহু মানুষকে অনুপ্রবেশকারী বলে ঘোষণার পর তাদের দুর্দশা কিছুই তাকে স্পর্শ করেনা। নইলে গঙ্গা দূষণ রুখতে ১১১দিন অনশনে বসা আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন একজন পরিবেশ বিজ্ঞানীর সঙ্গে তার কথা বলার সময় হত। নিদেনপক্ষে প্রধানমন্ত্রীকে লেখা তাঁর অসংখ্য চিঠির জবাব দিতেন তিনি। তেমন কিছুই ঘটেনি, ১১১দিন অনশনের পর মারা গেছেন পরিবেশবিজ্ঞানে বার্কলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডক্টরেট, কানপুর আইআইটি-র প্রাক্তন অধ্যাপক জি ডি আগরওয়াল। অনেকে তাঁকে সন্ত জ্ঞানস্বরূপ সানন্দ নামেও চেনে। একটা ন্যায্য দাবি প্রত্যাখ্যান ও তার পরিণতিতে ৮৭বছরের একজন পরিবেশ বিজ্ঞানীর মৃত্যুর এমন নির্মম ঘটনা সাম্প্রতিক অতীতে ঘটেনি। দেশের মানুষের কাছে প্রধানমন্ত্রীকে এর জবাব দিতে হবে। গঙ্গা দূষণ রোখার আন্দোলনে শহীদ হলেন সন্ত জ্ঞানস্বরূপ সানন্দ।
বেনারসের দশাশ্বমেধ ঘাটে বুকজলে দাঁড়িয়ে গঙ্গা স্তোত্র পাঠ করে নাটকীয়ভাবে ‘নমামি গঙ্গে’ প্রকল্প শুরু করেছিলেন দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। নাটক হয়েছে, কোটি কোটি টাকার অপব্যয় হয়েছে কিন্তু ২৫২২ কিমি জুড়ে প্রবাহিত দেশের প্রধান এবং সবচেয়ে পরিচিত নদী গঙ্গার হাল ফেরেনি। শাস্ত্র, পুরাণ, মহাকাব্যে পাতার পর পাতা গঙ্গার প্রশস্তি ও বন্দনা তার দূষণ আটকাতে পারেনি। গঙ্গা হয়ে উঠেছে নদী দূষণের এক চলমান বিজ্ঞাপন। পরিবেশ বিজ্ঞানীরা বলছেন , পান তো দূরের কথা তার বহু জায়গার জল স্নানেরও অযোগ্য। ২০১৯ এ এই প্রকল্প শেষ হওয়ার কথা, কিন্তু ২০১৮-র অক্টোবরে দাঁড়িয়ে আমরা দেখছি প্রকল্পের গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্যমাত্রাগুলি প্রায় কিছুই অর্জিত হয়নি। কিছু কিছু জায়গায় গঙ্গার পাড় সাজানো হয়েছে, তার সঙ্গে গঙ্গা দূষণরোধের কোন সম্পর্ক নেই। বুকে অনেক কষ্ট নিয়ে জি ডি আগরওয়াল তাঁর শেষ চিঠিতে মোদীকে লিখেছিলেন, গত চারবছরে আপনার সরকার যা করেছে তাতে গঙ্গাজির কোন উপকার হয়নি। উপকার হয়েছে কিছু ব্যবসায়ী ও বাণিজ্য গোষ্ঠীর।
অথচ মোদী বারবার বলেন গঙ্গা দূষণ রোখা তার কাছে একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। জি ডি আগরওয়াল তো একাজে তাকে সহায়তা করতেই চেয়েছিলেন। যার জন্য অনশনে প্রাণ দিলেন সেই দাবি আদায়ের জন্য ২০০৮,২০০৯,২০১০,২০১২ এবং ২০১৩সালে অনশনে বসেছিলেন তিনি। নানা প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাঁকে সেই অনশন প্রত্যাহার করতে বলা হয়েছিল। বারবার বলা সত্বেও কোন কাজ না হওয়াতে এবার তিনি আমৃত্যু অনশনে বসেছিলেন। মোদীকে অভিযুক্ত করে বলেছিলেন, আপনি কোন ব্যবস্থা নেননি তাই এছাড়া আমার অন্য কোন উপায় নেই। মোদীর মনে বৃদ্ধ পরিবেশ বিজ্ঞানীর এই আবেদন কোন রেখাপাত করেনি।
অথচ তিনি কোন অযৌক্তিক দাবি করেন নি। তাঁর ২২দফা দাবির মধ্যে ছিল গঙ্গার বুকে বাঁধ দেওয়া চলবে না, তার জলের বহমানতাকে বজায় রাখতে হবে, গঙ্গায় অবৈধ খননের কাজ বন্ধ রাখতে হবে, গঙ্গার ওপর জলবিদ্যুৎ প্রকল্প বাতিল করতে হবে, গঙ্গার দূষণমুক্তির নামে টাকা নয়ছয় করা চলবে না, উচ্ছেদ করতে হবে গঙ্গার বেআইনি দখলদারদের, গঙ্গা বাঁচাতে অবিলম্বে অর্ডিন্যান্স জারি করে একটা আইন করতে হবে ইত্যাদি। এসব দাবি নিয়ে তিনি ঘুরেছেন বিজেপি নেতাদের দরজায় দরজায়। যোগাযোগ করেছেন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী নিতীন গড়করি, উমা ভারতী, গোবিন্দাচার্যদের সঙ্গে, কিন্তু অবস্থা বদলায়নি। তাঁকে মোদী ২২মিনিট সময় দেননি। গত ২২শে জুন থেকে তিনি অনশন শুরু করেছিলেন। অনশনের প্রথম ৯০দিনে তাঁর সঙ্গে বিজেপি বা মন্ত্রীসভার পক্ষ থেকে কেউ যোগাযোগই করেনি। কারণ, মোদীদের গঙ্গা দূষণ রোখার আওয়াজের সঙ্গে নদীর স্বাস্থ্য ফেরানোর কোন সম্পর্কই নেই। গঙ্গাকে সামনে রেখে এটা মোদীদের আমরা কত সাচ্চা হিন্দু, এমন একটা ভাবমূর্তি নির্মাণের প্রক্রিয়া। আর জ্ঞানস্বরূপের কাছে এটা ছিল গঙ্গাকে বাঁচানোর একটা শপথ। প্রাণ দিয়ে তিনি তাঁর বিশ্বাসের সততা প্রমাণ করলেন।
মোদী এবং তার সাঙ্গপাঙ্গরা বৃদ্ধ বিজ্ঞানীর এই অনশনকে কোন গুরুত্ব না দিলেও দেশের পরিবেশ আন্দোলনের কর্মীরা কিন্তু বরাবরই তাঁর পাশে ছিলেন। গান্ধীর এবারের জন্মদিনে বিশিষ্ট পরিবেশ কর্মী এবং জল সংরক্ষক রাজেন্দ্র সিং এর নেতৃত্বে দেশের পরিবেশ কর্মীরা তাঁর অনশনের স্বপক্ষে একটা কর্মসূচি নিয়েছিলেন। গোমুখ থেকে উত্তরাখণ্ড, গঙ্গাসাগর থেকে পশ্চিমবঙ্গ পর্যন্ত তারা পদযাত্রা, নৌকা যাত্রার মধ্যে দিয়ে দেশের মানুষের কাছে গঙ্গা দূষণের বিপদ এবং তাঁর অনশনের বিষয়টি তুলে ধরেছিলেন। জি ডি বলেছিলেন, তাঁর দাবিগুলির মধ্যে কিছু গুরুত্বপূর্ণ দাবি মেনে নিলে তিনি অনশন তুলে নেবেন। কিন্তু মোদীরা তাঁর কোন দাবিই মানেন নি। তাই তিনি অনশন চালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন।
গঙ্গাকে তিনি স্বচ্ছ ও প্রবহমান দেখতে চেয়েছিলেন। তাঁর আওয়াজ ছিল নির্মল গঙ্গা, অবিরল গঙ্গা। কলুষিত রাজনীতি তাঁর জীবনস্রোত রুদ্ধ করে দিয়েছে। অভিযোগ উঠেছে গত বুধবার হরিদ্বার জেলা কর্তৃপক্ষ অনশন ভাঙার জন্য তাঁকে জোর করে হৃষীকেশের এআইআইএমএস-এ নিয়ে যান। সেখানে তাঁর সঙ্গে সঠিক ব্যবহার করা হয়নি। অনেকে বলছেন, ৮৭বছরের একজন বৃদ্ধকে অনশন ভাঙার জন্য জোর জবরদস্তি করা হয়। মরণোত্তর দেহদানের অঙ্গীকার করেছিলেন জি ডি আগরওয়াল। তাঁর দেহ বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটিতে দান করা হবে।
গঙ্গা শুধু একটা নদী নয়, তা আমাদের জাতীয় জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ প্রবাহ। কিন্তু তাকে আমরা সেই সন্মান দিই না। গঙ্গাকে শুধু আমাদের মনে পড়ে তর্পণের দিনে আর বিসর্জনের দিনে। সেসব দিনেও আমরা প্রতিমা বিসর্জন আর গুচ্ছের ফুল, পাতা আবর্জনা বিসর্জন দিয়ে তাকে দূষিত করি। একই ঘটনা ঘটে তর্পণের দিনেও। সেদিন অবশ্য ঠাকুরের কাঠামো থাকে না। মোদীর মত রাজনীতিবিদরা ধরেই নিয়েছেন গঙ্গা দূষণ রোখার কথা বলাটা স্রেফ একটা লিপ সার্ভিস। এটা শুধু বললেই চলবে করতে হবে না। কিন্তু জি ডি আগরওয়ালের মত পরিবেশপ্রেমীরা তা ভাবেন না। জি ডি নেই, গঙ্গা কিন্তু বয়ে চলেছে। তাকে আবার নির্মল ও স্রোতস্বিনী করে তোলার শপথ নিতে হবে আমাদের। অনশনে নিজের জীবন দিয়ে আমাদের সেই জ্ঞানই দিয়ে গেলেন জ্ঞানস্বরূপ বা জি ডি আগরওয়াল। মোদীদের নির্মমতা ও ঔদ্ধত্যের পরিণতিতেই প্রাণ দিলেন তিনি। ১৯শের ভোট এই নির্মমতার জবাব দেবে।
( মতামত লেখকের ব্যক্তিগত )