থিমের রাজ্যে পুজো চমক-ময়। ফলে বদলেছে পুরনো আঙ্গিক। সাবেকি পুজোর জায়গায় ধীরে ধীরে স্থান করে নিয়েছে থিমের পুজো। আধুনিকতার শৈল্পিক ছোঁয়ায় আমূল পরিবর্তন এসেছে প্রায় প্রতিটি পুজোমন্ডপ ও প্রতিমায়। ধারেভারে বেড়েছে পুজোর চেহারা। যার ফলে চারদিনের পুজো পরিণত হয়েছে সাতদিনে।
গত কয়েকবছর ধরেই তৃতীয়া-চতুর্থী থেকে মানুষের ঢল নামছে পুজোমণ্ডপে। কিন্তু সকলের তো আর সব পুজোমণ্ডপ দেখা হয়ে ওঠে না। শহর ও তার আশপাশের সবকটি আকর্ষণীয় পুজো দেখে শেষ করাও একার পক্ষে সম্ভব নয়। সেই সমস্যার নিরসনেই একসঙ্গে সব সেরা পুজোর প্রতিমা দেখার সুযোগ করে দিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
বছর দুয়েক আগে থেকে রেড রোডে দুর্গাপুজো কার্নিভাল শুরু করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। যা কম আকর্ষণীয় নয়। শুধু বর্ণাঢ্য বললে কম বলা হয়, এই অনুষ্ঠান যেন এক দিগন্তের দিকে সুদীর্ঘ যাত্রা। যে দিগন্তযাত্রায় উঠে আসে ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, কৃষ্টি, সম্প্রীতির বিভিন্ন রং। সব রং মিশে তৈরি হয় এক আলোকিত বর্ণমালা।
ফি বছর পুজোর এই বর্ণময় শোভাযাত্রা প্রত্যক্ষ করেন লক্ষ লক্ষ মানুষ। পুরো শোভাযাত্রাজুড়েই কোথাও সম্প্রীতির বার্তা, কোথাও বা রাজ্যের লোকায়ত গানের সুর। আবার কোথাও কোথাও দেখা মেলে ‘কন্যাশ্রী’ প্রকল্পের সাফল্যের কথা। শুধু এ শহর বা রাজ্যেরই নয়, ইন্টারনেটের দৌলতে রাত পর্যন্ত বিশ্বের প্রায় ৫০ লক্ষ মানুষ সরাসরি এই পুজো কার্নিভাল দেখেন। বাংলার শিল্প, সংস্কৃতি, কৃষ্টি, ঐতিহ্যের হাত ধরে এক অভূতপূর্ব আনন্দযাত্রা।
মুম্বইয়ের গণপতি উৎসবের বিসর্জনের মতো কল্লোলিনী কলকাতার সেরা প্রতিমার বিসর্জনের জন্য এই কার্নিভালের ভাবনা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। ২০১৬ সালে সেরা ৩০টি প্রতিমা এই কার্নিভালে অংশ নিয়েছিল। ২০১৭ সালে সেই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৫৬টিতে। আর এবার ৭৫টি পুজো স্থান পাবে বলে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। শুধু মূল শহর নয়, দক্ষিণ ২৪ পরগনার শহরতলি, উত্তর ২৪ পরগনার শহরতলি এবং হাওড়া জেলার সেরা পুজোও স্থান পাবে এই কার্নিভালে। তথ্য-সংস্কৃতি দপ্তর তার তালিকা তৈরি করে প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছে।
আগে পুজো কমিটি পেত আড়াই থেকে তিন মিনিট। তবে এবার সংখ্যা বেশি হওয়ায় প্রতিমা নিয়ে উপস্থিত পুজো কমিটিগুলি দেড় মিনিট করে সময় পাবে। দেড় মিনিটের মধ্যে গানের তালে তালে পুজো কমিটির সদস্য-সদস্যাদের পারফরম্যান্স করতে হবে। দুর্গা কার্নিভালে পুজো কমিটির সদস্যদের সঙ্গে অংশ নেন বলিউড-টলিউডের শিল্পীরা। কার্নিভালে অংশ নেওয়া পুজো কমিটিগুলির মধ্যে থিমযুদ্ধের মতই অদ্ভুত এক প্রতিযোগিতা লক্ষ্য করা যায়। এর জন্য সরকারি তরফে পুরস্কারও দেওয়া হয়।
সাধারণত মহালয়ার আগে থেকেই মুখ্যমন্ত্রী উত্তর থেকে দক্ষিণে পুজো পরিক্রমা করতে বেরিয়ে পড়েন। সেই সময় তাঁর নজরে পড়া পুজো মণ্ডপগুলি দুর্গা কার্নিভালে স্থান পায়। এবারে এই কার্নিভাল হবে ২৩ অক্টোবর, মঙ্গলবার। তার আয়োজনের জন্য প্রস্তুতি শুরু হয়ে গিয়েছে দিন ১৫ আগে থেকেই।
এবার কার্নিভালের জন্য রেড রোডের ধারে কাঠের পাটাতন দিয়ে দুর্গাপুজোর মণ্ডপের মত বিশাল ম্যারাপ বাঁধা হয়েছে। প্রায় ২০ হাজার মানুষ যাতে বসে দেখতে পারেন, তার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। কাঠ, বাটাম, থার্মোকল ও ফাইবার দিয়ে রেড রোডের ধারে তৈরি হচ্ছে দু’টি মঞ্চ। মঞ্চদুটির আদল অনেকটা রাজবাড়ির মতই।
দুটি মঞ্চের একটিতে বসবেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়-সহ অন্যান্য ভিআইপি’রা। আর উল্টোদিকের মঞ্চে বসবেন বিদেশি অতিথিরা। দুর্গা কার্নিভাল বিদেশিদের কাছে খুবই আকর্ষণীয়। তাই এই ব্যবস্থা।
এবার টেমস ফেস্টিভ্যালের সঙ্গে রাজ্য সরকারের চুক্তি হয়েছে। রাজ্যের স্বরাষ্ট্র-পর্যটনসচিব অত্রি ভট্টাচার্য ও ক্রীড়া যুবকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী লক্ষ্মীরতন শুক্লা টেমস ফেস্টিভ্যালে গিয়েছিলেন। সেখানকার প্রতিনিধিরাও রাজ্যে আসছেন।
পুজো শেষ হওয়ার পরেও এ যেন এক অন্য পুজো। যেখানে নাচে, গানে, বন্দনায় মুখর হয় ইতিহাসের রেড রোড। আশ্বিনের সন্ধ্যায় মুখর হয় মহানগর।